আমি একদিন না, দেখিলাম তারে।।

সালঃ ১৯৬২।

স্থানঃ কলাতিয়া গ্রাম। জেলাঃ ঢাকা।

বুড়িগঙ্গার ওপারে। ঢাকার থেকে যেতে হলে--- নদী পার হয়ে ঘণ্টা খানেক পায়ে হেটে যেতে হয়।

এক দিন পরে পারুলের বিয়ে। আজকে গায়ে হলুদ। আগামী কাল ছেলের গায়ে হলুদ। আত্মীয় স্বজন এসে ঘর বাড়ি ভরে গেছে। আল্পনা আঁকা উঠানে গানের আসর চলছে। গ্রামের সব মানুষ ছুটে এসেছে। গায়ে হলুদের গান, বিয়ের গান, হাসি-তামাসা, খাওয়া-দাওয়া চলছে পূর্ণোদ্যমে।

বরের নাম সৈয়দ এরফান আলি। মোড়ল বাড়ির ছেলে। করাচী বিশ্ববিদ্যলয় থেকে পড়ালেখা করেছে। কি নিয়ে পড়ালেখা লেখা করেছে তা নিয়ে কারো কখনো মাথা ব্যথা নাই। সবার গর্ব, তাদের ছেলে পড়ালেখার শেষ মাথায় পৌঁছতে পেরেছে। করাচী থেকে এরফান যখন প্রথমবার গ্রামে আসলো, গ্রামের মানুষ ভেঙ্গে পড়েছিল তাকে এক নজর দেখার জন্যে। পরে মোড়ল সাহেবকে তিনটা গরু কেটে মানুষ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।

গত তিন বছর ধরে সৈয়দ এরফান আলি কাজ করছে পশ্চিম পাকিস্থানে। জায়গাটার নাম ওয়াহ ক্যান্টনমেন্ট। পূর্ব পাকিস্থান থেকে প্রায় আঠারো শ মাইল দূরে; সে-ই পাঞ্জাবে। রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে। ঢাকা থেকে করাচী, সেখান থেকে ট্রেনে করে রাওয়ালপিন্ডি, তার পরে বাসে করে ওয়াহ। ঢাকা থেকে করাচী পর্যন্ত বিমানে গেলে, সব মিলিয়ে পাঁচ দিন লেগে যায়। আর চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে গেলে মাস খানেকের ব্যাপার।

সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্যে গোলা- বারুদ, আর অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হয় । ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পরে দেখা গেল ওই ধরনের কারখানাগুলো সব ভারতের ভাগে পরেছে। পাক নেতাদের মাথায় হাত। গোলা- বারুদ, আর অস্ত্রশস্ত্র না থাকলে কি আর ভারতকে ঠেকানো যাবে। হিন্দু রাষ্ট্র ভারত; একেবারে মুসলমান পাকিস্তানকে গ্রাস করে ফেলবে। জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হল নিজেদের গোলা বারুদ নিজেদেরই বানাতে হবে। প্রধান মন্ত্রী লিয়াকাত আলী খান সাহেবের ঘোষণা, সবাই এক বাক্যে মেনে নিল। নতুন দেশ পাকিস্থানের যত অভাব,সমস্যা থাকুক না কেন; দেশটাকে যে কোন মূল্যে ভারতের লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতেই হবে।

চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জায়গা, ওয়াহ ক্যান্টনমেন্ট । জায়গাটা বেছে নেয়ার মূল কারন হল, ভারত যাতে আক্রমণ করে সুবিধা করতে না পারে। পাহাড় ভেদ করে আসাই, তাদের জন্যে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তার পরেও, যদিও কোন ভাবে ভারত সেনাবাহিনী এসে পরে, তবে সেখান থেকে যাতে কোন ভাবে বের হতে না পারে, তার সব ব্যবস্থা নেয়া হল।

ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানের প্রথম Ordnance Factory (গোলা- বারুদ, আর অস্ত্রশস্ত্র কারখানা) স্থাপিত হওয়ার পরে, পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ আসলো কাজ করতে। পূর্ব পাকিস্থান থেকে দূরত্ব অনেক বেশী হওয়াতে, পশ্চিমের মানুষের সংখ্যাই বেশী। শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে সব ধরনের চাকুরী। ভাল বেতনের সাথে যোগ করে দেয়া হল দেশ প্রেম। কারখানা যাত্রা আরম্ভ করলো ৩০৩ বন্দুক আর তার গোলা বারুদ বানানের কাজ দিয়ে।

সৈয়দ এরফান আলি ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে কাজ করছে গত চার বছর ধরে। ৪ নম্বর শেড, যেখানে বন্দুকের নল লাগান হয়, সেখানকার এসিসট্যান্ট ম্যানেজার। অফিস থেকেই কাজের মানুষ, ড্রাইভার, গাড়ি, বাড়ি সব পেয়েছে। শুধু খালি ছিল একটা বউয়ের জায়গা। সেটা পূরণ করতে এরফান দেশে গেল বিয়ে করতে।

