উড়ে যায় রঙিন ফানুস

সারি সারি কর্মচারীদের কিউবিকাল। অফিসের এই দিকটায় আমার তেমন একটা আসা হয়নি। অবশ্য এখানে আমাকে নতুন-ই বলা যায়। মাত্র কিছুদিন আগে কোম্পানিতে জয়েন্ট করেছি।হাঁটছি আর কিউবিকালের বাইরের দেয়ালে কর্মচারীদের নাম লেখা যে বোর্ডগুলো আছে, সেগুলো পড়ে চলেছি। দেশে থাকতে দোকানের সাইনবোর্ড পড়াটা একেবারে অভ্যাসের মতো ছিল। সেটা কখনো হতো চলন্ত বাসের জানালা থেকে কিংবা পায়ে হেঁটে চলার সময়ে। যাই হোক হাঁটছি আর নামগুলো পড়তে পড়তে এগুচ্ছি। এমেরিকানদের নামের তেমন বেশি কোনো বৈচিত্র থাকে না। পুরুষ হলে জন, টম, রিচার্ড, মাইকেল জাতীয় নাম। মহিলাদের মেরী, টম, শেরী, লুসি ধরণের নাম। কিন্তু লাস্ট নেমগুলো নানা রকম হয়ে থাকে। যাই হোক এদের নামগুলোর সাথে মনে মনে বাঙালিদের নামের তুলনা করে চলছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একটা নামে এসে চোখটা থমকে গেল। এ কি করে সম্ভব?

বোর্ডটার মধ্যে লেখা ‘পারভিন সুলতানা’। একেবারে বাঙালি নাম। বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোথাও মেয়েদের ঠিক এ রকম নাম হয় বলে আমার জানা নাই। খুশি হলাম। মোটামুটি নিশ্চিত হলাম এই কিউবিকালে একজন বাঙালি বসে। শুধু তাই না এটা একটা বাঙালি ললনার আসন। মনে একটা ফুরফুরা ভাব চলে এলো। একজন বাঙালি সহকর্মী পাওয়া গেছে। সারাক্ষণ ইংরেজিতে বকবক করতে অনেক সময় ক্লান্তি আসে। এখন চাইলে দু চার মিনিট বাংলায় কথা বলে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে নিজের কাজে ফিরতে পারবো। হাতে যেহেতু কিছুটা সময় ছিল, ভাবলাম আজকেই না হয় পরিচিত হয়ে যাই। কিন্তু কিউবিকালের ভিতরে উকি দিয়ে যার পর নাই অবাক হলাম। একজন অতীব সুন্দরী নারী সেখানে বসে আছে ঠিকই; কিন্তু তার চুল সোনালী এবং সে শ্বেতাঙ্গ। এ কি করে সম্ভব? এই মেয়ের নাম কিভাবে পারভিন সুলতানা হবে?

এক সময়ে বাঙালিদের ঘর কুনো বলা হতো। নিজের পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে থাকতেই ছিল স্বাচ্ছন্দ্য। উর্বর মাটির ফলন এবং গান, কবিতা ও প্রকৃতি নিয়ে বেশ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আসার পর পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ব্রিটিশদের অত্যাচারের সাথে বাঙালি সমাজে অভাব ও দুর্ভোগ এসে ঠাঁই নেয়। কিছু সুযোগ সন্ধানী সৌভাগ্যবান বিদেশী শাসকদের কৃপা দৃষ্টি পেয়ে বিত্তবানে পরিণত হয়। ইতিহাস বলে সেই সময় থেকেই প্রথম বাঙালিরা সাত সাগর পাড়ি দেয়া আরম্ভ করে। বিত্তবানদের সন্তানরা উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশ যাওয়া আরম্ভ করলো। বেশ কিছু দরিদ্র পরিবারের বাঙালি ছেলে বিলেতি জাহাজে চাকরি নেয়। সে সময়ে জাহাজে শ্রমিকদের একেবারে দাসদের মতো অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হতো। কাজে সামান্য গাফিলতি করলে ভয়ঙ্কর শাস্তি দিতো। সে জন্যে জাহাজ বন্দরে নোঙ্গর করলে এই শ্রমিকরা পালানোর চেষ্টা করতো। জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে সাঁতরে ডাঙ্গায় যেয়ে উঠতো। ধারণা করা হয় এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু বাঙালি লন্ডন যেয়ে আবাস গেড়েছিল। একইভাবে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারের দেশ এমেরিকার কয়েকটা বন্দরে জাহাজ থেকে বাঙালিরা লাফ দিয়েছিল।

ভালো করে দেখে নিলাম কোনো ভুল হচ্ছে না তো। আমি কি নাম পড়তে ভুল করেছি না-কি ভুল কিউবিকালে উঁকি দিয়েছি। মুহূর্তেই একই কাজ কয়েকবার করে ফেললাম, নেম প্লেটে নামটা পড়লাম ও মহিলাটার দিকে তাকালাম। উত্তর নেগেটিভ। আমার পড়া ও দেখার মধ্যে ভুল নাই। তা হলে বিষয়টা কি হতে পারে? একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার নাম পারভিন সুলতানা! অপরিচিত একজনের কিউবিকালের সামনে অপ্রয়োজনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা একেবারে শোভন না। ভদ্র মহিলা কিংবা অন্য কেউ আমার কর্মকাণ্ড খেয়াল করলে কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার হবে। আমি আমার কিউবিকালের দিকে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু মাথার থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। ভাবলাম পরিচিত সহকর্মী যারা আছে তাদের কাছে জানতে চাইবো। দেখি তারা কেউ আমাকে মহিলাটার বিষয়ে কিছু বলতে পারে কি-না। কিন্তু পরের মুহূর্তে মনে হলো, কাজের জায়গায় অন্যের বিষয়ে নাক গলানোটা কোম্পানি ভালো চোখে দেখে না। শেষে আমার কৌতূহল মেটাতে যেয়ে ঝামেলায় না পড়ে যাই।

