পঠন, জ্ঞান- বিজ্ঞান এবং মুসলমান

জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া কি একটা জাতি এগুতে পারে? প্রশ্নটা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। কারণ এর উত্তর সবার-ই জানা। শুধু এগুনো কেন, টিকে থাকতে হলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরকার। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক --সব কিছু হওয়ার জন্যে শিক্ষা নিতে হয় বা জ্ঞান আহরণ করতে হয়। জ্ঞান আহরণের প্রধান উপায় কি? সেটা অবশ্যই পঠন বা পড়া। জানতে হলে পড়তে হবে, না পড়লে জ্ঞানের খোঁজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এখন আমরা একটু পরীক্ষা করে দেখি, পঠন বা পড়া এবং জ্ঞান আহরণ সম্পর্কে ইসলাম ধর্মের দিক নির্দেশনা কী।

ইসলাম ধর্মে বলা হচ্ছে, জ্ঞান আহরণের জন্যে প্রয়োজনে চীন পর্যন্ত যাও। এই কথাটার মধ্যে একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। এক, নিজের সমাজের মধ্যে প্রচলিত জ্ঞান নিতে হবে। দুই, জ্ঞান বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনে দূর দেশ তথা চীনে পর্যন্ত কষ্টকর ভ্রমণ করা আবশ্যক। তিন, চীনাদের ভাষা শুধু ভিন্ন না; তাদের ধর্ম বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিও একেবারে অন্যরকম। প্রয়োজনে তাদের ভাষা শিখে, বিধর্মীদের কাছ থেকে জ্ঞানের তালিম নিতে হবে।

হেরা পর্বতের গুহায় নবী করিম (দঃ) কে মহান আল্লাহ তা’ আলার দূত ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) বললেন, “পড়ুন”। আমাদের রাসুল (দঃ) হতবিহবল হয়ে পড়লেন। তিনি কিভাবে পড়বেন, তিনি তো নিরক্ষর। জিবরাইল (আঃ) কথাটা তিনবার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, “পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে পড়ুন, যিনি আপনাকে এক দলা রক্ত থেকে বানিয়েছেন। পড়ুন, আপনার প্রভুর জন্যে, যিনি সব চেয়ে বেশী উদার, যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দেন, মানুষ যা জানে না, তাকে তাই শিক্ষা দেন।” (সুরা আল-আলাকঃ ১-৫)।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছ থেকে, সমগ্র মানব ও জীন জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম যেই ওহি বা বাণী এসেছে, তা হল “পড়”। ইসলাম ধর্মকে জানতে, বুঝতে ও পালন করতে হলে পড়ার কোন বিকল্প নাই। বদরে মুসলমান জাতির ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হয়েছিল এবং বেশ কিছু পড়ালেখা জানা কুরাইশদের মুসলমানরা হাতে বন্দী হয়। আমাদের নবী (দঃ) শর্ত দিয়েছিলেন, বন্দীদের কেউ যদি নিরক্ষর মুসলমানদের পড়া লেখা শেখায়, তা হলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে।

স্পষ্টতই আমরা বুঝতে পারছি, ইসলাম ধর্মে, পড়া তথা জ্ঞান আহরণকে খুব বড় আসন দেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে, পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরিফ পড়ার সর্বোচ্চ তাগিদ দেয়া আছে। কারণ মানুষের জীবন ধারার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা এখানে লিপিবদ্ধ। সাথে সাথে আছে জীবন ধারণের প্রতিটি পদক্ষেপের দিক নির্দেশনা। বর্তমানে, পৃথিবীর বেশীর ভাগ বড় ভাষায় কোরআন শরিফ অনুবাদ করা হয়েছে। সে জন্যে আরবি না জানার কারণে, কোরআন শরিফ না পড়া ও বুঝার চেষ্টা না করার যুক্তি ধোপে একেবারেই টিকে না।

কোরআন তেলাওয়াতে বা সুর কর পড়ার মধ্যে ফজিলত আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশী জরুরী, অর্থ বুঝে পড়ে জ্ঞান লাভ করা এবং সেই হিসেবে চলা। নবীজি (দঃ) বলে গেছেন, “যারা সুন্দর করে কোরআন তেলাওয়াত করে তারা ফেরেশতাদের মতো, কিন্তু যারা শ্রম করে, কষ্ট স্বীকার করে পড়ে, তাঁদের পুরস্কার দ্বিগুণ হয়ে যায়।” (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)

শুধুমাত্র কোরআন শরিফ পড়ার মধ্যে জ্ঞান আহরণ সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কোরআন শরিফকে অনুধাবন করতে হলে হাদিস জানতে হবে, জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ছড়িয়ে পড়তে হবে। মানুষের কল্যাণ আছে, এমন সব বিষয় পড়তে হবে, জ্ঞান আহরণ করতে হবে। এক সময়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে মুসলমানরা ছিল পৃথিবীতে সবার থেকে এগিয়ে। জ্ঞান আহরণের সাথে সাথে, ইসলাম ধর্মের বিধান হলো, সেটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া।