চৌধুরী বাড়ির মেয়ে পারুল। ক্লাস এইটে পড়ে। মাস খানেক আগে বাবা হঠাৎ তার ঘরে এসে বলল, তোকে কালকে থেকে আর স্কুলে যাবার দরকার নেই। আগামী মাসের চার তারিখ শুক্রবার, তোর বিয়ে মোড়ল বাড়ির ছেলে এরফানের সাথে। ছেলে বিরাট চাকরি করে পশ্চিম পাকিস্তানে; লম্বা চওড়া, ফর্সা দেখতে রাজপুত্রের মত। আজকেই মোড়ল সাহেবকে কথা দিয়ে আসলাম। আমাদের সাত পুরুষের ভাগ্য যে আমরা এ রকম একজন ছেলে পাচ্ছি।

কথাটা শেষ করতে করতে বাবা মহা ব্যস্ত হয়ে পরল। একে ডাকো, ওকে ডাকে। চারিদিকে তার হাঁক ডাক শোনা যেতে লাগল। এতো মানুষ খাবে, শহর থেকে বাবুর্চি আনাতে হবে। স্কুলের খেলার মাঠে সামিয়ানা লাগাতে হবে। কমপক্ষে তিন ডেকোরেটরের দোকান থেকে টেবিল-চেয়ার ভাড়া করে আনতে হবে। এতো চেয়ার- টেবিলের সাপ্লাই তো আর চাট্টিখানা কথা না। তাও আবার ডেকোরেটরের দোকানগুলো নদীর ওই পারে ঢাকায়। নৌকায় করে সব আনতে হবে। কম তো আর ঝক্কি না! মোড়ল বাড়ির মেয়ে বিয়ে হয়েছিল গত বছর। ওরা গ্রামের সব মানুষকে টেবিল চেয়ারে বসিয়ে খাইয়েছিল। কাওকে মাটিতে বসতে দেয় নি। গ্রামের মানুষ তা নিয়ে এখনও কথা বলে। সেই মোড়ল বাড়ির সাথে সম্পর্ক হচ্ছে। ওদের অতিথিকে মাটিতে বসিয়ে খাওয়ানো চলে না! পারুলের বিয়েতে সমানে সমান আয়োজন থাকতে হবে। মনে হচ্ছে খরচ পাতি যোগাতে আবার ধানী জমি না বিক্রি করতে হয়।

পারুল জানত, তার এ রকম খবর শোনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার বেশীর ভাগ বান্ধবীদের এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। কয়েক জন আবার বাচ্চা-কাচ্চার মা। এক দিক দিয়ে বলতে গেলে একই বয়সের অন্যান্য মেয়েদের তুলনায়; সে বেশী সময় বাপের বাড়িতে কাটাচ্ছে। হয়তো বাবার মাথায় কোন বড় পরিকলপনা কাজ করছিল। তবে মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, বেশ কিছু দিন ধরে বাবা আর মোড়ল সাহেব দুই পরিবারের সম্পর্ক তৈরির জন্যে কথা বার্তা চালিয়ে আসছে। কিন্তু তার পরেও, মনে হত যদি অলৌকিক কোন ঘটনা ঘটতো, যদি প্রাণ ফিরে আসতো, সাহস করে তাকে নিয়ে কোথাও চলে যেত, পালিয়ে যেত, হারিয়ে যেত, উধাও হয়ে যেত; যেখানে ওদের কেও চেনে না। যেখানে শুধু ওরা দু-জন আর ওদের গান।

প্রাণ, দত্ত বাড়ির ছেলে। গ্রামে হাতে গোনা কিছু হিন্দু পরিবারের মধ্যে তারা একটা। গ্রামের বেশীর ভাগ হিন্দুরা দেশ ভাগের সময় ভারত চলে গেছে। পুলকেশ দত্ত শহরে এক উকিলের মুহুরি। আয় রোজগার ভাল। কাজের জন্যে তাকে বছরের বেশীর ভাগ সময় শহরে থাকতে হয়। তারই দুরন্ত ছেলে এই প্রাণ।

বাবা পড়া লেখা করে মুহুরি হয়েছে, কিন্তু ছেলের মন কোন ভাবেই সেখানে বসানো গেল না। এক বার বাউল দলের সাথে চলে গেল, কাওকে না জানিয়ে। ছয় মাস কোন খবর ছিল না। খবর পাওয়া গেল সে, বাউল ওস্তাদ সুজাউদ্দিন আর তার দলের সাথে চলে গেছে কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের আখড়ায়। বহু কষ্টে বাবা পুলকেশ দত্ত, নিজে যেয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনলো। বলা হল, ফিরে না আসলে মা বাঁচবে না। প্রাণ ফিরে এলো, এক শর্তে, যে তাকে স্কুলে যেতে বাধ্য করা যাবে না। তার বিনিময়ে গান শিখতে আর গাইতে দিতে হবে। ছেলের অনড় শর্ত বাবা, মা নিরুপায় হয়ে মেনে নিল। বাবা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, তাকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আয় রোজগার করে যেতে হবে। একমাত্র ছেলে যদি বাউল হয়ে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, তবে সংসারের হাল ধরবে কে?

