ততক্ষণ ক্ষণে ক্ষণে 

কেওড়া পানি নিশ্চয়ই চিনেন। কেওড়া তেল। তাও বাঙালির কাছে পরিচিত। কেমন যেন মিষ্টি গন্ধ কেওড়া নামটার সাথে জড়িত। এখন যদি জানতে চাওয়া হয় কেওড়া জিনিসটা আসে কোথা থেকে? কিছু মানুষ মাথা চুলকাতে পারেন। তাদের জন্য একটু হিন্টস দেই। এইটার উৎস উদ্ভিত থেকে। সেখান ফুল ও ফল দুটোই হয়। আরেকটু বলি, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে এই ফুল হয়। ফুলে কেমন একটা মাদকিয় গন্ধ আছে। রঙটা শ্বেত বা সাদা। আশ্বিন কার্তিক মাসে গুচ্ছাকারে ফল হয়। ফুলের মিষ্টি গন্ধ থাকলেও, ফলের স্বাদ একেবারে তিতা। ফল গাছের মধ্যে গুচ্ছাকারে থাকে। দূর থেকে আনারস মনে করে ভুল হতে পারে। 

চিনে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। আমি বলছি কেয়া ফুলের কথা। ফুল ও তার গন্ধ নিঃসন্দেহে যে কারোরই দৃষ্টি কেড়ে নিবে। ফুলটার চারিদিকে কিন্তু কাঁটাতে ভরা। আগেই বলেছি, কেয়ার গন্ধ গভীর ও মাদকতাপূর্ণ। গন্ধে পাগল হয়ে ভ্রমর দল ছুটে যায়। কিন্তু ফুলে মধু নেই। মধু লোভীরা হয়ত কাঁটার খোঁচা খায়। তাদের ভালোবাসা বিফলে যায়। তবে কেয়া ফুল থেকেই তৈরি হয় কেওড়া পানি ও তেল। আমাদের প্রিয় পোলাও বিরানি থেকে আরম্ভ করে নানা ধরণের মিষ্টিতে কেওড়া পানির ব্যবহার। জানা যায়, আড়াই হাজার বছর আগেও হিমালয়ের উঁচু স্থানে কেয়া ফুল ছিল। আমাদের প্রাচীন সাহিত্য ও লোক কাহিনীতে কেয়া ফুলের উল্লেখ আছে। কবি নজরুল ইসলাম কেয়া ফুলকে নিয়ে কাব্য রচনা করে গেছেন, ‘রিমি ঝিম রিমি ঝিম ঐ নামিল দেয়া।’

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু কেয়া ফুলের মাহাত্ম ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার চেষ্টা করছি না। আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব তন্বী, সদ্য প্রফুল্ল, অপরূপা একটা মেয়ের সাথে। ফুলের নামে তার নাম। তার নাম কেয়া। বাবা তার ভাল লাগা ফুলের নামে নাম দিয়েছিলেন কেয়া। উচ্চতা বাঙালি মেয়ে হিসেবে ভালই বলতে হবে। অন্যদের থেকে মাথাটা উঁচুই থাকে। একহারা গড়ন মানে ইংরেজিতে বললে স্লিম ফিগার। চলনে, বলনে পূর্ণ স্মার্ট। বাংলা কথা বলে স্পষ্ট উচ্চারণে। আঞ্চলিকতার কোন ভাব নাই। একেবারে বিদেশীদের মত ইংরেজি বলতে পারে। যেই মেয়ের এত গুণ, সে ব্যক্তি জীবনে কি করে? সেইটা না হয় কিছু পরেই বলি। তবে এটা বলে রাখি, সিনেমার পরিচালকরা এই পর্যন্ত তাকে বেশ কয়েকবার নায়িকা হওয়ার অফার দিয়েছেন।

সালটা ১৯৯০। মধ্যপ্রাচ্যে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। সাদ্দাম হোসেনের ইরাক কুয়েত দখল করে নিয়েছে। কুয়েতে পুনুরুদ্ধারের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অনেকগুলো দেশ এক হয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেয়া আরম্ভ করল। এত বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে সাদ্দামের ইরাক কয় দিন টিকতে পারবে, সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। অন্যদিকে সাদ্দামও প্রচুর হম্বিতন্বী করল, তাকে আক্রমণ করলে শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত সে লড়ে যাবে। প্রয়োজনে ক্যামিকেল অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না। শত্রুদেরকে লেজ তুলে পালাতে হবে। না হয় বহু বছর ধরে যুদ্ধ চলতে থাকবে। মার্কিনীদের জন্যে ইরাক হবে আরেক ভিয়েতনাম।

প্রচুর বাঙালি কুয়েত ও ইরাক, দুদেশেই বিভিন্ন ধরণের কাজ করতেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে সাধারণ শ্রমিক। যুদ্ধের দামামা বাজার আগেই মধ্যে নানা কথা বার্তা চলতে লাগল। বলা তো যায় না যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেয়। তবে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি যে হবে, সে ব্যাপারে সবাই একমত। প্রবাসী বাঙালিদের একটা অংশ ঠিক করলেন, এখানে থেকে জান দেয়ার কোন মানে হয় না। কাজ কর্ম এমনিতেই হচ্ছে কম। তার পরে অনেক কোম্পানি বেতনও দিচ্ছে না।

ডাঃ সালেহ কুয়েতের আল সাবাহ হাসপাতালের ডাক্তার। কাজে বেশ ব্যস্ততা। ডাক্তার হয়ে কাজের কমপ্লেন করলে কি আর চলে? তবে বেতন বাংলাদেশে থাকলে যা হত তার কমপক্ষে চারগুণ বেশী। দেখতে দেখতে কুয়েতে চাকরির বয়স পাঁচ বছর হয়ে গেল। আরও পাঁচ বছর কাজ করলে ভালই টাকা জমে যাবে। তার পরে দেশে যেয়ে একটা বড় ক্লিনিক খোলার ইচ্ছা। আত্মীয় স্বজন ছেড়ে বিদেশ বিভুয়ে আর কত দিন থাকা যায়! দেশে থাকার মধ্যে কত আরাম। অল্প খরচে কাজের মানুষ, ড্রাইভার রাখা যায়। তার ইচ্ছা দেশে ক্লিনিকে কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তারকে চাকরি দিয়ে নিজের উপর চাপটা কমিয়ে আনা। সারাটা জীবন নিজের উপর তো কম ধকল গেল না।

পুরো পরিবার নিয়ে ডাঃ সালেহ থাকেন। পরিবার বলতে স্ত্রী মালিহা এবং কন্যা কেয়া। মালিহা মোটামুটি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে কুয়েতে। তাকে ঘর, বাহির দুটোই সামাল দিতে হয়। মেয়েকে গাড়ি চালিয়ে স্কুলে দিয়ে আসেন। পরে স্কুল ছুটি সময় যেয়ে নিয়ে আসেন। বাড়িতে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা কাজের বুয়া আছে। সে ভালই রান্না বান্না জানে। তার পরেও সুযোগ পেলে মালিহা তাকে সাহায্য করেন। চাকরি না করলেও ঘর-বাইরের সব কাজ তার এখতিয়ারভুক্ত; হউক না সেটা বাজার সদাই কিংবা দেশে যাওয়ার জন্য টিকিট ।

কেয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ালেখা করে। এই বছরে এ লেভেল মানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিবে। বাবার ইচ্ছা মেয়ের এ লেভেল হয়ে গেলে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়ার। ওখানে মেডিকেল পড়ে ডাক্তার হবে। পরে বাবা-বেটি দু জনে এক সাথে নিজেদের ক্লিনিকে কাজ করবে। মেয়ে পড়া লেখায় বাবার মতই তুখার। ক্লাসে বিভিন্ন দেশের ছেলে মেয়ে পড়ে, কিন্তু সেরা হল বাংলাদেশের মেয়ে কেয়া। বাবা সুযোগ পেলেই গর্ব করেন, “দেখতে হবে না কার মেয়ে?”। মালিহা বেশীর ভাগ সময়ে এ কথার কোন উত্তর দিতেন না। কেমন জানি মাথা নিচু করে অন্য ঘরে করে চলে যেতেন। কিন্তু কেয়া ভালই করেই জানে, তার প্রতিটা কাজ কর্মেই মা। বাবা হয়ত অর্থের জোগান দেন; তার জীবনে মা’র অবদান অবশ্যই অনেক।

ডাঃ সালেহ অন্য বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, আপাতত কুয়েত ছেড়ে চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যুদ্ধ যে হবে সে ব্যাপারে কোন সংশয় নাই। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বোমা মেরে ছাতু বানিয়ে ফেলবে। হয়ত হাসপাতালে বোমা ফেলবে না। কিন্তু সাদ্দাম কেমিক্যাল বোমা ব্যবহার করলেই মহা বিপদ। সাদ্দাম কুর্দিদের উপরে ইতিমধ্যে কাজটা করেছে। যুদ্ধে অস্ত্রটা হয়ত আবার কাজে লাগাবে। ফলাফল নিশ্চিতভাবে ভয়াবহ। যাই হোক, ডাঃ সালেহ ও তার পরিবার ঠিক করলেন, প্রথমে লন্ডনে কেয়ার বড় চাচার কাছে কয়েকদিন থেকে দেশে যাবেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর চাকরি থাকলে আবার না হয় কুয়েতে ফিরে আসা যাবে।

