তৈলাক্ত বাঁশের কহন

একটা বানর বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে।

বাহার ছবিটা আকার চেষ্টা করছে। প্রথমে ভেবেছিল কাজটা একেবারে মামুলি। এখন দেখছে ব্যাপারটা তেমন সহজ না। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হয়ে গেছে সে কাজটা করার চেষ্টা করে চলেছে। অনুপাতটা ঠিক মেলাতে পারছে না। বানর উপরে উঠছে। তার মানে বানরের তুলনায় বাঁশটাকে মেলা লম্বা হতে হবে। বাঁশটা আঁকা সহজ হলেও, বানর আঁকাটা কিন্তু তেমন সহজ না। তার পরেও বানরের ছবিটা আঁকলো। এইতো অনেকটা মানুষের মতো, কিন্তু শরীর ভর্তি লোম। মুখটা গোল, তবে লেজ আছে। ছবির বানরটা দেখে খুব আনন্দ হলো। একেবারে পারফেক্ট বলা চলে। বাস্তব বানর থেকে বেশি পার্থক্য নাই। নিজেকে বেশ কয়েকবার বাহবা দিলো। মনে হচ্ছে ছবির বানরের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু সেই জো নাই।

আজকে শনিবার রাত। কাল রোববার সকাল নয়টায় অফিসে জরুরি মিটিং আছে। বিদেশি পার্টি আসবে। জাপানী দু জন ডেলিগেট এমডি সাহেব নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসবেন। তারা জয়েন্ট ভেঞ্চারে ইনভেষ্ট করবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড। ঠিক কোন খাতে বিনিয়োগ করবে সেটা তারা এখনো নিশ্চিত না। মিটিঙে সম্ভাব্য খাতগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এমডি সাহেব মোট ছয়টা প্রজেক্টের প্রপোজাল তৈরি করেছেন। পার্সোনাল ম্যানেজার হিসেবে বাহারকেও সেখানে থাকতে হবে। তাকে কোন প্রজেক্টে কি পরিমাণ মানুষ বা ম্যান পাওয়ার লাগতে পারে এবং কত খরচ পত্র হতে পারে; জাতীয় প্রশ্ন আসলে উত্তর দিতে হবে। এর মধ্যে এমডি সাহেব দু বার ফোন করে ফেলেছেন। সকাল দশটায় একবার। আবার বিকালের পাঁচটায় আরেকবার। দু বারই মনে করে দিয়েছেন কালকের মিটিঙের গুরুত্বের কথা। শেষে অনেকটা সাবধান বাণী উচ্চারণ করার মতো করে বলেছেন, “বাহার সাহেব রেডি থাকা চাই একবারে হানড্রেড পার্সেণ্ট। কালো স্যুট পরবেন। মুখটা সবসময়ে হাসিহাসি রাখবেন। বুঝলেন তো, একেবারে তিরিশ মিলিওন ডলারের কারবার।”

বাহারের আগের থেকেই জানা ছিল বিষয়টা কতো গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে এমডি সাহেব এই মিটিঙের প্রস্তুতি নিয়ে গেলো সপ্তাহে তিনবার মিটিং করে ফেলেছেন। বাহার সেই মোতাবেক যা যা প্রশ্ন আসতে পারে, তার সব উত্তর মোটামুটি মুখস্থ করে রেখেছে। তারপরেও ইচ্ছা আছে লেপটপ খুলে আরেকবার চোখ বুলিয়ে, জরুরি পয়েন্টগুলো একটা নোট প্যাডে লিখে নেবার। তা ছাড়া রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে বিছানায় যাওয়ার প্ল্যান। পরের দিন সকাল সকাল উঠতে হবে। অফিসে সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছে যাবে। ইদানীং ঢাকা শহরের ট্রাফিকের কোন ভরসা নাই। প্রায় দিনই সকাল হতে হতে না হতেই জ্যাম লেগে যায়। এমডি সাহেব আগেই সাবধান বাণী দিয়ে রেখেছেন, “খবরদার কেউ জ্যামের অজুহাত দেখাবেন না।” পুরো বোর্ড অফ ডিরেক্টরস যেখানে উপস্থিত থাকবে, সেই মিটিঙে কোন উনিশ- বিশ হলে চাকরি হারানোর যে সমূহ সম্ভাবনা, সেটা বুঝতে কারোর বাকী নাই।