প্রাণ বাড়ী ফিরে আসলো। কিন্তু, বাউল ওস্তাদ সুজাউদ্দিন যখন আসে-পাশের গ্রামে আসত, তখন যত টুকু সম্ভব প্রাণ তার সাথে থাকত। গানের আসরে গলা মিলানো তার নেশার মত হয়ে গেল। এ রকম ভাবে বছর খানেক কাটানোর পরে, একদিন ওস্তাদ বলল, দেখি তুই একটা গান ধর, আমি শুনি।

প্রাণ গান ধরলঃ

সময় গেলে সাধন হবে না

দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না।

গান শেষে প্রাণ ওস্তাদের দিকে তাকাল। গানের শুরুতে ওস্তাদ চোখ বন্ধ করেছিল। এখনো তা খুলে নি। প্রাণ দেখল, তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু জল অঝর ধারায় গড়িয়ে চলেছে। ওস্তাদ সুজাউদ্দিন চোখ খুলে প্রাণকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে বলল, আজকের থেকে তুই ও এক জন বাউল। তুই আমার মত একাই গান গেয়ে বেড়াতে পারবি। চাইলে দল গড়তে পারিস। তোর গান আমাকে কাঁদিয়েছে। আশীর্বাদ করি, তুই জীবনে বিশাল বড় একটা বাউল হ! তোর গান সব মানুষের মন কোমল, নরম করে দিক, ভালোবাসতে শেখাক। পৃথিবী থেকে হিংসা দ্বেষ উঠে যাক।

পারুলকে একটা সাঁকো পার হয়ে স্কুলে যেতে হতো। সাঁকো কাছাকাছি আসলেই শুনতে পেত গানের সুর ভেসে আসছে। সাঁকোতে পা দেয়া মাত্র গানের কথাগুলো একেবারে পরিস্কার হয়ে আসতোঃ

আশা পূর্ণ হল না

আমার মনের বাসনা

বিধাতা সংসারের রাজা

আমায় করে রাখলেন প্রজা।

মনটা যেন কেমন হয়ে যেতে চায় গানের সাথে সাথে। ইচ্ছে করত গানের সাথে মিশে যেতে, গানের মানুষটা ছুঁয়ে দেখতে। যেই মানুষের গলায় এতো সুর, এতো দরদ, সে দেখতে না কেমন। তাকে প্রতিদিনই কেন একই জায়গা থেকে একই সময় গান গেতে হয়। গানের কথা কি তার মনের কথা? অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, চোখ ঘুরিয়ে গানের মানুষকে আর খোঁজা হয় না। সংস্কারে বাঁধে। পাছে যদি কথা উঠে, কেও যদি ভুল বুঝে!

এক দিন গান শুনতে শুনতে মনটা উদাস করে পারুল সাঁকোতে পা রাখল। দ্বিতীয় পা দিল ভুল জায়গায়। আর যায় কোথায়? ধপাস করে শব্দ। নীচে যেয়ে পরলো পানির মধ্যে। পানির গভীরতা বেশী না। কিন্তু, তার পরেও জামা কাপড়, বই পত্র ভিজে একাকার হয়ে গেল। ভাবল, কেও না দেখলেই রক্ষা। ভেজা কাপড় নিয়ে তো আর স্কুলে যাওয়া যাবে না। আবার বাড়ি ফিরলে পথে কত মানুষ দেখবে। কি লজ্জা! কত কথা রটবে।

এই সময় শুনল, কে যেন বলছে, নাও আমার হাত ধরো। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে হাতটা ধরে উঠে আসলো। পরিচিত লাগল, কোথায় যেন দেখেছে। আরে এ যে প্রাণ! ছোট বেলায় এক সাথে কত না খেলেছে । দেখা নাই, বেশ অনেক বছর। বাবা-মা নিষেধ করে দিয়েছিল ছেলেদের সাথে বাইরে আর খেলা যাবে না। ‘ তুমি এখন বড় হচ্ছো’। পারুল ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি, বড় হওয়ার সাথে খেলা বন্ধ করে দেয়ার কি সম্পর্ক হতে পারে। তার পর থেকে পারুলকে বাইরে খেলতে যেতে দেয়া হয় নি। মেয়েদের বড় হলে কি আর আকাশ দেখতে হয় না?

প্রাণ দেখতে অনেক অন্য রকম হয়ে গেছে। আগের মত হ্যাংলা, পাতলা, আর বালক চেহারা নাই। দেখতে পুরো বড় মানুষের মত। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, গেঞ্জি, কোমরে একটা গামছা পেচান। গলার আওয়াজ কেমন ভারি ভারি। পারুল বলল, আরে প্রাণ দা, তুমি কি করে?। উত্তরে প্রাণ বলল, আমি তো এই খালটার ধারে বসে গান গাই। পাশেই বাবার ধানের জমি। গান গাওয়া হয়, বাবার জন্যে কাজও করা হয়; তার বর্গা দেয়া ধান ক্ষেত দেখে রাখা হয়।

প্রতিদিন তোমাকে স্কুলে যেতে দেখি। সবুজ ধান ক্ষেত, নীল আকাশ, খালের পানি’ র একেবারে কাছে আমাকে আসতেই হয়। মনে হয়, আমার গান-----এই ধান ক্ষেত, নীল আকাশ আর পাশের খালকে একই মালায় গেঁথে ফেলে। আমার গান আর সুর বিশাল এক মালার যেন সুতো হয়ে যায়।

