টিকি টিকি টিক টিক

টিঙ্কুর এক বিশেষ ধরণের খেলার ভীষণ সখ। সে খেলাটাই এখন সে খেলছে। খেলাটার নাম সে নিজেই দিয়েছে ‘টিকি টিকি টিক টিক’। বাড়ির অন্যরাও টিঙ্কুর এই খেলার সাথে বেশ পরিচিত।

ছোট একটা পানির বোতল। কিছুটা অবশ্য বোতলের মধ্যে ফাঁকা আছে। টিঙ্কু বোতল এক বার সোজা করছে, আরেকবার উল্টো করে নীচের দিকটা উপরের দিকে করে দিচ্ছে। এতে সামান্য কিছু বুদবুদ তৈরি হচ্ছে। টিঙ্কু মনোযোগ দিয়ে বোতলে পানির বুদবুদ দেখছে। বুদবুদ শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র, বোতলটা আবার উল্টিয়ে দিচ্ছে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেলা চলছে।

টিঙ্কু খেলাটা এক মনেই খেলে। তখন কোন দিকেই খেয়াল থাকে না। বুদ বুদটা শেষ হলে, শুধু মাত্র কয়েকটা শব্দ মুখ থেকে করে, টিকি টিকি টিক টিক। হয়ত আনন্দিত হয়ে কথাগুলো বলে। চোখ মুখ মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। খেলতে খেলতে বেচারা এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বোতল ঘুরানোর গতি আগের থেকে বেশ কমে যায়। বোতলে প্রথমে যে রকম বুদ বুদ হচ্ছিল, তাও সংখ্যায় কমে আসে। টিঙ্কুর মুখে বিরক্তির ভাব আসতে আরম্ভ করে।

বিরক্তি রেখা আসার পর দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। এক, সে ঘুমিয়ে যেতে পারে। আর অন্যটা হল বেশ অদ্ভুত। চিৎকার করে সে বলবে, টিকি টিকি টিক টিক। তার পরে পানি ভর্তি বোতল ছুঁড়ে মারে। সাথে সাথে চীৎকার করে কান্না।

টিঙ্কুর বয়স সবে চার। হাতে তেমন বেশী শক্তি হয় নি। ছুঁড়ে ফেলা বোতল বেশী দূর যায় না। বয়স কিংবা শক্তি আরেকটু হলে; বিপদ ঘটে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকত। বাবা মা আরও অনেক খেলনা টিঙ্কুকে দিয়ে খেলানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু না; মৃদু স্বরে বলেছে, টিকি টিকি টিক টিক। সাথে সাথে তার অস্থিরতা আর রাগ বাড়তে থাকে। হাতে পানির বোতল নিয়ে খেলা খেলা আরম্ভ করার পরেই শান্তি। আবার বিভিন্ন সুরে সেই একই কথা , টিকি টিকি টিক টিক।

টিঙ্কুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তারই বড় বোন রিমি। বয়সে টিঙ্কুর থেকে কিছু বড়; ছয় বছরের। মানে রিমির বয়স এখন দশ। কিন্তু তার পরেও, রিমি ভাল করেই বুঝতে শিখেছে, সে বড় বোন। সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখে টিঙ্কুর দিকে। কান খাড়া করে রাখে। টিঙ্কুর কোন মুডে 'টিকি টিকি টিক টিক’ খেলতে 'টিকি টিকি টিক টিক’' কথাটা বলছে; সেটা নিমিষেই বুঝে নিতে পারে। রিমি খুব ভাল করেই জানে, তার এই দায়িত্বে সামান্য অমনোযোগিতা বড় ধরণের সমস্যার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

শ্যামল আর সুমির এক মেয়ে, এক ছেলে। প্রেম করে বিয়ে করেছিল। শ্যামল বিয়ের আগের থেকেই বলত, তার পরিবার হবে সুখী পরিবার। এক ছেলে, এক মেয়ে। প্রথমে হবে ছেলে, তার পরে মেয়ে। ছেলেটা দেখতে হবে মায়ের মত, মেয়েটা হবে বাবার মত। তবে একটা ক্যারিকেচার বিধাতাকে তাদের জন্যে করতে হবে। মেয়েটা বাবার চেহারা পেলেও, গায়ের রং হতে হবে মায়ের মত; মানে ফর্সা। রসিকতা করে শ্যামল বলতো, মেয়ে বাবার কালো রং পেলে, আর বিয়ে দিতে হবে না।

স্বপ্ন আসলেও ধরা দিল, শ্যামল-সুমির সংসারে। তবে পুরোটা মিলল না। প্রথমে চেয়েছিল ছেলে, হল মেয়ে। একেবারে ৯০% ভাগ মায়ের মত। মায়ের মতই নাক চোখ, কপাল, গায়ের রং। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার সময় প্রচুর ভোগান্তি হল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও নরমাল ডেলিভারি হল না। সিসারিয়ান অপারেশান করে বাচ্চা বের করা হল। তা সত্ত্বেও বেচারির বেশ অনেক রক্তক্ষরণ হল। পুরো সাত দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

এই ছোট রিমি, জন্মের পর থেকেই মনে হয় শারীরিক যুদ্ধ আরম্ভ করল। জন্মের দু ঘণ্টা পরে আবিষ্কার হল, বেচারির শরীর গরম থাকছে না। টেম্পেরেচার নর্মাল থেকে বেশ নীচে নেমে যাচ্ছে। ডাক্তার সাহেব জানালেন, এ রকম বাচ্চাদের হতেই পারে। স্পেশাল হিট দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। ডাক্তার সাহেবের মতে, ভয়ের কোন কারণ নাই। তিন দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি দিনের মধ্যে এক সমস্যা শেষ হলেও, ছোট মানুষটা আরেক অসুখে পড়ল। জন্ডিস হয়ে গেল। ডাক্তার সাহেব আবার অভয় দিলেন, এইটা একেবারেই কমন। অনেক বাচ্চারই হয়, ঠিক হয়ে যাবে। এই আর কি বাচ্চাকেও হাসপাতালে কয়েক দিন অতিরিক্ত থাকতে হবে।

শ্যামলের সব দিক সামাল দিতে যেয়ে কাহিল অবস্থা। এক দিকে সুমি আর এক দিকে নবজাতিকা। দু জনের ঠিক ঠাক চিকিৎসা, ওষুধের ব্যবস্থা করতে করতে এক গাদা খরচ হয়ে গেল। নিজের জমানোর টাকা তো সব বের হয়ে গেলোই, সাথে বেশ কিছু ধার দেনা করতে হল। শ্যামল পণ করে ফেলল, আর না। এক বাচ্চাই তার জন্যে যথেষ্ট। সুমির এত কষ্ট হল। তার উপরে নিজের উপরে এত চাপ। নাহ, আর না!

সুমির শরীরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও, কিন্তু এক বারের জন্যেও কোন অভিযোগ করে নি। বরং মনে মনে ঠিক করে রাখল, শরীর একটু ভাল হলেই, আবার চেষ্টা করবে। শ্যামল ছেলের এত শখ করেছিল, তাকে সেইটা দিতে হবে। শ্যামল বলত, এক ছেলে, এক মেয়ে। কথাটা একটু ঘুড়িয়ে বললে, দোষের কিছু হতে পার না। একই তো ব্যাপার, এক মেয়ে, এক ছেলে। আগে পরে তে কি যায় আসে?

কিছু দিন যেতে না যেতেই সুমি প্রসঙ্গটা তুলল। কিন্তু শ্যামলের এক কথা। এত ঝামেলা, কষ্ট, খরচের কোন দরকার নাই। সে সুমির শত আহ্লাদকে কোন আমলেই আনল না। সুমি মনে মনে হাসল। দেখা যাক, শ্যামল নামের পুরুষ মানুষটা কত দিন গো ধরে বসে থাকতে পারে। কাছে তাকে আসতেই হবে। আকর্ষণের ছোঁয়ায় তাকে ভাসতেই হবে, নতুন করে হারাতেই হবে।

অবশ্য দেখতে দেখতে বেশ কিছু দিন পার হয়ে গেল। রিমির জন্মের সময় যে ঝড়-ঝাঁপটা এসেছিল, শ্যামল-সুমি তা বেশ সামাল দিয়ে ফেলল। কঠিন সময়গুলো স্মৃতিতে বিলীন হয়ে গেল। অনেকটা না জানিয়েই, সুমি নতুন এক শিশুকে পৃথিবীতে আনার কাজ আরম্ভ করল। চেষ্টার প্রতি বারই সে বিধাতার কাছে কায়মন বাক্যে চাইল, এক জন পুত্র সন্তান।

