সিংহ সমাচার

সিংহ।

আব্দুল করিম চোখ দুটো রগড়ে নিলো। এইটা কি করে সম্ভব। ঢাকার জিপিওর সামনে মনে হচ্ছে একটা সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সাইজে চিড়িয়াখানার সিংহ থেকে পাঁচ গুন বড়। আব্দুল করিম বুঝার চেষ্টা করতে লাগল, তার মাথাটা আসলে ঠিক আছে তো! রাতের ডিউটি করে করে; নিশ্চয়ই মাথাটা পুরোপুরি গেছে। বউয়ের কথাটা বুঝি সত্যি হয়ে গেল। না হলে; বলা নেই, কওয়া নেই নিজের চোখে সিংহ দেখছে কেন? একবার মনে হল, আলো ছায়ার কোন ব্যাপার না তো!

করিম দৈনিক সামনা সামনি পত্রিকার প্রেসে কাজ করে। প্রেস ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার। সারা রাত ধরে কাজ করতে হয়। চাকরির বয়স বিশ বয়স হয়ে গেছে। বিয়ের পর পর বউয়ের অনেক অভিমান ছিল। স্বামী রাতে কাজ করে। আর তার পরিচিত সব বান্ধবীরা রাতে স্বামী নিয়ে.........। বউ একদিন ঠোট ফুলিয়ে বলেছিল, দেখ একদিন রাত জেগে কাজ করতে করতে মাথাটাই যাবে।

তখন দিনের আলো মাত্র ফোটা আরম্ভ করেছে। আব্দুল করিম তার ফিফটি সিসি হোন্ডাটা ব্রেক করে থামাল। আবার ভাল করে তাকাল। আরে এ তো আসলেও সিংহ। কি বড় বড় কেশ। সেও তার দিকে আসিয়ে আছে। নিশ্চয়ই আব্দুল করিমকে পরিষ্কার দেখতে পারছে। কিন্তু কই তার দিকে তেড়ে আসছে না। সিংহ না মানুষ খেঁকো হয়। চাইলে তো তাকে নিমিষের মধ্যে খেয়ে ফেলতে পারে।

আব্দুল করিমের হাত পা কাঁপতে লাগল। নিজের হার্ট বিটের শব্দ নিজেই শুনতে পেল। ভয়ে হার্ট এ্যাটাক না হয়ে যায়। মাথার মধ্যে আসল না-- কি করা যায়। যাই হোক বিপদে সাহস আর বুদ্ধি ঠিক রাখাটাই এক নম্বর কাজ। সিংহ যত বড়ই হোক না কেন, সে নিতান্তই এক পশু। আব্দুল করিম একজন মানুষ। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, আশরাফুল মখলুকাত। সিংহ দেখে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ঠিক সেই সময়ে, সিংহটা মাথা ঝাড়া দেওয়া আরম্ভ করল। বাম থেকে ডান, ডান থেকে বাম। বেশ কয়েকবার করল। ঘাড়ের সব কেশগুলো খাড়া হয়ে গেল। এর পরে তো জগত কাঁপানো হুঙ্কার বের হওয়ার কথা।

না, আব্দুল করিমকে হতাশ করে গর্জন করল না। হয়ত খুব বেশি সকাল। ঢাকার সব মানুষের ঘুম এখনই ভাঙ্গাতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পশু হলেও বিবেক আছে।

আব্দুল করিম হিসাবে যে কোন সময়ে বড় ধরণের বিপদ ঘটতে পারে। হয়ত কালকে সব পত্রিকায় প্রথম পাতায় উঠবে, “ সিংহের পেটে দৈনিক সামনা সামনি পত্রিকার প্রেস ম্যানেজার”। না এখন ভবিষ্যতে কি হবে সেটা ভেবে সময় নষ্ট করাটা চূড়ান্ত বোকামি। দেখা যাক পরিস্থিতি কি করে মোকাবেলা করা যায়।

একটা কাজ করা যেতে পারে; ভো দৌড়। এতে সমস্যা হওয়ার একটা বড় সম্ভাবনা আছে। যদি সিংহ তার পেছনে তেড়ে আসে। সিংহের সাথে এক শ মিটার স্প্রিন্টে পেরে উঠার প্রশ্নই উঠে না। তা ছাড়া ভয়ে পা একেবারে ভারি হয়ে গেছে। দৌড় কি, হাটাও সম্ভব না। হোন্ডায় উঠে এক টান দেয়া যেতে পারে। কিন্তু ভারি পা আর কাঁপা হাত দিয়ে সেটা করার সাহসও হল না।

