ব্যাখাহীন 

আচ্ছা বলুন তো সব চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু কোথায় হয়? 

কেউ হয়তো বলবেন, কেনো যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে গোলাগুলিতে অগণিত মানুষ মারা যায়। অন্যরা বলতে পারেন, বাংলাদেশে রাস্তায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। গাড়ি এক্সিডেন্ট তো আছেই, তার সাথে আছে গাড়ির তলায় চাপা পড়ে মৃত্যু, ছিনতাইকারীদের হাতে খুন, পুলিশের ক্রস ফায়ার যোগ করলে সংখ্যায় নেহায়েত কম হবে না। তবে সঠিক উত্তরটা শুনলে অনেকেই হয়তো নিজের উত্তর পুনর্বিবেচনা করবেন। হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত মানুষ মারা যাচ্ছে। যদিও ডাক্তার, নার্সরা তাদের বাঁচানোর সব চেষ্টাই করেন। বলতে গেলে এখানেই সম্ভবত সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা যায়। হয়তো হাসপাতালের ইমারজেন্সির একটা বেডে সকাল আটটায় একজন মারা গেল। দুপুর বারোটায় দেখা গেল ঠিক একই বেডে আরেকজন নিস্তেজ হলো। একই ডাক্তার, নার্সের দল চার ঘণ্টার ব্যবধানে দুটো মানুষকে পরপারে যাত্রা প্রত্যক্ষ করলেন। এইটা হাসপাতালের জন্য একেবারে নিয়মিত ব্যাপার। হাসপাতালের কর্মচারীরা মানুষের মৃত্যুকালীন সময়টা যত-বেশি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান, তার কাছাকাছি অন্য পেশার মানুষেরা এতো মৃত্যু দেখেন না। 

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার দিক থেকে অন্যদের থেকে কারা এগিয়ে। এই উত্তরটা সম্ভবত সবাই সঠিক দিতে পারবেন। রুগী সেবায় সব চাইতে বেশি যুক্ত থাকে নার্সরা। ডাক্তাররা অবশ্যই থাকেন। তাদের তত্ত্বাবধানে নার্সরা সার্বক্ষণিক রুগীর দিকে দৃষ্টি রাখেন। অবস্থা খারাপ হলেই ডাক্তারদের ডেকে নিয়ে আসেন। প্রয়োজনে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন রুগীর অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার থেকে রক্ষা করতে। অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম হলে ডাক্তার চলে যান পরের রুগীর হাল-হকিকত জানতে। রুগীর পাশ থেকে সরে যাবার আগে ডাক্তার নার্সদের সব ধরণের নির্দেশনা দিয়ে যান। তারপরেও মাঝে মধ্যে ডাক্তার নার্সদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে রুগী জাগতিক শরীরকে ফেলে রেখে চলে যায়। 

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নার্স পেশাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ মনে না করা হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই পেশাকে অনেক সম্মানের সাথে দেখা হয়। দীর্ঘ পড়ালেখা ও ব্যাপক ট্রেনিং সফলতার সাথে শেষ করতে পারলেই কেউ নার্স হতে পারে। আগ্রহীরা উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে রেজিস্টার্ড নার্স হয়ে রীতিমত রুগী দেখে ওষুধের প্রেসক্রিপশন লিখতে পারে। শরীরের যে রকম নানা ধরণের সমস্যা হয়, তার সাথে তাল মিলিয়ে বিশেষায়িত নার্সদের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। ইমারজেন্সি রুম, সার্জারি রুম থেকে আরম্ভ করে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুদের সেবা করা সহ প্রতিটা ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা রেনিং থাকে।