শেষ বিচারের দিন, আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহ তা আলার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে হবে। তখন কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। কৃত কর্মের দায় ভার নিজেকেই নিতে হবে। এই জন্যে আমরা সরাসরি তাকেই বলি, ‘আমাদের সরল পথের ঠিকানা দিন’ (সুরা ফাতেহা)। আমরা বিশ্বাস করি, এই কাজটা একমাত্র তিনি-ই করতে পারেন। নিজে পড়লে ও বুঝলে তবেই না আমরা সরল পথ চিনতে পারবো।

নিজে না পড়ে, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটা ইসলাম সমর্থন করে না। কোরআনের কোন অংশ বুঝতে কষ্ট হলে, আমরা যারা জ্ঞানী, তাঁদের সাহায্য নিতে পারি। কিন্তু, এমন হতে পারবে না, আমরা শুধুমাত্র তাদের থেকেই জানবো; নিজের কোন চেষ্টা থাকবে না। অজ্ঞতা কোন অজুহাত হতে পারে না। নিজের প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যাতে বক্তা আল্লাহ’র কোন বাণী বিকৃত করলে, সেটা আমরা ধরতে পারি। আমাদের শিক্ষক থাকবে, কিন্তু আমাদের যাতে কেউ কু-শিক্ষা দিয়ে মতলব হাসিল করতে না পারে, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি ও বুঝার ক্ষমতা থাকতে হবে।

বর্তমান যুগে, যুব সমাজের একটা অংশ, নিজেরা আল্লাহ’র পাঠানো পবিত্র কোরান শরিফ না পড়ে, কথিত জ্ঞানী কিংবা নেতার ব্যাখ্যা শুনে সরল পথের জায়গায় বিপথে চলে যাচ্ছে। বিধ্বংসকারী, সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ঝুঁকে পড়ছে, যেখানে কি-না আল্লাহ তা আলা পরিষ্কার বলেছেন, “একটা খারাপ কাজের উত্তরে, আরেকটা খারাপ কাজ করা যাবে না।”

ইদানীং কালে ধর্মের নামে সারা পৃথিবীতে যে হানাহানি-খুনোখুনি চলছে ইসলাম তাকে কোনভাবেই সমর্থন করে না। আত্মঘাতী হয়ে অন্যের ক্ষতি করার যে উদাহরণ দেখতে পারছি সেটা অবশ্যই সবচেয়ে গর্হিত কাজ। যুব সমাজ একেবারে ভুল ধারণা নিয়ে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। তারা মিথ্যা আশা নিয়ে জীবন দিচ্ছে, যে মারা যাওয়া মাত্রই তারা বেহেশতে প্রবেশ করবে। এইটা কোন ক্রমেই সম্ভব না। বরং উল্টোটা হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা। কারণ মহান আল্লাহ তা’ আলা সুরা মাইদায় (৫: ৩২) খুব জোরালো ভাবে ঘোষণা করেছেন, কেউ যদি অন্যায়ভাবে একজনকেও খুন করে, তা হলে ধরা হবে, সে সমগ্র মানব জাতিকে খুন করেছে।

আমাদের প্রিয় নবী (দঃ) বলে গেছেন, পুরুষ ও মহিলা, প্রতিটা মুসলমানের জন্যে জ্ঞান অন্বেষণ করা বাধ্যতামূলক। এইটা কিন্তু আবার সীমিত কোন সময়ের জন্যে না। তিনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, দোলনা থেকে আরম্ভ করে কবর পর্যন্ত আমাদের জ্ঞান চর্চা করতে হবে। তিনি আরও জানিয়ে গেছেন, যে জ্ঞানের সন্ধানে বের হয়, সে আল্লার’র পথে চলে। এই জ্ঞানকে ব্যবহার করতে হবে নিজের ও মানব জাতির কল্যাণের জন্যে। যা মানুষের ক্ষতি করে, সেটা কোনোভাবে জ্ঞান হতে পারে না। বরং সেটা নিছক স্বার্থ উদ্ধারের কৌশল।

শেষে আল্লাহ তা’ আলার শিখিয়ে দেয়া, সুরা তাহা (২: ১১৪) থেকে নেয়া ছোট একটা দোয়া স্মরণ করছি, “রাব্বি জিদনি ইলমান--ও আমার প্রভু, আমাকে জ্ঞানে উন্নত করুন।” সাথে সাথে এইটাও যোগ করতে চাই, ‘আমরা যেনো সব সময় জ্ঞান বৃদ্ধি করার জন্যে কাজ করতে পারি, যার থেকে নিজের ও অন্যের উপকার হয়’। আমিন।

জুলাই ৩, ২০১৬

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com