বেশ কিছু দিন পর ছোট একটা সফরে ঢাকা ঘুরে এলাম। মোট নয় দিনের সফর। এমেরিকার টেক্সাস থেকে ঢাকা যেতে প্লেনে বসে থাকতে হয় প্রায় বিশ ঘণ্টা। আমার যাত্রা পথ ছিল ডালাস থেকে দুবাই। তারপরে প্লেন বদলিয়ে দুবাই থেকে ঢাকা। ডালাস থেকে দুবাই যেতে প্লেনেই লেগে যায় পাক্কা সাড়ে পনের ঘণ্টা। বাংলদেশের সময় টেক্সাসের সময় থেকে বারো ঘণ্টা এগিয়ে। তার মানে যখন টেক্সাসে বুধবারের রাত দশটা, তখন বাংলাদেশে বৃহস্পতিবারের সকাল দশটা। গ্লোবটাকে পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরাতে হয় বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দুটোকে দেখতে হলে। বুঝতেই পারছেন, এত দীর্ঘ সময় যাত্রাপথে থাকলে এবং সময়ের হের- ফেরের কারণে শরীরের অবস্থা কেমন কাহিল হতে পারে!

নয় দিনে কী কী করবো তার একটা বিরাট ফর্দ মাথার মধ্যে ছিলো। সেটা অনুসরণ করতে গেলে কমপক্ষে মাস তিনেক থাকার দরকার হবে। কত শত না আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও লক্ষ্য কোটি স্মৃতি এই ঢাকা ও বাংলাদেশে। কোনটা ছেড়ে কোনটা করবো, কোনটা দেখবো মাথায় এলো না। বেশ কিছু বছর আগে ছোট বেলার বন্ধু শামীম বলেছিলো, ঢাকা শহরে এক দিনে একটার বেশী কাজ করার প্ল্যান করতে হয় না। কারণটা হল ট্রাফিক জ্যাম। জায়গায় জায়গায় এমন জ্যাম যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। গত পাঁচ বছরে অবস্থাটা আরও করুণ হয়েছে। মনে হয় পুরো শহরটাতেই সারাক্ষণ জ্যাম। ছোট রাস্তা, বড় রাস্তা, ফ্লাই ওভার কোনটাই এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

‘আমি কি ডরাই সখি, ভিখারি রাঘবে’। ঢাকায় যেয়ে জ্যামের ভয়ে বসে থাকবো, সেটা মেনে নিতে আমি রাজী না। এই অল্প সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারটা আমাকে করতে হবে। ঢাকায় পৌঁছলাম মধ্যরাতে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে আরও ঘণ্টা দু’য়েক লাগলো। চারিদিকে হট্টগোল, ভিড় আর হৈ চৈ। বাঙালির এই উষ্ণতা অনেকদিন পর পেলাম। ক্লান্ত শরীর সাথে সাথে ফুরফুরে হয়ে গেলো। পঁচিশ বছর আগে প্রথম যখন দেশ ছেড়ে এমেরিকা গিয়েছিলাম, তখন বিদেশের মাটিতে কোনো বাঙালি চেহারা দেখলেই মন জুড়িয়ে যেতো। বাংলা কথা শুনতে পেলে মনে হতো কানে কেউ মধু ঢেলে দিচ্ছে। অবশ্য পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। এমেরিকা, ইওরোপ, আফ্রিকার যে কোন বড় শহরে চোখ বুলালেই বাঙালি খুঁজে পেতে বেশী বেগ পেতে হয় না।

অন্য ভাইরাও বিদেশ থেকে গিয়েছিল। সাথে দেশে যে ভাইরা থাকে, তারাও এসে জড়ো হলো। চাঁদের হাঁট বসতে সময় লাগলো না। আব্বাও এসে যোগদান করলেন। শুধু ছিলেন না আম্মা। বছর দেড়েক আগে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। যেই বাড়ি ছিল তার স্বপ্নের আরাধনা, সেখানে তিনি আর থাকেন না। এই পৃথিবীর নিয়ম। ইহলোকে সবকিছুই মায়া, মরীচিকা, এবং ক্ষণস্থায়ী। ভাবনাগুলো মাথায় আসলে সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। কোনো কিছুর পিছনেই আর ছুটতে ইচ্ছা করে না। যাই হোক পরের দিন ছিল শুক্রবার, ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৬। বাংলাদেশের ৪৫তম বিজয় দিবস।

