“মা"

বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে, হৃৎপিণ্ডটা ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। একটা আস্ত বটগাছ উপড়ে ফেলার অবস্থা। যে অদৃশ্য বন্ধন এতদিন একেবারে কাছে ধরে রেখেছিল, তা একটা প্রচণ্ড টানে যেন ছিঁড়ে যেতে যাচ্ছে।

সুমনের প্লেন ঢাকার আকাশ ছেদ করে যত উপরে উঠছে, ওর তত ভীষণ খারাপ লাগছে। কি যেন একটা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে! ঠিক বুঝতে পারছে না। কি, কি হতে পারে? এত খারাপ লাগছে কেন? কানে এর মধ্যে তালা লেগে গেছে। চোখের সামনের সব কিছু ঝাপসা লাগছে। চোখটা বন্ধ করতেই মানস-পটে ভেসে উঠলো একটা মুখ। একজন নারীর মুখ। কিন্তু, প্রেয়সী, তার ভালোবাসা ও জীবনের স্পন্দন তো তার পাশেই বসে আছে। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যায়!

সুমন, রঞ্জনা ক্যানাডা যাচ্ছে ইমিগ্রেশান নিয়ে। সাথে বিশাল বড় স্বপ্ন ও আশা। তাদের বিয়ের বয়স দুই বছর হতে চললো । মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই নিজেরাই বিয়ের পর্ব সেরে ফেলেছিল। অবশ্য প্রথমে কিছু জটিলতা হলেও, পরে সুমনের বাবা-মা বিয়েটাকে মেনে নেয়। বেশ কিছু লোকজন ডেকে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। রঞ্জনার একেবারে বেগ পেতে হয় নি শ্বশুর, শাশুড়ির মন জয় করে নিতে।

একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকরি করছিল সুমন। মোটামুটি বেতন। বাড়ি ভাড়া যেহেতু দিতে হয় না, বেতনের টাকা দিয়ে ভালই চলে যায়। সিনেমা, নাটক, চাইনিজ খাবার, এখানে সেখান বেড়াতে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া বেশ চলে। রঞ্জনার মনে হয়, জীবনের মানে কি এত সুন্দর হতে পারে! হয় সারাদিন ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকা কিংবা তার জন্যে অপেক্ষা করা। কোনটা যে বেশী মিষ্টি আর আনন্দের, তা বের করা একেবারে একটা কঠিন হয়ে দাড়ায়। এইভাবে যদি পুরোটা জীবন চলে যায়, তা হলে মরার পরেও কোন ক্ষোভ থাকতো না।

সুমন ছোট বেলা থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বুয়েটে ভর্তি হতে না পেরে, ঠিক করলো বিদেশে চলে যাবে। একটাই জীবন। আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে দোষ কোথায়। ইমিগ্রেশনের চেষ্টা করতে থাকলো। সেই বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নের সিঁড়ি অবশেষে হাতে ধরা দিলো। অবশ্য এর মধ্যে ছটা বছর পার হয়ে গেছে। একা মানুষ দোকা হয়েছে।

সুমন, সুমনা ভাই বোন। সুমনা দুই বছরের ছোট। তারা মায়ের দু চোখের দু মণি। মা জাহানারা বেগম ছেলে মেয়েদের একেবারে নিজের হাতে মানুষ করেছে। ঘুম পারানো, গোসল করানো, খাওয়ানো কোনটাই কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দেয় নি। বাচ্চা মানুষ করার প্রতিটা কাজই তার কাছে মহা তৃপ্তি ও আনন্দের। কোন ক্লান্তি নেই, কোন বিরক্তি নেই। অবশ্য মাঝে মাঝে অভিযোগ আসতো স্বামী শরিফ তালুকদার থেকে, “তুমি একটু বেশী বেশী করো। পৃথিবীতে মনে হয় আর কারোর বাচ্চা-কাচ্চা হয় না। কিছু কাজ তো কাজের লোকদের দিয়ে করালেও পারো।" বেচারা স্বামী মহাশয়েরই বা কি দোষ। তার এখন আর জাহানারাকে সময় মত পাওয়া হয় না। কিছু প্রয়োজন অপূর্ণ থেকে যায়। নরম, কোমল ইচ্ছাগুলো শক্ত পাথর হয়ে কাঁদতে থাকে।