প্রাণ নিজের একটা গামছা দিল পারুলকে। পারুল সেটা দিয়ে ভাল করে নিজের শরীরের উপরের দিকটা ঢেকে নিল। প্রাণ পারুলের বই পত্রগুলো হাতে নিয়ে বলল, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

হাটতে হাটতে অল্প সময় মধ্যে অনেক কথাই হল। প্রাণ বলল, তার গান আর সুরের দিকে ঝোঁকের কথা। বলল, আজ বেশ কয়েক বছর হল, সে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বাবা তাকে জোর করে ফিরিয়ে এনেছে বাউল ওস্তাদের কাছ থেকে। ওস্তাদ বলেছে, বাবা মা’র সাথে থেকে গানের চর্চা করে যেতে। বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে বাউল হওয়া যায় না। ওস্তাদের কথা মত, বাবা-মা খুশী মনে যে দিন অনুমতি দিবে, সে দিন সে বেরিয়ে পরবে “এক জন বাউল” হয়ে। একেবারে প্রকৃতি আর বিধাতার সাথে এক হয়ে যাবে। বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকার আগে সুর করে গাইল, ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’। সেই মুহূর্তে পারুল, গানের কথা থেকে তেমন কোন অর্থ বুঝল না।

বিয়ের সময়ে পারুলের বয়স ১৫ আর বরের বয়স ৩০, একেবারে দ্বিগুণ। বিয়ের রাতেই পারুল প্রথম মুখ দেখল এরফান আলির। ছোট বেলায় হয়তো দেখেছে, কিন্ত মনে করতে পারলো না। দেখে মনে হল অনেকটা স্কুলের অংকের নগেন স্যারের মত দেখতে আর একই বয়সী। ক্লাসের মেয়েরা ভয়ে, রাগী নগেন স্যারের দিকে তাকাত না। তাকালেই যদি পড়া জানতে চায়......। পড়া না পারলে কঠিন সব শাস্তি হতো। এক বার পারুলকে এক ঘণ্টা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি পেতে হয়েছিল। শাস্তিগুলো কিছুটা শারীরিক কষ্ট দিলেও, মনটাকে লজ্জা-অপমানে চিরস্থায়ী ভাবে ক্ষত করে দিত।

সে তো জানে স্বামীর নাম মুখে আনতে নাই, তা হলে তাকে কি নামে ডাকতে হবে। মা, বাবাকে বলে ‘পারুলের বাবা’। মা’র থেকে কখনো জেনে নেয়া হয় নি, তার জন্মের আগে বাবাকে কি নামে ডাকত। লোকটাকে স্যার বলে ডাকলে কেমন হয়? কিন্তু স্বামীকে স্যার বলতেও ইচ্ছা করলো না। স্যার তো চোখাচখি হলে পড়া জিজ্ঞাসা করে। স্বামীকে জীবন সঙ্গি হিসাবে পেতে ইচ্ছা করলো, ভালোবাসার মানুষ হিসাবে পেতে মন চাইল। অংকের স্যারের মত, কোন কঠিন মানুষ হিসাবে, না।

স্বামীকে স্যার না বলা হলেও, তার ব্যবহার একে বারে স্কুল টিচারের মত। বিয়ের পরের দিন থেকেই ঠিক করে দিল, পারুলের সারা দিনের রুটিন। কখন ঘুম থেকে উঠতে হবে, কি পোশাক পরতে হবে, কার সাথে কি কথা বলতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি সব। পারুলের চোখে ভাসতো সাবধানে সাঁকো পার হওয়ার দৃশ্য। সে কি আর কখনো সাঁকো পার হতে পারবে? স্বামী তাকে একজন পুতুল বানাতে চাচ্ছে; যার নিজস্ব কোন ইচ্ছা, ক্ষমতা থাকতে পারবে না। সুতোয় বাঁধা পুতুলের মত তাকে সারাদিন নাচতে হবে। অন্য মানুষের শিখিয়ে দেয়া কথা বলতে হবে। বিয়ে হলে মেয়েদের কি তোতা পাখি হয়ে যেতে হয়?

পারুল, বিয়ের পরে বাবা আর শ্বশুর বাড়ি মিলিয়ে প্রায় তিন মাস ছিল ছিল। তার পরে এরফান নিজে এসে তাকে নিয়ে গেল ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টের বাসায়। বিরাট বাসা; চাকর, বাবুর্চি, মালি, কাজের মানুষ মিলিয়ে চার জন মানুষ আছে, সাহেবকে সেবা করার জন্যে। কিন্তু পারুল কাউকে পেল না যার সাথে দু দণ্ড কথা বলা যেতে পারে। এরফান পারুলের জন্যে ছক কাটা নিয়ম কানুন দিয়ে দিল। শেষে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, এলাকার বাঙ্গালীদের সাথে কথা বলা, মেশা তার একেবারে পছন্দ না।