কেয়া ছোট বয়স থেকে বুঝতে পেরেছে, বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে কোথায় যেন গরমিল আছে। পরিবারে সব কিছু আছে, সব কিছু হলেও; মা বাবাকে কেমন যেন এড়িয়ে চলেন। কেন এড়িয়ে চলেন? কেয়ার ছোট মাথায় অনেক কারণ খেলে যেত। তার বন্ধু-বান্ধবীদের বাবা মা’রা সুযোগ পেলে এক সাথে মিলে মিশে হৈ চৈ, হাসা হাসি করে; এ দিক সে দিক বেড়াতে চলে যায়। কিন্তু তারা তিন জনে সাধারাণত একসাথে কোথাও যায় না। বাবা মা দুজনে খাবার টেবিলে এক সাথে বসে না। এক জনের খাওয়া শেষ হলে অন্যজন আসে। কেয়া বেশীর ভাগ সময়ে মায়ের সাথে থাকলেও বাবা মাঝে মাঝে তাকে ডেকে নেন। কেয়া মনে কোন সন্দেহ নাই দু জনই তাকে ভালোবাসে। তারপরেও এরা একে অপরকে কেন যে দূরে সরিয়ে রাখেন।

ডাঃ সালেহ দেশ ছাড়ার এক বছর পরে পরিবার আনালেন। ফুটফুটে মেয়েটা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। দেশে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তো। বিদেশে স্কুলে ভর্তি হয়ে তেমন কোন সমস্যা হয় নি। পড়ালেখায় দেশে ভাল ছিল, কুয়েতে দেখা গেল সে একেবারে ক্লাসের শীর্ষে। ছবি আঁকা, মিউজিক, দাবা, বিতর্কে নাম করলো। প্রায়ই প্রতিযোগিতা লেগে থাকে। পুরস্কার পেলে কেয়া বাবা, মা দু জনকেই সাথে নিয়ে যেতে চায়। বাবা ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে বলেন পরের বার যাবেন। বাবা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে না গেলেও, তিনি নিজে কেয়ার জন্যে দামী কোন উপহার নিয়ে আসতেন। কিন্তু কেয়ার মন তাতে ভরতো না। জিদ করে কয়েকবার বাবাকে সে ঠিকই নিতে পেরেছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে আরেক জায়গায়। মা তখন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সাথে না যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কেয়া বাবা মাকে শব্দ করে ঝগড়া করতে দেখে নি। একবার পাকিস্তানী বন্ধু নীনার বাসায় যেয়ে দেখল ওর বাবা মা চিৎকার করে ঝগড়া করছেন। কেয়া এ রকম পরিস্থিতির সাথে পরিচিত ছিল না। আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। নীনা আসস্থ করলো ভয়ের কিছুই নাই। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এ রকম হৈ চৈ প্রায়ই হয়। নীনার কথা সত্য প্রমাণিত হল। কিছুক্ষণ পরেই সবাই মিলে আইসক্রিম খেতে বের হল। দুই প্রতিপক্ষেরই হাসি খুশী মুখ। কত রকম কথাই না তারা বলছেন। মেয়ে ও তার বান্ধবীর সাথে দুষ্টুমি করলো। কেয়া অবাক হওয়ার আরও বাকী ছিল। নীনার বাবা প্রথমে নীনার মাকে নিজের হাতে আইসক্রিম খাইয়ে দিলেন। মাও একই কাজ করলন। কেয়া দেখল ওদের দু জনের চোখে মুখে কি দারুন ভালোবাসার ভাষা! ক্ষণিকেই কেয়ার মনে এলো নিজের বাবা মায়ের মুখ। ইস তারাও যদি এরকম ঝগড়া করতেন, তার পরে ভালোবাসার সাগরে না হয় ভেসে বেড়াতেন।

ডাঃ সালেহকে পেশার কারণেই অনেক কথা বলতে হয়। উনার উপস্থিতি যে কোন আসরকে প্রাণবন্ত করে তুলে। মেয়ের সাথে মেলা কথা, হাসাহাসিৎ কোন শেষ নাই। মেয়ের সব খবরই তার নখ দর্পণে। কিন্তু রুমে যদি মা এসে পড়েন কোন কারণে, বাবার মুখ সাথে সাথে চুপসিয়ে যায়। অন্যদিকে মালিহা বেশ কথা বার্তা বলেন। কিন্তু স্বামীর উপস্থিতিতে সেও গম্ভীর হয়ে যায়। কেয়া ভাল করেই জানে, বাবা মা একজায়গায় থাকা মানে থমথমে পরিবেষ সৃষ্টি হওয়া। কেয়া মোটামুটি নিশ্চিত, কোথাও কোন একটা বড় সমস্যা আছে। না হলে বাবা মা’র সম্পর্ক এত শীতল, এত কঠিন হয় কী করে?

লন্ডনে প্রথম কয়েকদিন ভালই গেল। চাচার সাথে ঘুরা-ফেরা, খাওয়া দাওয়া, আনন্দ ভালই চলল। ছোট ভাইয়ের সাথে অনেক দিন পরে দেখা। অফিস থেকে পুরো এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে নিলেন। চাচা কোন এক ব্যাংকের বড় পদে আছেন। চাচী বিদেশী। সেই জন্যে বাঙালিদের সাথে তেমন মেলামেশা নাই। লন্ডনে এত বাঙালি থাকা সত্ত্বেও তার তেমন একটা বাংলা বলা হত না। ছোট ভাই ও তার পরিবারকে পেয়ে যেন তিনি আকাশের চাঁদ পেলেন। এত দিনে বুঝি তার বস্তা বস্তা কথা জমে গিয়েছিল। ভাইয়ের সাথে শুধু কথা ও কথা আর হাসা হাসি। বেশীর ভাগই ছোট বেলায় গ্রামে বেড়ে উঠার সময়কার গল্প। অবশ্য বড় চাচার কাছে কেয়া, মালিহাদের জন্যও মজার মজার গল্প ছিল। সকাল থেকে কখন রাত হয়ে যায়, তা কেউ ঠাওর করতে পারতো না।

যাই হোক, এই নশ্বর পৃথিবীতে সব কিছুরই পরিসমাপ্তি আছে। সপ্তাহ গড়াতে সময় লাগলো না। শেষের দিকে আলোচনা আরম্ভ হল ডাঃ সালেহ ও তার পরিবারের করণীয় কি হতে পারে। মালিহা তার কোন মতামত জানাল না; অনেকটা কুয়েত, লন্ডন কিংবা ঢাকা, কোথাও তার তেমন কোন যায় আসে না। তার কাছে সবই এক। কেয়া একটা ব্যাপার লক্ষ করলো, চাচার সাথে কথা বলছে, হাসা হাসি করছে। মালিহা স্বামীর চোখের দিকে চোখ রেখে কথা না বললেও, ভাসুরের সাথে কি সুন্দর মাথা উঁচু করে কথা বলে যাচ্ছে। বড় চাচা কেয়াকে বললেন, “তুমি লন্ডনেই থেকে যাও। এখানে এ লেভেল পরীক্ষা দিতে পারবে। তার পরে একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে যেও।”

বাবা অবশ্য যুদ্ধ শেষ হলেই কুয়েতে ফিরে যাবেন বলে ঘোষণা দিলেন। তার ক্লিনিক বানানোর জন্যে আরও টাকা জমাতে হবে। লন্ডনে থাকলে ডাক্তারী লাইসেন্স বানাতে হবে, ইমিগ্রেশনের পারমিশন নিতে হবে, চাকরি খুঁজে পেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক ঝামেলার কথা বললেন। বড় চাচা বললেন, তার পরিচিত এটর্নি আছে, তার ফার্ম সব ব্যবস্থা করে দিবে। তার পরেও বাবাকে লন্ডনে থাকতে রাজী করানো গেল না। অন্যদিকে কেয়ারও ইচ্ছা লন্ডনে থেকে যাবার। ভবিষ্যতে এখানে আসার প্ল্যান তো আগের থেকে করা ছিল। কয়েক দিন আগেই না হয় এসে পড়েছে। তাতে বিশেষ কি আর যায় আসে? তার চেয়ে বড় কথা, মা লন্ডনে কত হাসি খুশী হয়েই না আছেন। আগে তো সব সময়ে মুখ গোমরা করে রাখতেন। চাচা বলেই রেখেছেন, তার এই বিশাল বাড়িতে সবাই একসাথে থাকলে কোন অসুবিধা হবে না। তবে ছোট ভাই চাইলে সুযোগ সুবিধামত অন্য বাসা নিতে পারে। তবে তখন শর্ত একটাই হবে, ছোট ভাইয়ের বাসা তার বাসার কাছাকাছি হতে হবে।

ফেব্রুয়ারি ২৮, ১৯৯১ যুদ্ধটা শেষ হল। স্থায়িত্ব হল মাত্র ৪২ দিন। কুয়েত থেকে ইরাকি সৈন্যরা হয় পালিয়ে গেল না হয় আত্মসমর্পণ করলো। কিন্তু যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হল। মার্কিন ও পশ্চিমাদের বিরতিহীন বোমা বর্ষণে ছোট দেশটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। ইরাকিরা পালানোর আগে তেলের খনিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। অবশ্য অনেকে বলে, ইরাকিরা না মার্কিনীরা এই কাজ করেছে। তবে লাভ যে হল পশ্চিমাদের তা সবারই জানা। আগুন নেভাতে যুক্তরাষ্ট্রের দমকাল বাহিনী উড়ে এলো। দেশটার অবকাঠামো মেরামতের বেশীর ভাগ কাজ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো পেল। মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দা দূর হল। সেখানাকার নেতারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাদের মনে হল পরের নির্বাচনে বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু বিধি বাম। থলের বিড়াল বের হয়ে পড়ল। যুদ্ধের প্রকৃত কারণ সবার জানা হয়ে গেল। রিপাবলিকানদের পরের নির্বাচনে ভরাডুবি হল। ডেমোক্রেট বিল ক্লিনটন এমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। 