জাহানারা ঠিকই বুঝতে পারে, তার আগের মত আর স্বামীর কাছে যাওয়া হয় না। অনেক সময়ে চাইলেও, হয়ে উঠে না। সারাদিন দুই বাচ্চা আর সংসারের অন্যান্য সব কাজ করতে করতে দিন শেষ। রাতে যখন শুতে আসে তখন শরীর আর চোখে দুনিয়ার সব ক্লান্তি, ঘুমে আর চোখ খোলা রাখতে পারে না। পরের দিন আবার উঠতে হয় সেই কাক ডাকা ভোরে, ফজরের নামাজের ওয়াক্তে।

কাউকে না বললেও, ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে জাহানারার গর্বের অন্ত নাই। তারা মায়ের মতই সৎ আর খোলা মনের। মায়ের সাথে শেয়ার করে না, এমন কোন বিষয় নাই। জাহানারার অবশ্য আরেকটা বিশেষ ব্যাপার আছে দু সন্তানকে নিয়ে। ছেলে, মেয়ের মুখ দেখলেই কিভাবে যেন তার জানা হয়ে যায়, তাদের মনের ভিতরের সব খবর। মাঝে মাঝে তার কৌতূহল হয়, এই ক্ষমতা কি সব মায়েদেরই থাকে?

সুমনার অল্প বয়েসেই বিয়ে হয়ে যায়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পর পরই। ছেলে পক্ষ চেপে ধরল। দাদা শ্বশুরের খুব শখ, নাত বউ দেখে যাবার। গত তিন মাস ধরে তিনি হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছে আশা নাই। তা ছাড়া বয়স হয়েছে অনেক। জাহানারা আর শরিফ তালুকদার মত দিল এই শর্তে, যে সুমনাকে পড়ালেখা শেষ করতে দিতে হবে। সেটাও এখন থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সুমনা গত তিন বছর ধরে লন্ডনে থাকে স্বামী আর দু কন্যা নিয়ে।

সুমনার বিয়ের পর, মা জাহানারা আরও বেশী করে ঝুঁকে পড়লো ছেলে সুমনের দিকে। সুমনের প্রতিটা বিষয়ে তার থাকা চাই। আশ্চর্য হলেও, সুমনের এইটা নিয়ে কোন সমস্যা বা অভিযোগ নাই। বরং এই ভেবে তার ভালোই লাগে, মাতৃ স্নেহ পাবার দিক সে পৃথিবীতে সবার থেকে এগিয়ে। তার মা শুধু মা' ই না, একেবারে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বলা যায়। মা’র থেকে বেশী তাকে কেউ বুঝে না।

সুমনের সাথে সব ব্যাপারে রহিমের প্রতিযোগিতা। পড়ালেখায় রহিম সব সময় এগিয়ে। কিন্তু খেলাধুলায় সুমন। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সুমন কমপক্ষে তিনটা প্রথম পুরষ্কার পায়। এইটা চলে আসছে কয়েক বছর ধরে। রহিম দু একটায় সেকেন্ড, থার্ড হয়। ক্লাস এইটে যখন পড়ে, রহিম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার তিন মাস আগেই ঘোষণা দিল, এইবার সে সুমন থেকে বেশী পদক পাবে। আর সেই অনুযায়ী প্র্যাকটিস আরম্ভ করে দিলো।

সুমনের কানে কথাটা গেল। সে বিষয়টা আমলেই আনলো না। গাপ্পাগোপ্পা রহিম তার থেকে খেলাধুলায় ভালো করবে। হা হা! প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে, রহিম তিনটা প্রথম পুরস্কার পেলো, আর সুমন শুধু একটা। সুমন কাউকে কিছু বলল না। জীবনে পরাজয়ের একটা শক্ত কঠিন বিস্বাদ পেলো।