১৮৮৭ সাল থেকে সংখ্যায় নগণ্য হলেও বাংলাদেশ থেকে মানুষেরা যুক্তরাষ্ট্রে আসা আরম্ভ করে। সে সময়কার ইমিগ্রেশন নিয়ম কানুন শুধু ইউরোপের শ্বেতাঙ্গদের এমেরিকায় আসতে উৎসাহিত করতো। ১৯০৫ সালে বঙ্গ-ভঙ্গের পর পর দু বঙ্গের বেশ কিছু যুবক ইংরেজদের রোষানল থেকে বাঁচতে দেশটায় এসে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই-ই ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে এদের বেশীর ভাগই পশ্চিম উপকূলের সান-ফ্রান্সিসকো, অরেগন, এবং ওয়াশিংটন এলাকায় বসত গাড়ে। সে সময়কার একটা মজার ঘটনা বলি। তারাকনাথ দাস নামে একজন ছাত্র একটিভিষ্ট কোর্টে যেয়ে দাবী করেন, নৃ-বিজ্ঞানীদের (anthropologists) সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি শ্বেতাঙ্গ (Caucasian) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তাকে এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেয়া হউক। তারাকনাথকে অনুসরণ করে আরও কিছু ভারতীয় সে সময়ে নাগরিকত্ব পেতে সমর্থ হয়। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি না থাকায় এইসব বাঙালিরা মেক্সিকান ও কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের সাথে সংসার আরম্ভ করে। ১৯৪৬ সালে এমেরিকার নাগরিকত্ব সবার জন্যে খুলে দেয়া হয়।

পারভিন সুলতানাকে নিয়ে চিন্তা মাথার থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। পরিচিত কয়েকজন সহকর্মীকে সরাসরি প্রশ্ন না করে জনাতে চাইলাম, তারা পারভিন নামে কাউকে চিনে কি-না। কারোর কাছে তেমন কোনো তথ্য পেলাম না। ভাবলাম অনলাইনে কিছু গবেষণা করবো। ফেসবুকে সার্চ দিতেই মেলা প্রচুর পারভিন সুলতানা খুঁজে পেলাম। তাদের বেশীর ভাগেরই আবাস বাংলাদেশ কিংবা ভারতে। অবশ্য কিছু অন্যান্য দেশেও থাকে। এক এক করে ওদের ছবি দেখলাম। কিন্তু যার ছবি খুঁজছিলাম, তাকেই পেলাম না। বেশ হতাশ হলাম। তা হলে এখনকার দিনে ফেসবুকে একাউণ্ট ছাড়াও মানুষ আছে। ভাবছিলাম আর কি করা যেতে পারে? মনে আসলো লিঙ্কড-ইনের (LinkedIn) কথা। এইবার আশাহত হতে হলো না। পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেলিনা পারভিনকে। প্রবল উৎসাহ নিয়ে তার সম্পর্কে যা যা তথ্য আছে, সব এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে কোনো সম্পর্কে আছে কি-না, তার কোনো উল্লেখ পেলাম না। আসলে এ রকম তথ্য থাকার কথাও না। লিঙ্কড-ইনে শিক্ষা ও চাকরিগত অভিজ্ঞতা লেখা থাকে। পারভিন সুলতানার বেলায় কোনো ব্যতিক্রম হয় নি। নিজের পণ্ডশ্রমে নিজের উপরই বিরক্ত হলাম।

১৯৭৫ সাল বাংলাদেশর ইতিহাসে একটা ভয়াবহ দিন। ১৫ ই আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে খুন করা হয়। এর আগে এক দলীয় শাসন চালু হয়েছিল। বিরোধীদল বিলুপ্ত করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর পরই বেশ কিছু বাঙালি যুবক জার্মানিতে যেয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা নাই এমন মানুষও যেয়ে বলেছে, যে দেশে তাদের জীবনের হুমকি। বাংলাদেশে থাকলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলা হবে। সেই সময়ে এক রঙ্গাত্মক ঘটনা বলি। বয়সে নবীন এমন একজন এসে বলল যে সে বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখার প্রধান। পরের দিন আরেকজন এসে দাবী করলো, সেও একই দলের ছাত্র শাখার প্রধান। জার্মান ইমিগ্রেশন বুঝতে পারলো না, আসলে বিষয়টা কি। দু জনকে সামনা-সামনি করা হলো। চতুর দু জন বুঝে ফেললো বিষয়টা কি এবং চোখে চোখে তারা শলা করে ফেললো। তারা জানালো, একজন দিনে ও অন্যজন রাতে শাখা প্রধানের দায়িত্ব পালন করে। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের সামান্য কিছু ভাতা দেয়া হতো। কিন্তু জার্মান ভাষা না জানা থাকায় কাজ কর্ম নিয়ে বেশী আয়-রোজগার করা কঠিন ছিল। তাদের কাছে খবর আসে এমেরিকার কথা। সেখানে ইমিগ্রেশন আইন বেশ শিথিল। বৈধভাবে বসবাসের নানা উপায় আছে। সে সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি তরুণ জার্মানি থেকে এমেরিকায় পাড়ি জমায়।

শ্বেতাঙ্গ মেয়ের বাঙালি নাম কিভাবে হতে পারে, সেই চিন্তা হাজার চেষ্টা করেও মাথার থেকে তাড়াতে পারলাম না। কাছের এক জ্ঞানী-গুণী বন্ধুকে বিষয়টা জানালাম। সে প্রথমে বলল, “এইটা কি কোনো ব্যাপার। মার্কিনীদের অনেক উদ্ভট ব্যাপার মাথায় চলে আসে। হয়তো মেয়েটার বাপ অথবা মায়ের কোথাও এই নামটা দেখে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তার থেকে এ রকম নাম করণ হয়েছে।” উত্তরটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো না। একবার এক মহিলার আমার নাম শুনে খুব পছন্দ করেছিল। সে আমার নামটা কাগজে টুকে নিয়ে বলেছিল, সে আমার নামে তার ছেলের নাম করবে। কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমার গোত্র-বর্ণ যে একেবারে ভিন্ন সেটা নিয়ে বিন্দু মাত্র চিন্তা করতে দেখলাম না। অবশ্য বলছি না সবাই একই রকম। কিন্তু বন্ধুটাকে জানলাম যে মনে হচ্ছে এর পিছনে কোনো ইতিহাস আছে। সে আমার আগ্রহকে অমুলক বলে উড়িয়ে দিতে চাইলো। আমি আমার ধারণা এতো সহজে ফেলে দিতে রাজী হলাম না। আমি পরিষ্কার বললাম আমার এর প্রকৃত কারণটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছে না। জ্ঞানী বন্ধু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো, “বেল পাকলে কাকের কি?”