যাই হোক ফিরে আসি ডাঃ সালেহ’র পরিবারের হাল হকিকতে । যুদ্ধের পরের খবর এলো, ডাঃ সালেহ যেন দ্রুত কাজে যোগদান করে। উনি দেরী করলেন না। তড়িঘড়ি করে ছুটলেন কুয়েতে। ঠিক হল, কুয়েতের অবস্থা ভাল হলে মা-মেয়ে দেশে যাবে। এর মধ্যে কেয়া লন্ডনে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে। পড়ালেখা, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরে সিদ্ধান্ত কিছুটা সংশোধন হল। কেয়া আপাতত কুয়েতে যাবে না। একবারে এ লেভেল শেষ করে বাবার কাছে যাবে। এইদিকে অদ্ভুত ঘটনা হল। কেয়া যাবে না শুনে মা ঘোষণা দিলেন, কেয়া যেহেতু কুয়েত যাচ্ছে না, তিনিও যাবেন না। কেয়ার মাথায় ঢুকল না এইটা কেমন কথা? সে এখন বড় হয়েছে। নিজের যত্ন সে নিজেই নিতে পারে। তার সাথে সারাক্ষণ মায়ের থাকার কোন দরকার নাই। মা’র বাবার সাথে যাওয়া উচিত। স্বামী স্ত্রীরা একসাথেই থাকে। মায়ের ঘোষণায় বাবা কিংবা বড় চাচু; কেউ প্রতিবাদ করলেন না। তবে মনে হল, বড় চাচার এই ব্যাপারে একটা মৌন সম্মতি আছে। 

বাবার কি অভিমান ছিল? হয়ত ছিল। লন্ডন থেকে ফিরে যাওয়ার সময়ে এয়ারপোর্টে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন। কেয়ার অবাক হওয়ার কোন সীমা পরিসীমা থাকল না। বাবাকে সে আগে কখন কাঁদতে দেখে নি। মনে হচ্ছিল মেয়ের সাথে বুঝি আর দেখা হবে না। হয়ত এমন হতে পারে, তিনি হয়ত ভাবছেন আবার যদি যুদ্ধ হয়, তার যদি প্রিয় কন্যার সাথে দেখা না হয়। এয়ারপোর্টে মা এসেছিলেন; কিন্তু আগের মত একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকাল না। ওদের ছেড়ে ইমিগ্রেশনে ঢোকার ঠিক আগে বাবা চাচুকে জড়িয়ে ধরলেন। ভেজা চোখে বললেন, “মেয়েটা তোমাকে দিয়ে গেলাম।”

লন্ডনের কিংস কলেজে কেয়ার এডমিশন হতে কোন সমস্যা হল না। ও লেভেলে কুয়েত থেকে করা ছিল, তার পরে লন্ডনে এ লেভেল পরীক্ষায় ভাল রেসাল্ট হল। প্রথম বছর টিউশনে অনেক খরচ হল। বিদেশী ছাত্রদের কিংস কলেজে স্থানীয় ছাত্রদের তুলনায় তিনগুণ বেশী বেতন দিতে হয়। ব্যাপারটা জানার পরে কেয়া ভাবছিল, কম খরচে অন্য কোন কলেজে পড়ালেখা করলে কেমন হয়। ইচ্ছা ছিল বাবার সাথে আলাপ করে মনে ইচ্ছার জানানোর। কেয়া এখন চাচ্ছে ক্লিনিক বানানোর ফান্ড থেকে যত টাকা খরচ করা যায়। বাবার ইচ্ছা যে তারও ইচ্ছায় পরিণত হয়েছে। তবে বাবা সরাসরি কলেজে কেয়ার প্রথম বছরের পড়ালেখার খরচ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। 

বড় ছুটি ছাঠা থাকলেই কেয়া বাবার কাছে যেয়ে সময় কাটিয়ে আসত। প্রথমদিকে মাকে সাথে যেযাওয়ার জন্যে সাধত। কিন্তু কোনবারই উনি যেতে রাজী হয় নি। পরে কেয়া একাই চলে যেত। বাবার সাথে খুব ভাল সময় কাটত। ঘুরা ফেরা, হৈ চৈ, আনন্দ, খাওয়া দাওয়া করে মন একেবারে তরতাজা হয়ে যেত। বাবার ছিল একাকিত্ব ও একঘেয়েমি কাজের চাপ। কেয়াও মেডিকেলে পড়ার চাপে একেবারে ন্যুব্জ প্রায় হয়ে যেত। সে জন্য এক ছুটি শেষ হওয়ার আগেই পরের ছুটির বিস্তারিত পরিকল্পনা চলতে থাকত। বাবাকে বললেও তিনি লন্ডনে আসতে রাজী হতেন না। অবশ্য বাবা মেয়েকে নিয়ে দু বার সুইটজারল্যান্ড, প্যারিস, রোম ঘুরেছেন। 

কেয়ার জানা ছিল না বাবা গান গান গাইতে পারেন। তবে সব বাংলা। হোটেলে রুমে সুযোগ পেলেই গান গাইছেন। কেয়ার বাংলা গানের দিকে তেমন আগ্রহ ছিল না। বাবা গান ধরলে কেয়া কানে হেড ফোন লাগিয়ে কোন গল্পের বই খুলে বসত। একবার খেয়াল করে দেখল, একটা গান গাওয়ার সময়ে বাবার চোখ অশ্রুতে ভরে হয়েছে। কেয়া হেড ফোন সরিয়ে শোনার চেষ্টা করল, বাবা কি গান গাইছেন। লিরিক্স খুব একটা বুঝতে পারল না। বাবা পর পর চার বার একই গান গাইলেন। তার পরে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। তার চোখ বেয়ে অশ্রুর বন্যা বয়েই চলল। কেয়া আর ধৈর্যের বাঁধ ধরে রাখত পারল না। বাবাকে যেয়ে বলল গানটার প্রতিটা প্রতিটা শব্দের অর্থ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে। বাবা এক লাইন করে গাইলেন, তার পরে অর্থ বুঝালেনঃ 

ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো

দিও তোমার মালাখানি। বাউলের এই মনটারে

ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছে তুমি হৃদয় জুড়ে। 

কেয়া বুঝল না বাবার মনে এত কিসের হাহাকার? বাবা কি তা হলে কাউকে ভালোবাসতেন? না প্রশ্নটা বাবাকে করা হল না। একটা সংশয় কাজ করল। কিন্তু বাবা তার কন্যাকে ধরে ধরে পুরো গানটা তুলে দিলেন। দু ঘণ্টার মধ্যে কেয়ার একটা বাংলা গান অর্থ সহ শেখা হয়ে গেল। বাবা উঠার আগে বললেন, “মারে আমি যখন থাকব না; তখন কিন্তু আমারে ভুলে যাবি না।” একটু বুকি হাসার চেষ্টা ক্রে বললেন, “ তুই আমাকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিবি।” কেয়া বাবার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাবা, তোমার আকাশে যাওয়ার কোন দরকার নাই। আমি তোমাকে এ রকম করে ধরে রাখব।” এর পরে দু জনে মিলে এই গানটা যে কতবার গেয়েছেন, তা কোন ইয়ত্তা নাই। 

সেই বার বাবা মেয়ে ইটালি সফরে এসেছিল। রোম ঘুরার সময়ে বাবা বললেন তার এক ছোটবেলার বন্ধু মিলানে থাকেন। ওখানে যে বাংলাদেশের কনস্যুলেট আছে, সেখানকার বড় কর্মকর্তা। তাকে সাররাইজ দেবার উদ্দেশ্যে একটা গাড়ি ভাড়া করে ড্রাইভ করে দু জনে রওয়ানা দিল। ছ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু মাঝ রাস্তায় বাবার বুকের ব্যথা আরম্ভ হল। কেয়া বাবাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে। তারা বলল, হার্ট এটাক। ডাক্তাররা বললেন, “ভাগ্যিস সময়মত এসেছিলেন। না হলে বড় ধরণের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।” হাসপাতাল থেকে তিন দিন পর ছাড়া পেলেন, কিন্তু বলা হল মাস খানেক রেস্ট নিতে হবে। সাথে সাথে কোন অনিয়ম করা যাবে না, খাবার ও স্ট্রেস কন্ট্রোল করতে হবে। কেয়া বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছিল বাবার সাথে সে কিছুদিন যেয়ে থাকবে। বাবা একেবারে রাজী হলেন না। তার এক কথা, কেয়া কোনভাবে ক্লাস মিস দিতে পারবে না। 

