বন্ধুত্ব ও নীলিমায় নীল

আ ম রি বাংলা ভাষা কিন্তু অনেকদিক থেকে অনন্য। তার মধ্যে একটা হল, বাংলায় ভাব প্রকাশ কিন্তু অনেক বেশী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করা যায়। কেন বলছি কথাটা একটু ভেঙ্গে বলি। ইংরেজিতে ভালোবাসা বিষয়ক একটাই শব্দ, Love। মায়ের ভালোবাসা থেকে আরম্ভ করে খাবার দাবার সব কিছুর জন্যে ওই একই শব্দ। কিন্তু বাংলায় , প্রেম ও ভালোবাসা নামের দুটো পৃথক শব্দ আছে। প্রেম হল প্রেমিক-প্রেমিকাদের সম্পর্ক। এবং অন্য সব কিছুর আকর্ষণকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয় ভালোবাসা শব্দটা। এই বিষয়ে কিছু পণ্ডিত গোত্রীয় মানুষ হয়ত পুরো একমত নাও হতে পারেন। তবে বলাই বাহুল্য শব্দ দুটোই বহুলভাবে প্রচলিত।

যাই হোক প্রেম, ভালোবাসার কাসুন্দিতে আজকে আর বেশী এগুবো না। তবে কথা বলবো, তার থেকে আরও বেশী শক্তিশালী অন্য একটা বিষয় নিয়ে। বলুন তো সেটা কি? না পারলে বলি; বন্ধুত্ব। প্রেম ও ভালোবাসার সমন্বয়ে তৈরি আরও অনেক বেশী শক্তিশালী সম্পর্ক হল বন্ধুত্ব। এখানে হিসেব-নিকেশের অবকাশ নাই। শুধু বন্ধুকে care বা যত্ন করার মধ্যেই আনন্দ, সফলতা ও সার্থকতা। কেন এইগুলো বলছি, কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা জানাব। তবে তার আগে, সদ্য প্রয়াত বক্সার মুহাম্মদ আলী কি বলে গেছেন, সেটা চট করে দেখে নেই , “Friendship is the hardest thing in the world to explain. It’s not something you learn in school. But if you haven’t learned the meaning of friendship, you really haven’t learned anything।” …… তুমি যদি বন্ধুত্বের অর্থ না জানো, তা হলে তুমি আসলে কিছুই শিখো নি।

এখন বলি আমি কেন কথাগুলো বলছি। কারণ নীলিমা আক্তার বাণী। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠিনী। আমরা এখন পৃথিবীর দু প্রান্তে বসবাস করি। আমার যখন রাত, তার সেখানে তখন দিন। দু জনের দু প্রান্তে অবস্থান সময়ের দিক থেকেও অনেক গড়িয়েছে; প্রায় বছর পঁচিশেক। কিন্তু তাতে কি যায় আসে? হৃদয়ে যার স্থান, সময় ও দূরত্বের ব্যবধান তার কাছে তুচ্ছ। দার্শনিক এরিসটোটল কথায়, "Wishing to be friends is quick work, but friendship is a slow ripening fruit." বন্ধুত্ব যে সময় ও দূরত্বের ব্যবধানে পোক্ত হতে থাকে।