পরিবারের সবাই মিলে উত্তরার এক মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গেলাম। ইমাম সাহেব তার বক্তব্যে অনেক কিছুই বললেন। তবে মনে হলো কোথায় যেন বাস্তব থেকে চিন্তাভাবনায় একটা দূরত্ব। তিনি কী বলবেন সে বিষয়ে তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। তার বক্তব্যে বিজয় দিবস উদযাপনের সমালোচনা পাওয়া যাচ্ছিল। দেশটা স্বাধীন হয়েছিল বলেই তো বাংলায় বক্তব্য রাখা সম্ভব হচ্ছে, পাক হানারারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। তিনি চোদ্দ শত বছর আগের বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বারে বারে ইহকাল ও পরকালের পরিণতির কথা বলছিলেন। তবে আমার মনে হয়, ভয় না ভালোবাসাই পারে প্রকৃত বিজয়ী করতে। দূরে ঠেলে না, কাছে টেনে নিলেই সুন্দর ও সৎ সমাজ বিনির্মাণ হতে পারে। সে জন্যে আমাদের শিক্ষা, চিন্তা ও কাজে সংস্করণের প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরী । ইমাম সাহেব নামাজের শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত সব মুক্তিযোদ্ধাদের রুগের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করলেন।

নামাজের পর মসজিদের পাশের এতিমখানায় আমার আম্মার আত্মার শান্তির জন্য দোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। দোয়া শেষে আমরা এতিমখানার শিশুগুলোর সাথে বসে দুপুরের খাদ্য গ্রহণ করলাম। তেহারী ও মাংস ওখানেই রান্না করা হয়েছিলো। সাথে সালাদ। মিষ্টি, দই বাইরের থেকে কেনা। ৮-১০ বছরের ফুট ফুটে বাচ্চাগুলো ছুটে ছুটে আমাদের আপ্যায়নের কাজটাও করলো। শিক্ষকরা তত্ত্বাবধানে ছিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ওই বয়সের আমারও সন্তান আছে। অন্য সন্তানেরা একই বয়সটা পার করেছে খুব বেশী দিন হয় নি। আমি আমার সন্তানদের ওরকম দৃশ্যে ভাবতেই পারি না। বিধাতার বিধান আমাদের পক্ষে বুঝাটা অসম্ভব। শিশুগুলোর মঙ্গল কামনা করে আমাদের উঠতে হলো।

এর পরে গেলাম আম্মার স্থায়ী ঠিকানায়; উত্তরার কবরস্থানে। একজন মানুষ মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে সারাক্ষণ টেনশন করছে; সে কি-না এখন নীরবে এক জায়গায় শুয়ে। না বলছে কিছু, না শোনা যাচ্ছে তার কোন শব্দ। প্রকৃতির এই বিচার থেকে কারোরই রেহাই নাই। দোয়া পড়ে পরম করুণাময়ের কাছে আম্মার আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম, ‘ইয়া আল্লাহ ছোট বেলায় সে যে রকম আমাকে যত্নে রেখেছিলো, রাহমানুর রাহীম তুমিও তাকে সেরকম ভালো রেখো।’ ভালো লাগলো আম্মার কবরটা বেশ যত্ন করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। গাছের ছায়ায় কবর ও কবরের সাথে ঠিক লাগোয়া আম্মার প্রিয় হাস্নাহেনা ফুলের গাছ। আমার আব্বা সেখানে নিয়মিত যান। তিনিই রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি করেন। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হয়তো নীরবে কথাও বলেন। এত দীর্ঘ দিনের ভালোবাসার সম্পর্ক কি মৃত্যু বিচ্ছিন্ন করতে পারে? না, কখনই না। চিন্তায় ছেদ পড়লো। পাশেই মসজিদ। আজানের ধ্বনি নিশ্চয়ই পৌঁছে যায় এখানকার প্রতিটা কবরে। কবি নজরুল ইসলাম অনুরোধ করেছিলেন, ‘মসজিদের পাশে কবর দিস ভাই।’

সন্ধ্যার পরে রওয়ানা দিলাম মগবাজারের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে মানুষ, গাড়ি, দোকান-পাট মিলে একেবারে এলাহী অবস্থা। আশির দশকে প্রথম দিকে উত্তরায় এসেছিলাম। তখন পুরো জায়গাটা ছিলো প্রায় জন-মানব শূন্য। হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি ঘর দেখা যেতো। মানুষজন সহজে উত্তরায় যেতে চাইতো না। বলতো ‘মেলা দূর’। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় প্রচুর বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছিলো। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে জেলখানায় না নিয়ে উত্তরার দিকে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই সময়ে অঞ্চলটা ছিল একেবারে অজ পাড়া গাঁ। বাসে করে ফিরে যাবার ব্যবস্থা ছিল না। তাদেরকে মেলা কসরত করে ঢাকায় ফিরতে হয়েছিলো। এই ছিল তাদের শাস্তি। আর এখন বড় বড় বিল্ডিং, দোকান-পাটে ঠাসা। পুরো ঢাকারই একই চেহারা। এটা মানতেই হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশে শতগুণ বেড়েছে।