এই ঘটনার পর কেয়ার জীবন গ্রন্থের একটা অধ্যায়ের দ্রুত সমাপ্তি হল। বাবা কুয়েতে ফিরে গেলেন। যাওয়া মাত্রই ভুলে গেলেন মাত্র কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে ঘুরে এসেছেন। কাজের চাপে চাপা পরে গেল ইটালির ডাক্তারদের সব সাবধান বাণী। নিজে ডাক্তার, সারাক্ষণ রুগী নিয়ে কাজ করছেন, প্রয়োজনীয় উপদেশ দিচ্ছেন; তার পরেও নিজের বেলায় সে সব কিছুই অগ্রাহ্য করলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হল। একদিন আর্জেন্ট কল এল চারতলায় রুগী অবস্থা খুবই খারাপ। একজন ডাক্তার সেখানে সেই মুহূর্তেই দরকার। তখন ডাঃ কায়েসই ছিলেন তার অফিসে দু তলায়। তিনি তাড়াহুড়া করে ছুটলেন সংকটাপন্ন রুগীকে দেখতে। লিফট আসতে দেরী হচ্ছিল বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠা আরম্ভ করলেন। যখন রুগীর সামনে উপস্থিত হলেন, তখন তিনি রুগীকে কি দেখবেন নিজেই পড়ে গেলেন মেঝেতে। রুগী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখল তার সামনে একজন ডাক্তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

ডাক্তারী পড়া তো আর চাট্টিখানি কথা না। মেলা চাপ। দম ফেলার সময় নাই। কেয়া একেবারে দাঁতে দাঁত চেপে লেগে আছে ডাক্তার হওয়ার জন্যে। ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন বলতে হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে একেবারে ১০০% স্কলারশিপ হয়ে গেল। কলেজে তো কোন খরচ লাগছেই না; উপরন্তু হাত খরচটাও চলে আসছে। সেই ছোট বেলার মত ক্লাসে পসিশন একেবারে শীর্ষে। প্রতিযোগিতা অনেক । লন্ডনের নাম জাদা স্কুল বলে কথা। সারা পৃথিবীর সেরা ছাত্রদের চোখ এখানে। এডমিশন পাওয়া মানে একেবারে সেরাদের সেরার দলে স্থান পাওয়া। সেখানে বাঙালি মেয়ে অন্যান্য সব ছাত্র-ছাত্রীদের ছাড়িয়ে ক্লাসের তপ পজিশন দখল করে রেখেছে। স্কলারশিপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ রকম মেধাবী ছাত্র যে কোন কলেজের মান বাড়ায়। 

ছাত্র -ছাত্রীদের এখানে দিন নাই, রাত নাই; শুধু কাজ আর কাজ। ক্লাসের বাইরে এরা হয় ইয়া মোটা বই খুলে পড়ালেখা করে, না হয় প্রফেসরদের সাথে রুগী দেখে। একদল যুবা ছেলে মেয়ে এত কাছাকাছি আসলে যে ব্যাপারটা অনেকটা অনিবার্যভাবে হয়, সেটা হল প্রেম। বেশ কিছু ছেলে মেয়ে শত ব্যস্ততার মাঝে প্রিয়জনের জন্যে সময় ঠিকই বের করে নেয়। হয়ত অন্যদের মত নিয়মিত হয় না, তারপরেও যতটুকু করতে পারে, তাতেই আনন্দ। তবে সব ছাত্র ছাত্রী যে বিশেষ প্রিয় জন খুঁজে নিয়েছে, তা কিন্তু না। বেশ কয়েকজনের চিন্তাভাবনা পড়ালেখা শেষ করে ডাক্তার হওয়ার পরে ঐ ধরণের চিন্তাভাবনা মাথায় আনার। এই দলের একজন হল কেয়া। তার একমাত্র লক্ষ্য প্রথমে ডাক্তার হওয়া, তারপরে বাংলাদেশে যেয়ে তার ক্লিনিক বানানোর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়া। কোন ছেলেকে বিশেষ সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য সময় দিতে সে এখন প্রস্তুত না। 

লম্বা, ফর্সা, টান টান ফিগারের কেয়া যখন হেঁটে যায়, তখন ছেলে মেয়ে সবাই এক পলক হলেও বিস্ময় নিয়ে তাকায়। একজন মেয়ে এত মায়াবিনী সুন্দর হয় কী করে। টানাটানা চোখ দুটো চশমা দিয়ে ঢাকা থাকলেও, সেগুলো যে কোন যুবকের মন মুহূর্তেই অস্থির করে দিতে পারে। একেবারে বরফের মত অদ্ভুত শীতল ও আটলান্টিকের থেকে বেশী গভীর। মনটা পূর্ণ হতে সময় লাগে না। কেয়া মেধাবী, তার পরে এমন পাগল করা সুন্দরী। এই পর্যন্ত জীবনে কম ছেলে সম্পর্ক করার চেষ্টা করে নি। এক সময়ে মনে হত একজন বিশেষ কেউ থাকলে কিন্তু নেহায়েত খারাপ হয় না। কিন্তু বাবা মারা যাবার পরে সম্পর্ক করার চিন্তা মাথার ঝেড়ে ফেলেছে। বাবা তার উইলে লিখে গেছেন, মেয়ে ডাক্তার হওয়ার পরে দেশে ক্লিনিক করার জন্যে তার সারা জীবনের সঞ্চয় টাকাগুলো পাবে। মেয়ে যদি ডাক্তার না হয়, তা হলে টাকাগুলো কোন এক এতিমখানায় দান করা হবে। 

কেয়ার মত আর মাত্র একজন পুরো স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছিল। ছেলেটার নাম স্কট। তাকে যে কেন স্কলারশিপ দেয়া হচ্ছিল, সেটা ক্লাসের অন্যদের খুব একট বোধগম্য না। সকালের ক্লাসে প্রায় দিনই দেরী করে আসে। অন্যরা যেখানে একটা ক্লাস মিস হয়ে গেলে, একগাদা হা হুতাশ করে। সেখানে সকালের ক্লাসে দেরী করে আসা ছাড়াও, প্রায় সপ্তাহে দু চারটা ক্লাস অনুপস্থিত থাকে। কিন্তু ক্লাসে যখন থাকে আলোচনা, পড়া, পরীক্ষা দেয়া ধরণ দেখলে মনে হতে পারে সে হয়ত আগে এই ক্লাস করেছে। তার সম্পর্কে অনেক ধরণের মতবাদ চালু আছে। কারোর ধারনা প্রফেসরদের থেকে অন্যদের অজান্তে সে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পায়। মানে নিচু গলায় তারা বলে, অনেক বড় লোকের ছেলে তো প্রশ্ন আগেই পেয়ে যায়। আরেক দলের ভিন্ন মত, স্কট আসলে জিনিয়াস। এই কলেজে আসার আগেও সে সব সময়ে ক্লাসে ফাস্ট, সেকেন্ড হয়ে এসেছে। বাবা বড় লোক ঠিকই। কিন্তু সে নিজের যোগ্যতায় স্কলারশিপ পেয়েছে। সারা রাত ধরে পড়ালেখা করার জন্যে সকালে সময়মত উঠতে পারে না। জানা থাকে বলেই ক্লাসে ও পরীক্ষায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।

ডাঃ সালেহ নামের এক জন মানুষ যে এক সময়ে পৃথিবীর বুকে একটা বিশাল বড় স্বপ্ন নিয়ে বসবাস করেছিল, সেটা তার আপন ভাই ও তার সহ ধর্মিণী অনেক সহজেই ভুলে গেল। শুধু ভুলে গেল বললে কম হবে। তাকে হয়ত অগ্রাহ্য করল। কিন্তু দুজনে মিলে একটা কাজ করল যেটা অন্য কারো পক্ষে চিন্তা করাটাও সম্ভব ছিল না। বিষয়টা কেয়া ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি। হয়ত বাবা জানতেন এ রকম কিছু একটা ঘটতে পারে, সে জন্য বাবা নীরবে দূরে থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। 

মালিহার বাসা ছিল ঢাকার কলাবাগান এলাকায়। ইডেন কলেজে পড়ত। রিকশা করে যেত। অবশ্য একা না। সাথে বান্ধবী ফিরোজা থাকত। মালিহার বাসার থেকে তিনটা বাসা পরে যে দু তলা লালা বাসাটা, সেখানকার উপর তালায় থাকে। সকালে মালিহা বাসা থেকে বের হয়ে হেটে ফিরোজাকে সাথে নিয়ে রাস্তার মোড় থেকে রিকশা নিয়ে কলেজে যায়। ফেরার সময়ে একই ব্যবস্থা। তখন হাটা কম। ফিরোজা তার বাসার সামনে রিকশা থেকে নেমে যায়। মালিহা সেই রিকশা নিয়ে বাসায় চলে আসে। এই ছিল প্রতিদিনের রুটিন। কিন্তু তার মধ্যে একটা ব্যতিক্রম ছিল। 

সপ্তাহের একটা দিন কলেজ যাওয়ার পথে ফিরোজা নিউ মার্কেটের সামনে ফিরোজা নেমে যেত। তার জন্যে একজন অপেক্ষা করত। নাম তার ফরিদ। সম্পর্কে খালাত ভাই। তবে একেবারে আপন খালার ছেলে না। বেশ কিছুটা দূরের। যাই হোক সেটা কোন জরুরী ব্যাপার না। ফরিদ পড়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুটো টিউশনি করত। ফিরোজাকে নিয়ে সিনেমা দেখত। পার্কে যেত, রেস্টুরেন্টে খেত। একটু আধটু ছোঁয়া লেগে যেত। দু পক্ষেই ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ত। দিনটা দু জনের কাছেই রঙ্গিন হয়ে উঠত। কলেজ শেষ হওয়ার আগেই ফিরোজা ফিরে আসত। তার পরে মালিহার সাথে রিকশা করে বাড়ি ফিরত। পুরোটা রাস্তায় ফিরোজা বলে চলত তার সারা দিনের অভিজ্ঞতা। কিছুটা যে আবেগ হত না, অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা হত না; সেটা কিন্তু বলা যাবে না। 