আশির দশকে বাঙালি ছাত্রদের ব্যাপক হারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়া আরম্ভ হয়। সে সময়ে বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি ছিল মাত্র একটা আর মেডিকেল কলেজ ছিল গোটা ছয়েক। যারা দেশে এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারতো না এবং ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নও তাড়াতে পারতো না, তারা এমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে উঠে-পড়ে লাগতো। ইংরেজিতে পারদর্শিতা প্রমাণের জন্যে টোফেল পরীক্ষা দিতে হতো। এমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে I-20 আসার পর এম্বেসিতে ভিসার জন্যে দাঁড়াতে হতো। ওকলোহোমা অঙ্গরাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ছাত্র এডমিশন বিভাগের প্রধান বাংলাদেশে খাবার খুব পছন্দ করতেন। প্রথম দিকে যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল তারা এই ভদ্রলোককে পোলাও-বিরানি রান্না করে খাওয়াতেন। এতে ভদ্রলোক মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশের হবু ছাত্রদের প্রচুর পরিমাণে I-20 পাঠিয়েছিলেন। সে সময়ে বিদেশে যাওয়া এবং পড়া-লেখার খরচ জোগান দেবার মতো সামর্থ ছিল এমন পরিবার বাংলাদেশে বেশী ছিল না। বিদেশ যাবার জন্যে মরিয়া হওয়া ছাত্ররা ভুয়া ব্যাঙ্ক-স্টেটমেন্ট ও অন্যান্য কাগজ পত্র বানানো আরম্ভ করে। এমেরিকান এম্বেসি সে সময়ে সচেতন ছিল না যে বাংলাদেশে এও সম্ভব।

সুযোগ পেলেই পারভিন সুলতানা যেদিকে বসে তার আশে পাশে চক্কর দিয়ে আসি। কোনভাবে যদি চোখাচোখি হয়ে গেলে আলাপ পরিচয়ের একটা সুযোগ যদি তৈরি হয়। এর মধ্যে আমি লিঙ্কড-ইন থেকে নিশ্চিত হয়েছি, সোনালী কেশের সুন্দরীর কিউবিকালে নেম প্লেটে তার-ই নাম। আমি একবার ভেবেছিলাম, হয়তো নেম প্লেটে আগে ওই কিউবিকালে যে বসতো তার নামটা বদলানো হয় নি। সেই চিন্তাটা ইতিমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এতে শ্বেতাঙ্গ মেয়ের বাঙালি নাম হওয়ার রহস্যটা ভেদ করার জন্য আমার জেদ আরও বেশী পোক্ত হলো। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি এর মধ্যে কোনো বিশেষ গল্প আছে। কিন্তু কাজটা আমার পরিকল্পনা মতো এগুচ্ছিল না। যাকে নিয়ে আমার এতো প্রচেষ্টা সে মনে হয় সারাক্ষণ কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। চোখ দুটো কম্পিউটার মনিটরে আঠার মতো লাগা। কয়েকবার ভেবেছি এক্সকিউজ মি বলে কথা চালু করে দিবো। না তাতে মেয়েটা আবার কি না কি ভেবে আসে। তা ছাড়া এক্সকিউজ মি বলার পর সে যখন আমার দিকে তাকাবে, তখন কি বলবো? সে বিরক্ত হলে আমার কৌতূহলের কি হবে? কোন মুখে জিজ্ঞাসা করবো, তোমার নাম পারভিন সুলতানা হলো কি করে।

তরুণ বাঙালিরা এমেরিকায় এসে নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দু এক সেমিস্টার যেতে না যেতেই দেশের থেকে আনা টাকা শেষ হয়ে যায়। এখন তাদের নিজের ভরণ-পোষণ ও স্কুলের টিউশনের খরচ যোগাড় করতে হবে। তাদের কাজ করে আয় করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। চাকরি পাওয়াটা তেমন কঠিন না। কিন্তু কাজগুলো ছিল ফাস্ট ফুড, রেস্টুরেন্ট জাতীয় ব্যবসায় অল্প আয়ের। এতে খাওয়া-দাওয়া চললেও, কলেজের টিউশনের টাকা উঠানো ছিল খুবই কষ্ট কঠিন। মাত্র অল্প সংখ্যক ছাত্র দুটো-ই সামাল দিয়ে পড়ালেখা শেষ করে গ্রাজুয়েশন করতে পেরেছিল। বাকিরা শুধুমাত্র কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এদের বিদেশে থাকার শর্তই ছিল যে কলেজে ফুলটাইম ছাত্র হিসেবে থাকতে হবে। পড়ালেখা শেষ করতে হবে। না হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওদের অবস্থান অবৈধ হয়ে যাবে।

আমি আমার অনুসন্ধান এগিয়ে নেবার নতুন কোনো রাস্তা খুঁজে পেলাম না। আমি এমনিতেই গল্প প্রিয় মানুষ। সাধারণত আমি কোথাও কাহিনীর হদিস পেলে সেটা ভুল হয় না। আমি পারভিন সুলতানার নামের সাথে যে একটা গল্প জড়িয়ে সে নিয়ে আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা নাই। এর মধ্যে মাস খানেক পার হয়ে গেছে। রহস্য ভেদ করার মতো কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না। সুযোগ পেলেই ওই দিকটা ঘুরে আসি। কিন্তু যথারীতি তাকে দেখি গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করে চলেছে। বেশ কয়েকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সাহস করে যেয়ে হাই হ্যালো বলে কথা আরম্ভ করি। তার পরে কথোপকথন কিছু দূর এগুলেই আমার কৌতূহলের কথা জানাব। কিন্তু না, একেবারে কিউবিকালটার কাছাকাছি যেয়েও কাজটা শেষ পর্যন্ত করা হয়ে উঠে নি। সেদিন ছিল শুক্রবার। লাঞ্চের পর থেকেই সবার মধ্যেই একটা ঢিলে-ঢালা ভাব কাজ করছিল। সাধারণত অফিসের কর্মচারীরা সময়টাতে উইক এন্ড কিভাবে কাটাবে সেটা নিয়ে কথা-বার্তা বলে। আমি তেমন কিছু না ভেবে পারভিন সুলতানার কিউবিকালে উঁকি দিলাম। আমার বিস্ময়ের চূড়ান্তটা হলো। দেখলাম সে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই মুচকি হেসে বলল, “আমি জানতাম তুমি আসবে।”