মগবাজারে প্রিয় বান্ধবী বাণীর বাসা। সেখানে তার ছোট বোন বহ্নির আকদ মানে বিয়ে পড়ানো হবে। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান আরও দু সপ্তাহ পরে; যার আগেই আমি ফিরে যাবো। সে জন্যে বাণী আমার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ঘোষণা করলো। অবশ বহ্নিও অনুরোধ করেছিলো। একেবারে পারিবারিক ঘরোয়া অনুষ্ঠান। বেশ অসস্থি লাগছিলো, কিছুটা বহিরাগত মনে হচ্ছিলো নিজেকে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে মানিয়ে নিলাম। দেখলাম বহ্নি খুব কান্নাকাটি করছে। বাঙালি মেয়েরা যে কেন বিয়ের সময় এত কাঁদে? এখন দিন কত পাল্টে গেছে। মেয়েদের যদি কাঁদার কোন যুক্তি থাকে, তা হলে একই যুক্তিতে ছেলেদেরও কাঁদা উচিত। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের পর ছেলে-মেয়ে দু জনেই নিজেদের পরিবারকে ছেড়ে নতুন সংসার গড়ছে। তা ছাড়া এখনকার প্রযুক্তির যুগে যোগাযোগ রাখাটা কি কোন ব্যাপার? বাণীর সাথে বহ্নির বয়সের বেশ পার্থক্য। তার পরে বহ্নি কিছুটা দেরী করে বিয়ে করছে। কত বয়সে? না থাক মেয়েদের বয়স বলতে হয় না। তবে দেরী করে বিয়ে করাতে একটা উপকার আমার হয়েছিল। এই বয়সে এসেও আমার একজন অবিবাহিত সুন্দরী শ্যলিকা ছিল। তার বিয়ে হচ্ছে। আমারই তো এখন কাঁদা দরকার।

পরের দিন বাংলাদেশে আরেক চেহারা দেখলাম। জমি-জমা রেজিস্টারী অফিসে নির্ধারিত সময়ে হাজির হলাম। তার পরে ভিতর থেকে ডাকের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হতে লাগলো। মাঝে দেখলাম জোহরের নামাজের ব্রেক হলো। অফিসের বেশ কিছু কর্মচারী জামাত করে নামাজ পড়লো। তারপরে দুপুরে খাবারের বিরতি। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সরকারী অফিসে কম্পিউটারের লেশমাত্র ব্যবহার দেখলাম না। আপাদমস্তক দুর্নীতিতে জায়গাটা ঠাসা। নিয়ম মোতাবেক এখানে কোনো কাজ হয় না। টাকা না দিলে কোন ফাইল নড়ে না। ন্যায়, অন্যায়ের কি অপূর্ব সংমিশ্রণ ও সহঅবস্থান! আপাতদৃষ্টিতে এর কোনো পরিসমাপ্তির নাই। লোকে বলে ঘুষের টাকার ভাগ নিচ থেকে উপর---সব পর্যায়ে বণ্টন হয়। এখানে আর বিস্তারিত কী বলব?

ফেসবুকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি বাংলাদেশ আসছি। দেশে পৌঁছে আমার ফোন নম্বর আবার ফেসবুকের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিলাম। কিছু নম্বর সাথে ছিলো। তাদেরকে এক এক করে ফোন করলাম। অন্যরা ফেসবুক থেকে আমার নম্বর দেখে কল করলো। ফোনটা অনবরত বাজতে লাগলো। বন্ধু-বান্ধবদের ভালোবাসায় একবারে বিমোহিত হয়ে গেলাম। সবাই দেখা করতে চায়, সবাই দাওয়াত দিতে চায়। কি করা যায়? একেবারে মহামুশকিল। কাউকে না বলতে ইচ্ছা করে না। আবার সবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করাও সম্ভব না। বন্ধুরাই আমাকে এ ঝামেলা থেকে উদ্ধার করলো। ফারাহ, অপু, রিজু, নিরু কিছু বন্ধুদের এক জায়গায় জড়ো করে ‘গেট টু গেদার’ আয়োজন করার ইচ্ছা জানালো। শেষে শুধু মাত্র নিরুর প্রস্তাবে সায় দিলাম; সময়, স্থান আমার জন্যে যথোপুযুক্ত হলো।

