দৌড়ের মধ্যে আছি রে ভাই...

দৌড় দৌড় এবং দৌড়। ছুটতে থাকো, চলতে থাকো। কোনোভাবেই থামা যাবে না। গতি কমলেই সমস্যা। প্রতিযোগিতা চলছে যে! পিছনের কেউ ধরে ফেলতে পারে। কিংবা সাথের জনের এগিয়ে যাবার আশংকা। কতটুকু এগিয়েছে ভেবে পেছনে ফিরে তাকালেও আবার সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। তাতে মনোযোগের ঘাটতি হয়ে সময়ের অপচয় হবে। সেই জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় আর দৌড়। যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, কাজটা আপনাকে করতেই হবে। আপনাকে প্রতিযোগিতায় থাকতেই হবে আর সে জন্য “দৌড়, দৌড় এবং দৌড়।”

জঙ্গলের বাঘ ঘুম থেকে উঠে পরিকল্পনা করে কিভাবে হরিণ থেকে দ্রুত গতিতে ছুটে যেয়ে শিকার ধরবে। অন্যদিকে হরিণ গবেচরা হলেও এতটুকু সে জানে, গতি কমলেই মহা বিপদ। বাঘ তাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। হিংস্র জন্তুটার উদরে চলে যেতে হবে। বাঘ, হরিণ দুটোই ছুটছে, জীবন বাঁচানোর জন্যে। মানুষও ছুটছে। তারাও তো আসলে এক ধরণের পশু। তবে উন্নত ধরণের পশু বলা যেতে পারে। এরিস্টটলের ভাষায় মানব সন্তানেরা হলো “রাজনৈতিক পশু”। বাঘ, হরিণের মতো তারা বেঁচে থাকার জন্যে ছুটছে তো ছুটছে। বলতে গেলে তারা সারাক্ষণই দৌড়ের মধ্যে থাকে।

দু পাখি শিকারি বন্ধু দেখলো এক ভাল্লুক তাদের দিকে তেড়ে আসছে। মুহূর্তেই তারা বুঝলো তাদের সামনে এখন মহা বিপদ। সাথে যে বন্দুক আছে, তা দিয়ে পাখি মারা যায়। কিন্তু ওই বন্দুক দিয়ে ভাল্লুককে গুলি করলে পশুটার মেজাজ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে যেতে পারে। তাতে মৃত্যুর আগমন আরও ত্বরান্বিত হবে। কি করা যায় এখন? নাহ; ভেবে সময় নষ্ট করা নিছক বোকামি। দু জনে প্রাণ পণে দৌড় আরম্ভ করলো। কিন্তু কয়েক কদম এগুনোর পর একজন বন্ধু থেমে কাঁধের ব্যাগ থেকে রানিং শু বের করে পরা আরম্ভ করলো। অন্যজন অবাক হয়ে বলল, “রানিং শু পরলে তো আর তুমি ভাল্লুক থেকে জোরে দৌড়াতে পারবে না?” এ রকম পরিস্থিতিতেও দৌড়রত বন্ধুটা উত্তর পেলো, “আমার তো ভাল্লুকের থেকে দ্রুত দৌড়ানোর দরকার নাই। তোমার থেকে এগিয়ে থাকলেই হলো।” তার মানে হলো ভাল্লুক প্রথমে যাকে পাবে তাকেই ভক্ষণ করবে। দৌড়ে যে আগে থাকবে সে বেঁচে যাবে। চালাক বন্ধুটা হয়তো জানতো সেই বিখ্যাত বাংলা প্রবাদ, “আগে গেলে রাজা হয়, পিছে থাকলে বাঘে খায়।”

একবার দেখা গেল শীর্ণকায় এক মহিলা পিছনের দিকে কদম দিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করছে। মানুষজন একেবারে হতবিহবল। করে কি মহিলা! উৎসাহী একজন যেয়ে জানতে চাইলো তার উল্টো দৌড় দেয়ার কারণটা কি। মহিলা বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে জানালেন, “ কারণটা একেবারে পানির মতো সহজ। সম্মুখ দৌড়ে যদি ওজন কমে, তা হলে পশ্চাৎ দৌড়ে নিশ্চয়ই তার উল্টোটা হবে। ডাক্তার আমাকে ওজন বাড়াতে বলেছেন। সেই জন্য আমি এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছি।”

