মার্চ ১২, ২০১৮

সমগ্র বাংলাদেশ নড়ে উঠলো। ইউএস বাংলা এয়ারলাইনের একটা বিমান নেপালের কাঠমুন্ডুতে ক্রাশ করলো। বেশ কিছু বাঙালি ও নেপালি নিহত হলেন। পত্রিকা থেকে সবাই জানলো পাহাড়ে ঘেরা কাঠমুন্ডু এয়ারপোর্ট বিমাল অবতরণের জন্য ভীষণ বিপদজনক। তারপর সেখানকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ইউএস বাংলার পাইলটকে বিভ্রান্ত করেছে। বাংলাদেশের অন্যান্য এয়ারলাইন্সের ঢাকা থেকে কাঠমুন্ডু গামী প্লেনের ক্রু ও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। ইউএস বাংলা তাদের নেপালের ফ্লাইট সাময়িকভাবে বাতিল ঘোষণা করলো। কিন্তু দেশের অন্যান্য এয়ারলাইনগুলো সিদ্ধান্ত নিলো তারা এই রুটে সার্ভিস বহাল রাখবে।

বে-সরকারী এয়ারলাইনের এক পাইলট আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত। দুর্ঘটনার অল্প কিছুক্ষণ পর সে প্লেন নিয়ে কাঠমুন্ডুতে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার কাছে খবর এলো বিমানের যাত্রীরা যতটুকু উদ্বিগ্ন, তার থেকে বেশী ভীত প্লেনের ক্রু রা। তাদের মনে একই চিন্তা, ‘এই যাত্রা যদি শেষ যাত্রা হয়ে যায়......!!’ পাইলট বুঝতে পারলেন এ রকম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কর্মীদের নিয়ে আকাশে উড়লে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। পাইলট মহোদয় প্লেনের ক্রু দের ডেকে পাঠালেন। তিনি সহকর্মীদের মানসিক অবস্থা চাঙ্গা করার জন্যে ছোট একটা গল্প বললেন। আমার সাথে এইবার দেখা হলে সে জানালো, গল্পটা সে আমার থেকে বহু বছর আগে শুনেছিল। আমার মানুষকে গল্প ও কৌতুক বলার এবং মাঝে মাঝে লেখালেখির অল্প-বিস্তর অভ্যাস আছে। লেখাগুলো আমার নিজের মাথা থেকে উদ্ভূত হলেও, অন্যদের যেগুলো বলি সেগুলোর মধ্যে নিজের ও সংগৃহীত দুই-ই থাকে। যাই হোক আমার বলা একটা গল্প এ ধরণের একটা সিরিয়াস পরিস্থিতে ব্যবহার করা হয়েছিল জেনে ভালো লাগলো। প্রসঙ্গটাতে একটু পরে আসছি।

কয়েক মাস আগে ঘুরে এলাম বাংলাদেশ। মানস-পটে প্রতিটা দৃশ্য উজ্জ্বল। সময়ের সাথে সেগুলো ম্লান হতে হতে স্মৃতি ভাণ্ডারে যেয়ে ঠাই নিবে। তবে স্মৃতি রোমন্থন ও শেয়ার না করলে সেগুলো বিলীন হয়ে যাবার আশংকা থাকে। কিন্তু এগুলো আমার কাছে অমূল্য। আমি প্রতিটা ঘটনা স্মৃতিতে সযত্নে গুছিয়ে রাখতে চাই। এগুলো আমার বেঁচে থাকার খোরাক। তবে আজকে আমি আমার পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র দেশের দুটো বিষয় প্রিয় পাঠকদের কাছে তুলে ধরবো। আমি জানি বাঙালি মাত্রই এর অম্ল স্বাদ পেয়েছেন।