ঢাকায় পৌঁছানোর একদিন পর থেকে শ্যালক কনক আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো। আসলে ঢাকায় আমার অনেকটা নিজের দেশে পরবাসী হওয়ার অবস্থা। পথ ঘাট চিনতে পারিনা বললেই চলে। তাই চলাফেরা করতে সব সময়ে কাউকে না কাউকে সাথে রাখতাম। কনক সেই কাজটা খুব সুচারুভাবেই পালন করেছিলো। প্রিয় বান্ধবী রুচি দিনে বেশ কয়েকবার করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছে। একদিন পুরোটা দিন আমার জন্যে ছুটি নিয়ে নিলো, ‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’। কত কথা বার্তাই না হলো। আমাকে নিয়ে নানা জায়গায় গেলো। ভীষণ ভালো লাগলো মেয়েটা ঠিক আগের মতই আছে। আমার জন্য ভালোবাসার কোন কমতি হয় নি। বরং, আমি বলবো সেটা বহুগুণ বেড়েছে। পৃথিবীতে এতো ভালোবাসা আছে বলেই, সবাইকে নিয়ে আরও অনেক অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছা করে।

রেজাউল বারী ডেল্টা এক সময়ে ডালাসে থাকতো। তখন থেকে অন্তরঙ্গতা। মাঝে মেলা দিন সে নিউ জিল্যান্ডে ছিলো। কয়েক মাস আগে ঢাকায় ফিরে এসেছে। এখন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান। সে আমন্ত্রণ জানালো তার বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করার। আমার খুব ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় দেখার। সুযোগটা লুফে নিলাম। আমার জন্যে সেখানে বড় ধরণের বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। শহরে মধ্যে বিশাল বড় নান্দনিক ইমারত নিয়ে গড়ে উঠেছে বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানটা। তেরো তলা বিল্ডিং, এম্পি থিয়েটার, এগারো শত দর্শক ধারণসক্ষম মিলনায়তন, বিরাট সংগ্রহের পাঠাগার আমার মনটা কেড়ে নিলো। ইদানীং কালের আলোচিত/সমালোচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপাতি, পড়ালেখা করানোর সব ধরণের উপকরণ একেবারে সর্বাধুনিক। জেনে ভালো লাগলো পড়ালেখার মান এখানে পশ্চিমের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ। ইদানীং গবেষণার দিকে জোড় দেয়া হচ্ছে। আমার মনে কোন সন্দেহ থাকলো না, এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা ভবিষ্যৎ উন্নত বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ডেল্টাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার জন্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু শাহীনুল ইসলাম লাবু। সূর্য সেন হলে আমাদের কাছাকাছি কামরা ছিলো। দু জনই আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র। এক ঘণ্টার নোটিসে লাবুর বাসায় যেয়ে হাজির হলাম। সাথে ছিল শ্যালক কনক ও তার পরিবার। লাবুর পরমা সুন্দরী স্ত্রী ঝর্ণার সাথে কয়েক বছর আগে একবার দেখা হয়েছিল। এই বার বেশ কথা বার্তা হলো। কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাদের পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখার চমক দিলেন। টেবিল ভর্তি খাবার। এত অল্প সময়ে এত বড় আয়োজন কিভাবে সম্ভব সেটা আমার মাথায় কোনো ভাবেই এলো না। মনে হলো তিনি যাদু জানেন। লাবুর কি বিরাট ভাগ্য। এত সুন্দরী বউ, তার আবার এত গুণ! পরে আবিষ্কার করলাম তিনি খুব সুন্দর কবিতা লিখেন, মানে কবি। প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হলো ঝর্ণা শব্দের অর্থটা যেন কি? পাহাড়ের আনন্দাশ্রু-ই তো ঝর্ণা!