সাঁকো থেকে পরে যাবার ঘটনার পর থেকে কেন পারুলের মনে, প্রাণ, একটা চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল। স্কুলে যাবার পথে প্রাণের সাথে দেখা হবে, তার গান শোনা হবে; এই কথা ভাবতেই শরীরে, অন্তরে শিহরন লাগতো। গানের শব্দ কানের আসার আগেই, গানের সুর তার হৃদপিণ্ড অনুভব করত, আবার প্রাণকে ছাড়িয়ে চলে গেলেও কানে সুর লেগে থাকত সারাটাক্ষণ।

পারুল একটু তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হওয়া আরম্ভ করলো; যাতে প্রাণ আর তার গানকে একটু বেশী ক্ষণ পাওয়া যায়। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে প্রাণ বলল, একটু বসে যাও না আমার পাশে। এর কিছু দিনের মধ্যে পারুলের অনেকগুলো গান জানা হয়ে গেল। প্রায় দিনই প্রাণ পারুলকে স্কুলের দিকে এগিয়ে দেয়া আরম্ভ করলো।

এক দিন প্রাণ বলল, মন চাচ্ছে তুমি আমার পাশে আজকে আরও অনেকক্ষণ থাক। পারুলের মনেও তাই ছিল। দু জনে একটা নৌকা নিয়ে খাল ধরে নদী পর্যন্ত গেল। স্কুল ছুটি হওয়ার সময় পর্যন্ত প্রাণ একটার পর একটা গান করলো। শেষের দিকে পারুলও প্রানের সাথে গলা মিলালোঃ

প্রেমের কি সাধ আছে বল

নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গাঁয়ে।

গানটা যখন শেষের দিকে, পারুল দেখল প্রাণের চোখে পানি। ও বলল, আমার ইচ্ছে করছে, তোমাকে সাথে নিয়ে বাউল হয়ে গান গেয়ে বেড়াতে। তোমার গান, আমার সুরের সাথে মিলে গেছে, আর সেই সুর আকাশ, বাতাস, নদীর সাথে মিশে একাকার হয়ে বিলীন হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি, তুমি আর প্রকৃতি মিলে যেন এক হয়ে, একাকার হয়। এই মিলে যাওয়াতে আনন্দ, এই মিলে যাওয়াতে বেঁচে থাকার সার্থকতা। এই মিলন না হলে পৃথিবী নিরানন্দ, নরকের যন্ত্রণা। এতো ভীষণ একটা ঐক্যতান। আমার ভীষণ আনন্দ হবে।

প্রাণ তার পরে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমরা দু জনে যদি বাউল হয়ে এক সাথে গান গেয়ে বেড়াতে পারতাম! পারুল একটু রসিকতা করে বলল, তোমাকে বাউলের গেরুয়া পোষাকে দেখলে আমি হেসেই খুন হয়ে যাবো। তোমাকে দেখতে যে কি অদ্ভুত লাগবে। প্রাণ বলল, যে গলায় বাউলের গানের সুর; সেই শরীরে বাউলের গেরুয়া পোশাক খুব মানাবে।

নিন্দা গায়ে যাতে না লাগে, পারুল আগে আগে যেয়ে বন্ধুদের বলল, খবরদার তারা যাতে বাসায় খবরটা পৌছে না দেয়, যে পারুল স্কুল কামাই দিয়েছে। এর পরে সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন প্রাণ আর পারুল নৌকা নিয়ে বের হতো। কিন্তু, মাস ছয়েকের মধ্যে মা’র কানে ঠিকই খবরটা আসলো। মেয়ে একটা হিন্দু ছেলের সাথে স্কুল কামাই দিয়ে খালে, নদীতে ঘুরে বেড়ায়।

মা সরাসরি মেয়েকে বলল, গ্রামে জানাজানি হওয়ার আগে, তোমার বাবার কানে যাবার আগে তুমি ওই ছেলের সাথে মেলা মেশা বন্ধ কর। তোমার বাবা জানলে, তোমাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলবে।

পরের দিনই পারুল প্রাণকে বলল, আমাদের সম্পর্ক এখানে, আজকেই শেষ হয়ে যাবে। দুটো তরুন মন আত্মসমর্পণ করলো মানুষের গড়া মিথা নিয়ম-কানুনে। পারুল তার পরিবারকে সবার কাছে হেয় করে একটা হিন্দু ছেলে, একটা বাউল ছেলে, প্রাণের হাত ধরে চলে যাবার সাহস পেল না। প্রাণ ভাবল মায়ের কথা। সে যদি আবার মাকে না বলে চলে যায়, মা তা হলে কাঁদতে কাঁদতে মারা যাবে। তার পর হয়তো আরম্ভ হতে পারে মুসলমান গ্রামবাসীদের উপহাস আর অত্যাচার। দুটো তরুন মনের নীল আকাশে উঠার পাখাগুলো ক্ষয়ে পরে গেল। কোন প্রতিবাদ হল না। নদীর পানির প্রবাহে কোন ব্যতিক্রম হল না।