সুমি যখন আবার প্রেগন্যান্ট হল, তখন প্রায় পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। এই দিকে রিমির রিমঝিম শব্দে সারাদিন বাড়িতে যেন আনন্দের ফোয়ারা বইতে থাকে। শ্যামল অফিসের পরে ঘরে যতটুকু সময় কাটায়, তার পুরোটাই যেন রিমির জন্যে। শ্যামলের মেয়ের সাথে সময় কাটাতে কোন ক্লান্তি নাই। কন্যাকে গোসল করানো, খাওয়ানো থেকে আরম্ভ করে শত কাজ করেও বিন্দু মাত্র কোন অভিযোগ করতো না।

সুমি শ্যামলকে ঠাট্টা করে বলত, সব ভালবাসা মেয়েকে দিয়ে দিলেই কি হবে? এর পরে যে পুত্র সাহেব আসছে, তার জন্যে কিছু রাখতে হবে না? শ্যামল গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছে, প্রিয়তমা- ডিভিশন অফ লেবার। মানে শ্রম বিভাজন। মেয়ে আমার, ছেলে তোমার।

সুমি বলে, এক সময়ে না জনাবের ছেলে না হলে, জীবন বৃথা হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। এক জন না, দুই সন্তানের আবদার সেই কবে দিয়ে রেখেছো। এখন কথা ঘুরালে কিন্তু বিপদ হয়ে যাবে। শেষে; বিচারকের রায় পড়ার ভঙ্গিতে বলেছে, ছেলে- মেয়ের ভাগাভাগি বলে কিছু হবে না। মেয়ে শুধু তোমার একা না, ছেলে শুধু আমার একার না।

আমাদের দু সন্তানই আমাদের দু জনের। এখনই বলে রাখছি, আমাদের ছেলেকে কিন্তু কোন ভাবেই মেয়ের থেকে কম ভালোবাসা যাবে না। একেবারে সমান সমান—ফিফটি ফিফটি।

শ্যামল-সুমির পরিবার নতুন সদস্য নিয়ে মেতে উঠলো। কাজ তো আর কম না। ছোট টিঙ্কু সারা দিন বেশ ঘুমালেও, সন্ধ্যা হতেই গলা ছেড়ে কান্না আরম্ভ করত। যত রাত গভীর হত, বেচারার কষ্ট মনে হয় বাড়ত। সামান্য একটু বিরতি দিয়ে আবার সেই কান্না। বাবা, মা দু জন সব রকম চেষ্টা করত বাচ্চাটাকে একটু আরাম দেয়ার। বুকে নেয়া, কোলে নিয়ে পায়চারী করা, গোসল করিয়ে দেয়া, খাওয়ানোর চেষ্টা করা, ডায়পার বদলিয়ে দেয়া থেকে গ্রাইপ ওয়াটার খাওয়ানো, পেটে তেল মালিশ করে দেয়া পর্যন্ত সব চেষ্টাই করল। যে যখন যেই বুদ্ধিতে দিয়েছে, সেটাই মনে হয়েছে; টিঙ্কুর রাতের ঘুম ঠিক করে দিবে।

ডাক্তার বললেন, টেনশনের কিছু নাই। কিছু দিনের মধ্যেই চলে যাবে। এ রকম অনেক বাচ্চাদের হয়ে থাকে। একটু ওজন বাড়লেই ঠিক হয়ে যাবে।

সুমির তো চিন্তার শেষ নাই। কিছু দিন। মানে কয় দিন? ওজন বাড়তে হবে। কতটুকু বাড়াতে হবে? বাচ্চা সারা রাত কাঁদে। ওর ওজন কি ভাবে বাড়বে? বাচ্চারা না রাতের ঘুমের মধ্যে বাড়ে?

ডাক্তার অভয় দিয়ে বললেন, এই তো মাস চারেক পার করলেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। সম্ভবত পেটে গ্যাস কিংবা ব্যথার কারণে এমন হচ্ছে।

শ্যামল পুরুষ মানুষ। তার পরেও অস্থির হয়ে পড়ল। চার মাস। এত লম্বা সময় তারা কি করে পার করবে। আসলেও কি বাচ্চাটার কষ্ট শেষ হবে। যদি ছোট মানুষ কষ্ট নিতে না পারে। কই রিমির সময়ে এ রকম কোন সমস্যা হয় নি। টিঙ্কুর কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? মনকে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। নিজেই শক্ত থাকতে পারছে না, আর সুমিকে কি বলে শান্ত করবে।

সুমির বান্ধবী রীতার গত বছর ফুট ফুটে এক ছেলে হয়েছিল। সেও সারা রাত ধরে কাঁদত। রীতা আর তার স্বামী সব ধরণের চেষ্টাই করেছে। কিন্তু না, লাভ হয় নি। বাচ্চাটা আড়াই মাসের মাথায় মারা গেল।

শ্যামল-সুমির দু জনের মাথায় একই চিন্তা। এই ফুটফুটে বাচ্চাকে যে কোন ভাবেই বাঁচাতে হবে। এই বাচ্চার যদি কিছু হয়, তারা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারবে না। কোন ভাবেই তারা এই ভালোবাসাকে হারাতে পারবে না।

দু জনে পালা করে টিঙ্কুকে নিয়ে জেগে থাকার পরিকল্পনা হল। কিন্তু বেশীর ভাগ রাতই দু জনে এক সাথে জেগে থাকে। ভোরের দিকে টিঙ্কু যখন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে; সুমি যেয়ে কাজের বুয়াকে ডেকে নিয়ে আসত। এর পরেই শ্যামল-সুমির কয়েক ঘণ্টার ঘুমের চেষ্টা।

ছয় বছর বয়সে কে কি করেছে, সেটা ক জনের মনে থাকে? কিন্তু প্রকৃতি সবার জীবন একই রকম হয়ত করে না। টিঙ্কুর জন্মের সময় বেচারি রিমির বয়স ছিল মাত্র ছয়। ছোট ভাইয়ের সারা রাত ধরে কান্না, বাবা মায়ের উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি—কোনটাই তার চোখ এড়ায় নি। সে বুঝে নিল, ছোট ভাইটার এমন কিছু একটা হচ্ছে, যেটা থেকে ভয়নঙ্কর কিছু হওয়ার ভয় আছে।

হঠাৎ করেই বাড়ির সব এটেনশান তার থেকে নব জাতক ভাইয়ের দিকে চলে গেল। প্রথম কয়েক দিন রাগ করে, মুখ ফুলিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদল। যদিও বুয়া সব সময়ে কাছাকাছি থাকত। তার পরেও তার আব্বু আম্মুর সাথে, সারাক্ষণ, আগের মত থাকতে ইচ্ছে করতো। বাবার কোলে করে বাইরে যেতে মন চাইতো। আর বাবার সাথে করিম চাচুর দোকান থেকে চকলেট কিনে খেতে ইচ্ছে হতো।

বাবা অফিস থেকে এসে তাকে কোলে নিয়ে খেলা করে না। কোন রকমে হাত মুখ ধুয়ে ছুটে যায় টিঙ্কুর কাছে। চিন্তিত হয়ে মাকে এটা সেটা প্রশ্ন করে। রিমি স্পষ্টই বুঝতে পারে, প্রশ্নগুলো সব টিঙ্কুকে নিয়ে। রিমি প্রচণ্ড অভিমান হয়। নতুন বাচ্চা আসলে বুঝি, আগের বাচ্চাকে ভুলে যেতে হয়! কিন্তু যেই বাবা তাকে এত আদর করে, সে কিভাবে তাকে ভুলতে আরম্ভ করেছে। বাবাকে খুব বলতে ইচ্ছে করে, আব্বু আমার খুব চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে, তোমার কোলে উঠতে ইচ্ছে করে। প্লিস প্লিস আমাকে একটু নাও, আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাও।

রিমি এক ঘুমে রাত পার করে দেয়ার মানুষ। ঘুম তার খুব পোক্ত। বাবা-মা গল্প, হাসি, টেলিভিশনের শব্দে তার ঘুমের কোন সমস্যা হত না। বাবা মার ঘরে যেয়ে আর শোয়া হয় না। একবার রিমির, টিঙ্কুর বাসায় ফেরার এক মাস পরে, রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখল, বিছানার পাশে মেঝেতে বুয়া ঘুমাচ্ছে আর পাশের রুমে লাইট জ্বলছে।

মনে হল মায়ের কান্নার আওয়াজ। প্রথমে ভাবল ভুল শুনছে। মা কাঁদবে কেন? পাশের রুম থেকে বাবা মায়ের চাপা গলায় কথা বলতে শুনল। মা বলছে, আমি এই ছেলেকে কোন ভাবেই মরতে দিব না। আল্লাহ চাইলে আমাকে নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এই বাচ্চাকে যেন তিনি মাফ করে দেন।

বাবা উত্তরে বলল, ডাক্তার তো বলেছেই কিছু দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। এ রকম অনেক বাচ্চারই হয়ে থাকে। এত তাড়াতাড়ি এত অস্থির হওয়াটার কোন মানে হয় না।

মা কান্না কান্না গলায় বলতে লাগল, তা হলে রীতার বাচ্চাটা মরে গেল কেন?