প্রায় পঁচিশ বছর পর দেখা হল রওনক ও হেলালের সাথে। রওনক আমাদের আপ্যায়িত করলো গুলশান এলাকার এক নামজাদা রেস্টুরেন্টে। খাওয়ার মান ও স্বাদ একেবারে বিশ্ব সেরা। অতীত ও বর্তমান নিয়ে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যাটাকে প্রচণ্ড উপভোগ করলাম। আমার এক্কেবারে স্কুল জীবনের বন্ধু আব্দুল্লাহ কবির লিটন। এখন বড় রাজনৈতিক নেতা। আমাকে আমন্ত্রন করলো ঢাকার ওয়েষ্টিন হোটেলে। ব্যাপক ভুঁড়ি ভোজে ও লিটনের সাহচর্যে ভালোলাগায় মনটা ভরে থাকলো। বেচারা বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ধরণের অসুখ-বিসুখে ভুগছে। দোয়া করি, আল্লাহ তা আলা তাকে যাতে সুস্থ, সবল ও নিরাপদ রাখেন। আরেকজন প্রিয় বন্ধু কবি আশরাফ শামীম পিজি হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। তারও শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। লিভার ঠিক করে কাজ করছে না। শরীরে পানি চলে আসছে। কিন্তু তাতে কী? আমাদের কবির মনের জোড়ের কোন কমতি নাই। আমি দেখা করতে আসবো শুনে বেচারা হাসপাতালের বিছানা থেকে উঠে যেয়ে শাহবাগের মোড় থেকে বিশেষ অর্ডার দিয়ে সরমা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলো। যাওয়ার পর আমাকে আসস্থ করলো, সব কিছু পরিষ্কার; আমার মার্কিন উদরে কোন সমস্যা হবে না। বন্ধুর এই ভালোবাসার প্রতিদান দেবার ক্ষমতা আমার মতো নগণ্য আদম সন্তানে নাই।

ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে প্রতিযোগিতা হলে ঢাকা শহরের স্বর্ণ পদক পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। রাস্তাগুলোর মারাত্মক করুণ দশা, বেশীর ভাগ হয় ভাঙ্গা না হয় গর্তে ভরা। অবশ্য গাড়ির ঝাঁকি স্বাস্থ্যের জন্যে নেহায়েত খারাপ না। হজমের জন্যে নিশ্চয়ই খুব উপকারী। তবে গাড়ির আয়ুর যে বারোটা বেজে যায়, সেটা বলাই বাহুল্য। ট্রাফিক জ্যামে নাজেহাল অসহায় নাগরিকদের অবস্থা আরও নির্মম করে দিচ্ছে ভিআইপি’ রা। তাদের যাতায়াতের জন্যে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। তার পরে উনারা উল্টো দিক থেকে জাতীয় পতাকা পত পত করে উড়িয়ে চলা ফেরা করেন। হায়রে স্বাধীন বাংলাদেশ!! গাড়ির কালো কাঁচ ভেদ করে হয়ত পাবলিকের ভোগান্তি দেখা যায় না!!! ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে এখন বেশ কিছু কৌতুক চালু হয়েছে। সকালে শেভ করে বের হলে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ছেলেদের দাঁড়ি বড় হয়ে যায়। মায়েদের বাচ্চা প্রসব হতেও মাস তিনেক দেরী হচ্ছে। কেউ কেউ না-কি বাচ্চাদের নাম পর্যন্ত রাখছে ‘জ্যাম’। রাস্তায় এত জ্যাম, তার প্রভাব মানুষের কর্মকাণ্ডে পড়াটাই তো স্বাভাবিক!

বাঙালিরা খাবার ব্যাপারে দেখলাম আরও সৌখিন হয়ে উঠেছে। এমনিতেই বাঙালি ভোজন ও আপ্যায়নে বিশ্ব সেরা। মধ্যবিত্তের কাছে খরচ করার বাড়তি অর্থের কমতি খুব একটা নাই। উচ্চবিত্তের কথা না-ই বা বললাম। তাদের প্লেন আছে, হেলিকপ্টার আছে, বিএমডব্লিউ ও লেক্সাস গাড়ি আছে। অফুরন্ত যে টাকা আছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এইদিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের একই শ্রেণীর মানুষদের তারা অনায়াসে টেক্কা দিতে পারবে। বাঙালি উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছে একের পর এক বিরানি হাউস, কাবার ঘর, পিঠা হাউস, কফি হাউস এবং বিদেশি ব্রান্ডগুলোকে নকল করে বার্গার, পিজা ও ফ্রাইড চিকেনের দোকান। তুলনা করে দেখলাম ঢাকার কোন অভিজাত কফি হাউসের কফির মূল্য এমেরিকার আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্টার বাক্স’র কফির সমতুল্য কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে বেশী। পশ্চিমা বিদেশী কোম্পানিগুলো উঠতি বাঙালি সমাজের খরচ করার প্রবণতা থেকে মুনাফা বানানোর সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজী না। নিজেদের দেশে দিনে দিনে ব্যবসা কমলেও বাংলাদেশে ব্যবসা হচ্ছে রম রমা। পিজা হাট, বার্গার কিং জাতীয় কোম্পানিগুলো দেদার ব্যবসা করছে। অন্যান্য দেশের মানুষদের স্থূলকায় বানিয়ে ওদের ক্লান্তি আসে নি। এখন নজর পড়েছে ভোলা-ভালা বাঙালির শীর্ণ স্বাস্থ্যের দিকে। এই বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিদের কোনভাবে তো পিছিয়ে রাখা যায় না। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে হবে না? বাঙালি কোনভাবেই শীর্ণ থাকতে পারবে না।