বিদায় ক্ষণে, দু জনে আবার গান ধরলঃ

আমি অপার হয়ে বসে আছি

ওহে দয়াময়

পারে লয়ে যায় আমায়।

মন ভরল না, আরেকটা গান চলে আসলোঃ

দেখ না মন ঝকমারি এই দুনিয়াদারি

পড়িয়ে কোপনি ধ্বজা কি মজা উড়ালো ফকিরি ।।

পারুল প্রাণকে ছেড়ে আসার সময় বারে বারে ঘুরে তাকালো। চোখে পানি, মনে ক্রোধ এই সমাজের বিরুদ্ধে। যে সমাজ মানুষ বুঝে না, সে সেই সমাজ মানতে চায় না। প্রাণ যখন চোখের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল, তখন শুনল দিগন্ত রেখা থেকে প্রাণ, পারুল পারুল বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়িয়ে আসছে। এসেই জড়িয়ে ধরল, পারুলকে। দুটো শরীর কিছুক্ষণ এক হয়ে থাকলো। গান আর সুরের মত ওদের শরীর একই তালে বেজে উঠলো।

প্রান বলল, আমি বাউল হয়ে একদিন তোমার সামনে যেয়ে দাঁড়াবো। আমার গায়ে বাউলের গেরুয়া পোষাক থাকবে। তুমি পৃথিবীর যেখানেই থাক না কেন। তোমাকে তখন আরেক বার আমার সাথে গান গাইতে হবে। তার পরে আমার মরে গেলেও কোন কষ্ট থাকবে না।

মোটামুটি দুই ধরণের বাঙালীরা ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টের ফ্যাক্টরিগূলোতে কাজ করে। যাদের পড়ালেখা কম কিংবা হয়তো নাই বললেই চলে, এমন মানুষরা শ্রমিকের কাজ করে। যারা পড়ালেখা করে এসেছে, তারা অফিসারের কাজ করে; বেতন পায় ভালো, ভালো বাসায় থাকে। এই দ্বিতীয় ধরণের পরিবারের সংখ্যা হাতে গোনা এগারো জন। ছুটির দিনের তারা এক সাথে হয়, খাওয়া দাওয়া করে, গল্প-আড্ডা করে।

কিন্তু এদের মধ্যে সৈয়দ এরফান আলি কিছুটা অন্য ধরণের। তার আয় রোজগার, ক্ষমতা অন্য বাঙালিদের থেকে বেশী। বাঙালিদের সাথে মেলামেশা নাই বললেই চলে। প্রয়োজন ছাড়া কথা পর্যন্ত বলে না। এখানকার রেওয়াজ হল, নতুন বিয়ে করে আনলে সবাইকে দাওয়াত দিয়ে বৌয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। কিন্তু এরফান কাজটা করলো না। এ মুখ, ও মুখ করতে সব বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলো। তাদের সবার বিষয়টা নিয়ে কিছুটা হতাশা আসলো। একটা বাঙ্গালি কি করে অন্য বাঙ্গালিকে, এতো পর ভাবতে পারে। বিদেশে সব বাঙালিই না আপন মানুষ।

দেখতে দেখতে পারুলের ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে পাঁচ বছর পার হয়ে গেল। মেয়ে পান্নার বয়স এখন তিন। খাঁচার পাখির জীবন কেটেই যাচ্ছিল। বিয়ের রাতের কথা প্রায় মনে পরে। স্বামীকে কি বলে সম্বোধন করবে তাই নিয়ে ভাবছিল, তখন এরফান বলল, এই বার সব কাপড় চোপড় খুলে ফেলো। অনেকটা একজন শিক্ষক যেভাবে একজন ছাত্রীকে নির্দেশ দেয়। তখন অংক স্যারের চেহারা মনে এলো। এরফান পারুলের শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। পারুলের কষ্ট, এরফানের উন্মাদনা। চিন্তা করতে থাকলো, সে খুব সাবধানে সাঁকো পার হচ্ছে। দূরে প্রাণের গান শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কি জানি মিলছে না। গানের সুর এক রকম, বাদ্য আরেক রকম। কিন্তু, প্রাণ তো বাদ্য ছাড়া গান গাইত। কি জানি প্রান বলেছিল, মিল না হলে পৃথিবী নিরানন্দ, নরকের যন্ত্রণা। সে কি এখন নরকের যন্ত্রণা পাচ্ছে? পারুলকে রক্তাক্ত করে বিজয়ী এরফান একটুও ভ্রূক্ষেপ না করে বীরের ভাব নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এক বারও, কোন কিছু জানতে চাইলো না পারুলের কাছ থেকে। পুরুষরা কি মাংসাশী প্রাণী? তারা কি বাঘ?

এরফানকে একবার তিন দিনের নোটিসে এক মাসের জন্যে বিদেশ যেতে হল। অল্প বয়সের সুন্দরী স্ত্রীকে একা বাসায় রেখে যেতে মন চাইল না। সময় কম, না হলে পারুলকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া যেত। শেষে অনেকটা বাধ্য হয়ে কথা বলতে হল, পাশের বাড়ির বাঙ্গালী প্রতিবেশী রহমান সাহেবের সাথে। রহমানের বউ রিনি মহা উৎসাহে পারুলকে বাসায় নিয়ে আসলো।

এর প্রায় সাত দিন পরে রহমান-রিনির ছেলের প্রথম জন্মদিন। নিমন্ত্রিত হয়ে সব বাঙ্গালী অফিসার আর তাদের পরিবারের হাজির হল রহমান সাহেবের বাসায়।। বাড়ির মালিকরা পারুলকে অন্য সব বাঙ্গালীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পারুল সবার সাথে কথা বলল, অনেক কথা বলল; অনেকদিন পরে--- হাসল, অনেক হাসল।