মালিহার ফিরোজার কথা শুনতে শুনতে নিজেরও শিহরিত হতে ইচ্ছা হল। কিন্তু তার তো সে রকম বিশেষ কেউ নাই। কার সাথে সে এমনভাবে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেরাবে? একবার অনেক কষ্টে মনের গোপন ইচ্ছার কথা প্রিয় বান্ধবী ফিরোজাকে জানাল। ফিরোজা মালিহাকে আসস্থ করে বলল, সে তার জন্যেও একজন বিশেষ কাউকে খুঁজে দিবে। এর পরের ঘটনা দশ দিনের মাথায় ঘটল। ফিরোজা যেয়ে বলেছিল ফরিদকে। ফরিদ খুঁজে নিয়ে এল সেলিমকে। তারই বন্ধু মানুষ। শোনা যায় আগেও দুটো মেয়ের সাথে চলা ফেরা করেছে। কিন্তু টিকে নি। তার এখন প্রেম না করলেই না। আগের দু জনকে সে দেখিয়ে দিতে চায়, সে চাইলে প্রেম করবে এমন মেয়ের কোন অভাব হবে না। 

সেলিম দেখতে শুনতে ভালই ছিল। লম্বা, শুকনো ধরণের, মাথায় কোকড়া চুল। মালিহার ভাল লেগে গেল। শুরু হল তাদের দিন ব্যাপী ঘুরা ফেরা। প্রথমে ওদের সাথে ফিরোজা, ফরিদ থাকত। কিন্তু সেলিম মালিহাকে একা পেতে চেত। মালিহা বিষয়টাতে সায় দিল। আর সাথে সাথে সেলিম সাহসী হওয়া আরম্ভ হল। শুধু হাত ধরাধরি, সামান্য ছোঁয়াতে, তার মন ভরল না। সে আরও অনেক বেশী চায়, পুরোটাই চায়। মালিহা রাজী হল না। পরিষ্কার জানিয়ে দিল বিয়ের আগে সে এই কাজ করবে না। কিন্তু সেলিম নাছোড়বান্দা। প্রতি বারই চাপ বাড়তে লাগল সাথে এক রাশি অভিমান। তার একই কথা। ভালোবাসা যখন হয়েছে, বিয়ে তখন কোন দিন নিশ্চয়ই হবে। সে জন্যেও তো মন ও শরীরের খোরাক তো আর সরিয়ে রাখা যায় না। 

মালিহার অনিচ্ছা শেষ পর্যন্ত সেলিমকে দূরে রাখতে পারল না। ওদের মিলন হতে লাগল। প্রথমে মালিহার সংশয় ছিল। কিন্তু পরে সেও বিষয়টা উপভোগ করা আরম্ভ করল। কিন্তু যেই ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ছিল না, সেটা হল অবাধে মিলন হলে তার কি পরিণতি হতে পারে। ছয় মাসের মাথায় মালিহার পিরিওড বন্ধ হয়ে গেল। সেলিম একেবারে বিস্মিত না হয়ে বলল, সে একটা ব্যবস্থা করবে। পরের দিনই সেলিম মালিহাকে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরিচয় হল ডাঃ সালেহ নামে এক যুবক ডাক্তারের সাথে। এইদিকে সেলিম সাবধান করে দিয়েছিল, যাতে কোন ভাবেই তার নাম না বলা হয়। মালিহা সেই মোতাবেক কাজ করল। ডাঃ সালেহ’র একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে আসার আগেই তাকে ধ্বংস করতে দিতে ইচ্ছা করল না। সে মালিহাকে প্রস্তাব দিল, বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসতে দেয়া হয়। প্রয়োজনে সে মালিহাকে ওই দিনই বিয়ে করতে রাজী। এর মধ্যে মালিহা বুঝে নিয়েছে সেলিম তাকে শুধু সম্ভোগের জন্যে ব্যবহার করেছে। দু দিন পরে ওরা বিয়ে করল। একেবারে অপরিচিত একজন মানুষের সাথে ঘর করা আরম্ভ করল। যখন ফুটফুটে মেয়েটা হল, ডাঃ সালেহ আনন্দভরে নামে রাখল কেয়া। 

পৃথিবীর সব চেয়ে অদ্ভুততম জিনিষ হল মানুষের মন। মালিহার মনে ধারনা হল ডাঃ সালেহ তার এক দুর্বল সময়ের সুযোগ নিয়ে তাকে বিয়ে করেছে। মাথার মধ্যে স্থান পেল না এই লোকটা তাকে ও তার পরিবারের মুখে সমাজের চুন কালি পরা থেকে বাঁচিয়েছে, তার সন্তানকে নিজের পরিচয় দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছে। মালিহা মেনে নিতে পারল না সালেহকে। যদিও ডাঃ সালেহ সব ধরণের চেষ্টা করল মালিহার মন জয় করার। কিন্তু বিধি এখানে ভীষণভাবে বাম। একই ছাদের দু জন নর নারীর মধ্যে শীতল সম্পর্ক চলতে লাগল। মালিহা কখনই সালেহের চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলত না। সেখানে না ছিল কোন ভালোবাসার , না কোন আহ্বান। 

কেয়ার প্রথমে মনে হয়েছিল বড় চাচুর ছোট ভাইয়ের জন্যে আছে অগাধ ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। কিন্তু ধীরে ধীরে চেই চিন্তায় ফাটল ধরতে লাগল। চাচু যতটুকু না সময় তার শ্বেতাঙ্গিনি স্ত্রীর জন্যে উৎসাহী , তার থেকে বেশী আগ্রহ তার মায়ের ব্যাপারে। বাবার মৃত্যু পথটাকে সুগম করল। চাচু তার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে মালিহাকে বিয়ে করলেন।

মায়ের ঘটনায় কেয়া বেশ বিস্মিত হল। এইটা কি করে সম্ভব? একজন মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেল আর তার কাছের দু জন মানুষ সে ব্যাপারে একেবারে নির্বিকার। বরং তাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তারা হয়ত এ রকম কিছুই চাচ্ছিল। কেয়া ঠিক করল আর কেউ না হোক সে ঠিকই বাবাকে মনে রাখবে। বাবা’র স্বপ্ন পূর্ণ করবে। বাংলাদেশে বাবা’র নামে ক্লিনিক বানাবে। সম্ভব হলে ক্লিনিকের জায়গায় বড় একটা হাসপাতাল বানাবে। অসুস্থ মানুষেরা চিকিৎসা পাবে। বাবা ওই পাড় থেকে মেয়ের জন্য গর্বিত হবেন। সেইজন্য সে নিজেকে তৈরি করবে। নিজেকে ডাক্তার বানাবে। এখন তার অন্য কোন দিকে মন দেয়ার সময় নাই। 

তখন কিংস কলেজে মেডিকেলের ফিফথ ইয়ার চলছে। মানে আর কয়দিন পরে ক্লাসের সবাই ডাক্তার হয়ে যাবে। ক্লাসের শুধু দু জনের ব্যক্তিগত জীবন রহস্যাবৃত থেকে গেল। এই দু জন হল কেয়া ও স্কট। কেয়ার হাঁটা, চলা, মৃদু কথা বলা যেমন ক্লাসে একটা আবেশ ছড়িয়ে দিত, ঠিক অনেকটা সে রকমই স্কটের দেরী করে আসা, উসখুস চুল, যত্নহীন পোশাক-আশাক অন্যদের দৃষ্টি কেড়ে রাখত। আরেকটা ব্যাপার ছিল সেটা এতক্ষণ বলাই হয় নি। স্কট কারণে অকারণে হো হো করে হাসতে পারত। ক্লাসে হয়ত প্রফেসর ফিসিওলজির কঠিন কোন কিছু ব্যাখ্যা করছেন, হঠাৎ শোনা গেল জোড়ে হাসির শব্দ। পরে জানা গেল স্কটের হাসির কারণ। তার চোখে পড়েছে শিক্ষক মহোদয়ের প্যান্টের জিপার অর্ধেক লাগান হয় নি। অন্য কারো চোখে পড়লে না দেখার ভান করত। কিন্তু স্কট হাসি সামাল দিতে পারল না। আশ্চর্যের বিষয় হল স্কট ক্লাস চলাকালীন নিয়মবিরোধী শব্দ করে হাসলেও, তাকে কোন শাস্তি পেতে হত না। 

কেয়া স্কটের অদ্ভুত আচরণ খেয়াল করত, কিন্তু মাথা ঘামাত না। মাঝে মাঝে অন্যদের স্কটকে নিয়ে আলোচনা কানে আসত। সবার ধারনা অনেক ধনী লোকের ছেলে। কলেজের দেয়ালে শুধু বাবা না, তার দাদার নামও খোদাই করাই আছে। পরিবারটা আগেও কলেজকে মেলা ডনেশন দিয়েছেন এবং এখনও নিয়মিত দিয়ে চলেছে। সেই পরিবারের একমাত্র ছেলে স্কট এই মেডিকেল কলেজে পড়ছে। সেটাই বিশাল একটা ব্যাপার। সে যে একটু ক্ষ্যাপাটে আচরণ করে, সেটা মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে মাস খানেক আগে কেয়ার কানে একটা কথা এলো, যার জন্যে সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। 