বাসায় ঢুকার সময় এক ঝলক মায়ের সাথে দেখা হলো। সুমন সরাসরি নিজের কামরায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত আড়াইটার দিকে যখন ঘুম ভাঙলো, দেখল মা পাশের চেয়ারে বসে আছে। সুমন চোখ খুলতেই, মা বলল, “যাও মুখ ধুয়ে আসো। আমি তোমার ভাত আনছি।”

মা জাহানারা নিজের হাতে খাইয়ে দিলো সুমনকে। একটা কথা পরিস্কার জানালো ছেলেকে, “এই প্রথম তুমি আমাকে গুড নাইট না বলে, আদর না করে ঘুমাতে গেলে।” মায়ের চোখের কোণায় পানি। মা হয়তো কিছু একটা শুনতে পেলো; মা-ছেলের দূরত্ব সৃষ্টির প্রথম সুর।

পরের দিন স্কুল বন্ধ ছিল। মা ছেলের বেশ দীর্ঘ কথোপকথন হল। মা সুমনকে সুন্দর ভাবে বুঝালো , জীবনে হারজিৎ থাকবে। জেতাটা মধুর। কিন্তু তার থেকে আরও বেশী মধুর আর গর্বের হল, পরাজয়ের পরে প্রতিযোগিতায় ফিরে আসা। কতবার পরাজিত হয়েছে, তার থেকে বেশী জরুরী নিজেকে পরের প্রতিযোগিতার জন্যে প্রস্তুত করা।

এক পর্যায়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সুমন অঝর ধারায় কাঁদতে লাগল, “মা, মা তুমি কেমন করে আমার ভিতরে ঢুকে পড়ো? আমি পরাজিত হয়ে তোমার কাছে মুখ দেখাব কি করে? তুমি এত কষ্ট করে আমাদের বড় করছো।” মা উত্তরে বলল,”সন্তানের জন্যে মায়ের ভালবাসা কখনো কমে না। তুমি জীবনের যেই পর্যায়ে যেভাবেই থাকো না কেন, আমি তোমার সাথে আছি প্রতিটা মুহূর্ত। তোমাকে সরাসরি সাহায্য করতে না পারলেও, আমার দোয়া ও শুভকামনা তোমার সব সময়ের সঙ্গী।”

রঞ্জনার সাথে পরিচয় হওয়াটা বেশ নাটকীয়। একটা বিয়ে বাড়িতে দেখা। সুমনের চোখ আরও পাঁচ জনের মত বারে বারে রঞ্জনাতে যেয়ে থেমে যাচ্ছিল। লম্বা, ফর্সা; বড় বড় চোখ দুটো আটলান্টিক মহা সাগর থেকেও বেশী গভীর, ওখানেই ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। তার পরে ইয়া বড় লাল একটা টিপ। যে কোন ছেলের হৃৎপিণ্ডের গতিবেগ বাড়িয়ে তিন ডবল করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। বন্ধুরা যে কাজটা করতে সাহস পেল না, সুমন সেই কাজটা করলো। রঞ্জনাকে যেয়ে বলল, “আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি……"। সেই সূত্র ধরেই প্রথম কথা বলা, পরিচয়।

পরিচয় থেকে ভালোলাগা। সেটা আবার অল্প সময়ের মধ্যে ভালোবাসায় গড়ালো। সুমন রঞ্জনার চোখ দুটোর মধ্যে কি যেন একটা খুঁজে পেলো। আহ কি শান্তি, কি ভালোলাগা, কত বড় বিশ্বাসের আশ্রয়। মনে হয় একেবারে নিশ্চিন্তে, জীবনটা এর মধ্যে কাটিয়ে দেয়া যায়।

সুমন বুঝল, তার একজন স্থায়ী সঙ্গিনী দরকার, যার মধ্যে থাকবে মায়ের প্রতিচ্ছবি। তার সব মনের এবং শরীরের প্রয়োজন মেটানোর চূড়ান্ত ঠিকানা। যাকে নিয়ে ঘর বাঁধা যাবে। মনের সব কথা বলা যাবে। এক জন আরেকজনের পরিপূরক হবে। প্রকৃতির নিয়ম রক্ষা করবে; দু জনের সন্তান হবে। কিন্তু আবার ভাবনা পেয়ে বসে, আসলেও তার মধ্যে কি মা কে খুঁজে পাওয়া যাবে? প্রতিটা জয়ে কি রঞ্জনা মায়ের মতো করে আন্দোলিত হবে ? প্রতিটা পরাজয়ে কি সেও কি সাথে থাকবে, সাহস জোগাবে? প্রতিযোগিতায় ফিরে আসার শক্তি জোগাবে?