বাহারের এক সময়ে মোটামুটি ছবি আঁকার হাত ছিল। ছোট বেলায় অনেকে বুদ্ধি দিতো, সে আর্ট লাইনে গেলে মেলা নাম কামাতে পারবে। স্কুলে পড়ার সময়ে কিছু পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছিল। সেটা সেই ক্লাস সিক্স-সেভেনের দিককার কথা। তার পরে এই লাইনে বেশি দূর এগুনো হয় নি। স্কুলে উপরের ক্লাসে আর্ট ক্লাস ছিল না। অন্য বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ততা বাড়তে থাকলো। হোম ওয়ার্ক, কোচিং করার পর ছবি আঁকার সময় আর অবশিষ্ট থাকতো না। কমতে কমতে শখের কাজটা বন্ধ হয়ে গেল। তার পরেও বায়োলজি ক্লাসের জন্যে টুকটাক আঁকা ঝোঁকা করতে হয়েছে। অবশ্য মাঝে মাঝে যে পেনসিল, রঙ তুলি নিয়ে বসতে ইচ্ছা হয় নি, তা কিন্তু না।

বাহারের মেয়ে টুম্পা মনে হয় গুণটা বাবার থেকে পেয়েছে। কলেজে পড়ছে, কিন্তু এখনো ছবি এঁকে চলেছে। টুম্পার মা ঝুমা মাঝে মাঝে অভিযোগ করে, মেয়ে ছবি নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করছে। কয়েকদিন পরে ইন্টার পরীক্ষা। এই সব নিয়ে মেতে থাকলে শেষে একেবারে ফেল করে বসবে। ঝুমার জানা ছিল বাহারও একসময় এই কাজ করতে পছন্দ করতো। তাই স্বামীকে এই ব্যাপারে তিরস্কার করতে হয়তো বাড়তি আনন্দ। কিন্তু স্ত্রীকে না বললেও বাহারের একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। নিজে যেটা করতে পারে নি, সেটা প্রিয় কন্যা করে যেতে পারলে ভালই হয়। তা ছাড়া মেয়েটা তো পড়ালেখায় ভালই করছে। ম্যাট্রিকে জিপিএ ফাইভ গোল্ডেন প্লাস ছিল। ইন্টারে মেয়েটা যে ভালো রেজাল্ট করবে তা নিয়ে বাহারের একেবারে নিশ্চিত। তবে ক্লাসের গত দুটো পরীক্ষায় ইলেকটিভ ম্যাথে তেমন ভালো করে নি। তাতেই ঝুমার কন্যাকে নিয়ে অভিযোগের মাত্রা বেড়ে গেছে।

বাবা হিসেবে মেয়ের উপর বাহারের আস্থার কোন কমতি নাই। টুম্পা ঠিকই সময়মতো ফাইনাল পরীক্ষার জন্য রেডি হয়ে নিবে এবং আগের মতই ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু ঝুমা বাহারের যুক্তি মানতে রাজি না। ভালো কিছু করতে হলে তো সময় দিতে হয়। টুম্পার সেই সময়টাই বা কোথায়? বাসায় থাকলে কানে হেড ফোন দিয়ে থাকে, না হয় ফেসবুক কিংবা মোবাইল ফোন টিপাটিপিতে ব্যস্ত। অবশ্য কালে ভদ্রে ছবি আঁকতে বসে। মা বই নিয়ে পড়ার তাগিদ দিলে হৈ হৈ করে উঠে, “যাও, যাও তোমাকে আমার পড়ালেখা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি জানি আমাকে কি করতে হবে।” সেই জন্যই ঝুমা স্বামীর সাথে লেগে আছে, যাতে মেয়েকে বলে পড়ালেখার দিকে মনোযোগী হতে। বাহার আবার কোনভাবেই মেয়েকে সরাসরি কিছু বলতে চায় না; কটু কথার প্রশ্নই উঠে না। শেষে না আদরের কন্যার মধ্যে ধারণা হয়, বাবার তার উপর থেকে আস্থা হারানো আরম্ভ করেছে।