বাংলাদেশে জন্ম নেয়া কিন্তু লস এঞ্জেলেসে বেড়ে উঠা শিরিন আক্তার বাবা-মা'কে জানাল সে একজন নার্স হতে চায়। অভিভাবকরা বুঝালেন, “নার্স কেনো, তুমি পুরো ডাক্তার হও। আমরা যতটুকু পারি তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি ভালো ছাত্রী। ভালো স্কলারশিপ নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। তা ছাড়া ডাক্তাররা অনেক টাকা ইনকাম করে।” এ রকম শুনে শিরিন বেশ অবাকই হলো। কি বলে তারা বাবা-মা। তারা এতো শিক্ষিত হয়ে এ কেমন কথা বলছে। টাকা পয়সা কারোর পেশা নির্ধারণ করতে পারে না। একজনের যা ভালো লাগে সেটাই তার পেশা হওয়া উচিৎ। মেয়ে কিছুটা রাগত স্বরে উত্তর দিলো, “আমি মানুষের পাশে থেকে মানুষের সেবা করতে ভালোবাসি। সেইজন্য আমি নার্স হতে চাই। আমি নার্স হয়ে যথেষ্ট আয় করবো যা দিয়ে আমার চলে যাবে। অনেক টাকার তুলনায় আমার ভালোলাগার কাজ করাটাই আমার কাছে জরুরী।” 

শিরিনের নার্স হওয়ার স্বপ্ন দেখার পিছনে কারণ আছে। সে ছোট ভাই সৃজনের জন্মের সময় মায়ের কাছাকাছি ছিল। যে মা পরিবারের প্রত্যেককে সব ব্যাপারে সাহায্য করেন; সেই মা'র কষ্টে নার্সরাই পালা করে যত্ন নিয়েছে। তারপরে বেবি সৃজন যখন মায়ের পেট থেকে বের হয়ে এলো আরেকদল নার্স কি আদর দিয়ে তাকে না তুলে নিয়েছিল। একজন নার্স মা'কে দেখিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে কিভাবে যত্ন নিতে হবে। শিরিন তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। সব সময়ে হাসি খুশি নার্সগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ উৎসাহ ও আনন্দ নিয়ে করাটা ছোট মেয়েটার মনে রেখাপাত করেছিল। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে দাদী দেশের থেকে বেড়াতে এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জরুরী ভিত্তিতে বাই পাস সার্জারি করতে হয়। স্কুল বন্ধ থাকাতে শিরিনকে হাসপাতালে দাদীর সাথে বেশ অনেকটা সময় থাকতে হয়েছিল। বাবা-মা'র ছুটি না থাকাতে তাদের কাজে ফিরতে হয়েছিল। ছোট ভাইটাকে রাখা হচ্ছিল ডে-কেয়ারে। 

শিরিনকে দোভাষীর হিসেবে কাজ করতে হলো। দাদীর ইংরেজি বুঝতেন না। ডাক্তার এসে নানা প্রশ্ন করতো। সে দাদীর থেকে উত্তর জেনে নিয়ে ডাক্তারদের বলতো। দাদীর কোন কিছু দরকার হলে নার্সদের জানিয়েছে। সেবার বেশ কয়েকজন নার্সের সাথে অন্তরঙ্গতা হয়ে যায়। সুযোগ পেলেই নার্স স্টেশনে যেয়ে বসতো। তারা কিভাবে মনিটরে সব রুগীদের দিকে নজর রাখছে সেটা খেয়াল করে দেখত। কোনো রুগী বেল প্রেস করলে ডিউটি নার্স সব কাজ স্থগিত করে ছুটে যাওয়াটা বলতে গেলে মনে মনে রপ্ত করে ফেলেছিল। আবার ঠিক সময়মত রুগীদের ওষুধ খাওয়ানর ব্যাপারটা মুগ্ধ করেছিল। ওয়ার্ডে বেশ কিছু রুগী ছিল। একেকজনের একেক ধরণের ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দিতে হতো। এখানে কোনো ত্রুটি যাতে না হয় সে ব্যাপারে তারা সতর্ক ছিল। আবার কারো ব্যথার মাত্রা বেড়ে গেলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতো। 