ছোট রিমির বাবা মায়ের উপর অভিমান নিমিষেই হারিয়ে গেল। বাবা মার পরিবারের নতুন সদস্যের জন্যে এত মনোযোগের কারণ জানা হয়ে গেল।

প্রকৃতি ছয় বছরের রিমিকে মুহূর্তেই জানিয়ে দিল, সে টিঙ্কুর বড় বোন। কেমন এক অজানা টান আবিষ্কার করল। মায়ের কষ্টের বোঝার ভাগ তার মধ্যে চলে আসল। সে নিজে নিজেই প্রতিজ্ঞা করল, ছোট ভাইটাকে বাবা মায়ের মত আগলিয়ে রাখবে।

ছোট ভাইটাকে বাঁচতে হবে। তাকে রীতা খালার ছেলের মত মরতে দেয়া হবে না।

মায়ের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে, ডাক্তারের কথা সত্যি প্রমাণিত হল। টিঙ্কুর সারা রাতের অবিরাম কান্না ছয় মাস বয়সে বন্ধ হয়ে গেল। আরাম করে বাড়ির সবাই রাতে ঘুমান আরম্ভ করল। বাবা মায়ের সাথে সাথে রিমিও হাফ ছেড়ে বাঁচল। আল্লাহ তা হলে সুমির কথা শুনেছেন, তিনি মাকে কষ্টের থেকে রেহাই দিয়েছেন।

সুমির যদিও দুই সন্তানকে নিয়ে মহাব্যস্ততা তার পরেও স্বামী স্ত্রীর খুনসুটি ঠিক আগের মতই চলতে লাগল। প্রেমের বিয়ে বলে কথা। সুমি বেশ যাত্রার ঢঙ্গে বলত, দেখেছেন জনাব; মহারানী সুমি যা বলে, সেটা সে করে দেখায়। আপনাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। আপনি এখন এক রাজকন্যার এবং এক রাজপুত্রের জনক।

শ্যামল একই সুরে জবাব দিল, চুক্তি অনুযায়ী পুত্র সন্তানের গাত্র বর্ণ পিতার অনুরূপ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে কন্যা ও পুত্র, দু জনেই মায়ের বর্ণ পেয়েছে। একে আমি আমি চুক্তির বরখেলাপ বলে জ্ঞান করছি।

এর উত্তরে সুমি শ্যামলের পিঠে দুটো কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, তোমার গায়ের রং পেলে আমার ছেলেকে দেখতে লাগত কুচলুচে কালো ভূতের মত। কোন মেয়েই ঘুরে তাকাত না।

এই বার শ্যামল, তেড়ে আসল, কি কি বললে। আমি কুচকুচে কালো ভূতের মত? জানো কত মেয়ে আমার জন্যে একেবারে অস্থির ছিল। এক বার শুধু ইশারা দিলেই, একেবারে রাজত্ব নিয়ে চলে আসত। আর আপনি কিনা এসেছেন শূন্য হাতে। হা হা।

সুমি হাসতে হাসতে উত্তর দিল, আমাকে ওই সব কল্পনার কথা বলতে হবে না। খুব জানা আছে, কয়টা মেয়ে ওই চেহারা দেখে অস্থির হয়েছে। শুধু এক জনই হয়েছিল। ভাগ্যিস আমি চান্স দিয়েছিলাম, না হলে নির্ঘাত যেয়ে বুড়িগঙ্গার মাঝ দরিয়ায় যেয়ে লাফ দিতে হত। এখন তো আবার বুড়িগঙ্গায় পানি থেকে আবর্জনাই বেশী। কি একটা বিচ্ছিরি ধরণের কেলেঙ্কারি হত। পত্রিকায় উঠত যুবকের আত্মহত্যার বিফল হয়েছে বুড়িগঙ্গায় পানি স্বল্পতা ও আবর্জনার কারণে। আর তোমাকে সারা শরীরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বাড়ি ফিরতে হত। হা হা হা ।

ছিমছাম সংসারে হাসি-আনন্দে বেশ দিন যেতে লাগল। রিমি সারাক্ষণ টিঙ্কুকে চোখে চোখে রাখে। ভাইয়ের জন্যে কাজ করতে কোন ক্লান্তি নাই। দৌড়ে যেয়ে ভাইয়ের জন্যে খাবার এনে দেয়া, ডায়পার বদলিয়ে দেয়া, মাকে গোসল করাতে সাহায্য করা থেকে থেকে আরম্ভ করে যে কোন কাজ। স্কুল থেকে ফিরে কোন রকমে হোম ওয়ার্ক করেই ভাইয়ের কাছে ছুটে যায়। তার পরে কথা বলা, গান করা, খেলার চেষ্টা করা আরও কত কি!

টিঙ্কুও মা, বোন আর সবার যত্নে বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠলো। বাইরের কেও কোলে নিতে চাইলে তার বিরাট আপত্তি। একেবারে চোখ বড় করে, ভয় পেয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়। বাড়ির কারো কোলে ফিরে আসার পরেই শান্তি। দাদী, নানী শত আহ্লাদ করলেও, একেবারে ক্ষণিকের জন্যে কোলে নিয়ে রাখতে পারে না। এই নিয়ে তাদের কত দুঃখ। আহারে নাতি যদি তাদের কোলে আসত। বেচারিদের মনে দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হত।

এক বছর বয়স থেকেই থপ থপ শব্দ করে হাঁটা আরম্ভ করল। এক মনে সারা বাড়ি হেটে বেড়ায়। হাঁটার দিকেই তার এমনই বেশী মনোযোগ যে প্রায় আসবাবপত্রের সাথে ধাক্কা খায়। কেও চিৎকার করে সাবধান করে দিলেও খুব একটা লাভ হয় না। ঘুরে পর্যন্ত তাকায় না। ব্যাথার মাত্রার উপরে নির্ভর করে, টিঙ্কু হাঁটা বন্ধ হবে, না-কি কান্না আরম্ভ করবে।

রিমি একটা নতুন কাজ আবিষ্কার করে মহাখুশী। কেও না বললেও, টিঙ্কুর পেছনে পেছনে সেও হাটতে থাকে। কোথাও ধাক্কার খাওয়ার আগে, টিঙ্কুকে ধরে ফেলে; না হয় হাঁটার ডিরেকশন বদলে দেয়। বাবা মা বেশ নিশ্চিন্ত হল, যে টিঙ্কুকে তার বড় বোন চোখে চোখে রাখছে। রিমির মনে হয় ভাইকে বিপদ থেকে সরিয়ে রাখার কাজে কোন ক্লান্তি নাই। টিঙ্কু যদি কখন কোন কারণে কেঁদে উঠেছে, যে কেঁদেছে তার থেকে বেশী কষ্ট বড় বোনই মনে হয় পাচ্ছে। একেবারে মুখ গম্ভীর করে রাখে, যতক্ষণ না টিঙ্কুর কান্না বন্ধ হয়েছে।

ভাইয়ের সাথে খেলার জন্যে আকুল থাকলেও, টিঙ্কু বোনের সাথে খেলার ব্যাপারে কোন আগ্রহ হল না। এক মনে সে হেটে চলে। সাথে সাথে মুখ থেকে কিছু শব্দ করতে থাকে। রিমি কতই না চেষ্টা করত, ভাইকে একটু হাসাতে একটু কথা বলাতে, একটু অন্য কিছু খেলাতে।

অবিরাম নিজের মত হেটে চলাটা চলতে লাগল। টিঙ্কুর বয়স ২ থেকে ৩, ৩ থেকে চার হল। কোন কিছু মনের মত না হলে, চিৎকার করে গগন বিদারী কান্না। বাড়ির অন্যদের এর মধ্যে টিঙ্কুকে নিয়ে ক্লান্তি চলে এসেছে। তার কান্না শুনে অন্যরা ছুটে না আসলে, তার রাগ আরও বাড়তে থাকে।

বাইরের যে কোন কিছু আর নতুন কোন কিছু দেখলেই তার প্রতিবাদ আরম্ভ হত। টিভির কার্টুন দেখা, তার একটা ভাল লাগার মধ্যে যুক্ত হল। কার্টুন চ্যানেল দেখতে তার কোন বিরক্তি নাই। এক নজরে তাকিয়ে থাকে টেলিভিশনের পর্দার দিকে।

