আমার একটা স্বপ্ন আছে

আপনি কি স্বপ্ন দেখেন?

উত্তর ‘না’ দেয়ার কিন্তু কোন উপায় নাই। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন, একজন মানুষ বছরে কমপক্ষে ১৪৬০ বার স্বপ্ন দেখে। স্থায়িত্ব ৫-২০ মিনিট। যার বুদ্ধিমত্তা (I.Q ) যত বেশী, তার স্বপ্ন দেখার পরিমাণ তেমন বেশী । বাঙালিরা যেহেতু খুবই বুদ্ধিমান জাতি, তাই তারা স্বপ্নও দেখে প্রচুর। তবে সব মানুষ যে ঘুমালেই স্বপ্ন দেখে, তা কিন্তু না। নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদের পাঠকরা ভাল করেই জানেন, যে ঘুমের রেম (REM- rapid eye movement) নামক একটা পর্যায় আছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী, সে সময়ে চোখ খুব দ্রুত গতিতে নড়াচড়া করতে থাকে। নিদ্রা কালীন সময়ের মাত্র ২৫% সময়ে চোখের তৎপরতা এ রকম হয়। স্বপ্ন সে সময়ে আসে। বাকীটুকু সময়ে মানে ৭৫% ভাগ সময়ে চোখ শান্ত থাকে, তাকে বলা হচ্ছে অ-রেম বা NREM পর্যায়। তখন কোন স্বপ্ন নাই। সময়টা শুধু বিশ্রামের।

কিছু চতুর বাঙালি দাবী করেন, তারা স্বপ্নে মহাওষুধ বানানোর ফর্মুলা পেয়েছেন। সেই ওষুধে ক্যান্সার সহ সব ধরণের অসুখ সেরে যায়। বাস্তবে তাদের দাবী যদি সত্য হতো, তা হলে প্রত্যেকেই কমপক্ষে একবার করে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতেন। এমনকি কেউ কেউ হয়তো একাধিকবার পুরস্কার পেয়ে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করতেন। তারা মিষ্টি কথা বার্তা দিয়ে ভুলিয়ে নিরীহ জনগণের কাছে ওষুধ বিক্রি করেন। অসুস্থরা উপকৃত হয়েছেন এমন কোন তথ্য অবশ্য পাওয়া যায় না। তবে শোনা যায়, অনেক বিজ্ঞ-ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে বড় বড় সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। ফরাসি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রুগেট ডে আইল (Rouget de l'Isle) ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। তিনি দাবী করেন, তিনি স্বপ্নের মধ্যে জাতীয় সঙ্গীতের প্রতিটা শব্দ ও সুর আবিষ্কার করেন। ঘুম থেকে উঠে তার সব কিছু স্পষ্ট মনে ছিল। তিনি আর দেরী করেন নি, পুরো সঙ্গীতটা কাগজে লিখে ফেলেন।

এতক্ষণ তো বললাম ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন আসে তার কথা। আরেক ধরনের স্বপ্ন আছে, যার জন্যে ঘুমানোর দরকার হয় না। এই অন্য ধরণের স্বপ্ন দেখতে শুধু প্রয়োজন ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর সৎসাহস ও পরিকল্পনা, এবং সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যে ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা। বাঙালি জাতিকে সব চেয়ে বড় স্বপ্ন দেখিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তিনি ঢাকার রেস কোর্সের ময়দানে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, “এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম ...দেশটাকে স্বাধীন করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।” স্বপ্ন পূরণে জাতি এগিয়ে এসে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করলো। যদিও মূল্য দিতে হল ভয়াবহ; ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও দু লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম।

‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ’। মানুষ প্রতিক্ষণ ভাবছে, চিন্তা করছে, পরিকল্পনা করছে। সকালে বিছানা থেকে উঠার সাথে সাথেই সারাদিনের কার্যক্রম মাথার মধ্যে খেলতে থাকে। কখন, কিভাবে আয় রোজগারের জায়গা মানে চাকরি/ব্যবসায় যাবে; সেখানে কিভাবে চলবে। তার পরে দিন শেষে বাড়ি ফেরা থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য সব কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা হতে থাকে। এক মুহূর্ত পরে কী হবে বা ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, আমরা সেটা কেউ জানি না। তা সত্ত্বেও, অজানাতে আমরা কী ভাবে এগিয়ে যাবো, তার কত না হিসেব নিকেষ! এই সব ছোট ছোট কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যায় একটা বৃহৎ কিংবা চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে। তখনই দীর্ঘ সময় ধরে লালিত স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয়।