শ্রেণী সখি অপরূপা নিরুর আয়োজনে বেশ শাহী ‘গেট টু গেদার’ হয়েছিলো। নিরু এখন যেমন সুন্দরী, ঠিক তেমন সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। সে যখন কিছু উচ্চারণ করে, তখন আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় শুধু কান পেতে শুনি; চোখ ভরে দেখতেই থাকি। মুহূর্তেই এই রহস্যের প্রকৃতির বিধান বুঝার চেষ্টা করলাম। ইদানীং দেখি বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেয়েরা আরও বেশী সুন্দরী হচ্ছে। অন্যদিকে ছেলেদের অবস্থা নিদারুণ। সময়ের সাথে অভিজ্ঞতা বাড়লেও, চুলের সংখ্যা দ্রুত কমছে। কারোর কারোর মাথার চান্দি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। মধ্য প্রদেশ মানে উদর স্ফীত হচ্ছে। যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত না করে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিজ্ঞ বন্ধু লাবুর দায়িত্ব ছিল উৎসাহীদের এক জায়গায় করা। ওরগানাইজার হিসেবে লাবু আমাদের মধ্যে সব সময়ে সেরা। সেই ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম সার্ক দেশগুলোতে শিক্ষা সফরের আয়োজন করেছিলো। লাবু অল্প সময়ের নোটিসে বেশ কিছু প্রিয় মুখ হাজির করতে পেরেছিলো। অনুষ্ঠানে এসেছিলো মাসুদ, জাহাঙ্গির, আজাদ, মাসুদ, লিটন, অপু ও ইশতিয়াক। লাবু, লিটনের সাথে ছিলো তাদের পরমা সুন্দরী স্ত্রী’ দ্বয়।

অবশ্য কয়েকজন অন্য ঝামেলায় আটকে পড়ার জন্যে আসতে পারে নি। খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডাবাজিতে আসর খুব জমে উঠেছিলো। একেবারে বড় ধরণের হা হা, হি হি চললো অনেকক্ষণ। শেষে যোগ হলো গান, কবিতা ও জোকস। এখানে আরেকজনের কথা চুপি চুপি আরেকবার বলি; রুচি। আমাকে সে জানালো, সে খুব কম সময়েই শাড়ি পরে। কিন্তু আমার জন্যে ওই স্বর্ণালী সন্ধ্যা অবিস্মরণীয় করে রাখতে সে শাড়ি পরেছে। সাথে মায়াবী সাজ। ভীষণ ভালো লাগায় হারিয়ে গেলাম, “পড়েনা চোখের পলক কি তোমার রূপের ঝলক দোহাই ………. আমি জ্ঞান হারাবো মরেই যাবো বাঁচাতে পারবে নাকো কেউ।”

ফিরে আসার একদিন আগে “একাত্তর টিভি” আসলো আমার ইন্টার্ভিউ নিতে। তাদের আমি বললাম, “বাংলাদেশ শুধু আজ পঞ্চান্ন হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। প্রায় দু কোটি বাঙালি মানে প্রতি আট জনের এক জন দেশের বাইরে থাকে। তারা শুধু সাথে করে বাঙালি সংস্কৃতিকে নিয়ে যায় নি, সেটাকে লালন ও পৃষ্টপোষকতাও করছে।” আমি আরও যোগ করলাম, “যেখানে বাঙালি, যেখানে বাংলা, সেখানেই বাংলাদেশ।” প্রবাসের সমান্তরাল ও মূল ভূখণ্ডের বাংলাদেশ মিলে ‘সম্পূর্ণ বাংলাদেশ’। একে ওপরের পরিপূরক হলে সবার জন্যেই উত্তম। সেটা বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে।”