এ রকম বিপদের সময়ে দোয়া দরুদ ঠিক ঠাক মনে আসলেও, উপকার ছিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে, সব সমস্যাই তাদের তেজ দেখান আরম্ভ করে। নিজেকে সব চেয়ে বড় ধরণের গালিটা দিতে ইচ্ছে হল। কত না প্ল্যান ছিল। পর পর দু দিন ছুটি নিয়েছে। বউ, বাচ্চা নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখতে যাবে। আর এখন কি না তাকে, সিংহের ‘ব্রেকফাস্ট’ হতে হবে।

এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে, বউয়ের সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছা হল; শেষ বারের মত। অনেক কষ্টে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল। কিন্তু বউকে ঘুম থেকে উঠানোর সাহস হল না। বেচারা একটু পরে এমনিই উঠবে। সারাদিন ধরে তার কত না ধকল সহ্য করতে হয়। তা ছাড়া ঘুম ভাঙ্গানোর অপরাধে তুমুল বকা খেতে হতে পারে। এর থেকে সিংহের পেটে চলে যাওয়াই ভাল।

শেষে মনে হল, পত্রিকার সম্পাদক সাহেবকে বিষয়টা জানিয়ে রাখলে ভাল হয়। তিনি আব্দুল করিমের সাথে সব সময় হাসি মুখে কথা বার্তা বলেন। বাড়ির সব খোজ খবর নেন। তাকে করিম সাহেব বলে কথা বলেন।

বেশ অনেকবার রিং হওয়ার পরে তিনি ফোন ধরলেন। ঘুম ঘুম গলায় বললেন, হ্যা...... লো......। স্যার, স্যার আমি। করিম। আব্দুল করিম। প্রেস ম্যানেজার। সিংহ স্যার। জিপিও’র সামনে। সম্পাদক সাহেব মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার কাজের ফাঁকে ফাঁকে রঙ্গিন পানি গিলছেন না-কি? না কি উন পঞ্চাশ বায়ু হয়েছে। আর কথা না বাড়িয়ে খটাং করে লাইন কেটে দিলেন।

প্রধান মন্ত্রীর বিষয়টা সকাল সকাল-ই জানলেন। সকালে ঘুম থেকে টিভির চ্যানেল উঠা নামা করা, তার বেশ অনেক দিনের অভ্যাস। সময় বেশ কেটে যায়। ভালই লাগে দেশের উন্নতির কথা ভেবে। আগে ছিল সারা দেশে একটা চ্যানেল। এখন দেশী বিদেশী মিলিয়ে কত না চ্যানেল। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে সব হতাশার কথা ভুলে থাকা যায়।

দেশের চ্যানেলগুলো ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে। কি কি সব বলছে আর বিশাল একটা সিংহকে দেখাচ্ছে। সিংহটা মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। তাকে ঘিরে রেখেছে বিরাট এক জনতা। চোখে সবার অবাক দৃষ্টি। সিংহ মাঝে দু একপা নড়াচড়া করছে। জনতা সাথে সাথে, সরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিচ্ছে। বাঙালির এত সুশৃঙ্খল আচরণ ভাবাই যায় না। সিংহ কাওকে আক্রমণ করছে না। আর জনগণ কোনভাবেই উত্যক্ত করছে না। বরং সযত্নে যক্ষের ধনের মত আগলিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে সিংহের জন্যে প্রচুর খাবার, দাবার আর পানির ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

প্রধান মন্ত্রী প্রথমেই ফোন করলেন কৃষি মন্ত্রীকে। মন্ত্রী জানালেন, এইটা তো আমার না পশু মন্ত্রীর জানার কথা। পশু মন্ত্রী আবার “কচ্ছপের দীর্ঘায়ু” বিষয়ক একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকা গেছেন। প্রধান মন্ত্রী নিজে তাকে পাঠিয়েছেন। বলা তো যায় না, পশু মন্ত্রী ওখান থেকে যদি কোন ফর্মুলা নিয়ে আসেন; সরকারকে কিভাবে অমরত্ব দেওয়া যায়। কিংবা কমপক্ষে কচ্ছপের মত কয়েক শ বছর। আসলে প্রধান মন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ আছে; কিভাবে আয়ু বাড়ানো যায় বিষয়টা ভাল করে রপ্ত করার।