ভিন দেশে অবৈধ হলে নানা সমস্যা। চাকরিতে কম বেতন দিয়ে মালিকরা ঠকায়। পুলিশ থেকে পালিয়ে থাকতে হয়। ধরা পড়লেই মহা বিপদ। জেল, মামলা এবং শেষে বহিষ্কার। বৈধ হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এমেরিকান নাগরিক বিয়ে করা। কিছু মার্কিন মহিলা এখানে ব্যবসার সুযোগ খুঁজে পায়। তারা টাকার বিনিময়ে বিদেশীদের পেপার-ম্যারেজ মানে কাগজে কলমে বিয়ে করা আরম্ভ করে। পাত্র বৈধ হওয়ার কাগজ-পত্র হয়ে গেলেই এই সব বিয়ের পরিসমাপ্তি ঘটতো। অবশ্য কিছু ছেলে এমেরিকান সুন্দরীদের প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিল। এতে এক ঢিলে দু পাখি মারা সম্ভব হয়েছিল। এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে থাকার অনুমতি হয়েছিল এবং তাদের প্রেম সফলতার মুখ দেখেছিল। বিয়ে ছাড়াও নানাভাবে বাঙালিরা মার্কিন দেশে থাকার গ্রিন কার্ড পাওয়ার পথ বের করেছিল। অল্প কিছু সংখ্যক বাঙালিদের তাদের চাকরি দাতার মাধ্যমে বৈধতার কাগজপত্র বানাতে পেরেছিল। আরও কিছু বাঙালি টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসে সত্য মিথ্যা কাহিনী ফেঁদে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে সক্ষম হয়। তবে ব্যাপক সংখ্যক বাঙালি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্রেশনের অপি এবং ডিভি লটারির মাধ্যমে এসে এমেরিকায় বসবাস আরম্ভ করে। বর্তমানে এমেরিকায় বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না।

আমি উত্তরে একটু হাসি মুখ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আশাতীত ঘটনা ঘটে যাওয়াতে আমার স্বাভাবিক হাসি মুখ কোথায় যেনো হারিয়ে গেল। মনে হচ্ছিলো যে কেউ আমার অপ্রস্তুত ভাবটা ধরতে পারবে। পারভিন আমার অবস্থা ঠিকই বুঝে ফেললো। একগাল হেসে বলল, “মেয়েদের চোখ, শুধু সামনে না চারিদিকেই থাকে। তুমি আমার কিউবিকাল আশে পাশে যতবার এসেছ, আমি ততবারই তোমাকে দেখেছি। তুমি যে আমাকে নিয়ে গবেষণা করছো, সেটাও জানি। লিঙ্কড ইন আমাকে নোটিফিকেশন দিয়েছে, যে তুমি আমার প্রোফাইল দেখেছো।” আমার মাথাটা কেমন একটা ঝিম মেরে উঠলো। HR এ রিপোর্ট করে দিলে আমি ঝামেলায় পড়ে যাবো। মানুষজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আমি না-কি এক মহিলা সহকর্মী আশে পাশে ঘুরঘুর করি। মেয়েটা হাসি মুখে কথা বলেছে। তার মানে হলো আমার উপর সে বিরক্ত হয়ে নাই। ওকে কাছের থেকে দেখতে আরও ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। কি সুন্দর মিষ্টি গলার আওয়াজ, “শুনো আগামী সোমবার না হয় আমরা একসাথে লাঞ্চ করি। আমার মা বলেছে বাঙালি ছেলেরা খুব লাজুক হয়। ওদের বুক ফাটে তো মুখ খুলে না। সে জন্য যেটা তোমার অফার করার কথা সেটা আমি-ই করছি।”

এখনকার দিনে এমেরিকার বড় শহরগুলোতে চোখ ঘুরালেই ভারত উপমহাদেশ থেকে আসা মানুষ চোখে পড়ে। কিন্তু আশি কিংবা নব্বুইয়ের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত দৃশ্য কিন্তু এ রকম ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা মানুষদের ব্রাউন বলে। অনেকটা গায়ের চামড়ার কারণে এ রকম নামকরণ হয়েছে। এই ব্রাউন যুবকদের প্রতি এমেরিকান তরুণীদের বিশেষ আগ্রহ কাজ করতো। তাদের ধারণা ছিল, ব্রাউন ছেলেরা বিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এখানকার মেয়েরাও শত অস্থিরতার মধ্যে বেড়ে উঠলেও সংসার জীবনে তারাও স্থায়িত্বের স্বপ্ন দেখে। এমেরিকায় বেড়ে উঠা যুবকরা এ ধরণের অঙ্গীকার সহজে করতে চায় না। কিংবা অঙ্গীকার করলেও রক্ষা করে না। বলতে গেলে অনেকটা সেই কারণেই বাঙালি ছেলেদের গার্ল ফ্রেন্ড যোগাড় করা ও বিয়ে করতে বেশী কাঠ-খড় পুড়াতে হতো না। কিন্তু যাদের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের কাগজ-পত্র তৈরি করাই মূল লক্ষ্য ছিল, তারা স্থানীয় মেয়েদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিয়ে করেছিল। আরেক দল শঠতার আশ্রয় না নিয়ে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করেছিল। মার্কিন কর্তৃপক্ষ কিছুদিনের মধ্যেই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের কারচুপি জেনে ফেলে। এই ধোঁকাবাজি ঠেকানোর জন্যে ইন্টার্ভিউতে দু পক্ষকে ইমিগ্রেশন অফিসাররা এমন সব প্রশ্ন করা আরম্ভ করে যার উত্তর একমাত্র বিবাহিত দম্পতির পক্ষেই দেয়া সম্ভব।