বাবা মায়ের অ, আ, ক, খ , এ , বি , সি, ডি শেখানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। বরং সুযোগ পেলেই বই ছিঁড়ে ফেলে। সুমি, শ্যামল নিজেরদের মধ্যে কথা বলল। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে, রিমির এই বয়স ছিল। তখন এই জাতীয় কোন সমস্যা হয় নি। রিমি কি সুন্দর বাইরে যেতে পছন্দ করত। নতুন মানুষদের অল্প সময়েই আপন করে নিত। আর টিঙ্কু কি না একেবারেই এর বিপরীত।

সুমি ভাবল, হয়ত ছেলেরা অন্যরকম হয়। সব কিছু শিখতে বেশী সময় নেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে এসে অন্য বাচ্চাদের মতই সব কিছু নিয়েই মেতে উঠবে। শ্যামল একটু চিন্তিত হলেই সুমি রসিকতা করে বলত, ছেলে বলে কথা। হয়ত পূর্ব পুরুষ রাজা-বাদশা ছিল। সব কিছু আরাম আয়েশ করে ধীরে সুস্থে করবে।

এর মধ্যে আশার একটা ব্যাপার হল। রিমির স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা করে ফেলল। রিমির এক বান্ধবী, তিন্নির জন্মদিন ছিল। তিন্নির মা আগের থেকেই সুমির সাথে যোগাযোগ করে জানিয়ে রেখেছিল, স্কুল থেকে তিন্নির সাথে রিমিকেও উঠিয়ে নিবে। তার পরে বাসায় কেক কাটার অনুষ্ঠান করে তিন্নি, রিমি কিছুক্ষণ খেলবে। সাথে আরও কিছু সম বয়সীদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল। তিন্নির মা পরে নিজেই রিমিকে বাসায় পৌঁছে দিবে।

রিমির স্কুল থেকে ফিরে আসার সমর পার হয়ে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই টিঙ্কুর কেমন অস্থিরতা আরম্ভ হল। এই রুম থেকে সেই রুম যেয়ে, বারে বারে এই দিক ওই দিক থেকে তাকিয়ে যেন কাউকে খুঁজতে লাগল। বিষয়টা প্রথম চোখে পড়ল বাড়ির বুয়ার। সে কানে কানে যেয়ে বলল সুমিকে। সুমি এসে দেখল, কথাটা একেবারে ঠিক। টিঙ্কু ছুটে কাউকে যেন খুঁজছে। মনে হল উদ্বিগ্ন হয়ে খুঁজার সাথে সাথে বিরক্ত হয়ে বিড় বিড় করে বলছে, টিকি টিকি।

বিড় বিড় করে বললেও, সুমি আর বুয়া দুটো জিনিশ পরিষ্কার বুঝল, টিঙ্কু রিমিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর বিরক্তির সুর গলার আওয়াজে বেশ স্পষ্ট হল। টিঙ্কু দেরী করে হলেও, বোনকে চিনতে পেরেছে। বোনের অভাব হয়ত তাকে কষ্ট দিচ্ছে। হয়ত বোনকে সে নাম দিয়েছে, টিকি।

কি আনন্দ, কি আনন্দ মায়ের মন একেবারে আনন্দে আত্মহারা। দেরীতে হলেও, টিঙ্কু কথা বলা আরম্ভ করছে। বোনটা বাসায় সময় মত ফিরে নি; তাই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর অকারণ টেনশন করতে হবে না।

মায়ের মন বলছে, টিঙ্কু আর পাঁচটা শিশুর মত ধীরে ধীরে বেড়ে উঠবে।

১০

কিন্তু মায়ের আনন্দ একেবারে ক্ষণস্থায়ী হল।

সুমির ছোট খালা খুলনায় থাকেন। স্কুলের প্রিন্সিপাল। ঢাকায় এসেছিলেন শিক্ষা মন্ত্রালয়ের এক সেমিনারে। সেই সুবাদে সুমির বাসায় ছিলেন সাত দিন। তিনি আবিস্কার করলেন, টিঙ্কু অন্য সব বাচ্চার মত আচরণ করছে না। বয়স চার হয়ে গেলেও, এখনও কথা বলছে না। দু চারটা যে শব্দ উচ্চারণ করে, তার তেমন কোন অর্থ হয় না। জিদ আর রাগ অন্য বাচ্চাদের থেকে বেশী। মনের মত কিছু না হলেই চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে এক জায়গায় জড় করছে। কিন্তু সব চেয়ে বেশী যে সমস্যার কথা, টিঙ্কু কারোর চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। মা- বাবা কারোর দিকেই না; এমনকি বড় বোন রিমির দিকেও না। আর যেই রিমি কিনা সারদিন ধরে ভাইয়ের সাথে বড় একটা সময় এক সাথে কাটাচ্ছে।

ছোট খালা সুমিকে ডেকে বললেন, তোর ছেলেকে মনে হয় ডাক্তার দেখানোর দরকার। ও ওর বয়সের বাচ্চাদের তুলনায় বেশ পেছনে। তার তো এর মধ্যে অনেক কিছু করার কথা। অন্যদের সাথে কথা বলা, খেলা আরও অনেক কিছু। কিন্তু টিঙ্কু কারোর সাথে তেমন ইন্টার একশ্যান করছে না। দোয়া করি, ফেরশতার মত বাচ্চার জন্য সব কিছু যেন ঠিক ঠাক থাকে।

খালা বলতে লাগলেন, ইদানীং অনেক বাচ্চাদের মধ্যে অটিজম দেখা যাচ্ছে। এদের মানসিক বিকাশ ঠিক মত হয় না। অন্যদের সাথে মেলামেশা, এমনকি কারোর সাথে কথা বলতে সমস্যা হয়। এ গুলো সাধারণত বাবা-মা কাছে দু বছর বয়স থেকে স্পষ্ট হতে থাকে।

সুমি অটিজমের কথা শুনলেও, বিষয়টা সম্পর্কে ভাল করে জানত না। মায়ের মন, মুহূর্তেই ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। কি, কি বললে খালা আমার টিঙ্কু পাগল। ও আমাদের সাথে কখনো কথা বলবে না।

খালা উত্তরে বললেন, আমি কি তাই বললাম? পাগল আর অটিজম এক জিনিষ না। সারা পৃথিবী জুড়ে এখন প্রচুর অটিস্টিক বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে। এখনো কারণ আবিষ্কার হয় নি। তবে অনেক রিসার্চ চলছে। চিকিৎসা বের হয়ে যাবে হয়ত খুব তাড়াতাড়ি। এদের জন্যে বিশেষ স্কুল আছে। উন্নত দেশগুলোতে অটিস্টিক বাচ্চারা বড় হয়ে অন্য সবার মত কর্ম জগতে ঢুকছে।

খালা দম নিয়ে বলতে লাগলেন, টিঙ্কুকে আগে ডাক্তার দেখুক, তার পরে দেখা যাক কি হয়। এমনো হতে পারে, সে হয়ত অন্য সবার মতই হবে। শিখতে একটু বেশী সময় নিচ্ছে, এই যা।

সুমি খালার বিছানার এক কোণায় পাথরের মত বসে রইলো। মুখ দিয়ে কিছু না বললেও, চোখ দুটো জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের দূর আকাশের দিকে স্থির হয়ে ছিল। এক জন মা এ রকম একটা খবর আর কি ভাবে নিতে পারে?

খালা বিষয়টা ধরতে পারলেন। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললেন, অটিস্টিকদের অনেকে বড় বড় জিনিয়াস হয়। তারা যেই কাজ পছন্দ করে, সেই কাজ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে করে। তাতে দেখা যায়, সেই কাজে তারাই সেরা। ভবিষ্যতে দেখা যাবে, অটিস্টিক মানুষরা নোবেল প্রাইজ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে জেকোব নামে এক অটিস্টিক কিশোরের আইকিউ আইনস্টাইনের থেকেও বেশী।

১১

সুমি বলি বলি করে কথাটা শ্যামলকে বলতে পারছিল না। এর মধ্যে এক এক করে সাত দিন পার হয়ে গেল। শ্যামল কথাটা শুনে কেমন প্রতিক্রিয়া করে বসে? যদি মন খারাপ করে ফেলে? কিছু দিন ধরে আবার তার কাজেও ঝামেলা চলছে। নতুন ম্যানেজারের সাথে মনোমালিন্য হচ্ছে না। অকারণে শ্যামলকে কথ শোনাচ্ছে, যন্ত্রণা করছে। এ জন্যে বাসায় আসার পরেও মন খারাপ করে বিরক্ত হয়ে থাকে।