যাই হোক, বাহার শনিবার সকাল থেকেই প্ল্যান মোতাবেক কাজ করে চললো। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে ঝুমার মাথা গরম হয়ে যায়। সে কিছু বললে একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় সেটা মেনে নিবে। সকাল সকাল উঠে বাজার করে এনেছে। ঝুমা বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলো, রান্না ঘরে কল থেকে পানি টিপ টিপ করে লিক করছে। সারা সপ্তাহ ধরে তো বলেই, ছুটির দিন আসলে আবার বেশি করে বলে। বাহার সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারছিল না। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সেই রাত সাড়ে আটটা। ছুটির দিনে কেমন একটা অলসতা পেয়ে বসে। কিন্তু মাথার মধ্যে ঠিকই খেলছিল, ঝুমার যে কোন মুহূর্তে এই নিয়ে মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে, “তোমার কান দিয়ে কি কথাটা যাচ্ছে না, রান্না ঘরের কল থেকে সারাদিন-রাত পানি পড়েই চলেছে।” ঝুমা খেপলে একেবারে সাক্ষাত বিপদ। বাহার কোন সময় কী কী কাজ করে নি, তার মুহূর্তেই সব এক এক করে বলতে থাকবে। বাহারের তখন মনে হতে থাকে, ঝুমু যে রকম করে তিরস্কার করছে যেন তার থেকে অধম পুরুষ সমগ্র পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নাই।

আজকে বাহার কোনো রকম ঝুঁকি নিবে না। কোন ভাবেই যাতে ঝুমা খেপে না উঠে। আসলে খেপা-খেপি সংক্রামক ধরণের। এক জন আরম্ভ করলে ছড়াতে থাকে। ঝুমা যদি আরম্ভ করে আর বাহার উত্তর দেয়, ত হলেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশংকা। সে রকম হলেই মহা বিপদ। বাহার তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে পারবে না। ঘুম আসলে দুঃস্বপ্ন আসার সমূহ সম্ভাবনা। যেই সময়ে ঝগড়া হউক না কেনো, বাহারের রাতের ঘুমটা মাটি হয়ে যায়। এ পাশ, ও পাশ করতে করতে চোখটা লেগে আসলেই আরম্ভ হয় দুঃস্বপ্ন। ঝুমা তেড়ে আসছে, বাইশ তালা বিল্ডিং থেকে পড়ে যাচ্ছে-- জাতীয় স্বপ্ন। তার রেশ পরের দিন অফিস পর্যন্ত গড়ায়। মন দিয়ে কাজ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। অলসতা পেয়ে বসে। কিছুক্ষণ পর পর হাই উঠে। এ রকম পরিস্থিতি কোনভাবেই হতে দেয়া যাবে না। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, কালকের মিটিঙের প্রস্তুতি নিয়েই সরাসরি বিছানা। একেবারে ঝরঝরে শরীর ও মন নিয়ে কালকের দিনটা আরম্ভ করবে।

পানির মিস্ত্রির সাথে কথা বলাই ছিল। সে শনিবার সকালে এসে হাজির। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে রান্না ঘরের কল বদলানো হয়ে গেল। মিস্ত্রি যাওয়া মাত্রই বিজয়ী ভঙ্গিতে সু-খবরটা জায়গা মতো পৌঁছে দিল। মতলব একটাই, বাসাটা যেন একেবারে সারাদিন শান্তিপূর্ণ থাকে। কোনো ভাবেই বাহার আজকে মাথা গরম করবে না, বাড়তি টেনশন নিবে না। হাল্কা মাথা নিয়ে রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে বিছানায় চলে যাবে। সকাল সকাল উঠে, বসের জরুরি মিটিঙে যাবার প্রস্তুতি আরম্ভ করবে।