সবাই কি আর একই গতিতে একইভাবে দৌড়ুতে পারে? কাউকে সে জন্যে নিন্দা করার আগে অবশ্যই অন্য প্রতিযোগীর অবস্থা ও পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়েকবহাল থাকাটা বাঞ্ছনীয়। ইংরেজিতে একটা কথা বলে, ‘stand in other people’s shoe’ যার বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘অন্যের জুতায় পা দিয়ে দাঁড়ানো’। তবে আক্ষরিক অনুবাদ করলে কথাটার মর্মার্থ সঠিক বুঝা যাবে না। বিষয়টা না হয় একটা ঘটনা দিয়ে ব্যাখ্যা করি। এক ট্রেনের বগিতে এক মহিলা তার দুটো শিশু পুত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলে দুটো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো ট্রেন জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফেললো। হৈ চৈ, দৌড়া-দৌড়ি, জিনিসপত্র ছোড়া-ছুড়ি থেকে আরম্ভ করে বিরতি-হীনভাবে অন্য যাত্রীদের বিরক্ত করে চললো। মায়ের সন্তানদের কর্মকাণ্ডের দিকে কোনো দৃষ্টিই দিলেন না। জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

অন্য যাত্রীরা ছেলে দুটোকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে সব দোষ মায়ের ঘাড়ে চাপাতে লাগলন। তাদের বক্তব্য যে মা তার সন্তানদের শাসন করেন না, তার সন্তানেরা তো এ রকম হবেই। কয়েকজন ভবিষ্যৎবাণী করলেন ছেলে দুটো বড় হয়ে সমাজ বিরোধী সব কাজ করবে। আরেকজন একগাল হেসে নিয়ে খক খক করে কেশে নিয়ে বিচ্ছিরি করে বলতে লাগলো, “আজ কালকার মহিলারা যেনো কেমন হয়ে গেছে। দায়িত্ব নিতে পারবে না আবার মা হয়।” উপস্থিত কেউ জানতো না মহিলাটা তার স্বামীকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করে ফিরছেন। তার মনে তখন স্বামীর স্মৃতি ও মাথায় আগামী দিনগুলোর অনিশ্চয়তা নিয়ে উথাল পাথাল ঝড়।

বাংলায় একটা শব্দ আছে ‘সহমর্মিতা’। শব্দটার খুব বেশী ব্যবহার কিংবা প্রয়োগ আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘empathy’। সহজ করে বলতে গেলে অন্যের মনের অবস্থা বুঝা ও সেটা শেয়ার করে নেয়ার ক্ষমতাটা হলো সহমর্মিতা। ট্রেনের বগি ভর্তি যাত্রীদের একজনও কিন্তু ভদ্র-মহিলার প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে পারেন নি। ট্রেন ছুটছিল, প্রত্যেকটা যাত্রীর মন ও জীবন একইভাবে ছুটছিল; যাত্রীদের মধ্যে সহমর্মিতা স্থান কতটুকু ছিল সেটা বলা মুশকিল। আবার মানুষ জাতি এই সহমর্মিতার থাকার কারণেই নিজেকে পশুদের থেকে উন্নত প্রজাতি হিসেবে দাবী করে থাকে।

জীবনের প্রয়োজনে আমরা সবাই দৌড়ে চলেছি। অনেকে তো কথাটা বলেও থাকেন, “দৌড়ের মধ্যে আছি রে ভাই।” তার পরেও আমাদের অন্যদের পাশে সহমর্মিতা নিয়ে সহ-অবস্থান করাটা একান্তই দরকার। আমরা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি, একজনকে পিছনে ফেলে রেখে, অন্যজন কি আসলেই এগিয়ে যেতে পারে? সবাই একসাথে এগিয়ে যেতে পারলেই না মানুষ হিসেবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব।

কাজী হাসান
লেখকঃ quazih@yahoo.com