শিরিন পরের বছর-ই হাই স্কুল আরম্ভ হলো। হাই স্কুলে একটা প্রোগ্রাম ছিল যার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীরা স্থানীয় হাসপাতালে নার্সদের সাথে ভলান্টিয়ার হয়ে কাজ করতে হতো। উদ্দেশ্য ছিল পেশাটার প্রকৃতি সম্পর্কে কিশোর ছেলে-মেয়েদের সম্যক জ্ঞান দেয়া। শিরিন সুযোগটা লুফে নিলো। সে তে আগের থেকেই জানতো নার্সরা কি কি কাজ কিভাবে করে। এইবার সে কাজগুলো নিজে করার সুযোগ পেলো। অবশ্য সাথে একজন নার্স থাকত। কিন্তু সপ্তাহ খানেকের মধ্যে নার্সদের শিরিনের উপর অনেক আস্থা তৈরি হয়ে গেল। বেশ কিছু কাজ শিরিনকে তারা একা করতে দিলো। এতে শিরিনের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল। সে তখনই তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে রুগীদের সেবা করতে ভালোবাসে এবং সে নার্সিং নিয়ে পড়ালেখা করবে। এইটাই চূড়ান্ত।

পড়ালেখা ও প্রশিক্ষণের পর নামজাদা একটা হাসপাতালে শিরিনের চাকরি হয়ে গেল। ইমারজেন্সি রুমে রাতের শিফটে কাজ। নার্সদের শিফট সাধারণত বারো ঘণ্টার শিফট হয়। আগের শিফটের নার্সদের কাজ বুঝে নিতে এবং শিফট শেষে কাজ বুঝিয়ে দিতে আরও বেশী কিচ্ছু সময়ের প্রয়োজন হয়। এত লম্বা সময় কাজ করার পরও শিরিনের কোনো অভিযোগ ছিল না। বরং যা চেয়েছে সেটা করতে পারছে বলে সারাক্ষণ মুখে একটা সন্তুষ্টির হাসি লেগে থাকতো। মেয়ে সারারাত কাজ করবে জেনে বাবা-মা'র প্রথমে অস্বস্তিতে ভুগেছিলেন। কিন্তু সেটা অল্প কিছুদিনের মধ্যে চলে গিয়েছিল। 

হাসপাতালটার ইমারজেন্সি রুম খুবই একটা ব্যস্ত জায়গা। গাড়ি এক্সিডেন্ট, গুলি খাওয়া থেকে আরম্ভ করে হার্ট এট্যাক, স্ট্রোকের রুগীরা প্রতিনিয়ত আসে। এখানে ডাক্তারদের মূল লক্ষ্য থাকে অবস্থার অবনতি যাতে না হয় সেটা ঠেকান। রুগীর সমস্যাটা কিছুটা স্থিতিশীল হলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় অথবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ডাকা হয়। হাসপাতালের ভর্তি করার দরকার হলে রুগীর সমস্যা সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শিরিন কাজগুলো দ্রুতই রপ্ত করে নিলো। প্রথমদিকে একটার একটার পর গুরুতর রুগী আসলে বিচলিত হয়ে পড়ত। নার্সিং পড়াকালে এই জাতীয় চাপ সামাল দেয়ার নানা প্রক্রিয়া শেখান হয়। তারপরেও বাস্তব কর্মক্ষেত্রে চাপের প্রকৃতি শুধুমাত্র কাজের ভিতরে ঢুকলেই বুঝা যায়। 

এক বছরের মাথায় শিরিনকে বদলি করে দেয়া হলো ইণ্টেনসিভ ও লাইভ সাপোর্ট ইউনিটে। সাধারণত আরও অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের এখানে আনা হয়। কিন্তু বাঙালি মেয়ে এর মধ্যেই হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টের মন জয় করে ফেলেছে। ফলে ওই ইউনিটে পদ খালি হওয়াতে শিরিনকে সেখানে সরিয়ে নেয়া হলো। এই পদটার জন্য আরও উচ্চতর ট্রেনিঙের দরকার ছিল। ম্যানেজমেন্ট সেই ব্যবস্থাও করে দিলো। এখানে শিরিনের দায়িত্বের ধরণ কিছুটা অন্যরকম হলো। প্রতিটা নার্স দু জন করে রুগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে। শরীরের ব্লাড প্রেশার, হার্ট বিটসহ যে কোনো সূচক হেরফের হলেই তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে হয়। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রুগীগুলোর জন্য কেমন একটা টান তৈরি হয়ে যায়। রুগীদের যতটুকু বেশী সময়ে পৃথিবীতে রাখা যায় ততই তাদের নিজেদের জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 