সন্ধ্যার ঠিক পর পরই ঝুমা খবর দিয়ে গেলো, “কালকে টুম্পার ইলেকটিভ ম্যাথ পরীক্ষা। সে সারাদিন বই নিয়ে বসে নি। দুপুর পর্যন্ত ছিল ফোন আর কম্পিউটারে। গত দু ঘণ্টা ধরে ছবি আঁকছে।” স্ত্রীর এ রকম খবর শোনানোর অর্থ হলো, তাকে এখন সরে-জমিনে যেয়ে মেয়েকে ছবি আঁকার থেকে তুলে কালকের পরীক্ষার পড়ার জন্যে পড়াতে বসাতে হবে। কাজটা না করলে, ঝুমা শান্ত পরিবেশটাকে অন্যদিকে নিশ্চিতভাবে টার্ন করাবে। বাহারের আজকের দিনটায় একেবারেই প্ল্যানের বাইরে কিছু করার ইচ্ছা নাই। তার পরেও উঠলো। পায়ে স্যান্ডেলটা দিয়ে মেয়ের রুমের দিকে রওয়ানা দিলো। যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি।

ঝুমার কথাই ঠিক। টুম্পা দেয়ালে বালিশ লাগিয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে। পা দুটো শরীরের দিকে গুটানো। পায়ের উপরের অংশে তার ড্রয়িং খাতা। হাতে পেনসিল। মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলেছে। বাহার যে কামরায় ঢুকেছে, সেটা বুঝতেই পারে নি। না হলে মুখ তুলে তাকাতো। মেঝেতে কয়েকটা দুমড়ানো কাগজ পড়ে আছে। পছন্দসই কিছু না হলে, টুম্পা খাতা থেকে পাতাটা ছিঁড়ে ফেলে এবং রাগ করে ছুড়ে ফেলে দেয়। মেঝেতে দুমড়ানো কাগজের সংখ্যা কমপক্ষে দশ। তার মানে টুম্পার মেজাজ এখন তুমুল খারাপ। বাহার একমাত্র কন্যার আচরণের সাথে বেশ পরিচিত। আগে এ রকম ঘটনা বেশ অনেকবার হয়েছে কি -না!

বাহার ভাবতে চাচ্ছিলো মেয়ে হয়তো ইলেকটিভ ম্যাথের কোন প্রব্লেম সল্ভ করার চেষ্টা করে চলেছে। উত্তর ঠিক না হওয়াতে বিরক্ত হয়ে এক এক করে পাতাগুলো ছিঁড়েছে। না, বাহারকে মুহূর্তেই ভাবনাটাকে সংশোধন করতে হলো। বুঝলো সমস্যাটা ম্যাথ না, ছবি আঁকা নিয়ে হচ্ছে। বাহার টুম্পার কাছাকাছি এসে উঁকি দিয়ে চট করে দেখে নিলো, আসলে সে কি করছে। সাথে সাথেই ভুল ভাঙলো । আদরের রাজকুমারী কাগজে পেন্সিল দিয়ে কিছু আঁকার চেষ্টা চলছে। বাহার খুব নিচু স্বরে ডাকলো, “মা মণি কি করছো? তোমার না কালকে ইলেকটিভ ম্যাথ পরীক্ষা?”

টুম্পা মাথা উঁচু করে বাবার দিকে তাকিয়ে কথা বলা আরম্ভ করলো। বাহার মেয়ের স্বরের মধ্যে পূর্ণ বিরক্তির রেশ পেলো। টুম্পা অভিযোগ করার ঢঙে বলা আরম্ভ করলো, “দেখো না বাবা, সেই কখন থেকে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনভাবেই হচ্ছে না।”

বাহারের পিতৃ মন কথাটা শোনা মাত্রই একেবারে উতলা হয়ে উঠলো। সে নিজে এক সময়ে কতো ভালো ছবি আঁকতো। আর তার মেয়ে কিনা একটা ছবি আঁকতে না পারার জন্যে এতো মনকষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাবা হয়ে এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না, “মা, আমাকে দেখা কি আঁকতে হবে। আমি হেল্প করছি।”

বাবা মন এর মধ্যে ঠিক করে ফেলেছে, সে মেয়ের ছবিটা এঁকে দিবে। তাতে মেয়ে কালকে পরীক্ষার পড়ার দিকে মন দিতে পারবে। এতে লাঠিও ভাঙবে না, আবার সাপও মরবে। ঝুমার গোমরা মুখ দেখতে হবে না। টুম্পাকে পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর সে নিজে চট করে ছবিটা এঁকে নিজের কাজে মন দিতে পারবে। তা ছাড়া তাড়াতাড়ি বিছানায়ও চলে যেতে হবে। নিজের পরিকল্পনায় আত্মপ্রসাদ চলে এলো। একেবারে গুলি খরচ না করে যুদ্ধে জয় লাভ!