শনি, রবি আমার প্রচণ্ড উত্তেজনার মধ্যে কাটলো। আমার গবেষণা শিঘ্রি ফলাফল পেতে যাচ্ছে। কিন্তু মনটা তর সইতে পারছিল না। পারভিন থেকে ওর ফোন নম্বর চাইলেই পারতাম। কিন্তু এইটা হয়তো ঠিক হতো না। প্রথম পরিচয়ে মোবাইল নম্বর চাইলে কি না কি মনে করে বসে। একবার এক উপন্যাসে পড়েছিলাম, বাংলাদেশের কোন এক অজ পাড়া গায়ে শ্বেতাঙ্গ কন্যা বাচ্চা নিলো। বাবা-মা দু জনেই হত দরিদ্র। পরিবারের কারোরই শ্বেতাঙ্গ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। অশিক্ষিত গ্রামবাসী ধরে নিলো দেবী জন্ম নিয়েছে। তারা ঘটা করে দেবীর তুষ্টির জন্যে পূজা-অর্চনা আরম্ভ করে দিলো। কিন্তু উৎসাহী এক গবেষক বের করলেন, যে কয়েক পুরুষ আগে পরিবারের কারোর সাথে ইংরেজ রক্তের সংমিশ্রণ হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে বিষয়টা গোপন রাখা হয়। সেই মিশ্রিত রক্তের ধারাবাহিকতায় এবং প্রকৃতির আশ্চর্য ইচ্ছার পরিণতিতে বেশ কয়েক পুরুষ পর সেই শ্বেতাঙ্গ শিশুর আবির্ভাব। কিন্তু এই কাহিনীর সাথে আমার অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু পুরোপুরি মিলে না গেলেও কিছুটা সামঞ্জস্য তো অবশ্যই আছে। একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়ের বাঙালি নাম হলো কি করে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় “ল্যান্ড অফ ইমিগ্র্যাণ্ট”। নেটিভ ইন্ডিয়ান ছাড়া আর সবাই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসেছে। ধর্ম পালনের স্বাধীনতার জন্যে ব্রিটিশরা এখানে আবাস গেড়েছিল। তার পরে অন্যান্য ইউরোপিয়ানরা আসে। আফ্রিকার কালো মানুষদের দাস হিসেবে ধরে নিয়ে আসা হয়। প্রতিবেশী ল্যাটিন এমেরিকার নাগরিকরা উন্নত জীবনের খোঁজে নিয়মিতভাবেই দেশটাতে আসছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের পর বড় সংখ্যার দূর প্রাচ্যের মানুষ রিফিউজি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। জাপানী বংশোদ্ভূতরা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এমেরিকা পশ্চিম উপকূলে থাকছে মেলা বছর ধরে। বলতে গেলে পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশের মানুষ এখানে বসবাস করে। এই দেশের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ থাকলেও এখানে শ্রম ও মেধার মূল্যায়ন বিশ্বের যে কোনো দেশ থেকে বেশী। পৃথিবীর সেরা মাথাগুলোকে গবেষণার জন্যে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়। মেধা, শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের বদৌলতে বর্তমানে এমেরিকাই হলো সব চেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশ। মানব কল্যাণ ও সেবায় মার্কিন জনগণের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

নিজের নিয়মমতোই সোমবার এলো। দুটো দিনকে চেয়েছিলাম ঠেলে দ্রুত এগিয়ে নিতে। নাহ সেটা কোনোভাবেই করা গেল না। তারপরেও সোমবার সকালে মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা প্রথম এলো; সেটা হলো সময়টাকে ‘ফাস্ট ফরওয়ার্ড’ করে লাঞ্চ টাইমে যদি দ্রুত নেয়া যেতো। না সে রকম কিছুই করতে পারলাম না। সময় নিজের মতোই এগুতে লাগলো। সোমবারে কাজের চাপ অন্য দিনের তুলনায় বেশী থাকে। মাথার মধ্যে লাঞ্চ টাইমের চিন্তা নিয়েই অফিসের কাজ এক এক করে করে চললাম। মাঝে একবার পারভিন আমাকে অফিস কম্পিউটারে ‘ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজ’ (চ্যাট) পাঠিয়ে বলল আমি যাতে দুপুর সাড়ে বারোটায় অফিস বিল্ডিঙের লবিতে চলে আসি। আমি উত্তর দিলাম, “অবশ্যই”। মেয়েটাকে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হলো। অফিসে পাড়ায় সাড়ে এগারোটার মধ্যে লাঞ্চ টাইম চালু হয়ে যায়। তখন ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে সিট পাওয়াটা কঠিন। তা ছাড়া শুধু খাওয়া না, আমাকে তো একটা কাহিনী শুনতে হবে। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে কাজের মধ্যে ডুব দিয়েছি, সেটা একেবারেই বুঝতে পারি নি। ঘড়িতে সময় দেখলাম দুপুর ১২.৪৫। কি লজ্জা পারভিনকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি। কোনো রকমে কম্পিউটার লক করে এক দৌড়ে চলে গেলাম লবিতে। দম নিতে নিতে এইদিক ওইদিক তাকালাম। না ওকে কোথাও দেখলাম না। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে চলে গেল! না-কি শেষ মুহূর্তে মত পরিবর্তন করেছে; সে আমার সাথে দেখা করতে আসবে না। তা হলে কি আমার আর পারভিনের নামের ইতিহাসটা আর জানা হবে না?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বাঙালিরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। স্থপতি ও প্রকৌশলী এফ আর খান আবিষ্কার করেছিলেন ৪০ তলার বেশী স্কাইস্ক্র্যাপার বিল্ডিং ডিজাইন ও নির্মাণের প্রক্রিয়া। তার নকশায় ১৯৭৪ সালে নির্মিত শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার (বর্তমান নাম উইলিস টাওয়ার) ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ার ছিল। বাংলাদেশী বাবার সন্তান জাওয়াদ করিম ইউ টিউবের (You Tube) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আরেক বাঙালি সালমান খানের নাম জানে না এমন ছাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিনামূল্যে অধ্যয়নের ওয়েব সাইড ‘খান একাডেমী’ পড়ালেখার ক্ষেত্র সবার জন্যে উন্মুক্ত ও সহজ করেছে। ২০০১ সালে এক শ্বেতাঙ্গ- আধিপত্যবাদী (white supremacist) মার্ক ষ্টরম্যান বাঙালি রইস ভুঁইয়াকে ঠিক মুখের উপর গুলি করে।, আক্রমণকারী মার্কের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলে, রইস তাকে ক্ষমা করে দেবার জন্যে আবেদন করেন। পরবর্তীতে রইস হিংসা মুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলার প্রচেষ্টায় World Without Hate সংগঠন গড়ে তুলেন। বাঙালির ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার ও প্রযুক্তি উন্নয়নে ক্ষমতা আজ বিশ্ববাসীকে অনুপ্রাণিত করছে।