শ্যামল ঠিক করে ফেলেছে, এই দেশে আর না। এত দুর্নীতি, অন্যায় নিয়ে মানুষ বাঁচে কি করে। দেশের সব কিছু নিয়ে বিরক্তি সহজেই তৈরি হয়। ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল ক্যানেডা, অস্ট্রেলিয়া দু দেশেই ইমিগ্রেশেনের জন্য এপ্লায় করল। যে দেশে আগে হয়, সেখানেই চলে যাবে। নতুন করে জীবন আরম্ভ করবে। খোলা আকাশে বুক ভরে পরিষ্কার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। ইদানীং দেশের বাতাস পর্যন্ত ভারী মনে হয়।

কিন্তু সুমির শ্যামলকে কথাটা না বললেই না। টিঙ্কুকে শিশু ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। ছেলেটা যদি আসলেও অটিস্টিক হয়ে থাকে, তখন সেই হিসেবে কাজ আরম্ভ করা দরকার। খালা বলে দিয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি অটিস্টিক বাচ্চাদের সমস্যা ধরা পড়ে তত ভাল। নিজের সন্তানকে তোর আর অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহ যদি তাকে অটিস্টিক বাচ্চা দিয়েই থাকেন, তা হলে মেনে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তা ছাড়া তার পক্ষে শ্যামলকে না জানিয়ে একা টিঙ্কুকে ডাক্তারের কাছে নেয়া সম্ভব না।

অনেক সাহস করে রাতে ঘুমানোর আগে সুমি কথাটা পাড়ল, বুঝলে ছোট খালা বলে গেছে আমাদের টিঙ্কু বড় হয়ে নোবেল প্রাইজ পাবে।

শ্যামল ভাবল ওর মন মরা দেখে সুমি হয়ত রসিকতা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুমির রসিকতায় সায় দিতে ইচ্ছে করল না। এমনিতেই বিরক্তি আর টেনশনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে।

সুমি বুঝল, তার কথা শ্যামল আমলে আনছে না। গলা ঝেড়ে কেশে নিয়ে বলল, জনাব একটু যদি এটেনশান দিতেন, তা হলে বাধিত হতাম। খুব সিরিয়াস বিষয়ে আলাপ ছিল।

এই বার শ্যামল সুমির দিকে ঘুরে তাকাল, বল কি বলবে। আমার আবার অন লাইনে যেয়ে ইমিগ্রেশান এপ্লিকেশনের স্ট্যাটাস চেক করতে হবে। কোন আপ ডেট না থাকলে, আজকে আর্জেন্ট দিয়ে ইমেল পাঠাব। আমার এই দেশে এক মুহূর্তের জন্যও ভাল লাগছে না। বদ লোকগুলো একটার পর একটা ঝামেলা তৈরি করে চলেছে।

সুমি হতাশ গলায় বলল, তা হলে থাক। তোমার যখন এত ঝামেলা, তা হলে আমার কথা না শুনলেও হবে।

শ্যামল বুঝল কিছু একটা বড় ধরণের কোন ব্যাপার হয়েছে। সাধারণত সুমি এই ভাবে কথা বলে না। সে সুমির হাত ধরে বলল, সরি তোমার সাথে এই ভাবে কথা বলাটা ঠিক হয় নি। ইদানীং মাথাটা মনে হয় ঠিক মত কাজ করছে না।

সুমির কথা বলতে আর মন চাইছিল না। তার পরেও ছোট ছেলেটার কথা ভেবে বলতে আরম্ভ করল, ছোট খালার ধারণা আমাদের টিঙ্কুর এক ধরণের ব্রেন ডিস অর্ডার আছে। দেখনা কারোর সাথে চোখে চোখ রাখে না, হাসে না। ইদানীং সারা পৃথিবী জুড়ে অটিজম নামে বাচ্চাদের ব্রেনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এই সব বাচ্চারা পাগল না; এরা অটিস্টিক।

১২

অনেক সময়ে মানুষ যা চায়, বাস্তবে তার উল্টোটাই হয়। সুমি, শ্যামল কায়মন বাক্যে সৃষ্টি কর্তার কাছে আর্জি করছিল, খালার আশংকা যাতে ভুল হয়। ডাক্তার যাতে বলে, এইটা কোন ব্যাপারই না। ওর সব ঠিক আছে। অন্য বাচ্চাদের থেকে পিছিয়ে আছে, সময়ে আর সমস্যা থাকবে না। কিন্তু না, ডাক্তার সাহেব নানা পরীক্ষা, নিরীক্ষা করে কেমন এক শীতল ভঙ্গিতে জানাল, সরি, আপনাদের সন্তান অটিস্টিক।

দু জনে আশা-নিরাশার দোলনায় দুললেও, ডাক্তার সাহেবের এই কঠিন রায়ের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। এর মধ্যে অবশ্য অটিজম সম্পর্কে কিছু ধারণা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পঞ্চাশ জন বাচ্চার মধ্যে ১ জন অটিস্টিক। বাংলাদেশে তেমন হিসেব না থাকেলেও, এর সংখ্যা নেহায়েত কম হবে না। অটিজম হওয়ার কারণ এখনও আবিষ্কার না হলেও, সমস্যাটা সমাজের প্রতি শ্রেণীর মধ্যেই আছে। অনেকের ধারণা বিশ্বব্যাপী ক্যামিকেলের বহুল ব্যবহার এর কারণ হতে পারে। বিজ্ঞান যে অভিশাপ হতে পারে তার একটা জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।

অটিস্টিক শিশুদের অন্যদের ভাল লাগা, খারাপ লাগা, মোট কথা আবেগ বুঝতে কষ্ট হয়। মানুষের সাথে কথা বলা, তাকানো, স্পর্শ অনুভব করা থেকে আরম্ভ করে সম্পর্ক তৈরি, অন্যের কাছে নিজেকে বুঝাতে খুব বেগ পেতে হয়। নতুন যে কোন মানুষ কিংবা পারিপার্শ্বিকতা তাদের গ্রহণ করতে কষ্ট হয়। বেশ কিছু ধরণের অটিজম চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে একটা হল এসপারগার সিন্ড্রোম (Asperger’s Syndrome) । অনেকে এবার একে হাই ফাঙ্কশানিং অটিজম (High-Functioning Autism- HFA) বলে থাকেন। এ ছাড়া কিছু অটিজমের কারণে বাচ্চারা দুরন্ত ও অস্থির (hyper) প্রকৃতির হয়।

ডাক্তার সাহেব রায় জানিয়ে দেয়ার পর একে একে অটিজম সম্পর্কে মেলা তথ্য দিয়ে চললেন। সুমি, শ্যামলের কান দিয়ে হয়ত কথাগুলো যাচ্ছিল; কিন্তু মাথায় যাচ্ছিল কি-না বলা মুস্কিল। তাদের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। শেষে ডাক্তার সাহেব জানতে চাইলেন, আপনাদের কি কোন প্রশ্ন আছে?

সুমি, শ্যামলের মন ইতিমধ্যেই অজানা আশংকায় ভুগা আরম্ভ করেছে। কি ভাবে এই বাচ্চাকে তারা বড় করবে। ছেলে বড় হয়েই বা কি করবে। মানুষ কথা না বলে বাঁচে কি করে? সে কি কখন বাব-মা বলে ডাকবে না? না ডাকলে না হয় ডাকুক। কিন্তু সন্তান ভাল থাকলেই হল। তার জন্যে যা যা করা দরকার, তাই তারা করবে। প্রয়োজনে গ্রামের জমি বিক্রি করে দিবে ছেলের চিকিৎসার জন্যে। কিন্তু কি ভাবছে এই সব। এ তো রোগ না। ডাক্তার বলেছে ডিস অর্ডার। ডিস অর্ডার যদি রোগ না হয়, তবে সেটা কি? এখন পর্যন্ত তার আবার কোন চিকিৎসা আবিষ্কার হয় নি। তা হলে এখন কি হবে আর কি করতে হবে? কেও যদি বলতে পারত!

শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সাহেব মুখ দেখে হয়ত ওদের ভিতরের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলেন। অনেকটা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে আবার বলা আরম্ভ করলেন, এক দিক দিয়ে ভাল যে আপনাদের বাচ্চার খুব সম্ভবত এসপারগার সিন্ড্রোম; তার মানে কোন একটা বিষয়ে সে ভীষণ ভাল হবে। সেটা অংক হতে পারে, কিংবা কোন খেলা। এই ধরুন, হয়ে গেল কোন এক বিখ্যাত ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলোয়াড়। পছন্দের জিনিস সে একেবারে ১১০% নিখুঁতভাবে করার জন্যে লেগে থাকবে। সেখানে কোন খুঁত থাকবে না। বলা তো যায় না, আপনার ছেলে দেশ জুড়ে একটা হৈ চৈ ফেলে দিতে পারে। হে হে হে !