মা জাহানারা এই প্রথম, একটা ব্যাপার সুমনের চেহারা দেখে বুঝলো না। না কি হয়তো, বুঝেও প্রকাশ করলো না। সুমনের অবাক হওয়ার সীমা, পরিসীমা থাকলো না। মা কি করে এত বড় একটা বিশাল ব্যাপার ধরতে পারলো না। কারো সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে কিনা, ক্লাসের টিচারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে কিনা, মাথা ব্যথা করছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি সব মা চেহারা দেখেই বুঝে ফেলে। পরে এক এক করে, মা, সে গুলো জানতে চায়। কখনো দেয় বাহবা, কখনো সাজেশন দেয় কি করলে ভাল হতো।

সুমনের একেবারে দৃঢ় ধারনা ছিল তার সাথে প্রতিটা বিষয়ে, প্রতিটা কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র বিন্দুতে ‘মা’ থাকবে, প্রতিটা আনন্দে সে দুলে উঠবে! কিন্তু মা কেন বুঝতে পারছে না, রঞ্জনাকে পেয়ে সে মহা খুশী। শুধু খুশী বললে কম হয়। একেবারে প্রচণ্ড পুলকিত। সে ইচ্ছে করলেই, একটা মেয়েকে স্পর্শ করতে পারে। তাও আবার অদ্ভুত সুন্দর বড় বড় মায়াবী চোখের একেবারে সেরা সুন্দরী।

এই বার মা হয়তো সুমনের মনের চিন্তার ঝড়টা ধরে ফেলল। মা একেবারে ক্লাসের টিচারদের মত করে উপদেশ দেয়ার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো, “বাবা সুমন একটা ছেলে যখন বড় হয়ে পুরুষ হয়; তখন তার ভালোবাসা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াটাই কৃতিত্বের। একটা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে থাকলে ভুগতে হয় বেশী। সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখলে, সব হারানোর সম্ভাবনা থাকে।”

মায়ের কথাটা সুমনের কাছে পরিষ্কার হলো না। মার কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হল না। মানুষের জীবন কি ডিম নাকি? ঠুনকো, সামান্য আঘাতেই ভেঙ্গে যাবে?

“এই নাও আমার হাতটা ধরো।”

কি অদ্ভুত সুমনের তো তাই ইচ্ছে করছে। রঞ্জনা জানলো কি করে। সুমন ভাবলো, মেয়েরা কি সবার ভিতরের কথা জেনে ফেলতে পারে। সব মেয়েই কি তার মায়ের মতন। তাই বা হয় কি করে?

রঞ্জনা আরেকবার বলল, “তুমি চাও কালকে আমি লাল শাড়ি আর কপালে বড় একটা টিপ দেই, ঠিক?” আসলেও এটা মিলে গেল। পরের দিন সুমনের জন্মদিন। মনের বাসনা তার সেইটাই। সুমনের প্রচণ্ড ইচ্ছা, এই বিশেষ দিনটায় সারাটা দিনের সারাটা-ক্ষণ রঞ্জনার আটলান্টিক গভীর মায়াবী দু চোখ আর কপালের বিশাল চাঁদের মতো বিশাল টিপ দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে।