টুম্পা আবার বলা আরম্ভ করলো, “আমার মনে হয়, তুমিও এটা আঁকতে পারবে না। এখন পুরো তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, আমি চেষ্টা করেই যাচ্ছি।” বাহার কোন উত্তর না দিয়ে টুম্পার ড্রয়িঙের খাতাটা এক টানে নিয়ে নিলো। খাতায় পুরো পাতা জুড়ে একটা বাঁশ এঁকেছে। নিচের দিকে একটা পশুর উল্টো দিক। লেজ ঝুলে আছে, তার থেকেই বাহার ধরে নিলো সেটা পশু। গাছের সাথে পশুটার শরীর জায়গায় জায়গায় লেগে আছে। তার মানে পশুটা হয় উপরে উঠছে কিংবা নামছে। বাহার ভালো করেই জানে টুম্পা ভালো ছবি আকে। কিন্তু এইটা দেখে সেরকম একেবারেই মনে হচ্ছে না।

বাহার আদরের কন্যার কাছে জানতে চাইলো, “কিরে মা কি সমস্যা হচ্ছে? এইটা দেখে তোর আঁকা মনে হচ্ছে না।” টুম্পা গলাটা ভারি করে উত্তর দিলো, “বাবা তুমি ঠিক সময়ে এসেছো। আমি চেষ্টা করতে করতে একেবারে টায়ার্ড হয়ে পড়েছি।” মেয়ের কথা শুনে বাবা একগাল হেসে নিয়ে বললো, “পাগলি মেয়ে আমার। ছবি আঁকা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, আমাকে বলবি না? আমি সারাদিন বাসাতেই আছি।”

বাহার টুম্পার ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো, “কোথায় আটকে যাচ্ছিস, সেটা দেখিয়ে দে।” টুম্পা কোন উত্তর না দিয়ে মেঝের থেকে কয়েকটা দুমড়ানো কাগজ হাতে নিয়ে সোজা করলো। সেখান থেকে একটা নিয়ে বাবাকে বলতে লাগলো, “দেখ, দেখ এই ছবিটা। তুমি দেখলেই সমস্যাটা বুঝতে পারবে।” না বাবা মেয়ের আঁকা ছবিতে তেমন কেমন গরমিল পেলো না। তবে একটু আগে টুম্পার যে কাজ দেখেছিলো, তার থেকে ঢের উন্নত। অসমাপ্ত কাজ, তার পরেও মেয়ের কাজ হিসেবে চিনে নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

কোনো কিছু বের করতে না পেরে, বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “না, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তুই আমাকে দেখিয়ে দে। আমার কাছে ভালোই মনে হচ্ছে। একটা বানর বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে……।” টুম্পা বাবাকে কথা শেষ করতে দিলো না, “তুমি কি করে বুঝলে, বানরটা উপরে উঠছে? আমার কাছে মনে হচ্ছে, বানরটা বাঁশ বেয়ে নিচে নামছে।”

বাহার বেশ মুশকিলে পড়ে গেলো। আসলেও তাই, ছবি দেখে দুটোই মনে হচ্ছে। ঠিক করে বলা যাচ্ছে না, উঠছে না নামছে। বেচারা গম্ভীর হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েকে কি বলবে, সেটা মাথায় আসছিল না। টুম্পা বুঝতে দেরি করলো না, বাবাও তার মতো একই গোলক ধাঁধায় পড়ে গেছে। বানরটাকে কিভাবে আঁকলে উপরে উঠছে কিংবা নিচে নামছে, সেটা মাথায় আসছে না। টুম্পা বাবাকে অনেকটা অভিযোগ করার সুরে বলল, “বাবা, আমার বান্ধবী শেলি বলছিলো, একবার আর্ট কলেজের পরীক্ষায় এই ছবিটা আঁকতে বলা হয়েছিল। তখন না-কি কেউ কাজটা করতে পারে নি। আমি ওকে বলেছি, এইটা আমার জন্যে কোন ব্যাপার না। আমি কালকেই ছবিটা এঁকে সবাইকে দেখাবো। এখন দেখছি, আমি নিজেও কাজটা করতে পারছি না। এখন জিদ চেপে ধরেছে, আমি চেষ্টা করেই চলেছি। কিন্তু হচ্ছে না।”