মাথায় আসছিল না কি করবো। মনে হলো আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিৎ। যদি না আসে, তবে ওর কিউবিকালের সামনে থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসবো। যদি সাক্ষাৎ পাই ‘সরি’ বলে দেরী করার জন্যে ক্ষমা চাইবো। এই দিকে সময় দ্রুত পার হচ্ছে। লাঞ্চ টাইম মাত্র এক ঘণ্টার। যদিও ম্যানেজারকে ই-মেইল দিয়ে এসেছিলাম যে ফিরতে দেরী হতে পারে। মিনিট পাঁচেক পরে দেখি পারভিন কারোর সাথে কথা বলতে বলতে আসছে। মাথাটা সাথে সাথেই গরম হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে ওই দেরী করে আসছে। সাথে আবার আরেকজন। এ রকম কোনো কথা ছিল না। সাথের লোকটাও কি আমাদের সাথে যাবে? তৃতীয় জনের উপস্থিত থাকলে আমি আমার প্রশ্নগুলো করবো কি করে? দু জন আমার দিকে আসতে লাগলো। যে কেউ খেয়াল করলে বুঝতো যে আমার মুখ রাগে ফুলে গেছে। পরের মুহূর্তেই আমার ফোলা মুখটা স্বাভাবিক হয়ে হাসি হাসি হয়ে উঠলো। পারভিনের সাথের জন দেখলাম একা একা দরজা দিকে এগুতে লাগলো। তার মানে সে বিদায় নিয়েছে। আর পারভিন আমার কাছে এক গাল হেসে বলল, “কি, কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছো?” মুহূর্তেই মনে হলো এই দেশে দেরী করে কেউ হাসি মুখে আসে না। ওকে লজ্জা দেওয়ার জন্যে বললাম, “পাক্কা এক ঘণ্টা।“ মেয়েটার হাসি আরও বেড়ে গেল, “মশাই মিথ্যা কথা বলো না। আমি জানি বাঙালিরা অফিসের কাজ ছাড়া অন্য সব কাজে দেরী করে আসে। তুমি যে আজকে এর ব্যতিক্রম হবে না, সেটা আমার ভালো করেই জানা ছিল।”

সালটা ১৯৮০। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান জামিল আহমেদ ওকলাহোমার অঙ্গরাজ্যের এক ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে এলো। দেশে বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে পড়ালেখায় তেমন বিশেষ সময় দিয়ে উঠতে পারে নি। ক্লাসে ফেল না করলেও আহামরি রেজাল্ট কখনো হয় নি। কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর আসল সমস্যা হলো। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল থেকে আরম্ভ করে ভালো কোনো জায়গায় সুযোগ হলো না। কিছু বন্ধু-বান্ধবদের মতো সেও এমেরিকা যাওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগলো। এক এক করে সব বাঁধা অতিক্রম করে ঠিকই চলে এলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম সেমিষ্টারে প্রত্যেক সাবজেক্টে ‘এ’ পেলো। নিজের উপর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলো। সে পারবে, সে ঠিকই ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী ব্যাপারটা সেই সময়ে মাথায় খেলে নি। দেশের থেকে আনা টাকা প্রায় শেষের পথে। পরের সেমিষ্টারে দেওয়ার মতো টাকা নাই। দেশে যোগাযোগ করলে কোনো লাভ হবে না। বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ড ভাঙ্গিয়ে এবং সাথে জমানো টাকা যোগ করে প্লেনের টিকিট কিনে দিয়েছিলেন। তিনি পুত্রের হাতে তিন হাজার ডলার দিয়ে বললেন, “বাবারে সর্বস্ব দিলাম। আমাদের পরিবারের মান রাখিস।”

একটা গ্লোবে বাংলাদেশেকে খুঁজে বের করলে, তার ঠিক উল্টো দিকে পাওয়া যাবে এমেরিকাকে। এক জায়গায় যখন রাত, অন্য জায়গায় তখন দিন। বাঙালিরা এতো বিশাল ভৌগলিক দূরত্ব পার করে যুক্তরাষ্ট্রে আসে সোনার হরিণের খোঁজে। কিন্তু ক-জনই বা কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছতে পারে? বেশীর ভাগেরই রুটি ও রুজি নিশ্চিত করতে করতেই জীবন অস্তমিত হওয়ার ঘণ্টা বেজে যায়। আবার কেউবা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় জীবন দুর্বিষহ করে ফেলে। সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত থাকার কারণে দু বাঙালি যাবৎ-জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। এমনকি বাঙালির খুন খারাপীর সাথে যুক্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডও পেয়েছে। কিছু বাঙালি জেলে যেয়ে শাস্তি পেয়ে এসেছে। এ ধরণের মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি সুন্দর- সচ্ছল জীবন খুঁজে পেয়েছে। আবার এই জীবন খুঁজে পাওয়ার পথচলায় মেলা বঙ্গ সন্তানের বিদেশ-বিভুঁয়ে ইহকাল শেষ হচ্ছে। তার মধ্যে মাত্র অল্প কিছু সৌভাগ্যবান লাশ হয়ে দেশের মাটিতে ফিরছে, অন্যদের বিদেশের শক্ত মাটিতে শেষ ঠিকানা হচ্ছে। তবে এই কথা অবশ্যই বলা বাংলাদেশ ছেড়ে যারা এসেছে, তারা সারাটা জীবন বুকের ঠিক মাঝখানে লালন করে ছোটবেলার বাবা-মায়ের আদর ও শৈশবের সেই দুরন্ত দিনগুলো।

বিদেশী ছাত্রদের ১২ ক্রেডিট আওয়ারের নিচে নেওয়ার নিয়ম নাই। চাকরি করলে কিছু আয় হয় কিন্তু তা দিয়ে সব খরচ সামাল দেয়া সম্ভব না। ক্লাস বাদ দিয়ে কাজ বাড়িয়ে কিছু সঞ্চয় করে পরের সেমিষ্টারে ক্লাস নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে স্টুডেন্ট স্ট্যাটাস নষ্ট হয়ে অবৈধ হয়ে যেতে হবে। ইচ্ছা ছিল তাড়াতাড়ি পড়ালেখা শেষ করে বাবার থেকে নেয়া টাকা ফেরত দেবার। দেখতে দেখতে সময় পার হতে লাগলো। টিউশন আর দেয়া হলো না। কলেজের ডর্ম (হোস্টেল) ছেড়ে দিতে হলো। আরও কয়েকজন বাঙালি ছাত্রের সাথে পরিচয় হলো যারা একই সমস্যার ভুক্তভোগী। এ রকম চারজন মিলে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করলো। এদের সবাই দোকানে, রেস্টুরেন্টে কাজ নিলো। ভবিষ্যৎ একেবারে অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ালো। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো অনেক স্বপ্ন নিয়ে এদের বিদেশে পাঠিয়েছিল। ছেলেদের কয়েকজন বাবা-মায়ের কাছে সত্য কথা বলতে পারলো না। চিঠি লিখে জানালো পড়ালেখা বেশ চলছে। কয়েকজন তো আবার মিথ্যা ছবি পাঠিয়ে বুঝাতে চাইলো যে তাদের সব কিছু ঠিক-ঠাক আছে।