ইণ্টেনসিভ ও লাইভ সাপোর্ট ইউনিটে সাথেই একটা লাগোয়া ওয়ার্ড আছে যেখানে এমন রুগীদের রাখা হয় যাদের আর কোনো আশা না থাকতে ডাক্তারদের পরামর্শে ও প্রিজনদের অনুমতিতে লাইভ সাপোর্ট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ রকম ক্ষেত্রে রুগী কয়েক মিনিট থেকে আরম্ভ করে কয়েকদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও হয়। বিধাতার ইচ্ছা থাকলে অলৌকিক বলে সামান্য কিছু রুগীর জীবন আরও একটু বেশি লম্বা হয়। ডাক্তাররা এদের নিয়ে কাজ করার বাড়তি সুযোগ পান। এই বিশেষায়িত ওয়ার্ডে মূল লক্ষ্য থাকে রুগীদের জীবনে শেষ কয়েকটা মুহূর্ত যতটুকু সম্ভব আরামদায়ক করা। এই সময় রুগীরা প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ও ব্যথার মধ্যে থাকেন। ডাক্তারদের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ, মরফিন জাতীয় ওষুধ দিতে হয়। বাঙালি কন্যা শিরিনকে ছয় মাসের মাথায় এই ওয়ার্ডে আনা হলো। কারণটা অনেকটা আগের বদলি হওয়ার মতোই। এখানকার একজন নার্স চাকরি ছেড়ে আরেক শহরে চলে গিয়েছিল। 

শিরিনের এই ওয়ার্ডে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। রুগীদের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি প্রিয় জনদের আসন্ন মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হয়। আবার মৃত্যু হয়ে যাবার পর প্রিয়জনরা ভেঙে পড়লে তাদের যতটুকু সম্ভব সান্ত্বনা দেয়ার কাজটা করতে হয়। রুগী ও তাদের আপনজনদের সামাল দেয়াটা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ পীড়াদায়ক। সে জন্য এখানে নার্সদের বেশী দিন রাখা যায় না। শিরিন নিজেকে নিজে বলল এখানেই সে কাজ করে যাবে। নিজেকে মানুষের সেবায় বিলিয়ে দেয়ার যে পণ করেছিল, তার জন্যে এর থেকে ভালো ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়াটা কঠিন। 

এখানে রুগীদের দর্শনার্থীদের বেশ আনাগোনা থাকে। চেনা জানা পরিচিত যে খবর পায় সেউ একবার দেখে মৃত্যুপথযাত্রী ও তাদের পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে চায়। কিন্তু শিরিন একটা ব্যতিক্রম দেখল। উনিশ নম্বর কেবিনে স্যামুয়েল নামে একজন রুগী আছে। লাইভ সাপোর্ট খুলে এখানে আনা হয়েছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় তাকে দেখতে কেউ দেখতে আসে নি। না কোনো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা অন্য কেউ। ব্যাপারটা তাকে কৌতূহলী করে তুলল। সে ছেলেটার ফাইল আগেই দেখেছে। স্যামুয়েলের ভ্যাপার (vapor) ও ড্রাগ সম্পর্কিত সমস্যা। ফুসফুস কার্যক্ষমতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।। শরীরের এই অঙ্গ আর ঠিক করা সম্ভব না। গত দু সপ্তাহ লাইভ সাপোর্টে ছিল। বাবা অনুমতি দিয়েছেন লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলতে। লাঞ্চে দেখা হলে লাইফ সাপোর্টে ইউনিটের রীতা সেনের সাথে। সে কলকাতার মেয়ে, বাংলায় কথা বলে। দু জনার খুব ভাব। শিরিন ওর থেকে জানতে পারল স্যামুয়েলের বাবা এলাকার একজন খুব নামী-দামী মানুষ। ছেলেকে ড্রাগের আসক্তি থেকে সরানোর জন্যে সব ধরণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লাভ হয় নি। কিছুদিন বিরতি নিয়ে আবার সেই আসক্তিতে ফিরে গেছে। এখন হয়তো অভিমান, ব্যর্থতা, রাগ থেকে কষ্টে পাথর হয়ে গিয়েছেন। পুত্রের সামনে আর দাঁড়াতে চান না। 