বিষয়টা নিয়ে সারা দেশ জুড়ে তুলকালাম কাণ্ড। সিংহকে জনতা সুশৃঙ্খল ভাবে ঘিরে রেখেছে। মিডিয়ার জন্যে একটা কোণা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু দেশে না বিদেশেও দেখান হচ্ছে। বিভিন্ন লাইনের বিশেষজ্ঞরা তাদের সু চিন্তিত মতামত দেয়া আরম্ভ করেছেন।

টিভি চ্যানেল কিউ 6’র মাওলানা আবুল মাজেদ বললেন, মনে হচ্ছে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সময় চলে এসেছে, যাকে বলে রোজ কেয়ামত। তার কিছুদিন আগে দজ্জালের আসার কথা। ধর্মীয় শাস্ত্রে যে ভাবে বলা হয়েছে, তার সাথে এই সিংহকে দজ্জাল বলাটা মুশকিল। তবে কোন কারণে দজ্জাল সিংহের রূপ নিয়েও থাকতে পারে।

ইতিহাসবিদরা হেলেন অফ ট্রয়ের ঘটনার উদাহরণ বারে বারে দিতে লাগলেন। একটা নকল কাঠের ঘোড়ার মধ্যে শত্রু পক্ষের সৈন্যরা লুকিয়ে ছিল। তার পরের গল্প যে, যতটুকু পারলেন, তেল লবণ লাগিয়ে বলতে থাকলেন। কিন্তু জনগণ এর সাথে ঢাকা থেকে শূন্য কিলোমিটার দূরে সিংহের আবির্ভাব নিয়ে তেমন কোন মিল পেল না।

এর মধ্যে অখ্যাত এক রিকশাওয়ালা মুহূর্তের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেল। পঁচিশ বয়সের এই যুবক গ্রাম থেকে এসেছে বছর দুয়েকে আগে। সে ‘চ্যানেল তীক্ষ্ণ চোখ’ র ‘জনতার মঞ্চ’ অনুষ্ঠানে বলল, দেশে যে অনাচার চলছে, তাতে মনে হয় আল্লাহ তালা তার প্ল্যান পরিবর্তন করেছেন। এক মানুষের বিপদ দেখলে অন্য মানুষ আর এগিয়ে আসে না। সেটা ছিনতাই,ডাকাতি হোক কিংবা খুব খারাবী হোক না কেন। মানুষ তার শোবার ঘরে এক শ বার ছুরির কোপে খুন হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া নিয়ম কানুন না মানাটাই যেন সবচেয়ে বড় একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ পাক হয়তো ভাবছেন, এ রকম অরাজকতা পূর্ণ পৃথিবী রাখার কোন মানে হয় না।

দেশের পত্রিকাগুলো সকাল দশটার মধ্যে বিশেষ সংখ্যা বের করল। “বনের রাজা সিংহ, রাজধানী ঢাকায়”, “দজ্জাল কি আসলে কি এই সিংহ?”, “কেয়ামতের আর কয়দিন বাকি?” --- ধরণের অনেক অনেক শিরোনাম বের হল।

বিশ মিনিটের মধ্যে চিড়িয়াখানার পরিচালককে, প্রধান মন্ত্রীর সামনে এনে হাজির করা হল। স্পেশাল ফোর্স যেয়ে তাকে বিছানার থেকে তুলে নিয়ে আসল। বেচারার পরনে তখন লুঙ্গি আর গেঞ্জি। থর থর করে কাঁপছে আর বিড় বিড় করে দোয়া দরুদ পড়ছে। ধরেই নিয়েছে, র্যাবের ক্রস ফায়ার জাতীয় কোন ঘটনা হয়ত একটু পরে ঘটতে যাবে। কিন্তু পরিচালক সাহেবের মাথায় আসল না, তার কি অপরাধ হতে পারে। সারা জীবন সে সরকারী দলের জয়গান আর সে হিসাবে কাজ করে এসেছে।