কথা শেষ হতে না হতেই, বেচারির চোখ দিয়ে পানি বেয়ে পড়তে লাগলো। বাবা হয়ে এ দৃশ্য মেনে নেয়া একেবারে অসম্ভব। বাহার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এই সমস্যা, আমাকে বললেই পারতি। এখন শোন, তোর ড্রয়িং খাতা, পেন্সিল আমাকে দে। আমি ছবিটা এঁকে দিচ্ছি। আর তুই কালকের পরীক্ষার পড়ালেখা কর”। কথাটা শুনে টুম্পা সস্স্থি পেলো। কালকে ছবিটা নিয়ে শেলি আর অন্যদের দেখাতে পারলেই হলো। ওরা তো জানবে না, ছবিটা আসলে কে এঁকেছে।

বাহার নিজের রুমে যেয়ে ফ্রেস কাগজ নিয়ে ছবি আঁকতে বসে পড়লো। প্রথমেই কঠিন কাজটা করে ফেলল। বানর এঁকে ফেললো। কিন্তু তাকে দেখাতে হবে বানর বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে। এতো সুন্দর বানরের ছবিটা দুমরে মুছরে মেঝেতে ফেলে দিলো। আসলে বাঁশ এঁকে তারপরে বানর আঁকতে হবে। কাজটা এক এক করে বেশ কয়েকবার করলো। বাঁশ ও বানরের অনুপাত ঠিক রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইটা যখন ঠিক হলো, তখন টুম্পা যে সমস্যায় ভুগেছিলো, তারও ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বানর দেখে ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না, বানর উঠছে না নামছে। মেয়ের মতো সেও মেঝেতে বেশ কিছু কাগজ দলা করে ছুড়ে মারলো। এর মধ্যে যে কত সময় পার হয়ে গেছে সেই দিকে আর খেয়াল থাকলো না। অবশ্য মাঝে ঝুমা এসে তাড়া দিয়ে গেছে, “তোমার না সাড়ে নয়টায় ঘুমানোর কথ?” বাহার স্ত্রীকে কোনো উত্তর দেয় নি। শেষের বার মনে হয় বলেছিল, “রাত বারোটা বাজে, তুমি এখনো উঠলে না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।”

বাহার চিন্তা করা আরম্ভ করলো, সে যেই ছবি আঁকতে চাচ্ছে, বাস্তবে সে রকম দৃশ্য দেখেছে কি-না। নাহ, তেমন কিছু মনে পড়লো না। বানর দেখেছে চিড়িয়াখানায়, টিভিতে। ফুটপাথে বানরের খেলা দেখেছে। পুরনো ঢাকায় এক বাড়ির ছাদ থেকে অন্য বাড়ির ছাদে বানর লাফিয়ে যেতে দেখেছে। না এইগুলোতে লাভ হচ্ছে না। আরও ভালো করে চিন্তা করলো। ইয়েস, পেয়েছে। কোন এক ইংলিশ সিনেমা দেখেছে বানর গাছে উঠছে। শটটা দূর থেকে নেয়া। একটা বানর তরতর করে গাছে উঠে যায়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। সিনেমায় ভিডিওতে আগে পরের দৃশ্য থাকে। বানর গাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে বুঝাতে কোন বেগ পেতে হয় নি। কিন্তু তাকে একটা দৃশ্যের মধ্যে বুঝাতে হবে বানর সাহেবের কার্যক্রম। তিনি বাঁশ বেয়ে নামছেন না, তিনি আসলে উপরের দিকে উঠছেন!