স্কট যে শুধু শিক্ষকদের নিয়েই হাসত, তা কিন্তু না। ক্লাসে কোন সহপাঠীর মধ্যে নিয়মের বাইরে কিছু দেখলেই তার হা হা আরম্ভ হয়ে যেত। সবাইকে নিয়ে তার হাসি পেলেও কেয়ার ব্যাপারে সে মনে হয় খুব সাবধান। কেয়া নিয়ে এ পর্যন্ত সে হাসে নি। কেয়ার মনোযোগ পড়ালেখায়। অন্যদের সাথে খুব একটা দরকার না হলে কথা বলত না। স্কট হাসাহাসি করার সাথে সাথে ছিল মহা আড্ডাবাজ। সবার সাথেই তার খাতির। কখন কে কার সাথে আড্ডা দিবে সেটা আগের থেকে বলা কঠিন ছিল। যাই হোক সে দিন ছিল সোমবার। আগের রাতে কেয়ার বিছানায় যেতে যেতে ভোর চারটা বেজে গেল। ঘুম যখন ভাঙল তখন সকালের সাড়ে সাতটা। আটটায় ক্লাস। কেয়া তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ছুটল। 

সকালের ক্লাসে স্কট যথারীতি দেরী করে এল। একঘণ্টার ক্লাসের ইতিমধ্যে বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। কেয়া এসেছিল পৌঁছেছিল আটটা পাঁচে। ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে যেয়ে বসল। তার পনের মিনিট পরে হন্ত দন্ত হয়ে স্কট এসে এদিক ওদিক তাকাতে কেয়ার পাশে যেয়ে ধপাস করে বসল। হয়ত তিন মিনিটও পার হয় নি। আরম্ভ হল স্কটের হাসি। ক্লাস শুদ্ধ সবাই ঘুরে ওদের দিকে তাকাল। প্রফেসর বিরক্ত হয় জানতে চাইলেন, স্কট কেন হাসছে। সে হাসি কিছুটা কমিয়ে উত্তর দিল, কেয়া দু পায়ে দু ধরণের স্যান্ডেল। সাথে সাথে আরম্ভ হল সবার কেয়ার পায়ের দিকে তাকান। হাসি এমনিতেই সংক্রামিত। তার পরে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটে নি। কারোর ধারনা ছিল না কেয়া এমন অদ্ভুত কাজ করতে পারে। পুরো ক্লাস স্কটের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগল। 

আসলে তাড়াহুড়া করতে যেয়ে কোন কাপড় আর কোন স্যান্ডেল যে পরছে, সে দিকে নজর দিতে পারে নি। অবশ্য আসার সময়ে মনে হচ্ছিল দু পায়ে দু রকম লাগছিল। এক পায়ে মনে হচ্ছিল স্যান্ডেলটা একটু বেশী টাইট। কিন্তু তখন সে ছুটছে। ক্লাসে দেরী করে যাওয়াটা তার ধাঁচে যায় না। তার পরেও দেরী হচ্ছে। কেন যে অ্যালার্মের শব্দের সাথে সাথে উঠল না। দশ মিনিট অতিরিক্ত ঘুমাতে যেয়ে চোখ খুলল সেই এক ঘণ্টার পর। নিজের উপর জিদ হতে লাগল। মাথার মধ্যে একবারও খেলেনি এই তাড়া করতে যেয়ে তাকে এমন নাজেহাল হতে হবে। 

সবার হাসি দেখে কেয়ার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অন্যদের উপরে না নিজের উপরই রাগ হল। মুখের চোয়ালটা শক্ত হয়ে এলো। কেয়া প্রাণপণে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। ব্যর্থ হল। না চাইলেও কেয়া বেশ জোড়ে কেঁদে উঠল। সে আর দেরী করল না, উঠে দাঁড়াল। এখন তার একা থাকা দরকার। ডেস্ক থেকে বই পত্র উঠিয়ে নিয়ে সে ক্লাস থেকে গট গট করে বের হয়ে গেল। মুহূর্তেই সব হাসি বন্ধ । স্কটের মাথায় ছিল না, তার হাসির কারণে কেয়া কাঁদতে কাঁদতে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবে। এর আগে কখনও তার হাসির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এতদূর পর্যন্ত গড়ায়নি। 

ক্লাস থেকে বের হয়ে কেয়া হোস্টেলের দিকে রওয়ানা দিল। শরীর রাগে শির শির করছে। এর সে একটা বিহিত করবেই। প্রয়োজনে কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করবে। স্কটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে, অন্য কলেজে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল কিছুদিন আগে ক্লাসের কয়েকজনের স্কটকে নিয়ে আলোচনার অংশ বিশেষ। রিচার্ড বলছিল সে কলেজের বিস্বস্থসূত্র থেকে খবর পেয়েছে, স্কটের একটা খুব খারাপ রোগ হয়েছে। রোগটার নাম মায়েলোমা (Myeloma)। কেয়া ভাল করেই জানে রোগটা কি। এইটা এক ধরণের ক্যান্সার। রক্তের শ্বেত কণিকার মধ্যে হয়। ধীরে ধীরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়। এখন পর্যন্ত এর কোন ওষুধ বের হয় নি। তবে অনেকের শরীরে এইটা খুব ধীর গতিতে ছড়ায়। 

মেডিকেলে ভর্তির আগে স্কটের রোগটা ধরা পড়েছিল। প্রথমে ডাক্তারদের ধারনা ছিল খুব বেশী হলে তার আয়ুকাল এক বছর। এখন তার চার বছর চলছে। শরীরের ব্যথা ও দুর্বলতা কমাতে হাই ডোজের ওষুধ খায়। তার পরেও সারাদিন ধরে শারীরিক কষ্ট চলতে থাকে। এই সব কষ্টের দিক থেকে এটেনশ্যান থেকে মনকে অন্য দিকে নেয়ার জন্যে সে সুযোগ পেলেই প্রাণ খুলে হাসে। কথা ছিল শুধু কলেজের শিক্ষক ও স্টাফরা ছাড়া আর কেউ স্কটের রোগের কথা জানবে না। তার পরিবার থেকেই এমন অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু এক মুখ থেকে আরেক মুখ করতে করতে অনেকেরই জানা হয়ে গিয়েছিল। কেয়াও সেদিন জানটে পেরেছিল যখন রিচার্ড কথাটা অন্যদের বলছিল। 

অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই কেয়ার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। একটা লোক যদি তার কোন ব্যাপার থেকে হেসে শরীরের প্রচণ্ড ব্যথাকে একটু হলেও ভুলে থাকতে পারে , তাতে কি যায় আসে। মানুষটা একটু আরাম পেয়েছে সেটাই বড় কথা।

পরের দিন একেবারে অন্যরকম হল। কেয়া বেশ সকাল করে উঠল। ক্লাস শুরু হওয়ার প্রায় আধা ঘণ্টা আগে পৌঁছে গেল। কালকের ঘটনা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করছে। কালকে সবার সামনে না কাঁদলেও পারত। তার পরে স্কটের জন্যেও খারাপ লাগল। বেচারা অসুস্থ মানুষ। পৃথিবীর আলো বাতাস আর কয় দিনই বা দেখবে। ছেলেটা না হয় একটু হেসেছিল, তাতে কি বা যায় আসে। কেয়ার চোখে স্পষ্ট ভাসছে, সে যখন কান্না আরম্ভ করল স্কট কেমন জানি হাসি বন্ধ করে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। যাই হোক, আজকে বের হওয়ার আগে আয়নায় নিজেকে ভাল করে দেখে নিয়েছে। সে আর কোনভাবেই হাসির কারণ হতে চায় না। আজকের প্ল্যান ক্লাসে একেবারে প্রথম বেঞ্চে বসবে। 

এই সব ভাবতে ভাবতে আর খেয়াল করে নি ক্লাসে আর কেউ আছে কি-না। সে ধরেই নিয়েছিল এত তাড়াতাড়ি কারোর আসার প্রশ্নই উঠে না। ক্লাসে ঠিক মধ্যখানে প্রথম বেঞ্চে নিজের বই, পত্র, ফোল্ডার রেখে বসার প্রস্তুতি নিল। প্রফেসর যা পড়াবেন সেটা বই খুলে কিছুটা পড়ে নিবে। তাতে বুঝতে সুবিধা হয়। ক্লাসে আলোচনা হলে ভাল করে অংশগ্রহণ করা যায়। হঠাত একটা গলার আওয়াজে একেবারে চমকে উঠল। চেয়ে দেখে স্কট তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে ফুলের বিশাল এক তোড়া। সবগুলো লাল টকটকে গোলাপ। ছেলেটা জানল কি করে কেয়ার প্রিয় ফুল লাল গোলাপ। স্কট কাছে এসে অদ্ভুত কাণ্ড করল। যে ভাবে ছেলেরা মেয়েদের বিয়ে করার প্রস্তাব নেয়, ঠিক সে রকম ডান হাঁটু গেড়ে নিচু হয়ে ফুলের তোড়াটা কেয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি কালকে ওইভাবে হাসার জন্যে সরি। তুমি বল, তুমি আমাকে মাফ করে দিয়েছো। না হলে আমি সারাদিন এইভাবে এই জাগাতেই এই ভঙ্গিতেই থাকব।” 