জামিল আহমেদের ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন ছিল বলা যায়। এঞ্জেলা রবার্ট কলেজে একই ক্লাসে ছিল। তার সাথে দেখা হয়ে গেল এক সুপার মার্কেটে। এঞ্জেলা নিজের থেকে কথা জুড়লো। জামিল আর ক্লাস নিচ্ছে না শুনে খুব অবাক হলো। দু জনের অল্প সময়ে বেশ অনেক কথা হলো। এবং কথা গড়াতে ও এগুতে থাকলো। এক মাসে মাথায় জামিল এঞ্জেলার এপার্টমেন্টে যেয়ে উঠলো। তিন মাসের মাথায় সিদ্ধান্ত নিলো ওরা বিয়ে করবে। তাতে প্রধান যে সুবিধাটা হবে সেটা হলো জামিলের গ্রিন কার্ড হয়ে যাবে। তখন কলেজে অল্প ক্রেডিট আওয়ার নিলেও কোনো সমস্যা হবে না। একজন আরেকজনকে সাহায্য করলে পড়ালেখা শেষ করে ডিগ্রি নেয়া অনেক সহজ হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না ছিপ-ছিপে গড়নের স্বর্ণ-কেশী এঞ্জেলা ও জামিলের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। দু জন শপথ নিয়ে ফেলেছে সারাটা জীবন বিপদে-আপদে ও আনন্দে পাশাপাশি থাকবে। এঞ্জেলা জামিলকে নিয়ে ওর পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। কঠিন হলেও শ্বেতাঙ্গ পরিবারটা জামিলকে পরিবারে স্বাগতম করলো। কিন্তু সমস্যা হলো জামিল যখন ফোন করে বাবাকে তার বিয়ে করার পরিকল্পনা জানালো।

বাঙালি ছেলে জামিল ও শ্বেতাঙ্গ মেয়ে এঞ্জেলার দাম্পত্য জীবন সুখ ও অর্জনে ভরা ছিল। বিয়ের এক বছরের মাথায় ওদের কন্যা সন্তান হয়। জামিল নিজের মায়ের নামটাই প্রিয় কন্যাকে দেয় “পারভিন সুলতানা”। কিন্তু বেচারা এই খবরটা মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারে নি। কারণ বিদেশী-বিধর্মী বিয়ে করার অপরাধে তাকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছিল। জামিল প্রবাস জীবনের পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রথমে বাবা ও পরে মা’র মৃত্যুর খবর পেয়েছিল। জামিল ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে ও এঞ্জেলা নার্সিঙে ডিগ্রি নিলো। অবশ্য পড়ালেখা শেষ করতে দু জনের-ই বছর তিনেক করে বেশী সময় লেগেছিল। এমেরিকায় এটা কোনো ব্যাপারই না। অনেক বয়স্ক মানুষ পড়ালেখা করতে ফিরে আসে। এর পরের পুরো ৩৫ বছর দু জনে প্রতিটা দুর্যোগ একসাথে মোকাবেলা করেছে। জামিল এঞ্জেলা ও পারভিনকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছে। বিনিময়ে তারাও ভালোবাসার জালে আঁকড়ে রেখেছে জামিলকে। বেচারার দেশে বাবা-মা হারানোর কষ্ট কমাতে মা-মেয়ের প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। দু ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। অফিসের সহকর্মীরা হয়তো টেনশন করছে। লাঞ্চে এতো দেরী হওয়া কথা না। আমি একটু উসখুস করতে লাগলাম। তাকিয়ে দেখলাম পারভিনের চোখ ভরা অশ্রু। ভাবলাম হয়তো এলার্জি। না, অশ্রু টপ টপ করে পড়ছে। এতো সুন্দরী একটা মেয়ের মনে এতো কষ্ট! সে যে কোনো জায়গায় সবার দৃষ্টি কেড়ে নেবার ক্ষমতা রাখে। আর সে কি-না আমার মতো একজন বাঙালের সামনে বসে কাঁদছে। আমি কি করে ওকে একটু স্বস্তি দিতে পারি? এই দেশে কেউ কোনো ব্যাপারে কষ্ট পেল, তাকে জড়িয়ে ধরা বা হাগ (hug) দেওয়াটা একটা রেওয়াজ। কিন্তু সংস্কার এসে আমার মাথায় ভর করলো। কাজটা আমি করতে পারলাম না। পারভিন ওর মোবাইল ফোন বের করে একটা টেক্সট করলো। তারপরে কিছুটা আদেশের ভঙ্গিতে বলল, “তুমি তোমার ম্যানেজারকে টেক্সট করে দাও যে তুমি আজকে আর অফিসে ফিরছো না। তোমাকে আমি এক জায়গায় নিয়ে যাবো।”

এঞ্জেলা ভোর চারটার দিকে হাসপাতালে ডিউটি শেষ করে হাসপাতাল থেকে ফিরছিল। এক মাতাল গাড়ি চালক ঠিক উল্টো দিক থেকে সজোরে আঘাত করে। গাড়িটার একেবারে থেঁতলে যায়। এঞ্জেলার মুখ গাড়ির স্টিয়ারিং উইলের সাথে বারি খায়। উদ্ধার-কর্মীরা যখন গাড়ি কেটে এঞ্জেলাকে বের করে তখন সে পৃথিবীর সব মায়া ছিন্ন করে পরকালে চলে গেছে। তখন পারভিনের বয়স পনেরো । মৃত্যুটা তিন জনের সুখের সংসারটাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিলো। জামিল একসাথে বাবা ও মায়ের দুটো ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। কন্যাকে আদর-সোহাগে বড় করে তুললো। সারাক্ষণ কন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও, মনের মধ্যে ভীষণ শূন্যতা ও কষ্ট কাজ করতো। তার বিশ্বাস ছিল বিদেশী মেয়ে বিয়ে করার কারণে বাংলাদেশে বাবা মা খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং সে জন্যে তাদের দু জনের মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছিল। বিধাতা সে জন্যে তাকে শাস্তি দিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রী এঞ্জেলার মৃত্যু দিয়ে। পারভিন বাবাকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে এইভাবে চিন্তা করার কোনো যৌক্তিক কারণ নাই। কিন্তু শিক্ষিত মানুষের মনও অনেক সময়ে যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় কাজ করে না।