খাওয়া দাওয়ার পরে, সবাই অনুরোধ করলো রহমানকে গান গাওয়ার জন্যে। আসলে বাঙ্গালী ভদ্রলোকদের মধ্যে রহমানই এক মাত্র গান করতে জানত। মাঝে মাঝেই তাকে অন্যদের অনুরোধে গান গেয়ে শুনাতে হয়। আজকেও তাই হল। রহমানকে আবার তার জানা গানগুলো গাওয়া আরম্ভ করতে হল।

অল্প সময়ের মধ্যে পারুল আর রিনির খুব অন্তরঙ্গতা হয়ে গিয়েছিল। এক জন আরেক জনকে মনের সব কথা জানিয়ে ফেলল। রিনির জানা হল, পারুল গান আর সুর কত ভালবাসে! সে পারুলকে জোরাজুরি করতে থাকলো গান গাওয়ার জন্যে। পারুল বলল, তা কি করে হয়! অনুরোধ আসতেই থাকলো। সবার দাবী নতুন মানুষের থেকে নতুন গলার সুর।

কিন্তু পারুল আজকে অনেক দিন গান করে নি। তবে, মনে মনে গান গায় সুযোগ পেলেই। এতো মানুষ, এতো করে বলছে, গান গেতে। তারো গান গেতে ইচ্ছা করতে লাগল। হৃদপিণ্ড সুরের তালে বাজতে আরম্ভ করলো। গান, সুর বহু দিন পরে তার গলা থেকে বের হয়ে আসতে চাইল। সাথে সাথে মনে আসলো, স্বামী সৈয়দ এরফান আলি’র কথা। সে যদি জানে, তার স্ত্রী সবার সামনে গান গেয়েছে, তা হলে প্রলয়ঙ্করী ঘটনা হবে।

পারুল সবাইকে সুরের জগতে পৌঁছে দিলঃ

বাড়ির পাশে আরশী নগর

সেথা পরশী বসত করে।

এক পরশী বসত করে।

আমি একদিন না, দেখিলাম তারে।।

পারুল একই গান পর পর তিন বার গাইল। মনে হল, বড় কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই গানের কথা পরিষ্কার না বুঝলেও, গানের সুর তাদের মোহিত করে রাখল।

শ্রমিকদের গুলশান কলোনির সামনে যে চৌ রাস্তা, তার আশে পাশে অনেক ধরণের হকার জিনিস পত্র নিয়ে বসে। অনেকটা হাটের মত, ভিড় হয় বেশ। বেচা কেনা চলে অনেক। সেখানে কাজের খোঁজে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোক জন এসে দাঁড়ায়। কি ভাবে যে জায়গাটা তারা চিনে ফেলে, তা বলা মুশকিল। হয়তো ভিড় দেখে হাজির হয়। হকাররাই নতুন মানুষ দেখলে জিজ্ঞাসা করে, কোথা থেকে এসেছে। তার পরে খবর দেয়া হয় একই এলাকা থেকে, আগে যারা এসেছে এমন মানুষদের। এর পরে এলাকার মানুষরাই তাদের স্বজনদের থাকা, খাওয়া আর কাজের ব্যবস্তা করে দেয়।

এক দিন সন্ধ্যায় দেখা গেল চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের পনেরো বছরের এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে চৌ রাস্তায়। এক পাঠান হকার বাঙ্গালী জেনে খবর দিল রংপুরের রহমানকে। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে আসলো সে, বাঙ্গালী ছেলেকে স্বাগতম জানাতে। রহমান ছেলেটাকে নিয়ে গেল চট্টগ্রামের রফিক সাহেবের বাসায়।

ছেলেটা বলল, তার নাম সিরাইজ্জা। দু সাহসিক সব গল্প বর্ণনা করলো। পয়সা ছাড়াই জাহাজে করে এসেছে করাচী। সেখান থেকে ট্রেনে করে রাওয়ালপিণ্ডি। তার পরে এক বাসে চড়ে ওয়াহ ক্যান্টনমেন্ট। সব মিলিয়ে সময় লেগেছে দেড় মাস। তার কথা শোনার জন্যে বেশ কিছু বাঙ্গালী এক জায়গায় হল। সিরাইজ্জা খাওয়া, থাকা আর কাজের জন্যে চিন্তা করতে হল না।

এর পর কোন বাঙ্গালী আসলেই সব ঝাঁপিয়ে পরত নতুন বাঙ্গালীকে সাহায্য করার জন্যে। অল্প সময়ে কাজ আর থাকার ব্যবস্থা হয়ে যেত। প্রতি মাসে দু-একজন বাঙ্গালীকে চৌ রাস্তার মোড় থেকে উদ্ধার করে পূর্ণবাসিত করা হত।