খুবই কাছাকাছি আরেকটা বিষয় স্মরণে এলো। সিক্স-সেভেনে থাকতে ক্লাসের এক ধরণের অঙ্কের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সেগুলো, অনেকটা এ রকম , এক বানর যদি এক তৈলাক্ত বাঁশ দিয়ে মিনিটে দশ ফুট উপরে উঠে, পরের মিনিটে পিছলিয়ে ছয় ফুট নেমে আসে; তা হলে বিশ ফুট উঁচু একটা বাঁশের মাথায় যেতে কত সময় লাগতে লাগবে? পরের মুহূর্তেই মনে হলো, সে বানরের উঠা নামার অঙ্ক করেছে, সে বিষয়ের ছবিতো আঁকেনি । বাহার বুঝলো, তার চিন্তা-ভাবনা কেমন স্থবির হয়ে আসছে। কোনো ভাবেই মাথায় আসছে না, বাঁশের সাথে বানরটাকে কি-ভাবে আঁকলে, সবার নিশ্চিতভাবে মনে হবে বানরটা উপরের দিকে উঠছে; নিচের দিকে নামছে না। না ভাগ্যটা খারাপই বলতে হবে, ব্যবহার করার মতো কোন আইডিয়া খুঁজে পেলো না। মাথাটা নিজের থেকে সেই ছোট বেলার অঙ্ক করা আরম্ভ করলো। প্রথম মিনিটে দশ ফুট বিয়োগ পরের মিনিটে ছয় ফুট; সমান সমান দুই মিনিটে চার ফুট। বাঁশটা জানি কতো লম্বা? একেবারেই খেয়াল আসছে না। বাঁশের উচ্চতা না জানলে চূড়ায় কি পৌঁছানো যাবে?

ছোট বেলার বন্ধু সালাম আর্ট কলেজের টিচার। একেবারে স্পষ্ট মনে আছে ওর বায়োলজি ল্যাব ক্লাসের প্রতিটা ছবি এঁকে দিয়েছিল। ব্যাটা ছবি আঁকবে কি তখন, কোন পেন্সিল দিয়ে শেড দিতে হয় কিংবা কোনটা দিয়ে লাইন টানতে হবে তাই জানতো না। পরে জানি কেমন করে আর্ট কলেজের চান্স পেয়ে গেল। বাহার নিশ্চিত এখানে সালামের কোন মামু প্রভাব কাটিয়েছে। সেটা যাই হোক, ওখানে যেহেতু সে পড়ায়; এই লাইনের কাজ কর্ম রপ্ত করেছে। ব্যাটাকে ফোন করে হেল্প চাওয়া যেতে পারে। বিষয়টা মাথায় আগে আসা উচিত ছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, রাত পৌনে একটা বাজে। এই সময়ে সালামকে ফোন করা যায় না। গত বছর হার্ট এট্যাক করে হাসপাতাল থেকে এসেছিলো এক সপ্তাহ। মেলা টাকার বিল এসেছিল। বাহার থেকে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। এই রাতে ওকে ফোন করলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার ১০০ ভাগ সম্ভাবনা।

অসহায় বান্দা ভেবে কুল কিনারা পেলো না, ছবিতে সমস্যা কোথায় হচ্ছে। কেনো ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছে না, বানরটা বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে। শেষে বাহারের মাথায় একটা উপায় ঝিলিক দিলো। উপরের দিকে উঠছে, তা হলে উপরের দিকে যেই পা, সেই পায়ের মাংস পেশীকে শক্ত দেখাতে হবে। নাহ, এখানেও ঝামেলা থেকে যাচ্ছে। নিচের দিকে নামার সময়েও একই ব্যাপার হতে পারে। এই ছোট একটা জিনিসের সমাধান সে বের করতে পারছে না। মেয়ের কাছে সে সকালে মুখ দেখাবেই বা কি করে? ঝুমাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞাসা করা যাতে, সে কিছু বলতে পারে কি-না। অনেক সময়ে তৃতীয় পক্ষ থেকে সহজ সমাধান পাওয়া যায়। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিস্কারের’ মতো। কিন্তু বুদ্ধিটা পরের মুহূর্তেই নাকচ করে দিলো। ঝুমাকে ডেকে তুললে সাথে সাথেই সবচেয়ে বড় রাম ঝাড়িটা খেতে হবে। এই গভীর রাতে ঝাড়ি খেতে একেবারেই ইচ্ছা হলো না।