কেয়া জানে স্কট যা বলছে সে সেইটা করবে। অন্য কেউ এই দৃশ্য দেখে ফেললে একেবারে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সবাই ফিসফিস করে আলাপ করবে আর মুখ টিপে হাসবে। কেয়া ফুলের তোড়াটা নিয়ে স্কটকে বলল, “না ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নি।” কথাটা শেষ করেই কেয়া নিজের কাজে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করল। স্কট একেবারে কোন দ্বিধা ছাড়াই কেয়ার পাশে যেয়ে বসল। তার পরে নিজের কাজে মন দিল। সেও কেয়ার মত প্রফেসর যেটা পড়াবেন, তা চট করে দেখে নেবার চেষ্টা করল। 

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লাসে অন্যরা আসা আরম্ভ করল। ক্লাসে ঢুকা মাত্রই তাদের চোখটা বড় হয়ে গেল। স্কট সব সময়ে পেছনের বেঞ্চে বসে। আজ সে একেবারে সব চেয়ে সামনের বেঞ্চে। তা ছাড়া আরও অবাক হওয়ার কারণ আছে। স্কট এত সকালে এসেছে, কেয়ার পাশে বসে আছে এবং কেয়ার পাশে ডেস্কে এতগুলো লাল টকটকে গোলাপ। পুরো ক্লাস রুম ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে। সময়মত প্রফেসর এসে ক্লাস আরম্ভ করে দিলেন। তার চোখে বিষয়গুলো ভাল ভাবেই ধরা দিল। তিনি বুঝতে পারলেন না স্কট কেন একেবারে সামনে বসেছে। আবার তাকে নিয়েই না হো হো করে হাসা আরম্ভ করে। যাই হোক তিনি খুব সাবধানে তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। পাছে কিছু উনিশ বিশ হয়ে গেলেই স্কটের হাসিতে অপদস্ত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। 

পুরো ক্লাসে স্কট একবারও হাসা হাসি করল না। দু, তিনবার হাত তুলে প্রশ্ন করল। ক্লাসের শেষ ভাগে এসে আলোচনায় অংশ নিল। ক্লাস শেষে রুম থেকে বের হয়ে যাবার আগে টিচার আরেকবার ঘুরে স্কটকে দেখলেন। গত কালই না ছেলেটা কেমন ঝামেলা করেছিল। আজকে মনে হচ্ছে সুবোধ বালক হয়ে গেছে। মুখের মধ্যে একটা আনন্দের ছায়া স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল। তা হলে আজকে কি স্কট ভাল ফিল করছে। ওষুধের কারণে শরীর দুর্বল ও মুড সুইং করে। ক্লাসে সেইটা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে যায় হাসি। 

স্কটের আকস্মিক পরিবর্তন প্রফেসরের সাথে সাথে প্রায় সবাই লক্ষ্য করল। কেয়া বাদ গেল না। বুঝল না স্কটের এমন কি হল, যে আজকে সে একেবারে অন্যরকম। কেয়া আর দেরী করল না, বের হয়ে পড়ল। আজকে এপার্টমেন্টে যেয়ে রান্না করতে হবে। বিকালে আবার গাইনি ওয়ার্ডে ডিউটি আছে। রানার পর সময় পেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিবে। ডিউটি সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল চারটা পর্যন্ত। হয়ত ওখান থেকে ছুটি পেতে পেতে সকাল আটটা বেজে যাবে। বেশ জোড়ের সাথে হাঁটা আরম্ভ করল। কিছুটা যাওয়ার পর মনে হল কেউ যেন পেছন থেকে ডাকছে। তাকিয়ে দেখে স্কট ফুলগুলো নিয়ে তার দিকে আসছে। আসলে জলদি করে আসতে যেয়ে ফুলগুলো তুলে নিতে আর খেয়াল ছিল না। কেয়া স্কটের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ছুটতে লাগল। 

স্কটকে এভয়েড করা সম্ভব হল না। কেয়ার পাশে পাশে চলতে লাগল। অনেকটা জোড় করে নিয়ে গেল কলেজের কফি সপে। টুক টুক কথা হতে অনেক কথা আরম্ভ হয়ে গেল। মনে হল দু জনে প্রাণ খুলে অনেক দিন কথা বলে নি। আসলে কেয়ার প্রাণ খুলে কথা বলার মত তেমন কেউ নাই। মা তো দূরে সরে গিয়েছেন। প্রতি রোববার সকাল ১০.৩০ মিনিটে কল করেন। একেবারে রেডিও’র খবর পড়ার মত করে গৎ বাঁধা কিছু প্রশ্ন করে রেখে দেন। প্রায়ই ভাবে মায়ের ফোন আর ধরবে না। তার পরেও ধরে। মনে হয় মা যদি বাবাকে স্বামীর সম্মান দিতেন, একটু যত্ন নিতেন ; তা হলে বাবা হয়ত এখনও বেঁচে থাকতেন। কেয়া এক একে করে তার কুয়েতের জীবন থেকে আরম্ভ করে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত হাজার কথা থেকে বের হয়ে আনল। শেষে বাবার থেকে সেই গানের কথা জানাল, “বাবা বলে গেছেন তাকে যেন আমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি দেই।” 

সাথেই সাথেই স্কট গানটা শুনতে চাইলো। কেয়া বলল আরেক দিন। তার পরে স্কটও তার জীবন কাহিনীও শেয়ার করল। পরিবারের প্রাচুর্যের কথা, কলেজে নিয়মিত বড় ডনেশনের কথা। তার প্রায় প্রতিটা ব্যাপারে হাসি লাগার ব্যাখ্যাও দিল, “আমাকে প্রতিদিন যেই শারীরিক ও মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার থেকে আমাকে সব কিছুতে না হাসলে, কাঁদতে হবে। আমার ধারনা কান্নার থেকে হাসা ভাল।” একটু ঢোক গিলে রসিয়ে বলতে লাগল, “সবার ধারনা আমি কয়েক দিনের মধ্যে মরে যাব। সে জন্যে কোন মেয়ে আমাকে ডেট করে না। ওদের দোষ দিয়ে-ই বা কি লাভ। চার বছর আগে ডাক্তার বলেছিলেন, খুব বেশী হলে এক বছর। আমি তো এখনও দিব্যি আছি। আরে আমি বলি, যে কারোরই যে কোন সময়ে মৃত্যু হতে পারে। এখন হোস্টেল ফেরার পথে তুমি যদি এক্সিডেন্টে মারা যাও; তা হলে কি আমার থেকে বেশী বাঁচতে পারলে?” আবার স্কট সেই হো হো করে তার বিখ্যাত হাসি হাসতে লাগল। 

দু জন নিঃসঙ্গ মানুষ সঙ্গী পেয়ে গেল। প্রতিদিন এক সাথে কিছু সময় কাটাত। ভাল-মন্দ, পড়ালেখা, ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হত। কেয়া জানাল, ডাক্তার হয়ে কিছু অভিজ্ঞতা হওয়া মাত্রই বাংলাদেশে চলে যাবে। সেখানে তার মেলা কাজ, ক্লিনিক মানে সম্ভব হলে হাসপাতাল বানাতে হবে, তার পরে হাসপাতাল চালাতে হবে। স্কট অবাক হয়ে কেয়ার পরিকল্পনা শুনল, “আমিও তোমার সাথে বাংলাদেশে যাব। আমিও গরিব মানুষদের সেবা করব।” কেয়া বুঝল, স্কট তার মনের কথা বলেছে। ওকে সাথে নিতে পারলে কিন্তু ভালই হয়। কিন্তু বেচারার ওপারের ডাক যে কোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে। মানুষটাকে অনেক ভুগতে হচ্ছে।

১০

মাস তিনেক পরের কথা। মাঝে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার কারণে খুব ব্যস্ততা গেল। তার পরেও দেখা হলে কথা বার্তা হয়েছে। এর মধ্যে গুজব রটে গেছে যে দু জনের প্রেম চলছে। নানা মানুষের মন্তব্য কেয়ার কানে আসতে লাগল। বেশীর ভাগই ছিল ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ধরণের। কেয়া টাকার লোভে মৃত্যুপথ যাত্রী এক জনের সাথে সম্পর্ক গড়েছে শুধু মাত্র টাকার জন্যে। কিন্তু দু জনেই অন্য মানুষের কথায় কান দিল না। যতক্ষণ একসাথে থাকত আনন্দ, হৈ হুল্লোড়ে ও হাসাহাসিতে মেতে থাকত। মাঝে মাঝে স্কটের কেয়ার থেকে বাংলা গান শুনতে ইচ্ছা করত। কেয়ার তো জানা ছিল সেই একটাই গান, ‘ভাল আছি ভাল থেকো...’। 

গান শুনতে শুনতে স্কট উদাস হয়ে যেত। চোখটাও ভিজে উঠত। বাংলা গান কি একজন ব্রিটিশ যুবককে ছুঁয়ে দিতে পারে। একবার কেয়া গান শেষ করা মাত্রই স্কট ওকে জড়িয়ে ধরল। অস্থির হয়ে কেয়া গালে, ঠোটে চুমু খেতে লাগল। কেয়া এই আচরণের জন্যে একেবারে প্রস্তুত ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেয়া স্কটকে তার বুকের মধ্যে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। স্কট অঝড় ধারায় কাঁদতে লাগল। কেয়া শক্ত করে ধরে রাখল। ছেলেটা কিছুদিনের মধ্যে এই পৃথিবীর আলো, বাতাস, ভালোবাসার বাঁধন ছিঁড়ে চলে যাবে। তাকে যদি সবসময়ে এইভাবে ধরে রাখা যেত। 