সফরটা ছিল নেহায়েতই সংক্ষিপ্ত; দশ দিনের। জমি জমার কাজ। এই সংক্রান্ত প্রত্যেকটা অফিসই দেখলাম দুর্নীতির মহা আখড়া। একেবারে পয়সা নাই তো কথা নাই। অঘোষিত নিয়মে কথা ছাড়া ফাইলের নড়া-চড়া নিষিদ্ধ। পয়সা না ঢাললে কিছ-ছু হয় না। ব্রিটিশরা যেভাবে কর্ম ধারা ঠিক করে গিয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে তার কোনো ব্যতিক্রম হয় নি। ইয়া মোটা মোটা কাগজের ফাইলে নথি চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সব দপ্তরগুলোতে কম্পিউটার ব্যবহারের লেশমাত্র দেখলাম না। পাছে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দুর্নীতির সুযোগ না কমে যায়! তাইতো এখানকার হর্তা-কর্তারা পুরনো ধারার কাজে পরিবর্তন আনতে একেবারেই অনিচ্ছুক।

যেই অফিসের শিরা-উপশিরায় ঘুষ, সেখানকার দেয়ালে এক পোস্টারে দেখলাম লেখা, “ঘুষ-দাতা ও ঘুষখোর উভয়ই দোজখের আগুনে জ্বলিবে।” লেখাটার নীচে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এ রকম একটা ছবি। তার নিচে ব্র্যাকেটে লেখা “দোযখের আগুন শত সহস্র গুণ তীব্র।” পোস্টারটা দেখে সিগারেটের প্যাকেটে লেখা সংবিধিবদ্ধ সতর্কতার কথা মনে এলো। সেখানে লেখা থাকে ধূমপান করলে ক্যানসার হয়। ধূমপায়ীরা থোরাই তোয়াক্কা করে? তারা দেদারসে ধূমপান করে চলেছে। বাংলাদেশে “ঘুষ”টা এতই মারাত্মক নেশায় পরিণত হয়েছে যে ঘুষখোরদের কাছে উপরি টাকাটাই বেশি আনন্দের ও ভোগের। দোজখের আগুন নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নাই। এক সময়ে এই দেশে দুধে পানি মেশানো হতো। সে দিন বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন পানিতে সামান্য কিছু দুধ মেশালেই চলে।

ঢাকায় হাজারো সমস্যার মধ্যে সম্ভবত শীর্ষস্থানে আছে ‘যানজট’ বা ট্রাফিক জ্যাম। এমন কোনো নগরবাসী নাই যে এর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ না। পুরো শহরটাই মনে হয়ে স্থবির হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার চলার গতি পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্ব নিম্ন। দু কোটি মানুষের শহরে গাড়ির সংখ্যা বেশী হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার সাথে যোগ হয়েছে বাস ও হকারদের রাস্তার অনেকটুকু দখল করে রাখার দৌড়াত্ব । তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এ রকম জঘন্য ট্রাফিক জ্যামের প্রধান কারণ হচ্ছে, চালক, যাত্রী, পথিক, পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের আইন-কানুন মেনে চলার প্রতি প্রচণ্ড অনীহা। সবাই অন্যকে ছেড়ে এগিয়ে যাবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলাফলটা হলো, সবাই একসাথে আটকা পড়ে যাচ্ছে। গাড়ি লেন ধরে চললে একটা শৃঙ্খলা থাকতে পারে; গাড়িগুলো একটা আরেকটা ঘাড়ের উপরে চলে এসে দুর্ঘটনা ঘটায় না। শুনে হাসলাম যে জ্যামে এত সময় লাগছে যে বাসার থেকে অফিস যেতে যেতে ছেলেদের শেভ করা মুখে দাড়ি গজিয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের মেক আপের কথা নাই বা বললাম।