এর বেশ কিছু বছর পর, একই জায়গায় এক জন বাঙ্গালী মানুষকে দেখা গেল। বলল, সে এখানে চাকরির জন্যে আসে নি। একজনকে খুঁজতে এসেছে। তার সাথে এক বার দেখা করে চলে যাবে। কিন্তু, কার সাথে দেখা করতে চায় তার নাম বলল না। শুধু বলে চেহারায় চেনে। গ্রাম থেকে শুনে এসেছে, সে যাকে খুঁজছে সে ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে থাকে। আবার, দেখতে কেমন প্রশ্ন করলে, সরাসরি কোন উত্তর দেয় না।

বাড়ী ঢাকা শুনে অনেকটা ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে যাওয়া হল এরফানের বাসায়। কিন্তু এরফান দু চারটা কথা বলে বিদায় করে দিল। পরিষ্কার করে বলে দিল, দেশী মানুষদের জন্যে তার কাছে কোন বিশেষ ব্যবস্থা নাই।

রহমান তাকে নিয়ে গেল নিজের বাসায়। আদর যত্ন করে বসতে দিল, খেতে দিল। আর বলল, আপনি যত দিন এখানে থাকেন, আমার বাসাতেই থাকবেন। বাঙ্গালী বলল, সে বাউল। গানবাজনা করে। দেশ দেখতে, আর এক জন মানুষ খুঁজতে বেড়িয়েছে। দুই এক দিন থেকে চলে যাবে। রহমান এই বার বলল, আমি তো এখানকার সব বাঙালীদের কম বেশী চিনি। আপনি যদি, যাকে খুঁজছেন তার কথা কিছু বলতেন, তা হলে হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম!

রহমান খবর দিল অন্য বাঙালীদের। বাসার সামনের মাঠে, পরের দিন মহা উৎসাহে আয়োজোন করা হল গানের আসর। বাংলা বাউল গানের। খবর ছড়িয়ে পরল চারিদিকে। আশে পাশের পাঠান, পাঞ্জাবী, বেহারি---সবাই মহা আনন্দে বলল তারাও গানের অনুষ্ঠানে আসবে। মাইক ভাড়া করা হল সবাই যাতে শুনতে পায়। স্টেজ বানানো হল, ইলেকট্রিক লাইন টানা হল।

স্টেজে উঠলো বাংলাদেশের বাউল। এখন তাকে চেনাই যাচ্ছে না। গেরুয়া পোষাক, মাথায় বাউলদের পাগড়ী বাঁধা, হাতে দো তারা। একের পর এক গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে তুললোঃ

আশা পূর্ণ হল না

আমার মনের বাসনা

বিধাতা সংসারের রাজা

আমায় করে রাখলেন প্রজা।

হঠাৎ দেখা গেল এক জন মহিলা এগিয়ে আসছে স্টেজের দিকে। বাঙ্গালী মহিলা, শাড়ি পরা, কপালে বড় টিপ। কিছু মানুষ চিনলো তাকে; পারুল। সৈয়দ এরফান আলির স্ত্রী। গত চার বছর তাকে তেমন একটা দেখা যায় নি।

কিভাবে যেন এরফানের কানে খবরটা পৌছায়, পারুল, রহমান সাহেবের বাসায় বাঙ্গালীদের আসরে আসরে গান গেয়েছে। আর পর পুরুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। প্রয়লঙ্করি কিছু না ঘটলেও, এর পরে পারুলের জন্যে বাইরের জগত একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। মেয়ে পান্নাই তার এক মাত্র সঙ্গি। অবশ্য মাঝে মাঝে এরফানের চাহিদা পূরনের বিষয়টা তো ছিল!!

সবাইকে অবাক করে দিয়ে, মহিলা, বাউলের সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে থাকলো,...

বিধাতা সংসারের রাজা, আমায় করে রাখলেন প্রজা।

স্টেজের পাশে সৈয়দ এরফান আলিকে দেখা গেল। কট-মট করে তাকিয়ে আছে স্ত্রী পারুলের দিকে। চোখ মুখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে।

আবার দু জনে হারিয়ে গেল সুরের জগতেঃ

দেখ না মন ঝকমারি এই দুনিয়াদারি

পড়িয়ে কোপনি ধ্বজা কি মজা উড়ালো ফকিরি ।।

প্রাণ বাউল গান গাইছে পারুলের দিকে তাকিয়ে। চোখের ভাষায় বলছে, বলেছিলাম না একদিন আমি গায়ে বাউলের গেরুয়া পোষাক পরে তোমার সামনে যেয়ে দাঁড়াবো। । তোমাকে তখন আরেক বার আমার সাথে গান গাইতে হবে। তার পরে আমার মরে গেলেও কোন কষ্ট থাকবে না।

প্রাণ আর পারুল শেষের গানটা ধরলো। গানটা আগে কখনা পারুল প্রানের সাথে গায় নি। কিন্তু, আরও কিছু মানুষের সামনে তিন বার গানটা গেয়েছে।

যে গানটা গাওয়ার জন্যে বাইরের পৃথিবীর আলো বাতাস তার নিষিদ্ধ হয়েছে ঃ

বাড়ির পাশে আরশী নগর

সেথা পরশী বসত করে।

এক পরশী বসত করে।

আমি একদিন না, দেখিলাম তারে।।

জুলাই ৩০, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com

www.facebook.com/lekhaleki