বয়স্ক কিংবা দুর্বল শরীর হলে ফুসফুসের অকার্যকারিতার জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যু হতো। স্যামুয়েলের ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেলেও শরীরের বাকী অংশ সবল এবং সেগুলো কাজ বন্ধ করে দিতে রাজী ছিল না। সে জন্য অল্প যতটুকু অক্সিজেন শরীর পাচ্ছিল তাই দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বেশীর ভাগ সময়ে তাকে মরফিন দিয়ে রাখলেও কিছু সময়ে সে সজ্ঞানে ফিরছিল। মস্তিষ্ক ধীর হয়ে গেলেও অস্পষ্টভাবে কথা বলেছে। নিজের কষ্টের কথা জানাত। সাথে অনুভূতি ও দুঃখের কথা থাকত। প্রথমবার স্যামুয়েল শিরিনের সাথে মিনিট দশেক কথা বলল। হাইডোজের ব্যথার ওষুধ দেয়া হয়েছিল। এই কারণে সে বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখতে পারত না। স্যামুয়েলের চার ঘণ্টা পর পর হুশ ফিরতো। সে হুশ ফিরা মাত্রই সামনে শিরিনকে না দেখলে কলিং বেল প্রেস করতো। শিরিন যদি সাথে সাথে না যেতো কলিং বেলটা চেপেই রাখত। শিরিনকে দেখা মাত্রই তার বেল বাজানো বন্ধ হতো। সে এসেই ছেলেটার চোখে চোখ রেখে একটু হাসতো। কপালে হাত দিয়ে অভয় দিতো। নিজের কাজ করার পাশাপাশি ছেলেটার যাতে ভালো লাগে এ রকম কথা বলত, “বাহ তোমার তো খুব মায়াবী চেহারা আছে। তুমি নিশ্চয়ই অনেক মেয়ের মাথা করেছ।” 

নিঃসঙ্গ ছেলেটা আবার নিজের মতো করে কথা আরম্ভ করত। তবে একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত ছিল। সে মনে রাখতে পারত আগেরবার সে কতটুকু বলেছিল। একই কথা কিংবা কোনো ঘটনা সে তেমন পুনরাবৃত্তি করে নি। স্যামুয়েলের সেই ছোট ছোট কথাগুলো এক করলে অনেকটা এ রকম হয়, “আমি জানি আমি খুব তাড়াতাড়িই মারা যাবো। বাবা আমাকে নেশার জগত থেকে বের করার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি তো দেখেছি সেই ছোটবেলায় সে মাকে কেমন অত্যাচারই না করতো। এই কারণেই মা সুইসাইড করেছিল। সেই কষ্ট আমি সামাল দিতে পেরেছিলাম। কিন্তু পরে যখন আমার সুইট হার্ট জেনি আমাকে অন্য একটা ছেলের জন্যে ডাম্প করলো, তখন ভেপিং (Vaping ) আর ড্রাগই আমার সব সময়ের সাথী হয়ে গেল। বাবা আমাকে সারাক্ষণ উপদেশ দিয়ে গেছে কিন্তু কখনও ভালোবাসা দেয় নি। না হলে হয়তো আমি আরও অনেকদিন বাঁচতাম। আমি খুব ভালো গান গাইতে পারতাম। গায়ে যদি আরেকটু শক্তি থাকত তোমাকে গান গেয়ে শোনাতাম, 'Country roads, take me home' To the place I belong। তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে যদি আমার আর কিছুদিন আগে দেখা হতো, তা হলেও আমি নেশা ছেড়ে দিতাম। তোমাকে আমার বড় বোন বানাতাম। তোমার সব কথা আমি শুনতাম।” 