ট্রাফিক জ্যাম হওয়ার আরও মেলা কারণ আছে। যেগুলো আমাদের সবারই কম বেশী জানা। এগুলোর পেছনে বাংলাদেশের জাতীয় হুমকি “দুর্নীতি” র অবদান কমপক্ষে শতকরা ৯০ ভাগ। তবে ব্যতিক্রম আছে। ঢাকা সেনানিবাস ও বসুন্ধরা সিটি এলাকায় দেখালাম যানবাহন সব নিয়ম-কানুন মেনে চলছে। তেমন কোনো জটলা হচ্ছে না। 'সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই বাংলাদেশ'; একই গাড়ি চালক দুই জায়গায় দুই ধরণের আচরণ করছে। বলাই বাহুল্য এ দু এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যারা নিয়োজিত, তারা কিন্তু বাকী জায়গাগুলোতে যে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের থেকে ভিন্ন। সম্প্রতি আমাদের শিশু-কিশোররা প্রমাণ করে দেখালো, বাঙালিদের পক্ষে সড়কে আইন-কানুন মেনা চলা সম্ভব।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্যে “ফুট ওভার” ব্রিজ বানানো হয়েছে। অসহায় এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত পাবলিককে প্রায় তিন তলা সমান উঁচুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ব্রিজের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হতে হয়। আবার ‘পাতাল ফুট ওভারে’ সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্য পারে যাবার ব্যবস্থা। এগুলো ব্যবহার করতে সময় লাগে বেশী, তার পরে যে কারোর জন্যই এটা একটা বিড়ম্বনা। বয়স্ক, অসুস্থ, পঙ্গুদের ফুট ওভার ব্রিজে যেতে বাধ্য করাটা আমার কাছে একেবারে অমানবিকতার পর্যায়ে পড়ে। যে সব উর্বর মস্তিস্ক এই ধারণা বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পর্কে কতটুকু ধারণা আছে, সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। সারা বিশ্বে গাড়ির থেকে পথচারীদের অধিকারকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। রাস্তা পারাপারের জায়গায় যান্ত্রিক গাড়িগুলোকে ‘ব্রিজ কিংবা পাতাল’ দিয়ে পাঠালে কি বেশী কার্যকারিতা পাওয়া যেতো না? বিবেকহীন ড্রাইভারগুলো ভাবেই না রাস্তা-ঘাট শুধু তাদের একার না। সড়ক ব্যবহারের সবার সমান অধিকার। তারা দ্বিধাহীনভাবে একের পর এক নিরীহ পাবলিক আহত-নিহত করে চলেছে। তা ছাড়া তারা এতো দ্বিধাহীন হবেই না কেনো? ড্রাইভারদের অগণিত অপরাধের শাস্তি হয়েছে মাত্র হাতে গোণা কয়েকটা!

বেশ কিছু ভারি কথা হলো, এইবার না হয় হালকা কিছু বলি। পরপারে দেখা গেল বাংলাদেশের বড় মাপের একজন ধর্ম যাজকের স্থান হয়েছে স্বর্গের সপ্তম স্তরে মানে সর্ব নিম্ন শ্রেণীতে। আর এক বেপরোয়া বাস ড্রাইভার জায়গা পেলো স্বর্গের উপরের ক্লাসগুলোর একটাতে। এই নিয়ে ধর্ম যাজক অভিযোগ নিয়ে সৃষ্টি কর্তার কাছে গেলেন। উত্তরে সৃষ্টিকর্তা জানালেন, “আমার বিচারে কোনো ভুল নাই। তুমি যখন বয়ান করতে, তখন মানুষজন বিরক্ত হতো, ঘন ঘন সময় দেখতো ও ভাবতো তোমার কথা কখন শেষ হবে। আবার তোমার কিছু শ্রোতাকে ঘুমেও ঢুলতে দেখেছি। আর ওই ড্রাইভার যখন ঝড়ের গতিতে বাস ছুটাতো, তখন যাত্রীরা সব আমাকে ঘন ঘন স্মরণ করতে থাকতো। ফরিয়াদ করতো আমি যাতে ওদের জীবন বাঁচিয়ে দেই। এখন তুমি বলো, ওই ড্রাইভারকে স্বর্গে তোমার উপরে স্থান দেয়াটা কি ভুল হয়েছে?”