আরেকটু ব্যাখ্যা করি। বাবা-মা ঠিক করলেন সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা ক্রিকেট খেলোয়াড় বানাবেন। এই ঠিক করাটা একটা স্বপ্ন। বাবা-মা ধরে নিলেন, সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তাদের সন্তান স্বপ্নের পেশার জগতে প্রবেশ করবে। সে জন্য তারা দীর্ঘ সময় ধরে সন্তানকে তিলে তিলে গড়ে তুলেন। হয়ত এক পর্যায়ে সন্তানও বাবা-মার স্বপ্নের অংশীদার হয়ে পড়ে। শেষে স্বপ্ন বাস্তব হয়। তবে সবাই কি অভীষ্ট জায়গায় যেতে পারে? না সেটা পারে না। স্বপ্ন পরিবর্তিত হয়ে যায়। নতুন স্বপ্ন তৈরি হতে বেশী সময় লাগে না। ছোট ছোট স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হয় বড় একটা স্বপ্ন। এইভাবে আমাদের জীবনটা একের পর এক স্বপ্নে ভরে থাকে।

স্বপ্ন সম্পর্কে কয়েকজন বিজ্ঞ মানুষের মতামত জানা যাক। প্রথমে বলি ভারতের প্রেসিডেন্ট আবুল কালামের কথা। খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। বাবা ছিলেন নৌকার মাঝি। তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়নের খুব বড় একটা দৃষ্টান্ত। তিনি বলে গেছেন, “স্বপ্নকে সত্য করার জন্যে স্বপ্ন দেখতে হবে (You have to dream before your dreams can come true.)। বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সামরিক জেনারেলের, কলিন পাওয়েল, যারা স্বপ্ন দেখেছে, তাদের উদ্দেশ্য খুব সুন্দর উপদেশ দিয়েছেন, “কোন যাদু দিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় না। এর জন্যে ঘাম ঝড়ানোর সাথে সাথে মনোবল ও কঠোর পরিশ্রমের দরকার হয় ।” (A dream doesn't become reality through magic; it takes sweat, determination and hard work.)। এইবার বলি একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ষ্টিভেন স্পিলবার্গের কথা। তিনি তার সাফল্যের চাবিকাঠি এইভাবে জানিয়েছেন, “আমি রাতে স্বপ্ন দেখি না, আমি সারাদিন স্বপ্ন দেখি; আমি জীবিকার জন্য স্বপ্ন দেখি।” ("I don't dream at night, I dream all day; I dream for a living.")

অনেক কঠিন কঠিন কথা হয়ে গেল। এইবার না হয় একটা হালকা ধরণের গল্প বলি। এক সুন্দরী মহিলা ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে সোহাগী কণ্ঠে জানালো, “জানো জান, স্বপ্নে দেখলাম, তুমি আমাকে খুব দামী একটা হীরার আংটি উপহার দিচ্ছো। বলো দেখি এর অর্থ কি হতে পারে?” স্বামী জবাবে বলল, “ঠিক আছে, এর উত্তর আজকে রাতে পাবে।” স্ত্রী সারাদিন মহা উত্তেজনা ও আনন্দে কাটালো। ধরেই নিলো রাতে নিশ্চয়ই স্বামী তাকে হীরার আংটি দিতে যাচ্ছে। খুব সুন্দর করে সেজে গুঁজে অপেক্ষা করতে লাগলো। যখন মহেন্দ্রক্ষণ এসে হাজির হলো, স্বামী ছোট একটা প্যাকেট স্ত্রীকে দিলো। স্ত্রী ভাবলো স্বামীটার মধ্যে কোন রোমান্টিকতা নাই। নিজের হাতে হীরার আংটিটা হাতে পরিয়ে দিবে, তা না। যাই হোক স্ত্রীর আর তর সহ্য হচ্ছিল না। তাড়াহুড়া করে প্যাকেট খুলে দেখে ভিতরে ছোট একটা বই। বইয়ের নাম ‘খোয়াব নামা’। সেখানে নিশ্চয়ই বেচারি স্ত্রীর স্বপ্নের অর্থ লেখা ছিলো।

আবার ফিরে আসি আমাদের স্বপ্নের কথকথায়। মনে আছে নিশ্চয়ই, কথা এগুচ্ছিল নিদ্রাকালীন স্বপ্ন না; যে স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে পারে, সেই স্বপ্ন নিয়ে। মায়ের স্নেহ-মমতা ছেড়ে বাঙালি সমুদ্র পাড়ি দেয় ভাল একটা জীবনের স্বপ্নে। যুদ্ধগ্রস্থ দেশের মানুষগুলো শান্তির আশায় দিন গুণে। তাদেরই কিছু অংশ নিজের দেশ ত্যাগ করে ভিন দেশে চলে যায় নিরাপত্তার খোঁজে। বিখ্যাত র্যাপ সঙ্গীত শিল্পী টুপাক শাকুরে মতে, ‘বাস্তবটা ভুল। স্বপ্নই সত্যি।’ বিশাল স্বপ্নকে সত্য করার জন্যে কঠিন পরিশ্রমের সাথে আরেকটা উপাদানের প্রয়োজন একেবারে অনস্বীকার্য। সেটা হলো মনে, প্রাণে ‘বিশ্বাস’ করতে হয় স্বপ্নকে অবশ্যই বাস্তব করা সম্ভব। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে চাঁদ দেখে কবিতা লিখেছে, পড়েছে, ‘আয় আয় চাঁদ মামা...’ । সেই চাঁদে কিন্তু মানুষ ঠিকই যেয়ে হাজির হয়েছে। আকাশে উড়া, সাবমেরিন নিয়ে পানির নিচে যাওয়া, কিংবা সেল ফোনে কথা --সবই ছিল এক সময়কার স্বপ্ন। এগুলো বাস্তব করতে কত মানুষেরই না দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে!