দু জনই হবু ডাক্তার। তারা ভাল করেই জানে স্কট ভিতরে ক্ষয় হতে হতে একেবারে শেষ পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেছে। যে কোন সময়ে শেষ ঘণ্টা বেজে উঠতে পারে। অন্য কেউ হলে এই অবস্থায় একেবারে শয্যাশায়ী থাকত। কিন্তু এই ছেলের মনের জোড় প্রচণ্ড। তার জন্যে এখনও নিজের পায়ে হেঁটে বেরাতে পারছে। অবশ্য ইদানীং ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কেয়াও একই কাজ করতে চাচ্ছিল। স্কট দেয় নি, “তোমার ক্লাস ছাড়া কোন ভাবেই চলবে না। তা হলে আমাদের বাংলাদেশের প্রজেক্ট পিছিয়ে যাবে। আমি না হয় একটু ভাল ফীল করলে, তোমার থেকে ক্লাস লেকচার সব জেনে নিব।” 

বাঙালি মেয়ে কেয়া ও ইংরেজ ছেলে স্কট কায়মন বাক্যে অলৌকিক কোন কিছুর অপেক্ষায় দিন কাঁটাতে লাগল। যদি একদিন সকালে উঠে স্কট দেখে তার শরীরে কোন সমস্যা নাই কিংবা এমন ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে যা অসুখটাকে নিমিষেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। বিষয়টা নিয়ে কথা না বললেও, দু জনের মাথায় একই জিনিষ যে খেলে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একদিন সন্ধ্যায় স্কট ফোন করে জানাল, কেয়ার যদি কোন সমস্যা না থাকে সে হাইড পার্কে যেতে। কেয়া সাথে সাথে রাজী। ঠিক হল পরের দিন সকাল দশটায় পার্কের পূর্ব গেটে ওরা মিলিত হবে। কথার শেষে স্কট বলল, “কালকে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিব।” কেয়া ভেবে পেলো না অসুস্থ স্কট কি সারপ্রাইজ দিতে পারে। দু জনে পার্কে ঘুরে ফিরে বেরানোটাই সারপ্রাইজ কি-না! 

কেয়া ঠিক সময়মত পূর্ব গেটে পৌঁছে গেল। দশ মিনিট, বিশ মিনিট করে পুরো আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেল। টেনশান আরম্ভ হয়ে গেল। স্কটের শরীরটা খারাপ করে নি তো। বাধ্য হয়েই স্কটের সেল ফোনে কল দিল। ফোনটা বাজতেই থাকল। কিন্তু কেউ ধরল না। কেয়ার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। রীতিমত ঘামা আরম্ভ করল। ঠিক সে রকম মুহূর্তে স্কট হাজির। তার একহাতে গিটার, পিছনে ব্যাক প্যাক। বলার কোন উপায় নাই যে সে অসুস্থ। কেয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “আমি ইচ্ছা করেই দেরী করে এসেছি। দেখতে ইচ্ছা করছিল আমার জন্যে তোমার কত টান।” 

কেয়া একে বারে তেড়ে গেল স্কটের দিকে। পারলে একটা কিল দিয়ে দেয়। কিন্তু রাগটা অন্যদিকে সরানোর জন্যে দাঁত কিটমিট করতে করতে বলল, “পার্কে কোন মানুষে গিটার নিয়ে আসে? কাঁধে ব্যাক প্যাক কেন? এত ভারী জিনিষপত্র নিয়ে কি করার প্ল্যান?” 

স্কট কোন কথার উত্তর না দিয়ে পার্কের ভিতরের দিকে চলল। কেয়া পিছু নিল। স্কট একটা চেরি গাছের নিচে যেয়ে থামল। ব্যাক প্যাক থেকে প্লাস্টিকের মাদুর বের করে বিছাল। ব্যাগ থেকে চিপস, ড্রিঙ্ক বের করে সাজিয়ে রাখল। কেয়াকে হাত ধরে বসাল। কেয়া অবশ্য কিছুটা লজ্জাই পেল। তার উচিত ছিল খাবার নিয়ে আসার। ব্যাপারটা মাথাতেই আসে নি। আসলে কেয়ার তো তেমন করে পার্কে যাওয়া হয় নি। যাই হোক এর মধ্যে কেয়ার রাগে ভাটা পড়া আরম্ভ করেছে। আগের একটা প্রশ্ন আবার করল, “অন্য মানুষের গিটার কেন এনেছো?” স্কট নরম গলায় উত্তর দিল, “গিটারটা আমার। তোমাকে গান শুনাব, তাই এনেছি। বলেছিলাম না তোমাকে সারপ্রাইজ করব”। 

কেয়া আসলেও ভীষণ ধরণের অবাক হল। ইংরেজ ছেলে বাংলায় গান ধরল। শব্দ উচ্চারণে কোন ফাঁক নাই। মানুষ চাইলে কী না পারে? গানটা আবার সে নিজে স্কটকে শিখিয়েছেঃ 

ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো

দিও তোমার মালাখানি। বাউলের এই মনটারে

ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছে তুমি হৃদয় জুড়ে। 

কি অদ্ভুত স্কট গান গাচ্ছে এবং চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে গেছে। মুহূর্তেই বাবাকে মনে হয় দেখল। ঠিক বাবা তার চোখের সামনে ঠিক এমনিভাবে চোখের অশ্রু ফেলেছিলেন। তার পরে তিনি একেবারেই হারিয়ে গেলেন। আসলে আমরা সবাই এক ধরণের বাউল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাই। কিন্তু কি করে এমন সম্ভব? সে কোনভাবেই স্কটকে হারাতে চায় না। সে স্কটকে কোথাও যেতে দিবে না। তার বাউল হওয়ার কোন দরকার নাই। একই গান স্কট বাবার মত পর পর চারবার গাইল। বাবা এই কাজ করতেন। 

স্কট কি চায়? ও কেমন করে এমন করতে পারছে। গান শেষ করা মাত্রই স্কট কেয়ার কানের লতিতে ছোট একটা কামড় দিয়ে বলল, “আমি মরতে চাই না। আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই। ঈশ্বরের কাছে আমি প্রতিটা মুহূর্তে বলছি, তিনি যেন আমাকে আরও কয়েকটা তোমার কাছে থাকার সুযোগ দেন। আমতা যাতে একসাথে বাংলাদেশে হাসপাতালটা চালু করতে পারি।” কথা শেষ করতে না করতেই স্কট শব্দ করে বলে উঠল, “আমাকে যদি ঈশ্বরের এত কম সময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে পরিকল্পনা থাকত, তা হলে তিনি আমাকে পাঠালেন কেন?” কেয়া আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। স্কটকে জড়িয়ে ধরে সেও কান্না আরম্ভ করল। স্কটকে মিথ্যা কোন সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছা করল না।১১

এর পরে গল্পের অল্পটুকুই অবশিষ্ট আছে । স্কটের হাইড পার্কে কেয়াকে বাংলা গান শোনানোর পর আয়ু মাত্র দু সপ্তাহ বাকি ছিল। হাসপাতালে স্কটকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার সব ধরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মানুষের ক্ষমতাকে এক জায়গায় হার মানতেই হয়। স্কট কেয়ার হাতে হাত রেখে শেষ কথাটা অনেক কষ্টে ফিস ফিস করে বলল, “তোমাকে বাংলাদেশে হাসপাতালটা বানাতেই হবে। আমি তোমার পাশেই থাকব।” স্কট জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে চোখ বড় করে এইদিক ওইদিক তাকাল। তারপরে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। 

স্কটের হারিয়ে যাবার দেশে চলে যাওয়ার পরে লন্ডনের একজন এটর্নি কেয়ার সাথে যোগাযোগ করে জানাল, স্কট কেয়ার ভবিষ্যৎ হাসপাতালের জন্য দেড় মিলিওন ডলার পাউণ্ড তার সম্পত্তি থেকে উইল করে গেছে। হাসপাতালের কাজ আরম্ভ করার সময় হলে, কেয়া যাতে এটর্নির সাথে যোগাযোগ করে। কেয়া অবাক হল। দুটো মানুষ তাকে ভালোবাসত। দুজনই তাকে হাসপাতাল বানানোর শর্ত দিয়ে গেছে। কেয়া জানে সে এই শর্তটা অবশ্যই পূর্ণ করবে। কিন্তু আরেক শর্ত সে কিভাবে পালন করবে? আকাশের ঠিকানায় সে কি করে চিঠি লিখবে? আকাশে ঠিকানায় কি চিঠি লেখা যায়? চিঠি লেখা গেলে কি লিখতে হয়? চিঠি লেখা হলে কিভাবে আকাশের পাঠান যায়? আকাশই বা চিঠি বাবা আর স্কটকে পৌঁছে দিবে? 

প্রথমেই বলেছিলাম কেয়া ফুলের কথা। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মাদকিয় গন্ধ নিয়ে ফুটে। গন্ধে পাগল হয়ে ভ্রমর দল আসলেও বেশীক্ষণ সেই সম্পর্ক স্থায়ী হয় না। কেয়া ফুলে যে মধু নাই। সে জন্য ভ্রমর উড়ে চলে যায় অন্য কোথাও। আমাদের কেয়া ভাবে তার কাছে কি নাই যে সে তার ভালোবাসার মানুষদের ধরে রাখতে পারে না। তাদের কেন হারিয়ে যেতে হয়?  

নভেম্বর ১৯, ২০১৬