দিল-দরিয়ার মানুষ বিভি রঞ্জন। তিনি নামজাদা এক প্রকাশক। প্রতি বই মেলাতে তিনি আমার বই প্রকাশ করেন। আমি লিখি, তিনি ছাপিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেন। একটা আত্মিক সম্পর্ক হয়ে গেছে। তিনি আমন্ত্রণ করলেন রমনা পার্কের রেস্টুরেন্টে। সবুজের বনানীতে বসে ভাস্কর চৌধুরী, শামসুন্নাহার সহ অন্যান্য কবি-লেখকদের সাথে নানা বিষয়ে আড্ডা হলো। সাথে চললো আরেকদফা উচ্চমার্গের ভোজন। ছোট গল্পকার নুরুল মোমেনও সেখানে যোগদান করেছিলো। সে একজন উদীয়মান গীতিকারও। গুলশানের এক কফি সপে শামীম ওয়াহিদের সাথে মিলিত হয়েছিলাম। তিনি বিদেশে থাকলেও বাংলাকে ভীষণ ভালোবাসেন। মহিলাদের জন্যে ‘নন্দিনী’ নামে একটা পত্রিকা বের করছেন। কিছু বইও প্রকাশ করেছেন। পরিকল্পনা আছে তার সাহিত্য পত্রিকা বের করার। তিনি জানলেন, এইবার একুশের বই মেলায় তিনি স্টল নিবেন। স্বপ্ন নিয়ে কথা বলার সময়ে চোখ দুটো তার চকচক করছিলো। কিছু মানুষ বড় বড় স্বপ্ন দেখতে পারে বলেই পৃথিবীটা এখনো টিকে আছে।

ঢাকা শহরটা এখন হয়ে গেছে বিজ্ঞাপনের শহর। বিলবোর্ড, পোস্টার, চীকা দিয়ে একেবারে চারিদিকে আচ্ছন্ন। যে যেইভাবে পারছে প্রচার করছে। মানুষেরা তাদের প্রচার কাজে দৃষ্টি দিচ্ছে কি-না সেদিকে বিশেষ কোন নজর নাই। মূল রাজনৈতিক দল এদিক থেকে শীর্ষে। শহরের কোথাও পোস্টার, ব্যানারে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি দেখলাম না। এই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্যটা করাটা সমীচীন হবে না। তবে একটা কথা আছে, “খালি কলসি বাজে বেশী, ভরা কলসি বাজে না। রূপ নাই তার সাজন বেশী, রূপের মাইয়া সাজে না।” সীমিত কিছু বিজ্ঞাপন রুচি সম্মতভাবে দিলে বেশী কার্যকারিতা পাওয়া সম্ভব। আরেকটা ব্যাপার খুব পীড়া দিলোঃ চারিদের শুধু আবর্জনা ও ধুলা-বালি। জীবাণু খুব সহজে ছড়াচ্ছে। সবারই জানা, ‘পরিষ্কার পরিচ্ছনতা ঈমানের অঙ্গ’। তার পরেও এত আবর্জনা কেন? আমার ধারণা প্রচুর সমস্যা আমরা নিজেরাই তৈরি করছি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় গাড়িগুলো সব নিয়মকানুন মেনে চলছে। ফলশ্রুতিতে তেমন কোনো জ্যাম সেখানে হচ্ছে না। কিন্তু পুরো ঢাকা শহর জুড়েই অন্য রকম ব্যাপার। অনিয়মটাই নিয়ম। আমরা কেন যে বুঝি না, সৎ ভাবে নিয়ম কানুন মেনে চললে অধিকাংশ অকারণ সমস্যা সৃষ্টিই হবে না।

দুটো টিভি অফিসে যাওয়ার আমার সুযোগ হয়েছিল। বন্ধু ইশতিয়াকুর রেজা ‘একাত্তরের টিভি’ র বড় কর্মকর্তা। এক সময়ে একসাথে কত আড্ডাবাজি করে সময় কাটিয়েছি। টেলিভিশন কেন্দ্রটা ঘুরে দেখে ভালো লাগলো। কয়েক বছর আগে এক টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে যেয়ে পরিচয় হয়েছিল খান মোহাম্মদ সালেকের সাথে। তারপর থেকে আমাদের মধ্যে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ আছে। তিনি এখন ‘মাই টিভি’ র কর্মকর্তা। তার সাথে দেখা করলাম তার অফিসে। তিনি নিয়ে গেলেন অফিসের ছাদের ক্যান্টিনে। চায়ের সাথে সাথে মেলা গল্প হলো। সেখান থেকে রাতের হাতির ঝিল ও ঢাকা শহরের একটা অংশ দেখলাম। দুই টিভি অফিসে যেয়ে দেখলাম, বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নির্মাতাদের পরিকল্পনায় গাড়ি পার্কিং বিষয়টা ছিলো না। আবার ব্যাপক সংখ্যক অফিস আদালত আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাড়ি খুঁজতে যেয়ে আরেক বিড়ম্বনায় পড়লাম। বাড়ির নম্বরগুলো ধারাবাহিকভাবে নাই। মনে পড়লো সেই অনেকদিন আগে শুনা একটা গল্প। একজন জানতে চাইলো, ‘বাড়ি কই?’ উত্তর পেলো, ‘স্কুলের পাশে।’ এবার সে প্রশ্ন করলো, ‘স্কুল কই?’ উত্তর পেলো, ‘বাড়ির পাশে।’ শেষে বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলো, আরে ভায়া বলুন, ‘বাড়ি ও স্কুল কোথায়?’ এইবার সে উত্তর পেলো, “কেনো পাশাপাশি?”