১৩

সুমি, শ্যামল বাসায় ফেরার পথে কোন কথা বলল না। সুমির ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু শ্যামলের কথা চিন্তা করে নিজেকে সামলে নিল। এখন ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। অটিস্টিক হোক আর যাই হোক নিজের বাচ্চা তো। কত মানুষের কানা, খোঁড়া, বোবা বাচ্চা হয়। তারা কি বাচ্চাদের ফেলে দেয়। টিঙ্কু শুধু মানুষের ভালোবাসা বুঝবে না, নিজের ভালোবাসা অন্যকে বুঝাতে পারবে না। ইয়া আল্লাহ এইটা কেমন কথা? তার পরেও নিজের বাচ্চা। মা হয়ে নিজের ছেলেকে কম ভালোবেসে পারা যায়? সে ছেলে যাই হোক না কেন।

শ্যামল বুঝল স্বামী হিসেবে সে এক কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। তার একান্ত দায়িত্ব সুমিকে শক্তি যোগানো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। কি-ই বা বলবে? মাথায় কিছু খেলছে না। সুখ-দুঃখের সমান ভাগীদার হওয়ার শপথ নেয়াটাই না বিয়ের মুল মন্ত্র। এক জন অটিস্টিক বাচ্চাকে তারা কি ভাবে বড় করে তুলবে। সময়ের সাথে ছেলে এক দিন বড় হয়েই যাবে। তার পর কি হবে? বাবা মা কি কারো সারা জীবন থাকে?

দু জনের মনের ভিতর সমান তালে নীরব ঝড় বয়ে চলল। এক জন অন্য জনকে মুখ ফুটে না কিছু বলল, না জানতে চাইল কিছু। বাড়ির কাছা কাছি যখন গাড়ি চলে এসেছে, শ্যামল সুমির ডান হাতটা টেনে নিজের কাছে নিল। অনেকটা অভয় দেয়ার মত করে বলতে লাগল, এত মন খারাপ কর না। আমি তো আছি, তোমার পাশে। দু জনে মিলে আমরা টিঙ্কুকে মানুষ করব। এর মধ্যে যদি আমাদের বিদেশ যাওয়াটা হয়ে যায়, তা হলে অনেক সুবিধা হবে। শুনেছি বিদেশে অটিস্টিক বাচ্চাদের জন্যে অনেক ধরণের ব্যবস্থা। দেখ আমাদের টিঙ্কুকে নিয়ে কোন সমস্যা হবে না।

খরস্রোতা নদীর বাঁধ মনে হয়ে উঠিয়ে নেয়া হল। সুমি ডুকরে কেঁদে উঠল, কেন কেন আমার ছেলেকে অটিস্টিক হতে হবে? কেন আমি? কেন আমি??

শ্যামলের নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হতে লাগল। তা স্ত্রী তাকে ধরে কাঁদছে, আর তার কি না কিছু করার নাই। শুকনো গলায় বলল, নিয়তির উপরে কি আমাদের কোন হাত আছে?

শ্যামলও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। সুমিকে শক্ত করে জড়িয়ে নিজের অজান্তেই কাঁদতে শুরু করল। আমাদের সমাজের অঘোষিত নিয়ম, ছেলেদের কাঁদতে নাই। ছেলেরা কিছু ক্রান্তিকালে এই নিয়ম মেনে চলতে পারে না। শ্যামলের এ রকম একটা ক্রান্তি কাল এসে হাজির হল।

শ্যামল- সুমি কাঁদতে লাগল একই সাথে, অঝর ধারায়। তাদের শক্তি দরকার, অনেক শক্তি। কেঁদে ভিতরটাকে ধুয়ে যদি সেই শক্তিটাকে পাওয়া যায়।

বেচারা শরাফত ড্রাইভার ঘটনার কিছুই জানত না। শুধু জানত, সাহেব-বেগম সাহেব ডাক্তারের কাছ থেকে বাসায় ফিরছে। এতক্ষণ তারা চুপচাপই ছিল। এখন কি এমন হল, দু জনই শব্দ করে কাঁদছে। প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল, সাহেব কি আসলেও শব্দ করে কাঁদছে। কি এমন দুঃখ তাদের।

শরাফত গলা ঘুড়িয়ে জানতে চাইল, স্যার গাড়ি কি থামাবো?

১৪

দু জনে বাসায় যখন পৌঁছল, তখন দু জনে কান্না বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু সুমির চোখ ফোলাফোলা। দেখলে যে কেও বুঝে নিবে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন, টিঙ্কুকে আনার দরকার নাই। তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়ে গেছে। রিপোর্ট নিয়ে শুধু বাবা মার সাথে কথা বলবে। তাই ভাই বোনকে বুয়ার কাছে রেখে শ্যামল-সুমি বের হয়েছিল।

কান্না বন্ধ করে, শান্ত হয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। ধারণা ছিল ভাই বোন এর মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু দরজা খুলে ঢুকতে দেখল, টিঙ্কু এক বোতল পানি নিয়ে “টিকি টিকি টিক টিক” খেলছে। রিমি মহা উৎসাহে চোখ বড় বড় করে খেলা দেখছে। কাজের বুয়া এক কোণায় বসে বসে ঘুমাচ্ছে।

বাবা মা কে ঢুকতে দেখে, রিমি উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, দেখ দেখ টিঙ্কু “টিকি টিকি টিক টিক” খেলায় কি করতে পারে। প্রথমে এক, তার পরে দুই, এই ভাবে সাত পর্যন্ত বুদবুদ বানাতে পারে। কথাটা শেষ করেই, রিমি টিঙ্কুর হাতে আরেকটা বোতল ভর্তি পানি তুলে দিল। কি অদ্ভুত, টিঙ্কু পানি প্রথম বার যখন উল্টালো, তখন একটা বুদ বুদ তৈরি হল। তার পরের বার, দুই, তিন…সাত পর্যন্ত করে দেখাল।

সুমির ছেলেকে জড়িয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। না, নিজেকে সামলিয়ে নিল। ছোট শিশুকে কোন ভাবেই আঘাত দেয়া যাবে না। নতুন কোন ঘটনা অটিস্টিকদের জন্যে নেয়া ভীষণ কষ্টকর। টিঙ্কু মাকে কাঁদতে দেখেনি। তা ছাড়া শ্যামল সুমিকে বলেই এনেছিল, টিঙ্কুর সামনে কোন ভাবেই কাঁদা যাবে না।

ছোট ছেলে মেয়ে দু টোকে সুমি বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। এক বারে শরীরের সব শক্তি দিয়ে। টিঙ্কুর অবুঝ মন কান্না না চিনলে, মায়ের ভালবাসা আর সোহাগ ভাল করেই চিনে। হাতের বোতল রেখে, চোখ বন্ধ করে মায়ের স্পর্শ হয়ত উপলব্ধি করছিল। এর পরে সুমি পাগলের মত ছোট ছেলে মেয়ে দুটোকে চুমু খেতে খেতে, বলতে লাগল; এরা আমার বাচ্চা। এরা আমার কলিজা।

রিমি বুঝল না, বিষয়টা কি হতে। মা আদর করে ওদেরকে, কিন্তু এই ভাবে অস্থির হয়ে করে না। তার পরেও খুব ভাল লাগল। জবাবে মাকেও সে পাল্টা কয়েক বার চুমু খাবার চেষ্টা করল। অনেকটা নিজের অজান্তেই বলতে লাগল, মা, মা। আমরা তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না; মা মা।

টিঙ্কু আবেশে কোন এক স্বর্গীয় সুরে বলল, “টিকি টিকি টিক টিক” ।

দৃশ্যটা এখানেই শেষ হয়ে গেল হয়ত ভাল ছিল। শ্যামল এতক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে সবার কর্ম কাণ্ড দেখছিল। এই বার হয়ত তার দৃশ্যে প্রবেশ করার পালা। বেচারা নিজের দেয়া সাবধান বাণী নিজেই মানতে পারল না। টিঙ্কু আর রিমিকে জড়িয়ে সে কেঁদে উঠলো। বুয়ার ঘুম এর মধ্যে ভেঙ্গে গেছে। তার জানা ছিল বাড়ির সাহেব-বেগম সাহেব টিঙ্কুর ব্যাপারে জানতে ডাক্তারের কাছে গেছে। ধরেই নিল, নিশ্চয়ই কোন খারাপ খবর। না হলে সাহেব, পুরুষ মানুষ; সে কি আর এমনিতেই কাঁদবে। বুয়াও শব্দ করে কেঁদে উঠলো।

এই বার টিঙ্কু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কেমন একটা ভীত সম্ভ্রস্থ স্বরে বলল, "টিকি টিকি টিক টিক” ।