জামিল আহমেদ রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটালেও কন্যার আদর-যত্নের বিন্দু মাত্র কমতি করে নি। পারভিন ধীরে ধীরে স্কুল, কলেজ শেষ করে বিবিএ, এমবিএ করলো। এখন চাকরির বয়স চার বছর হয়ে গেছে। তবে গত তিন বছর ধরে বাবা অসুস্থ। স্ট্রোক করেছিল। বাম পা প্যারালাইসিস ধরণের হয়ে গেছে। পা আর শরীরের ওজন নিতে পারে না। উইল চেয়ারে করেই হাটার কাজটা সারতে হয়। ঘরেই সারাদিন কাটে। পারভিন পুরো বাড়ি, বাথরুম উইল চেয়ার উপযোগী করে দিয়েছে। অনেকে বলেছিল জামিলকে নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দিতে। বাবাও এক পর্যায়ে একই অনুরোধ করেছিল। কন্যা কোনোভাবেই সেই প্রস্তাবে রাজী হয় নি। বাবাকে সে যে কোনো মূল্যে নিজের কাছে রাখবে। এইভাবে চললো বেশ কিছুদিন। এর মধ্যে জামিল মারাত্মক মানসিক চাপ মানে ডিপ্রেশনে ভুগা আরম্ভ করলো। ওষুধ, থেরাপি কোনো কিছুতেই উপকার হলো না। বরং দিনে দিনে খারাপ হতে লাগলো। এক পর্যায়ে ডাক্তাররা ডায়গনসিস করলেন, জামিলের এমনেসিয়া হয়েছে। তার মগজের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্থ (damage) হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকবে। ইতিমধ্যে শর্ট টার্ম মেমোরি কাজ করছে না। এখন বলা যায় মস্তিস্ক কার্যক্রমের শেষ পর্যায় চলছে। লং টার্ম মেমোরির অল্প কিছু মাত্র অবশিষ্ট থাকে। স্মৃতি বলতে এই-ই।

পারভিন দরজা খুলে আমাকে নিয়ে তার বাড়িতে ঢুকলো। বড় একটা কুকুর ছুটে এলো। সে কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলো, “আমি যখন থাকি না বাবা আর এই কুকুর বাড়ির বাসিন্দা। অবশ্য একজন নার্স এসে বাবার প্রয়োজনীয় কাজ করে দিয়ে যায়।” আমি কিছু না বলে ওর পিছনে পিছনে যেয়ে লিভিং রুমে যেয়ে বসলাম। এইবার সে আমাকে কাছে এসে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো যে আমি তোমাকে এখানে কেনো নিয়ে এলাম। আমি মোটামুটি বাংলা বুঝলেও, বাবা ইদানীং তার লং টার্ম মেমোরি থেকে যে কি সব বলছে, তার আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু ধরতে পারছি না। তুমি আশা করি বাবার কথা বুঝতে পারবে এবং অনুবাদ করে দিবে।”

উইল চেয়ার ঠেলে পারভিন ওর বাবাকে নিয়ে এলো। বুঝাই যাচ্ছে একসময়ে তিনি লম্বা, চওড়া, সুদর্শন ছিলেন। শ্যামলা মুখটায় খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। শরীর শুকিয়ে কেমন কুচকে গেছে। পারভিন পরিচয় করিয়ে দিয়ে ইংরেজিতে বলল, “দেখো বাবা একজন বাঙালি নিয়ে এসেছি।” জামিল আহমেদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। মেয়ের কথা মনে হচ্ছে বাবার কানে যাচ্ছে না। আমি আমার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আস সালামু আলাইকুম।” কথাটা শুনে তিনি আমার দিকে কেমন একটা উদাস দৃষ্টিতে তাকালেন। মুহূর্তেই আমার উচ্চারণ করা শব্দগুল তিনি বিড় বিড় করে আওড়াতে লাগলেন। হয়তো লং টার্ম মেমোরিতে আস সালামু আলাইকুম শব্দটা কোথাও মিলে যাচ্ছে।

না তিনি মনে হয় “আস সালামু আলায়কুম” শব্দগুলো তার স্মৃতি ভাণ্ডারে ঠিক খুঁজে পেলেন না। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। শূন্য দৃষ্টি কেমন যেনো প্রচণ্ড রিক্ত। আকাশের দিকে তার চোখ। নীল আকাশটার আলো কেমন করেই না দ্রুত কমে যাচ্ছে। একেবারে সূর্য অস্ত যাবার পূর্ব মুহূর্ত। তিনি বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। পারভিন আমাকে রেখে ভিতরে গেল। এইবার তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট কিন্তু প্রচুর উৎসাহ নিয়ে গ্রাম বাংলার আঞ্চলিক ভাষার ঢঙে বললেন, “শুক্কুর মামা তুমি এতদিনে আইসো। চলো নদীতে জাল ফালাই। তার পর সাঁতারের কম্পিটিশন দিমু। দেইখো কইয়্যা দিলাম এইবার আমিই ফাস্ট হমু।” আমি উত্তর খুঁজে পেলাম না। আরেকটু বিরতি নিয়ে তিনি আবার কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, “দেহো মামা জালে কত্তো মাছ উঠসে।” ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। মিনিট খানেক পরে মুখটা কেমন খুশিতে ভরে উঠলো, “শুক্কুর মামা আইজকে বিকালে কিন্তু আমরা রঙিন ফানুস উড়ামু। দেইখো আমরটা কত্তো উপ্রে যায়, ঠিক আকাশে যাইয়া ছুইবো।” বুঝলাম জীবনের শেষ লগ্নে একজন বাঙালি কল্পনায় হাজার হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশে তার শৈশবে ফিরে গেছে। সেখানকার নাম না জানা কোনো এক নদীতে মাছ ধরছে, সাঁতার কাটছে এবং রঙিন ফানুস উড়িয়ে আনন্দ আত্মহারা হচ্ছে।

 

নভেম্বর ২৩, ২০১৮

লেখকঃ quazih@yahoo.com