সিরাজ মামা হঠাৎ হার্ট এটাকে মারা গেল। খুবই প্রিয় মামা ছিল। দাবী, আবদার মেটানোর সর্বশেষ এবং নিশ্চিত অবলম্বন। সুমনের খুব কাঁদতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু কাঁদতে পারলো না। মনে হলো, কাঁদলে মানুষে আবার হাসাহাসি না করে, “ইউনিভার্সিটি যাওয়া ছেলে কাঁদছে, হে হে।” রঞ্জনা সুমনকে দেখেই নিয়ে গেল পার্কের এক নিভৃত জায়গায়। সুমনের মুখটা নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে বলল, “তুমি এখন কাঁদতে পারো। ছেলে হলে যে কাঁদতে পারবে না, এমন কোন কথা নাই। সুমন নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, “আমি বুঝলাম না, আমার সব চেয়ে প্রিয় মামাকে কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে যেতে হলো।” উত্তরে রঞ্জনা নিজের বুকে হাত দিয়ে বলল, "তোমার কাঁদতে ইচ্ছে করলেই আমার বুকের ঠিক এইখানে চলে এসো।”

এরকম আরও কতো সব ঘটনা, রঞ্জনা সুমনের মুখ দেখেই বলে দিয়েছে। তার পরে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছে। কখনো হাত ধরা, কখনো বুকে নেয়া, কখনো হয়তো আরও কিছু বেশী কাজগুলো পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। সুমন ভালো করেই জেনে ফেললো, রঞ্জনাও তার মুখ দেখে তাকে পড়ে ফেলতে পারত তার ভিতরে কি আছে; অনেকটা যেন মায়ের মতই।

সুমনের বয়স তখন ৪-৫ হবে। বাবা শরিফ তালুকদারের খুব জ্বর এলো। বাবা একটা ছোট বাচ্চার মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, “ মা, মাগো খুব কষ্ট হচ্ছে।” ছোট সুমন বুঝতে পারলো না, বাবার মত শক্ত, পোক্ত পুরুষ মানুষ কি করে কাঁদতে পারে।

সুমন যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন বাবার চাকরি চলে যায়। অফিসের কিছু প্রভাবশালী মানুষ ষড়যন্ত্রের কারণে। বাবা একেবারে মরিয়া হয়ে গেল একটা চাকরির জন্যে। কিন্তু প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলো; বাবার চাকরি হলো না। সুমন একদিন রাতে দেখলো, বাবা বারান্দায় বসে কাঁদছে। একটু পরেই শুনল, বাবা চাপা গলায় যেন কার সাথে কথা বলছে আর কাঁদছে। সুমন শোনার চেষ্টা করলো বাবা কি বলে, "মা, মাগো তুমিই বলে দাও, আমি এখন কি করি। কি করে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেই?”

শরিফ তালুকদারের জন্মের সময় তার মা মারা গিয়েছিল। সারা জীবন তার মানসলোকে ছিল মায়ের একটা ছবি, যাকে সে বাস্তবে কখনো দেখে নি বললেই চলে। কিন্তু, প্রতিটা কষ্টে, প্রতিটা প্রয়োজনে মা মা করে ডেকেছে, কথা বলেছে, পরামর্শ চেয়েছে। বাবার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার মার প্রয়োজন বাড়তে লাগল। দিনের অনেক বারই শোনা যেতো, শরিফ তালুকদার মা মা করে ডাকছে।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুমনের ক্যানাডার জীবন প্ল্যান মোতাবেক হয় নি। আসলে প্রবাস জীবন সবার জন্যে না। চাকরি হারাতে হয়েছে কয়েকবার। ব্যবসার চেষ্টা করেও বিফল হতে হয়েছে। পরিণামে সংসার জীবন হয়েছে দুঃসহনীয়। সুমন- রঞ্জনার দাম্পত্য জীবনে এসেছে বিরোধ ও দূরত্ব।

ক্যানাডা আসার এক বছর পরেই অঞ্জনার জন্ম। তখন রঞ্জনা ব্যস্ত হয়ে পড়লো কন্যাকে নিয়ে। তার পরে আবার একটা চাকরিও নিলো। সুমন আর রঞ্জনাকে আগের মত পায় না। রঞ্জনা সুমনের মুখ দেখে বলে না, “তোমার কি আমার বুকে মুখ রেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে?” সুমন খুঁজতে থাকে আশ্রয়। নারীর আশ্রয়। মায়ের আশ্রয়। একটা নিরাপদ ও স্বস্তির আশ্রয়।