প্রধান মন্ত্রী সরাসরি জানতে চাইলেন, বলেন আপনি এই সিংহ সম্পর্কে কি জানেন। পরিচালক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, জী কোন সিংহ? আমাদের চিড়িয়াখানার সিংহ মারা গেছে সেই কবে, আজ প্রায় বছর খানেক হল। পশু মন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, সরকারী দলের এক মোটা সোটা লোক সিংহের পোশাক পড়ে সিংহের চাকরী করে।

প্রধান মন্ত্রী মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমি সিংহ কেনার জন্যে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্ধ করেছিলাম। অবশ্য তার থেকে এক কোটি টাকা পার্টির ফান্ডে গেছে। বাকি টাকা দিয়ে এক ডজন সিংহ কেনা যেত। পরিচালক সাহস করে বললেন, সেটা আমার জানার কথা না। তবে পশু মন্ত্রী ত্রিশ হাজার দিয়ে বলেছিলেন, মরা সিংহের চামড়া খুলে পোশাক বানাতে। আমি অবশ্য কাজটা দশ হাজারে করেছি। মিরপুরে আমার পরিচিত এক দর্জি দিয়ে করিয়েছি। পাবলিক বুঝতেই পারে না, খাঁচায় সিংহের পোশাক পড়ে মানুষ বসে থাকে। কথাটা শুনে প্রধান মন্ত্রী চোখ বড় বড় করে তাকালেন। পরিচালক মিন মিন করে বললেন, যদি চান ওই বিশ হাজার টাকা মাসে মাসে আমার বেতন থেকে কেটে রাখতে পারেন।

প্রধান মন্ত্রী দাঁত কড়মড় করে বললেন, আপনার চিড়িয়াখানায় কি আসল-জন্তু জানোয়ার কি একটাও আছে। পরিচালক খুব আস্তে আস্তে বললেন, পশু মন্ত্রী বলেছেন কোন পশু মারা গেলে, আমারা যাতে একই ব্যবস্থা করি। তাতে সব পক্ষই লাভবান হবে। সাথে সাথে কিছু বেকার লোকের চাকরীও হয়ে যাবে। তবে সব পাখি অরিজিনাল। নকল পাখি উড়ানো, এখন পর্যন্ত আমরা আবিষ্কার করতে পারি নি।

প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের জরুরি মিটিং ঢাকলেন। সবাইকে খবর দেয়া হল, এক ঘণ্টার মধ্যে এসে হাজির হতে। যারা ঢাকার বাইরে ছিলেন, তাদের বলা হল হেলিকপ্টারে করে চলে আসতে। এর মধ্যে খবর আসতে থাকল, ঢাকার ফার্মগেট, উত্তরা, মিরপুরেও সিংহ দেখা গেছে। প্রতিটা জায়গায় জনগণ তাদের বিরাট সম্মান দিয়ে আগলে রাখছে। তারা জান দিবে, কিন্তু সিংহের গায়ে কোন আঁচড় পর্যন্ত পড়তে দিবে না।

মিটিঙে মন্ত্রীরা বিজ্ঞ মাথাগুলো ঘন ঘন চুলকালেন। কিন্তু, কেও বলতে পারলেন না এত সিংহ আসছে কোথা থেকে। তবে একেবারে চুপ করে থাকার মানুষ তারা না। একের পর এক সমাধান তারা প্রস্তাব করতে লাগলেন।

এক জন বললেন, সিংহগুলোকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। তার পরে তাদের চামড়া এক্সপোর্ট করে কিছু টু পাইস কামানো যেতে পারে। অন্য আরেক মন্ত্রী বললেন, এইটা এখন একেবারে অসম্ভব। কোটি কোটি বাঙালি এই সব সিংহদের পাহারা দিচ্ছে। আরেক জন বললেন, টিয়ার গ্যাস দিয়ে তাদের কাঁদিয়ে বেহুশ করে সিংহগুলোকে চিড়িয়াখানায় আটকিয়ে রাখা যেতে পারে।

চিড়িয়াখানার পরিচালককেও এক কোণায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। অবশ্য তাকে একটা শার্ট প্যান্ট পড়তে দেয়া হয়েছে। তিনি বেশ জোড়ে সোড়ে বললেন, বাংলাদেশে এত সিংহ আটকিয়ে রাখা কোন ভাবে সম্ভব না।