রিমি মায়ের থেকে টিঙ্কুর অটিজমের কথা শুনলো। মাকে অভয় দিয়ে বলল, মা বাবা আছে, তুমি আছো, আমি আছি —আমরা তিন জনে মিলে ওকে দেখে রাখব। তুমি কোন ভেবো না। সুমি কথাটা শুনে, মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই বড় লক্ষ্মী রে, মা।

রিমি বয়সে ছোট হলেও, নিজের মধ্যে এক শক্তির ফোয়ারা আবিষ্কার করলো। ছোট বালিকা দায়িত্ব পালন অঙ্গীকারে নারীত্বকে অনেক দ্রুতই আবিষ্কার করল।

১৫

শ্যামল প্রতিজ্ঞা করে ফেলল যেই করেই হোক বিদেশে চলে যেতে হবে। পরিচিত অনেকেই বলল, ক্যানেডা, অস্ট্রেলিয়ায় অটিজম শিশুদের জন্যে অনেক সুযোগ সুবিধা আছে। টিঙ্কুর জন্যে অনেক ভাল হবে। বাংলদেশে এখন অটিজমে ভুগছে এমন শিশুদের তেমন কিছু ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। সন্তানের ভাল’র জন্যে; বাবা হয়ে সে যে কোন কিছু করতেই প্রস্তুত।

ক্যানেডা যাওয়ার কাগজ পত্র আসতে আসতে পুরো দেড় বছর চলে গেল। পরিবারটার জন্য সময়টুকু ছিল একেবারে বিভীষিকাপূর্ণ। এক দিকে শ্যামলের চাকরিতে বিরক্তি আর দেশের থেকে মন উঠে যাওয়া, অন্য দিকে সংসারের জন্যে প্রয়োজন হয়ে উঠল বাড়তি খরচের। টিঙ্কুকে দেয়া হল অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুলে; সেটা হল আবার বনানীতে। সে জন্যে শুক্রাবাদের বাসা ছেড়ে মহাখালীতে বাসা ভাড়া নিতে হল। ভাড়া বেড়ে হল তিন গুণ। মতিঝিলে অফিসে ট্রাফিক জ্যাম ভেঙ্গে যেতে ডবল সময় লাগা আরম্ভ করল।

ওই দিকে আবার সুমি যেন কেমন বদলাতে লাগল। শ্যামলের সাথে আগের মত হাসি-মশকরা করে না। বাইরের জগতের ক্লান্তি-বিরক্তি বাসায় এসে আর মুছে যায় না। বরং চক্র বৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। মাঝে মাঝেই দু জনের মধ্যে লেগে যায়। এক দিন শ্যামল সুমিকে ভীষণ শক্ত একটা কথা শুনালো, আমি এক বাচ্চাতেই খুশী ছিলাম। তোমার জন্যেই আরেকটা বাচ্চা নেয়া। এখন বুঝো কি ভোগান্তি।

সুমি জানে, এইটা শ্যামলের মনের কথা না। তার পরেও খারাপ লাগে। ভীষণ খারাপ। বাচ্চা কি তার শুধু একার? সুমি সারা রাত জেগে কাঁদল। শ্যামলও সারা রাত জেগে কাঁটাল, সেটা বুঝতে সুমির কষ্ট হল না। শ্যামল এমন ছিল না। সামান্য মন খারাপ হলে কত কিছু না করত। এই তো মাত্র কয়েক দিন, টিঙ্কুকে নিয়ে প্রেগ্ন্যান্সির প্রথম দিকে; একেবারে অকারণে মন খারাপ হল। দুপুরে খেয়ে বিছানায় শুতেই চোখ দুটো লেগে এসেছিল।

বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। জানালা দিয়ে কিছু ক্ষণ বৃষ্টি দেখল। মন একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। আগে বৃষ্টি হলেই মনটার মধ্যে কেমন আনন্দ চলে আসত। এখন কি-না হল উল্টো। হয়ত প্রেগ্ন্যান্সিতে হরমোনের তারতম্যের কারণে একটা উল্টা-পাল্টা দশা হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে শ্যামল অফিস থেকে ফিরল। সুমির মুখ দেখে মুহূর্তেই বুঝে ফেলল প্রিয়তমার মন খারাপ। সুমিকে একটা আদর করে জানাল, অফিসে একটা জিনিষ ফেলে এসেছি, যাব আর আসব। এক ঘণ্টা পরে ফিরল, একশ একটা গোলাপ নিয়ে। তার পরে কি আর সুমির মন খারাপ থাকতে পারে!

ওদের ভোগান্তি পর্বের আরেক ঘটনা। শ্যামল ছুটির দিন শুক্রবারে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাবার জন্যে তৈরি হল। কিন্তু মানি ব্যাগ কোথাও খুঁজে পেল না। বালিশের নীচে, আলমারির ভিতরে, প্যান্টের পকেটে কোথাও না। ভাবল সুমি জানে। ওকে যেয়ে জিজ্ঞাসা করল। সুমি জানে না বলেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিষয়টা শ্যামলের সহ্য হল না। আগে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ে দরকারি সব কিছু সুমি এগিয়ে দিত। এখন ঘুরেও দেখে না, কখন বাসায় আসল, কখন গেল। এই সব ভাবতেই শ্যামলের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, আমার মানি ব্যাগটা খুঁজে দিলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। সারাক্ষণ টিঙ্কুকে নিয়ে লেগে থাকলেই কি হবে। বাসায় কি আর কেউ থাকে না?

সুমি বেড রুমে এসে ঢুকল। শ্যামলের কথার কোন জবাব দিল না। বিছানার পাশে মেঝেতে মানি ব্যাগ পড়েছিল। সম্ভবত হাত লেগে বালিশের তলা থেকে পড়ে গেছে। ওই দিকে টিঙ্কুর ঘরে রিমি ছিল। চিৎকার শোনা মাত্র টিঙ্কু আতঙ্কিত হয়ে মুখ থেকে কেমন একটা শব্দ করতে লাগল। রিমিও ছুটে আসল বাব-মায়ের রুমে।

রিমি ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে, বাবা মায়ের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। কারণটা তার জানা। বাবা-মা’র উদ্দেশ্যে গলা নীচু গলায় গম্ভীর হয়ে বলল, টিঙ্কুকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে না। আমি তোমাদের বলেছি না, আমি টিঙ্কুকে দেখব। তোমরা এই সব ঝগড়া-ঝাটি বন্ধ কর। টিঙ্কু ভয় পায়।

বিধাতার কি খেলা…জীবনের রং মঞ্চে কন্যা, জননীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হল।

১৬

বার বছর বেশ বড় একটা সময়। শ্যামল- সুমি আর তাদের সন্তানরা ক্যানেডায় আবাস গেড়েছিল। এত দিনেও নিজেদের শীতের দেশে মানিয়ে নিতে পারে নি। শ্যামল দেশ থেকে বুয়েট পাশ ইঞ্জিনিয়ার। ভাবনা মোতাবেক যোগ্য কোন কাজ জোগাড় করতে পারল না। ওই দেশে অনেক বাঙালির মত দোকান, রেস্টুরেন্টে কাজ করতে হল। পরিচিত কিছু মানুষ বুদ্ধি দিয়েছিল ক্যাশ টাকায় ট্যাক্সি চালাতে। আর তার সাথে সাথে সরকারি ভাতা। চার জনের সংসার ভালই চলে যাবার কথা।

সরকারি ভাতা নিতে মন চাইত না। তার পরেও বেশ কয়েক বার নিতে হয়েছে। আত্মগ্লানিতে ভুগতো। সুস্থ, সবল মানুষ কি অন্য মানুষ মানে সরকারের দয়া নিয়ে চলতে পারে। দয়া, ভাতা হল সুন্দর কিছু শব্দ। আসলে এইটা ভিক্ষা। আর কত দেশী মানুষ দিনের পর দিন ভাতা নিয়ে চলেছে। আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিতে তাদের সমস্যা হচ্ছে না।

শ্যামলের বিদেশি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা ছিল আরেক কারণে। সেখানে অটিস্টিক শিশুদের পূর্ণ দায়িত্ব সরকার নেয়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও শিক্ষা তো আছেই। টিঙ্কুর ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটা খুব উপকারী হল। দেশের থেকে যখন আসে, তখন শব্দ ভাণ্ডারে ছিল মাত্র চারটা শব্দ, “টিকি, টিকি, টিক, টিক”। দিনে দিনে অভিধান বাড়তে লাগল। অন্য সব বাচ্চাদের মত পড়া লেখা আরম্ভ করল। সাথে সাথে প্রাত্যহিক সব কাজ কর্ম একে একে শিখতে লাগলো। স্কুলের টিচারদের সাথে সাথে পুরো পরিবার, বিশেষ করে রিমিকে, এই জন্য কৃতিত্ব দিতে হয়।