শিরিন নার্স স্টেশনে এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। নার্স হলেও সে একজন মানুষ। তার শরীর পাথর কিংবা লোহা দিয়ে তৈরি না। তার ভিতরে আর দশ জনের মতো রক্ত মাংস আছে। শিরিন ভাবেই চলল কোনোভাবে ছেলেটাকে যদি বাঁচিয়ে ফেলা যেতো! বোন হয়ে ছোট ভাইয়ের জন্যে সে কিছু করতে পারছে না। এর থেকে বেশী কষ্ট আর কিসে হতে পারে? শিরিনের বুঝতে পারছে স্যামুয়েলের সাথে আর দেখা হবে না। ১২ ঘণ্টার শিফট চারদিন করার পর আগামী তিন দিন ছুটি। ছোট ভাইটার জীবনীশক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সে আগামী তিন দিন আর টিকবে না। 

শিরিন যা ভেবেছিল তাই হলো। তার ছুটির দ্বিতীয় দিনেই স্যামুয়েল মারা গেল। খবরটা সে আগেই পেয়েছিল। মা কে স্যামুয়েলের কথা বলতে বলতে অনেক কেঁদেছিল। কাজে ফিরে প্রথমেই সে স্যামুয়েলের কেবিনে গেল। খালি বিছানা দেখে আবার নতুন করে কান্না পেলো। না এইবার সে নিজেকে সামলে নিলো। বোনকে কাঁদতে দেখলে ছোট ভাইয়ের ভালো লাগার কথা না। নিজের ডেস্কে বসতে না বসতেই ওয়ার্ডের সুপারভাইজার ডাঃ মাইকেল তাকে অফিসে ডেকে পাঠালেন। তিনি বেশ নরম গলায় শিরিনকে বললেন, “আমাদের এখানে কিছু বিষয় হয় যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বাইরের মানুষ শুনলে বিশ্বাস করবে না। স্যামুয়েল মারা যাবার পর ওর কেবিন আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। প্রথমে প্রতি চার ঘণ্টা পর পর ওখান থেকে কেউ কলিং বেল প্রেস করছিল। এখন প্রতি ২০-৩০ মিনিটে হচ্ছে। আমরা ইলেক্ট্রিশিয়ান দেখিয়েছি। কিন্তু কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।” 

ডাঃ মাইকেল কথাগুলো বলে একটু থামলেন। সামনে পানির বোতল ছিল। সেটা উঠিয়ে পানি ডক ডক করে গলায় ঢেলে আবার মুখ খুললেন, “ আমার ধারণা স্যামুয়েলের আত্মা ওই কেবিনে এখনও অবস্থান করছে। সে সম্ভবত আশা করছে কলিং বেল চাপলে তুমি সেখানে যাবে। আমি জানি সে তোমার পেশেণ্ট ছিল। তোমার উপর ইয়ং ম্যানটার অনেক বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। তুমি যদি ছেলেটাকে বলো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা মতোই পৃথিবীর সব কিছু হয়। সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। আমারা ওকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে সব চেষ্টাই করেছি।” 

শিরিন কিছু না বলেই সুপারভাইজারের অফিস থেকে উঠে এলো। তার মাথায় এলো না একটা মৃত ছেলের সাথে কিভাবে কথা বলা যায়। নিজের ডেস্কে এসে রুগীদের কার কি অবস্থা সেই রিপোর্ট দেখতে লাগল। এর মধ্যে ১৯ নম্বর কেবিনের বেল বেজে উঠল। মুহূর্তেই খেয়াল হলো এ তো স্যামুয়েলের কেবিন। সে ছুটে গেল। কিন্তু সেখানে কেউ নাই। শিরিন কান্না আটকে রাখতে পারলো না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ছোট ভাইটা তাকে ডাকছে আর সে কি-না তাকে দেখতে পারছে না। শিরিন রুমের চারিদিকে তাকালো। নাহ কাউকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “ভাইটা আমার। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি যদি পারতাম তোমাকে আমার কাছে রেখে দিতাম। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার উপর আমাদের কোন হাত নাই। তোমাকে আর আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না। আমি তোমাকে বাকী জীবন ভালোবেসে যাবো। আমাদের পরকালে নিশ্চয়ই দেখা হবে। তুমি এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যাও। আমি তোমার জন্য সব সময়ে প্রাণ ভরে দোয়া করবো।” 

১৯ নম্বর কেবিন থেকে এর পর স্যামুয়েল আর কলিং বেলে চাপ দেয় নি।