ছোট দুটো প্রাণ আমার হৃদয় ছুঁয়েছিলো। আমার শালার দুই মেয়ে মাইশা ও মাহিবা। পারলে পুরোটা সময়ে ওরা আমার কাছাকাছি থাকে। দু জনে কাছেই আমি একজন সুপার হিরো। আমার সবকিছুতেই ওরা মুগ্ধ হয়। দু জনেই আবার আমার পাঠক। আমার সাথে ছবি তুলতে, সেলফি তুলতে মহা আনন্দ। মাইশার অভিযোগ আমি না-কি ঠিক করে সেলফি তুলতে জানি না। আমাকে সে সঠিকভাবে সেলফি তোলা শেখাতে চেয়েছিল। এর পরের বার ওর থেকে ব্যাপারটা রপ্ত করতে হবে। ওদের মা লাভলী আমার ছোট বোনের মতো। আমার কিসের ভালো লাগবে, কিসে আনন্দ পাবো; সেটা করতেই তার মহাসন্তুষ্টি। আসলে আমরা সবাই ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসা পেলে, ভালোবাসা দিতে ইচ্ছা করে। এর কোন শেষ নাই। আছে শুধু পৌনপৌনিকভাবে বেড়ে চলা। ফিরে আসার দিন লাভলী অনেক কান্না কাটি করলো। প্রতিটা মুহূর্তে তার কান্না মাখা মুখ আমার চোখে ভাসে।

‘ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সেদেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’--- সেখানকার নয় দিনের প্রতিটা বৃত্তান্ত স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা অসম্ভব। আম্মার মৃত্যুর পরে বড় ভাবী ও ভাই পরিবারের বটবৃক্ষ। তাদের নিরাপদ ছায়া থেকে চলে আসাটা খুব পীড়াদায়ক। বিটটু ভাই, নাসিমা ভাবী আমাদের আপ্যায়নের জন্যে কি ছুটাছুটি না করেছে! পাইলট নাজমূল ইসলাম টুকুনের সাথে এ বার বাইরে কোথাও যাওয়া হয় নি। আমাদের দু জনের প্রচুর মজার স্মৃতি আছে। বন্ধু নিশুকা আমার সাথে দেখা করার জন্যে বের হয়েছিল। কিন্তু খবর এলো তার একজন আত্মীয় মারা গেছেন। এইবার আর প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখে হলো না। ভালো থেকো বন্ধু। দেখা হবে খুব শিগ্রি। ভাতিজা- ভাতিজি শমী, তিন্নু, রুদাবার মায়া ভরা মুখগুলোকে দেখে অনাবিল প্রশান্তি পেলাম। এর কি কোন তুলনা হতে পারে?

নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, দুবাই, ব্যাংকক, কোলকাতা, দিল্লি সহ পৃথিবীর বহু শহর আমি দেখেছি। হাজার সমস্যা থাকার পরেও একমাত্র ঢাকাই ‘আমার প্রাণের শহর’। যতবার এখানে আসি ততবার-ই বুকটা ফুলে ইয়া বড় হয়। আর চলে যাবার সময় বুকটা শুকিয়ে শুধু কাঠই হয়ে যায় না; মনে হয়ে কষ্টে পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিদায় ঢাকা। বিদায় প্রতিটা প্রিয় মুখ। আমি আবার ফিরে আসবো। আমাকে ফিরে আসতেই হবে, “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়; হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে।” যেখানে এতো স্মৃতি, এতো ভালোবাসা, যার স্থান একেবারে হৃদয়ের মধ্যখানে, সে তো আমার বেঁচে থাকার সুধা।

জানুয়ারি ১৪, ২০১৭

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com