এক লাফে গাছে উঠা

গানের সুর একদিকে। বাজনা বাজছে আরেক তালে। এ রকম ঘটনা এখন অহরহই চোখে পড়ে। টিভি রিমোট দিয়ে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল গুলোতে উঠা নামা করলেই এর একেবারেই চাক্ষুষ ও শ্রবণের অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবে মিলে যাবে। এ রকম পরিস্থিতিতে সঙ্গীত সমঝদাররা হয়তো ঢোক গিলে বিরক্ত হয়ে চ্যানেল বদলিয়ে ফেলেন কিংবা গান শোনার শখটাকে গলা টিপে হত্যা করেন। শুধু সঙ্গীত শিল্পী কেনো; একুশের বই মেলাকে কেন্দ্র করে নিত্য নতুন গজিয়ে উঠা কবিরাও এর ব্যতিক্রম না। ছন্দ নাই, ভাব নাই, শব্দের প্রবাহ বারে বারে হোঁচট খায়; তার পরেও তারা একুশ কিংবা ফেসবুক কেন্দ্রিক কবি। ধরাধরি, অর্থনৈতিক ক্ষমতা কিংবা প্রযুক্তির সহজ লভ্যতার কাছে পরাজিত হচ্ছে মান নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতা।

বেশ পুরনো একটা গল্প বলি। ক্যানাডার আইবিএম একবার এক জাপানী কোম্পানি থেকে কিছু পার্টস অর্ডার করলো। আইবিএম প্রথমেই সাবধান করে দিলো যে পার্টসের মান কঠিন-ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; আইবিএম মাত্র ১.৫% পর্যন্ত নষ্ট যন্ত্রপাতি গ্রহণ করবে। চালান যখন ক্যানাডা পৌঁছল, দেখা গেল আলাদা কয়েকটা প্লাস্টিক ব্যাগে কিছু যন্ত্রপাতি। সাথে চিঠিতে লেখা, “আমরা ঠিক বুঝলাম না, তোমরা ১.৫% নষ্ট যন্ত্রপাতি দিয়ে কি করবে। কিন্তু তোমাদের সুবিধার জন্যে এগুলোকে আলাদা করে দেয়া হলো।” তার মানে জাপানীরা ইচ্ছা করে অর্ডার মাফিক নষ্ট যন্ত্রপাতি বানিয়েছে। যন্ত্রপাতি শতভাগ মান সম্মত হলেই, তার সেগুলো কাস্টমারকে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হয় মান নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একেবারে অন্য রকম দর্শন অনুসরণ করা হয়। কোনো রকমে কাস্টমারের টাকা হাতাতে পারলেই হলো। সে ভবিষ্যতে ব্যবসা করবে কি-না, সেইটা পরের কথা। বিদেশীরা কাস্টমাররা তাই চিংড়ির মধ্যে পায় পেরেক। দেশি কাস্টমাররা পায় পচন বিহীন অমর মৎস্য মানে ফরমালিন দেয়া মাছ, পানি মেশানো দুধ ও ভেজাল ওষুধ।

বাংলা ভাষায় বেশ প্রচলিত কথা, “ঠগ বাঁচতে গা উজাড়।” গ্রামে ভালো, সৎ মানুষ পাওয়া কি আসলেও এতো কঠিন? এইবার একটা ভাব সম্প্রসারণ বলি, “পশু জন্ম নিয়েই পশু, মানুষ প্রাণ পণ চেষ্টায় মানুষ।” আর মানুষের পরিচয় কিসে? উত্তরটা হলো কর্মে, “বৃক্ষ তোমার নাম কি”......ফলেই আমার পরিচয়।” আমরা কী পরিমাণ নিবেদিত প্রাণ, তার প্রমাণ মেলে আমাদের কর্ম কতটুকু মান সম্পন্ন। প্রতিযোগিতার বিশ্বে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে না পারলে কিন্তু একেবারে ছিটকে পড়তে হবে। পরীক্ষায় নকল, চাকরি পেতে ঘুষ, কাজে ফাঁকি, কাস্টমার ঠকিয়ে, ধরাধরি করে কিংবা পয়সার জোরে কোনো ভাবেই মান সম্মত কিছু পাওয়া সম্ভব না। এর জন্য কোনো সহজ রাস্তা কিংবা শর্ট কাট নাই। এক লাফে গাছে উঠার যাদুও কারোরই জানা নাই। একমাত্র সততা, অধ্যবসায়, শ্রম, এবং সাধনা থাকলেই সর্বোচ্চ মান পাওয়া সম্ভব। হউক না সেটা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন কিংবা সৃজনশীল শিল্পের কোনো পরিবেশনা।

জুলাই ৩১, ২০১৭
কাজী হাসান
প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com