দীর্ঘ প্রবাস জীবনে খুব বেশী দেশে যাওয়া হয় নি। হাতে গুনলে মাত্র তিন বার। প্রথমবার গেলাম প্রায় সতের বছর পর, গ্রীষ্মকালে। বৃষ্টি নাই, বিদ্যুৎ নাই। পুরো পরিবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ফোনে বাণীর সাথে কথা হচ্ছিল নিয়মিত। বললাম, এইবার হয়ত সরাসরি দেখা করা হবে না। কিন্তু বাণী এই কথা মানতে রাজী না। তার বাসায় আসতে বলতে গেলে বাধ্য করলো। নিজের হাতে মেলা রান্না-বান্না করলো একবারে সব দেশী খাবার। ভাজি ভর্তার বিশাল সমাহার। কিন্তু বেচারির খেয়াল ছিল না, এখন সারা পৃথিবীতেই কম বেশী দেশী খাবারের সামগ্রী পৌঁছে যাচ্ছে। যদিও আমি সেই সময়ে শাহী খাদ্যের বেশী ভক্ত ছিলাম, তার পরেও অনেক সাধুবাদ জানালাম। বাণী আরও কিছু বন্ধু-বান্ধবদের আমন্ত্রণ করেছিল। বুঝলাম প্রিয় বান্ধবী, আমাকে ভাল লাগা দিতে চেষ্টার কোন কমতি করে নি।

দ্বিতীয়বার সফরে যেয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে হাত-পা ভেঙ্গে যাতা কাণ্ড করে ফেললাম। তিন সপ্তাহ অতিরিক্ত থাকতে হলো দেশে। হাসপাতালে অস্ত্রপোচার পর্যন্ত হল। যদিও চাকরি, সংসার নিয়ে বাণী তখন কর্মব্যস্ত একজন মানুষ, তার পরেও নিয়মিত আমার খবর নিয়েছে, পাশে এসে সাহস যুগিয়েছে। তৃতীয়বার দেশে গেলাম আমার মায়ের মৃত্যুর পর পর। সেই চেনা জানা বাণী ঠিক আগের মত আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। সান্ত্বনা দিল। দেশে তখন প্রচুর আন্দোলন। তারপরেও ওর বাসায় নিয়ে গেল। মজার বিষয়, এইবার সে হাজীর বিরানি দিয়ে আপ্যায়ন করলো। কিন্তু প্রিয় বান্ধবী জানতো না, মাঝে বেশ কিছু সময় পাড় হয়ে গেছে। এখন আমি শাহী খাদ্য থেকে নিজেকে গুটানোর চেষ্টা করছি। কৃতজ্ঞতায় মনে মনে বাণীকে বললাম, ‘তুমি মানুষটা এত ভালো কেন?’ শুধু পাশে থেকেই না, আমার ভালো লাগার জন্যে মেয়েটা কত কিছুই না করতে পারে।

গাইবান্ধার মেয়ে বাণী। একেবারে গোটা গোটা অক্ষরে বাংলা লিখে। কি যেন কথাটা...লেখায় যেন মুক্তা ঝড়ে। কবিতা লিখে। দেখতে অপরূপা সুন্দরী। কত ছেলে যে টপাটপ প্রেমে পড়লো, তার হিসেব করাটা এখন অনেক কঠিন। কিন্তু তার আগেই সে মন দিয়ে রেখেছিল, বুয়েটের এক সৌভাগ্যবানকে। সেই ছেলের সৌভাগ্য হলেও, আমাদের জন্য হল দুর্ভাগ্য। আমাদের কঠিন পথে এগুতে হল। আমরা বন্ধুত্বের বীজ বপন করলাম বছর তিরিশেক আগে। ধীরে ধীরে চারা বের হল, তার পরে গাছ। এখন তো পূর্ণ বট বৃক্ষ।

পিছন দিকে তাকালে কত ঘটনাই না মনে পড়ে। কারোর কথা পছন্দ না হলে, বাণী বলে বসতো, ‘তুই থু থু খা।’ আমাকে কোন কারণে কথাটা বললো। সে তখন ঠিক আমার পাশে বসা। আমি একটা খাতা দিয়ে মুখের বাম দিকটা ডেকে বললাম, ‘ঠিক আছে, তবে সংযোগ পদ্ধতিতে’। এর পর থেকে থু থু খাওয়ানোর কথাটা সে কাউকে বলেছিল বলে জানা যায় না। আরেকবার ফাস্ট ইয়ারে থাকতে ক্লাসে বসে দু জনে মিলে একটা কবিতা লিখলাম। ও দু লাইন, আমি দু লাইন। প্রফেসরের লেকচার চলছে, আমাদের কবিতা এগুচ্ছে। তখন মনে হচ্ছিল, বিশাল কিছু একটা কিছু তৈরি হয়েছে। আফসোস, সেই কবিতা আমরা দু জন ছাড়া আর কেউ পড়তে পারে নি। মহাশূন্যের বিশাল গর্ভে বৃহৎ সৃষ্টিটা হারিয়ে গেছে।