স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে, রিমিকে একেবারে লেগে থাকত টিঙ্কুর সাথে। স্কুলের টিচার বলেছে, মায়ের হেল্প জরুরী, কিন্তু তার থেকে বেশী উপকারী হয় যদি কোন ভাই-বোন বাসায় সাহায্য করে। এমনিতেই রিমি নিজেকে যতটুকু না টিঙ্কুর বড় বোন, তার থেকে কাজে কর্মে সে পুরো এক জন অভিভাবক হিসেবে প্রমাণ করলো। প্রথমে সুমির মনে হত টিঙ্কুর কারণে রিমির সহজাতভাবে বেড়ে উঠা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কিন্তু না, রিমি দেখিয়ে দিল নিজের কাজ করার পাশাপাশি সে ভাল ভাবেই অটিস্টিক ছোট ভাইয়ের যত্ন নিতে পারে। পড়া লেখায় রিমি ক্লাসের একে বারে উপরের দিকে জায়গা করে নিল। আর টিঙ্কুরও অনেক অগ্রগতি হল। এমনকি পাড়ার সম বয়সীদের সাথে খেলা আরম্ভ করল। কিন্তু প্রতিটা খেলার আগে রিমিকে দেখিয়ে দিতে হত, খেলায় টিঙ্কুকে কি করতে হবে।

বাড়ির কাছে এক মাঠে, বাবা-মা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছে, সে রকম বালকেরা ক্রিকেট খেলতো। ক্যানেডায় ক্রিকেট খেলা তেমন একটা প্রচলন নাই। বলতে গেলে বাবাদের উৎসাহেই ছেলেদের ক্রিকেট খেলা। রিমি এক দিন বাসায় ফেরার পথে পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখল। পরের দিন টিঙ্কুকে নিয়ে আসল খেলার মাঠে। টিঙ্কু খেলা দেখে তেমন কোন এক্সপ্রেশান করল না। অবশ্য তার করার কথাও না। তার মস্তিষ্ক অন্য পাঁচ জনের মত তথ্য বিশ্লেষণ করে না।

রিমি বাবাকে বলে বল, ব্যাট, ইউকেট জোগাড় করলো। ইউ টিউব আর ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে খেলাটা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করল। তার পরে বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডের মাঠে আরম্ভ হল টিঙ্কুকে ক্রিকেট খেলা শেখানো। বোলিং করা চালু হল। রিমি নিজে ধরল ব্যাট। শুধু খেলা চালু হওয়ার আগে রিমি ওর কানে কানে বলত, টিকি টিকি টিক টিক।

চলতে থাকল টিঙ্কুর বোলিং অনুশীলন। একেবারে পাকা ক্রিকেটারদের মত হাত ঘুড়িয়ে বল করে। শ্যামল ছেলের বল করার উৎসাহ দেখে আরও কিছু বল কিনে দিল। আর সাথে বল আটকানোর জন্যে নেট লাগিয়ে দিল। কোন কারণে রিমি আসতে না পারলে, টিকি টিকি টিক টিক শব্দগুলো উচ্চারণ করে টিঙ্কু একাই বল করতে থাকত। কেমন বল ছুড়বে তার উপর নির্ভর করত কি সুরে সে শব্দ চারটা উচ্চারণ করবে। অফ স্পিন, লেগ স্পিন, পেস থেকে আরম্ভ করে কাটার, স্লেয়ার সহ সব ধরণের বল ছোড়া রপ্ত করে ফেললো।

টিঙ্কু এক নাগাড়ে প্রায় ছয় মাস বল করার অনুশীলন করল। শুধু অনুশীলন বললে ভুল হবে। নেট থেকে বল কুড়িয়ে আবার আরম্ভ করতো বোলিং করা। মাঝে মাঝে রিমিকে ডেকে নিয়ে আসতো, বল ঠিক ভাবে করছে কি-না তার মতামত নেয়ার জন্যে। রিমিও কঠিন ক্রিকেট কোচের মত ভুলটা দেখিয়ে দিত। তার পরে টিঙ্কু আবার ভুল সংশোধন করে বোলিং করা আরম্ভ করতো। যতক্ষণ একেবারে ঠিক ভাবে বল করতে পারছে, ততক্ষণ যেন টিঙ্কুর যেন ক্লান্তি নাই।

পাড়ার মাঠে টিঙ্কুকে ক্রিকেট খেলতে রিমি নিয়ে গেল। খেলায় নামার আগে রিমি টিঙ্কুর কানে কানে বলল, টিকি টিকি টিক টিক। টিঙ্কুও উত্তরে একই কথা বলল। তার পরে আরম্ভ করা হল, টিঙ্কুর বিধ্বংসী বল করা। মনে হতে লাগল চুনোপুঁটিরা সব ব্যাট করছে। ওর বলের সামনে কেও দাঁড়াতে পারল না। ওভারের ছয়টা বল ছয় ভাবে ছুড়ত। ব্যাটসম্যান বুঝতেই পারতো না, কোন দিকে ব্যাট চালাতে হবে।

টিঙ্কুর খেলা নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল। বড়দের টিমগুলো থেকে ডাক আসা আরম্ভ করল। সেখানেও তার জয়জয়াকার। কিন্তু টিঙ্কুর খেলার একটাই শর্ত। বোনকে খেলার পুরোটা সময় থাকতে হবে। বোন টিঙ্কুর কানে কানে বলে, টিকি টিকি টিক টিক। তার পরে আরম্ভ হয় খেলা । টিঙ্কু প্রতি বার বল ছোড়ার আগে, কি যেন বিড়বিড় করতে থাকে। রিমি ঠিকই জানে তখন সে কি বলছে।

এর মধ্যে শ্যামলকে কিছু মানুষ এসে বলে গেল, তোমরা বাংলাদেশে ফেরত চলে যাও। এই ছেলের ভবিষ্যৎ আমরা স্পষ্ট ক্রিকেটের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। শ্যামল নিজেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সুমিকে জানাল, চল দেশে ফিরে যাই। আমার এখানে ভাল লাগছে না। টিঙ্কু এখন এগিয়ে গেছে। তা ছাড়া সবাই বলছে, দেশে গেল টিঙ্কু ন্যাশনাল টিমে চান্স পেয়ে যেতে পারে।

টিঙ্কুর বয়স যখন ষোল; শ্যামল-সুমির সুখী পরিবার দেশে ফিরে আসল। অবশ্য ছোট বেলার বন্ধু ইমরানের কিছু পীড়াপীড়িও ছিল। সে এখন দেশে বিশাল ব্যবসায়ী। তার কোম্পানিতে হাজার বিশেক মানুষ কাজ করে। গার্মেন্টস, ব্যাঙ্ক, ওষুধ, ইলেক্ট্রনিক্স থেকে আরম্ভ করে নানা ধরণের ব্যবসা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার সামগ্রী রপ্তানি হচ্ছে। সে বলল, দেশে চলে আয়। আমার সাথে কাজ করবি। সম্মান নিয়ে থাকতে পারবি। তোর মত ব্রাইট মানুষের বিদেশে পড়ে ঘোড়ার ঘাস কাটার কোন মানে হয় না।

আঠারো বছর বয়সে টিঙ্কু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে খেলতে নামল। সাথে সাথে বলা যায়, রিমিও তার দায়িত্ব চালাতে লাগল। ছোট ভাইয়ের কানে "টিকি টিকি টিক টিক” বলে মাঠে খেলতে পাঠাত। কোচরা জানত বিষয়টা। টিঙ্কুকে কিছু বলতে কিংবা বুঝাতে হলে, তারা আগে রিমি জানাত।

১৭

আরও তিন বছর পরের কথা।

রিমি হাতে আজকের দৈনিক পত্রিকা নিয়ে চোখ বুলাচ্ছে। প্রথম পাতায় এক জায়গায় এসে চোখ দুটো থেমে গেল। পত্রিকায় টিঙ্কু বল করছে এমন একটা ছবি। সাথে খবর 'আন্তর্জাতিক ক্রিকেট র্যঙ্কিঙ্গে জাহিদ হোসেন টিঙ্কু পৃথিবীর শীর্ষে’। খবরটা পড়তে পড়তে রিমি কাঁদতে শুরু করল।

শ্যামল দৌড়ে ছুটে এল, মেয়ের কান্নার কারণ জানার জন্যে।

শ্যামল রিমিকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে মা, কি হয়েছে?

রিমি বাবাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে টিঙ্কুর ছবি দেখিয়ে বলল, টিকি টিকি টিক টিক।

মে ২৪, ২০১৪

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com