প্রধান মন্ত্রী বুঝলেন এই মিটিং থেকে কোন কিছু বের করা সম্ভব না। এর পরে তিনি একটা একেবারে অভাবনীয় কাজ করলেন। নিজের হাতে স্পিকার ফোন দিয়ে কল করলেন বিরোধী দলের প্রতিপক্ষকে। প্রথমে দু একটা কেমন আছেন, ভাল আছেন জাতীয় কথা। তার পরে কিছু স্মৃতি রোমন্থন। আপনার মনে আছে, যখন পাশাপাশি বাসায় থাকতাম, তখন আপনার হাতের রান্না আমি কত খেয়েছি। একবার তো আপনি ডালে লবণ দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।

মন্ত্রীরা সব অবাক। বিরোধী দলের নেতার, তাদের নেতার এত সখ্যতা! তারা না কথায় কথায় একে অন্যের গুষ্টি উদ্ধার করেন। হাসি হাসি মুখে কথা বলছেন। মনে হচ্ছে পৃথিবীর যে কোন সমস্যা, তারা অনায়াসে সমাধান করে ফেলতেন। প্রধান মন্ত্রী বললেন, আপনার এই সিংহের চালটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বিরোধী নেতা বললেন, আমিও তাই। আমার বাসার সামনেও একটা সিংহ দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকাচ্ছে । আপনার এ রকম রসিকতা আমি ঠিক ধরতে পারলাম না।

কিছুক্ষণের মধ্যে মন্ত্রীরা সব বাসা থেকে কল পেতে থাকলেন। বাসার সামনে সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। দেশের চারিদিক থেকে খবর আসতে লাগল বেশির ভাগ হোমরা চোমরাদের বাসার সামনে সিংহ চলে এসেছে।

সবার যখন আতঙ্কে হাত পা গুটিয়ে শরীরের মধ্যে ঢুকে যেয়ে চাইছে, তখন দপ্তরী মতি মিয়াঁ কনফারেন্স রুমে ঢুকল। মন্ত্রীদের জন্যে নতুন করে পানি নিয়ে এসেছে। প্রধান মন্ত্রী লক্ষ করলেন, সেই ওখানকার একমাত্র মানুষ যার মধ্যে কোন ভয় ডর দেখা যাচ্ছে না। তার তো এর মধ্যে জেনে ফেলার কথা, সারা দেশে কত বড় মুসিবত চলে এসেছে।

প্রধান মন্ত্রী বললেন, মতি মিয়াঁ এ ব্যাপারে তুমি কিছু জান না-কি। মতি মিয়াঁ প্রধান মন্ত্রীর সাথে আছে বেশ কিছু বছর। বয়স হয়ে গেছে তবু সে কাজ করে। দেশে হাতে গোনা কয়েক জন মানুষের মধ্যে সে হল একজন, যে প্রধান মন্ত্রীর মুখের উপরে সত্যি কথা বলে দিতে পারে। এক সময়কার মুক্তিযোদ্ধা কাওকে ছেড়ে কথা বলার মানুষ না।

মতি মিয়াঁ বলতে লাগল, যে সব মানুষরা খারাপ কাজ করে, নিজের ভালোর জন্যে অন্যকে বঞ্চিত করে, তাদের বিবেকরা বের হয়ে সিংহ হয়ে যাচ্ছে। এই সিংহ এখন সব পাপ আর খারাপ খেয়ে পরিষ্কার করে দিবে।

এর আগেও আমি এ ধরণের সিংহ দেখেছি। একাত্তরে এই সব সিংহ এসেছিল। তখন অবশ্য যার সিংহ, সেই দেখেছিল। তার পরে এরা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশ স্বাধীন করল। বাঙালি ভীতু এই কথার কবর তারাই দিয়েছিল। এই বার অবশ্য অন্য ধরণের সিংহ। জাতিটার একটা অংশ পচতে আরম্ভ করেছে।

সিংহ এখন সবাই দেখতে পারছে।

মতি মিয়াঁ পর্দা সরিয়ে দেখাল বাইরে বেশ কিছু বড় বড় সিংহ মাথা নাড়াচ্ছে।

তার পরে, সব সিংহ এক সাথে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো।

দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে।

মার্চ ১৮, ২০১২

www.lekhalekhi.net