সকালে বাহারের যখন ঘুম ভাঙলো , তখন বেলা আটটা। সাথে সাথেই রক্ত মাথায় চড়ে গেলো। অ্যালার্ম বাজলো, তার ঘুম ভাঙলো না, এইটাই বা কেমন কথা। তার মানে অ্যালার্ম দিয়ে শোয় নি। কিন্তু ঝুমা তাকে সকালে ডেকে দিলে পারতো। রান্না ঘর থেকে ঝুমার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সে নিজে সকাল সকাল উঠলো আর তাকে ডাকলো না। এইভাবে চললে বেশি দিন ঘর সংসার করা মুশকিল হয়ে যাবে। নয়টার সময়ে মিটিং, মানে এক ঘণ্টা হাতে। বাথরুমে যাও, গোসল করো, রেডি হও, নাস্তা করো; তারপরে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম ভেঙ্গে অফিস পৌঁছাতে পৌঁছাতে, যে কয়টা বাজবে সেটা আল্লাহ’ই মালুম!

রাতে ছবি আঁকতে আঁকতে এবং চিন্তা করতে করতে কখন যে বিছানায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেইটা স্মরণে এলো না। কিন্তু বানরের বাঁশ বেয়ে উপরে উঠার ব্যাপারটা মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আদরের টুম্পাকে কথা দিয়েছিল, সে যাতে বন্ধুদের কাছে ছোট হয়ে না যায় সেই জন্য সে তার কাজটা করে দিবে। বাবা হয়ে কথা দিয়ে কন্যার জন্যে কাজটা করতে পারলো না। মেয়েটা কী এ জন্যে রাগ করবে? অনেক অভিমান করবে? বন্ধুরা কী টুম্পাকে নিয়ে এক গাদা হাসাহাসি করবে? অফিসে মিটিং চালু হয়ে যাওয়ার পরে ঢুকলে কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার হবে। বিদেশীরা চোখ তুলে তাকাবে। এমন একটা ভাব করবে জাপানে কেউ কখনও দেরি করতে পারে না। তার পরে যদি জাপানী ইনভেস্টমেন্ট কোনোভাবে ফসকে যায়, সব দোষ যেয়ে পড়বে বাহারের উপর। বিদেশীরা চলে যাওয়া মাত্রই তার ডাক পড়বে এমডি সাহেবের রুমে। এই কয়েক বছরে চাকরিতে যতটুকু উন্নতি করেছিল, তা আবার নিমিষেই সাই করে উধাও হয়ে যাবে। বানরের পরের মিনিটে চার ফুট পিছলিয়ে পড়ার দশা। কিন্তু পিছলিয়ে নিচে পড়াটা যদি ছয় ফুট কিংবা তার থেকে বেশি হলে বাহার কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে? মাটির সমতলে ধপাস করে পড়বে? মাটির ভিতরে ঢুকে যাবে না নিশ্চয়ই? তবে মাথার মধ্যে চট করে খেলে গেলো, এত ভোগান্তি হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছে। বানর বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে কিংবা তৈলাক্ত বাঁশে পিছলিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে; সেটা যেমন ছবিতে ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছিল না; তেমন সেও কাউকে বুঝতে দিবে না আসলে সে উপরের দিকে উঠছে না নিচের দিকে পড়ছে। বাহারকে পরিস্থিতি যাই হউক না কেনো, নিজেকে শান্ত-সুস্থির রাখতে হবে। কোনো ভাবেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। প্রয়োজনে অভিনয় করতে হবে। অন্য কেউ বুঝলেই বিপদ যে সে পিছলিয়ে নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। পিছলিয়ে পড়াটা এক পর্যায়ে বন্ধ হবে। তখন-ই আবার উপরে উঠার সুযোগ তৈরি হবে।

বাহার লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলো। দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে, মুখে একটা কলা পুরে দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। দেখা যাক আজকে পিছলিয়ে নামার দিন না-কি বীর দর্পে উপরে উঠার দিন।

এপ্রিল ৪, ২০১৭

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com