এখন এই মুহূর্তে যা বর্তমান, পরের মুহূর্তে সেটা অতীত। আমরা বর্তমানে অবস্থান করলেও, অতীতের উপর ভিত করে তৈরি হয় ভবিষ্যৎ। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্কন শিল্পী ভিন্সেণ্ট ভ্যান গগ বলে গেছেন, “আমি ছবির স্বপ্ন দেখি এবং তারপরে আমি আমার স্বপ্নকে রং করি।” কখনই নতুন একটা স্বপ্ন দেখার জন্যে দেরী হয়ে যায় না। অভিনেতা জেমস ডীনের ভাষায়, “এমনভাবে স্বপ্ন দেখো যাতে মনে হয় তুমি সব সময়ে বাঁচবে; জীবন যাপন করবে এই ভাবে যেন আজকেই তোমার শেষ দিন (Dream as if you’ll live forever, live as if you’ll die today )। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ে প্রথমে শেষ মাথাটা দেখতে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা একটা করে সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকলে ঠিকই উপরে সিঁড়ির শেষ মাথায় পৌঁছানো যায়। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা প্রচণ্ড কিছু করার শক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তারা সবাই জগত কাঁপানো অবদান রাখার ক্ষমতা রাখেন।

আবার কিছু হালকা কথায় ফিরে যাই। এক বালক জ্যোতিষীর কাছে যেয়ে জানতে চাইলো, সে বড় হয়ে একজন বিশিষ্ট লেখক হতে পারবে কি না। জ্যোতিষী জানতে চাইলেন, সে বিশিষ্ট বলতে কি বুঝাচ্ছে। বালক জানাল, সে এমন লেখক হতে চায় যার লেখা পড়ে মানুষ কাঁদবে, চিৎকার করবে। জ্যোতিষী কিছু পাথর বিক্রি করে বললেন, ‘বালক তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে’। বালক বড় হয়ে মাইক্রোসফটের Error message Writer হল। কম্পিউটারে সমস্যা হলেই তার লেখা চলে আসে, বলে ‘প্রোগ্রামে ঝামেলা আছে। এখন প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যাবে’। কম্পিউটার মনিটরে এই ধরণের লেখা উঠলে পাবলিক মহা বিরক্ত হয়, কেউ কেউ চিৎকার করে উঠে, এমনকি নরম মনের মানুষ কেঁদে পর্যন্ত ফেলতে পারে।

আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে বক্তৃতা দিয়ে সব চেয়ে জোড়াল বক্তব্য দিয়েছিলেন মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়র। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের জন্যে লড়েছিলেন। ১৯৬৩ সালের ২৮শে আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙকন মেমোরিয়ালের পাদদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে ঘোষণা করেছিলেন, “ I have a dream.........আমার একটা স্বপ্ন আছে।” তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেন যেখানে মানুষকে তার গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবে না। যেখানে প্রতিটা মানুষের সমান অধিকার থাকবে। এই বক্তৃতা ও তার পরবর্তী আন্দোলনের মুখে প্রতাপশালী মার্কিন সরকার কৃষ্ণাঙ্গদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। কিন্তু দাবী মেনে নেয়া ও সেটা বাস্তবায়ন তো এক কথা না। যুক্তরাষ্ট্র ও পৃথিবীর বেশীর ভাগ দেশে মানুষের সম অধিকারের মৌলিক দাবী এখনও প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। শাসনের নামে শোষণ ও অত্যাচার চলছে। মার্টিন লুথার কিঙের স্বপ্নকে সত্য করার জন্যে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে বাকী আছে।

শেষে জোর গলায় বলতে চাই, আমাদের প্রত্যেককে অবশ্যই স্বপ্ন দেখতে হবে। এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্ন, সেখান থেকে আরও অনেক স্বপ্ন। আজীবন আমাদের স্বপ্ন চলতে থাকবে। নিজেকে ও পরিবারকে নিয়ে স্বপ্ন, দেশ ও পৃথিবীকে নিয়ে স্বপ্ন আমরা দেখতেই থাকব। মানুষ যাতে বিবেক ও যুক্তি দিয়ে নিজেকে বিচার করে । বিশ্ব থেকে যাতে হিংসা-দ্বেষ উঠে গিয়ে শুধু ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। সৎ ও সুন্দর স্বপ্ন সত্য করার জন্যে বিশ্বাসী ও পরিশ্রমী মানুষের কখনও কমতি হয় নি। এই সব চমৎকার সুন্দর স্বপ্নগুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেই দুঃখী অসহায় মানুষগুলোর কষ্ট বিলীন হয়ে যাবে।

অক্টোবর ৩, ২০১৬

কাজী হাসান
প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com