ছোট বেলায় ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখেছি। ইউনিভার্সিটি জীবনে গবেষণামূলক কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ি। বিদেশে আসার পর মেলা বছর ওই মুখো আর হয় নি। বছর পাঁচেক আগে ঠিক করলাম গল্প লিখবো। বললেই তো আর সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। তার পরেও সাহস করে কলম ধরলাম। ব্লগ, ফেসবুকে দেয়া আরম্ভ করলাম। বেশ কিছু পাঠক পছন্দ করলো। কিন্তু সব চেয়ে বেশী উৎসাহ এলো প্রিয় বান্ধবী বাণীর কাছ থেকে। আমার প্রতিটা লেখা তার ভাল লাগলো। আমাকে বড় বড় লেখকদের সাথে তুলনা করে ফেললো। আমার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখতে পেলো। আমার বেশীর ভাগ লেখা পড়ে বলতো, ‘সিক্যুএল (sequel) বানাও।’ আমার কোন ছোট গল্প আচমকা (শেষ হওয়াই হইল না শেষ) সমাপ্ত হলে জানিয়েছে লেখাটা আরও দূর যাওয়া উচিত ছিল। বাণী আমার গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে সহজেই বন্ধুত্ব করে ফেলে। হয়ত এই চরিত্রগুলো তার কাছে থাকার মানে হল পক্ষান্তরে আমাকে কাছে রাখা। বাস্তবে সে না বুঝলেও , আমি তো জানি, বন্ধুত্ব সাহিত্যের থেকে ঢের বড়। সাহিত্যের কি ক্ষমতা বন্ধুত্বকে পরিমাপ করার।

প্রিয় বান্ধবী নীলিমা আক্তার বাণী এখন সরকারি ডাক সাইটে অফিসার। ধরেই নিয়েছি সে খুবই ব্যস্ত একজন মানুষ। গত বই মেলায় আমার কয়েকটা বই’র মোড়ক উন্মোচন হল। সেখানে নিজের কোন মানুষ থাকলে হয়ত ভাল লাগতো। কিন্তু না সে রকম হল না। বাণী মোড়ক উন্মোচনের কথা জানলো কয়েক দিন পরে। আমার থেকে জানতে চাইলো আমি খবরটা তাকে আগে কেন দেয় নি। আমি নিচু গলায় উত্তর দিল, ‘ভাবলাম তুমি ব্যস্ত মানুষ, তোমার সময় কোথায়?’ বাণী প্রকৃত বন্ধুর মতই জানালো, ‘তোমার জন্যে আমার সব সময়েই সময় আছে।’

আমরা দুই বন্ধু পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকি না কেন, আমাদের মাথার উপরে একই নীল আকাশ, একই তারার মিটি মিটি আলো, একই চাঁদের মোহনীয় হাতছানি। একই সূত্রে আমরা বন্ধুত্বের ভালোবাসায় বাঁধা। আমরা কখনই বিচ্ছিন্ন হব না, কারণ আমাদের বন্ধুত্বের আবাস যে আমাদের হৃদয়ে! "A strong friendship doesn't need daily conversation or being together. As long as the relationship lives in the heart, true friends never part” আবারও বলি, আমরা কখনই বিচ্ছিন্ন হব না, কারণ আমাদের বন্ধুত্বের আবাস যে আমাদের হৃদয়ে!

আগস্ট ৭, ২০১৬

Friendship Day

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com

www.lekhalekhi.net