সুমন নিজের অজান্তেই কি ভাবে যেন বাবার মত, মা মা বলে ডাকার অভ্যাস পেয়ে গেল। একদিন সুমনের একটা আশ্রয়ের দরকার। রঞ্জনাকে পেল না। সে তো হারিয়ে গেছে সেই কবে। তার পরে বাসায় নেই। শোবার ঘরে যেয়ে একা একা, মা মা বলে ডাকতে থাকলো।

পাশের কামরায় খেলছিল অঞ্জনা। ছুটে আসলো। বাবাকে কাঁদতে দেখে বলল, “চোখ মুছো বাবা, এই যে আমি, তোমার মা। আমাকে বলো তোমার কি হয়েছে।” সুমন নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। মনে পড়ল সেই ছোট বেলায়, মাকে জড়িয়ে কান্নার কথা। ছোট্ট অঞ্জনার মাঝে নিজের মাকে স্পষ্ট দেখতে পেলো।

১০

সুমন দেশ আর মাকে ছেড়ে এসেছে প্রায় বিশ বছর। মায়ের সাথে কমপক্ষে সপ্তাহে একবার হলেও ফোনে কথা হয়। সুমন বৃদ্ধা মাকে তার জীবন সংগ্রাম, ভোগান্তির কথা বলে না। শুধু বলে, মা দোয়া করো। মা ওইদিক থেকে কি বুঝে তা বলা মুশকিল। শুধু বলে, ”বাপ আমার, আমি তোমার সাথে আছি সব সময়।.”

প্রথম বার যখন সুমন চাকরি হারিয়ে বিপর্যস্ত, মা টেলিগ্রাম পাঠায়, “বাবা কালকে স্বপ্ন দেখলাম, তোমার খুব কষ্ট। ভেবো না, ঠিক হয়ে যাবে।” এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন একটা চাকরি হয়ে গেল। অঞ্জনার বয়স যখন পনের, তখন একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে পড়লো। চার দিন জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ফোন এলো, “বাবা আমার খুব অস্থির লাগছে। তোমরা কি সবাই ঠিক আছো?”

এই ভাবে মা জাহানারার জীবন চলতে থাকে। মাঝে তাকে কয়েকবার হাসপাতালে যেয়ে থেকে আসতে হয়েছে। বয়স হলে যা হয়। কত রকমের অসুখ-বিসুখ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। কয়েক মাস আগে, দেশের থেকে খবর আসে মায়ের স্ট্রোক করেছে। কাউকে চিনতে পারছে না। কথাটা শুনেই মাকে ফোন করে সুমন। মা চিনতে পারে না সুমনকে, তার নিজের ছেলেকে। জানতে চায়। ‘আপনি কে বলছেন?”

পরে অবশ্য মায়ের স্মৃতিশক্তির কিছু উন্নতি হলো। কিন্তু তার পরেও বেচারির বেশীর ভাগ বিষয়ই মনে করতে কষ্ট হতো।

১১

“বাবা আজকে তোমাকে খুব খুশী খুশী লাগছে, কি ব্যাপার?”

‘আজকে কম কথা বলছো কেনো, কি হয়েছে তোমার?”

অঞ্জনা এখন তার বাবা মানে সুমনের ভিতরটা বেশ পড়তে, বুঝতে পারে। কখন কি করতে হবে তাও বলে দেয়। বয়স যখন ছয় তখন সুমনকে এসে বলে, ”বাবা আসো, আমার ম্যাজিক কার্পেটে এসে বসো। আমি তোমাকে দাদীর কাছে নিয়ে যাবো”।