এবার ফিরে আসি, লেখাটার সুচনায় যে প্রসঙ্গটা বলার অঙ্গীকার করেছিলাম। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের পাইলট তার বিমানের ক্রু’ দের ডেকে এক জায়গায় জড় করলেন । ক্রু’ রা দুর্ঘটনার আশংকায় কাঠমুন্ডুতে বিমান নিয়ে যেতে আতঙ্কিত ছিল। পাইলট সাহেব নিচের অংশটুকু তার সহকর্মীদের নিজের মতো করে বললেন:

বন্ধু ১ঃ তুই নাকি জাহাজে চাকরি নিয়েছিস? শুনলাম তোর বাবার জাহাজে মৃত্যু হয়েছিল।
বন্ধু ২ঃ ঠিকই শুনেছিস। শুধু বাবা না, আমার দাদা এবং তার বাবারও জাহাজে কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন।
বন্ধু ১ঃ এত কিছুর পরেও তুই জাহাজে চাকরি করবি। তোর ভয় লাগে না?
বন্ধু ২ঃ তোর প্রশ্নের উত্তরটা পরে দিচ্ছি। এখন বল, তোর বাবা, দাদা ও তার বাবার মৃত্যু কোথায় হয়েছিল?
বন্ধু ১ঃ বাসায়।
বন্ধু ২ঃ তা হলে তোর বাসায় থাকতে ভয় করে না? তোর পূর্ব-পুরুষদের সবার তো দেখি বাড়িতেই মৃত্যু হয়েছিল !!

এর পরে পাইলট সাহেব বুঝিয়ে বললেন, মৃত্যু উপরওয়ালার নির্ধারিত স্থান ও সময়েই হবে। আপাতত দৃষ্টিতে সেটা নিরাপদ কিংবা বিপদজনক যাই হউক না কেনো। শেষে তিনি সেক্সপিয়ার উদ্ধৃতি করলেন, “Cowards die many times before their deaths; The valiant never taste of death but once” বিমান কর্মীরা নিজেকে কোনভাবেই ভীতু ভাবতে রাজী না। তাদের মনের সংশয় ও আতঙ্ক মুহূর্তেই উবে গেল। তাদের কাজ এখন বিমানটাকে সঠিক ও নিরাপদ-ভাবে পরিচালনা করা। এতোগুলো যাত্রীর জীবন তাদের হাতে!

পরিশেষে উলু-বনে না হয় কিছু মুক্তা ছড়াই। জানি যাদের উদ্দেশ্যে বলা, তারা কোনো ধরণেরই ‘সংবিধিব্ধ সতর্কতা’ গ্রাহ্য করেন না। তারপরেও এদের বিবেকে সামান্য রেখাপাত করলে বাংলাদেশটা দারুণ সুন্দর একটা দেশ হতে পারে। বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের অনেক যুক্তি থাকতে পারে, তবে তারা স্পষ্টই জানেন তারা ভুল কাজ করছেন, চুরি করছেন, অন্য মানুষের ক্ষতি করছেন এবং সমগ্র জাতিকে বঞ্চিত করছেন। দুর্নীতি থেকে সরে আসলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে না। তারা ঠিকই সুষ্ঠুভাবে তাদের কর্তব্য সম্পন্ন করতে পারবেন। বরং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে, বিবেকের কাছে নিজেদেরকে বারে বারে হত্যা করতে হবে না। শুধু এতটুকু মনে রাখতে হবে, বাঙ্গালী বীরের জাতি। উদ্দেশ্য সৎ ছিল বলেই একাত্তরে সমগ্র জাতি যুদ্ধ করে দেশটাকে শত্রুমুক্ত করতে পেরেছিল। তাদেরকে বলি, “আপনি বাঙালি হলে আপনি ভীতু হতে পারেন না, আপনি দুর্নীতিবাজ হতে পারেন না। আপনি বাঙালি হলে ভয়ে নতজানু হয়ে জীবিত অবস্থায় বারে বারে মৃত্যুবরণ করতে পারেন না। কারণ বীরদের শুধু একবারই মৃত্যু হয়। এবং সেই মৃত্যুটা হবে একমাত্র আপনি যখন প্রকৃতভাবে পরলোকে যাত্রা করবেন।” শেষে আরও একটা কথা যোগ করতে চাই, ন্যায় ও সৎ পথে থেকে মৃত্যু বরণ করলেই একমাত্র আপনি শেষ বিচারের দিন পরম করুনাময়ের সামনে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবেন।

আগস্ট ১৮, ২০১৮

কাজী হাসান
লেখকঃ quazih@yahoo.com