ছোট অঞ্জনা আরব্য উপন্যাসের একটা কার্টুন ছবি দেখেছিল। সেখানে আলাউদ্দিনের একটা ম্যাজিক কার্পেট থাকে। সে কার্পেটে চড়ে যে কোন জায়গায় উড়ে চলে যেতে পারে। সে বাবার জন্যে ওরকম কল্পনার একটা কার্পেট বানিয়েছে। অঞ্জনা বাবার মুখে স্পষ্ট দেখেছে, দাদীকে দেখার, দাদীর কাছে যাবার ভীষণ এক ব্যাকুলতা।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অঞ্জনাও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এখন সে আর বাবাকে দেখার,পড়ার, বুঝার সময় পায় না কিংবা চেষ্টাও করে না। তার পরেও সুমনের ভালো লাগতো, তার মেয়েও তাকে পড়তে পারে, বুঝতে পারে। এইটা হয়তো বিধাতা বিশেষ কিছু নারীদের দিয়ে থাকেন। তারা যখন কাউকে অন্তর দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসে, তখন তাদের কাছে ভালোবাসার মানুষের ভিতরটা একেবারে উন্মুক্ত হয়ে যায় । অন্তরের শব্দহীন কথাগুলোর ভাষা, তাদের কাছে কি সুন্দরভাবে না ধরা দেয়!

অঞ্জনা জানালো, সে লন্ডন যাবে। সেখানকার এক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এডমিশন হয়েছে। সে ভালো ছাত্রী। একেবারে ১০০% স্কলারশিপ দিচ্ছে। এক জন বাবার কাছে এর থেকে ভাল খবর আর কি হতে পারে? মেয়ের এত বড় অর্জনে সুমনের গর্বে বুকটা ভরে ইয়া বড় হয়ে উঠলো। কিন্তু, লন্ডন তো বহু দূর। বাবার টেনশন অঞ্জনা ধরে ফেললো, “ওখানে সুমনা ফুপি আছে। দরকার হলে তারা হেল্প করতে পারবে।”

সুমনের বিষয়টা ভাবতেই খারাপ লাগতে লাগল। মনে এলো তার নিজের মাকে ফেলে আসার কথা। সেই প্রথম বার প্লেনে উঠে ক্যানাডা আসার সময় যেমন লেগেছিল। মনে হল, বুকের হৃৎপিণ্ডটা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে, নিঃশ্বাসের কেমন একটা ভারি কষ্ট। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে এলো। অঞ্জনাকেও আর পাওয়া যাবে না। তাকে পড়তে পারে, এমন মানুষরা সব দূরে দূরে থাকবে। ভালোবাসা এমন হয় কেন? শুধু দূরে চলে যায়, মেঘের মত আকাশে ভেসে ভেসে কোথায় যে চলে যায়। তার পরে একেবারে নাগালের বাইরে। এক সময়ে হয়তো হারিয়েও যাবে।

মায়ের আরেকটা কথা মনে পড়লো। পুরুষদের ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হয়। তার যদি আরও কিছু ভালোবাসা থাকতো, তা হলে হয়তো জীবনটা এতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো না। আরেকটা মানুষ যদি তাকে পড়তে পারতো! সে যদি পাশে থাকতো!! কিংবা, তার জীবনে যদি আরও কিছু বিষয় থাকতো, যা তাকে ভুলিয়ে রাখতে পারতো। তার মানসলোকের নির্ভরতা এতো কষ্টকর হতো না।

১২

সুমনের বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। বিছানায় এ পাশ ও পাশ করেও লাভ হলো না। নিজেই চলে গেল হাসপাতালে। সাথে সাথে ভর্তি করে নিলো। ডাক্তাররা বলল, ম্যাসিভ হার্ট এ্টাক। হাসপাতালে আসতে একটু দেরী হলে, সুমনকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।

ভোর হতে না হতেই মায়ের ফোন কল, বাংলাদেশে থেকে। ওই দিক থেকে মা বলতে লাগলো, “বাপ আমি কিছু বুঝতে পারছি না, মনটা যেন কেন বলছে তুমি খুব অসুস্থ। তুমি ভালো নাই। চিন্তা করো না। তুমি কালকেই ভালো হয়ে যাবে। আমি দোয়া করছি। আমার দোয়া সব সময়ই তোমাকে সাথে আছে, তোমাকে ঘিরে রেখেছে; আমার বাপ”।

উৎসর্গ: পৃথিবীর সব মা ‘কে

মা দিবস

মে ০৮, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক, Email: quazih@yahoo.com