প্রেম এসেছিল গোপনে

ব্যাপারটা কাকতালীয় না বলে উপায় নাই।

গণি গুলশান আবাসিক এলাকায় ২৬ নম্বর রোডের “স্বপ্ন নিকেতন” বাড়ির তিন তলায় সোলায়মান সাহেবের ছোট ছেলে রিচিকে পড়িয়ে ফিরছে। গণি গেট থেকে বের হবার সময়ে, এক পলকে দেখল খুব চেনা জানা চেহারার একটা মেয়ে “স্বপ্ন নিকেতনে” গাড়িতে করে ঢুকছে। শুধুই এক পলক দেখা।

গণিকে টিউশনির পরে সাধারানত মিনিট পনের পায়ে হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে যেতে হয়। সেখান থেকে বাসে করে শাহবাগ। শেষে পদব্রজে মুহসিন হল। রাতের খাবার খেয়ে নিজের পড়ালেখা ও এসাইনম্যাণ্ট করা। তার পরে ক্লান্ত হয়ে যে কখন ঘুমিয়ে যায়, সেটা সকালে চাইলেও স্মরণ করতে পারে না। কিন্তু আজকে অন্য দিনের মত হচ্ছে না। মেয়েটাকে এক পলক দেখার পর থেকে শুধু মনে হচ্ছে, মেয়েটা জানি কে? চেহারাটা যেন কারোর সাথে মিলে যাচ্ছে! কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব?

গণি নিজেকে বারে বারে বলছিল, ভুল ভুল। এইটা মনের ভুল। কোনভাবেই সম্ভব না। মেয়েটা সিনথিয়া না। অন্য কেউ। হয়ত সিনথিয়ার মত দেখতে। কিংবা চুল, চোখ, চেহারা একই রকমের। তাই তার কাছে মনে হয়েছিল, সিনথিয়া। আবার এমনও হতে পারে, একেবারে অন্য কোন মেয়ে। মনের মধ্যে সিনথিয়া, তাই ভুল করে অন্য একটা মেয়েকে সিনথিয়া ভেবেছে। শুধু মাথার মধ্যে খেলে যাচ্ছে, সিনথিয়া-ই বসে ছিল গাড়িতে। না-কি গাড়ির পিছনের সিটে আসলে কেউ ছিল না। মরীচিকা মানে মরুভূমিতে বালির মধ্যে সূর্যের আলোর ঝলকানিকে পানি দেখে ভুল করার মত হয়েছিল। আবার মনে হচ্ছে, সিনথিয়া আনমনে বসে কি যেন ভাবছিল। হয়ত তার কথাই!

নেগেটিভ পজেটিভ মিললেই সাথে সাথে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। গণির বুকের রক্ত সিনথিয়াকে দেখা মাত্রই ছলাৎ ছলাৎ করে উথাল পাথাল করে প্লাবন বইয়ে দেয়। বানের পানির লাহান সব বাঁধ ভেঙ্গে ভিতরের নদী বের হয়ে আসতে চায়। গত দু বছর ধরে এ রকম হচ্ছে। একবারে ইউনিভার্সিটির প্রথম দিককার কথা। সিনথিয়া সেবার মাইক্রো ইকোনোমিক্স ক্লাসে মিনিট দশেক দেরি করে এলো। তার বান্ধবীদের পাশের কোন জায়গা খালি ছিল না। সিনথিয়া এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গণির ঠিক পাশে একই বেঞ্চে যেয়ে বসলো।

মিনিট দু’য়েক যাওয়ার পর ম্যাডাম বোর্ডে যখন লিখছিলেন, সিনথিয়া ক্ষণিকের জন্যে গণির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটু হাসলো। গণির মনে হল এই এতটুকু হাসিতে সিনথিয়া তাকে এক মহাকাব্য উপহার দিল। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া সিনথিয়ার দিক থেকে এসে গণিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সাথে কি সুন্দর সুবাস। নিশ্চয়ই বিদেশী খুব দামী কোন পারফিউমের গন্ধ। গণির মধ্যে খেলে গেল, ইস সিনথিয়া আরেকবার যদি তার দিকে আবার মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকাত, কিংবা সব সময়ে ......।

না কল্পনাটা বেশীই হয়ে গেল। ক্লাসে বাকীটুকু সময়ে সিনথিয়া একবারও গণির দিকে চোখ তুলে তাকাল না। শেষ আশাটারও গুড়ে বালি হল। গণি ধরেই নিয়েছিল, ক্লাস শেষে বেঞ্চ থেকে উঠার সময়ে মেয়েটা আরেকবার তাকাবে, আরেকবার পাগল করা মুচকি হাসিটা হাসবে। না কিছুই হল না। সিনথিয়া মনে হয় পাশে বসা গণির কথা বেমালুম ভুলে গেল। ম্যাডাম ক্লাস থেকে বের হওয়া মাত্রই, সিনথিয়া বই, ফোল্ডার নিয়ে চলে গেল। ঝড়ো হাওয়ায় সিনথিয়া যে পাশের একজনকে ভীষণ অস্থির করে দিল; সে ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না।

ছেলেদের মন কেন যে এত সহজে এত দ্রুত গতিতে মোমের মত গলে গলে পড়তে পারে, সেটা একমাত্র বিধাতাই জানেন। সিনথিয়ার সামান্য তাকানো ও মৃদু হাসিতে গণির যেন ‘কাল’ হল। এই ঘটনার পর থেকে সিনথিয়াকে দেখা মাত্রই গণির হৃদপিণ্ড তার কার্যক্রম দশগুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্তরের নদীতে বন্যা আসে, বাইরের কারোর সেটা আর জানা হয় না।

সেই সিনথিয়াকে ইউনিভার্সিটির বাইরে কোথাও এই প্রথম হয়ত এক ঝলক দেখল। তখন থেকেই সেই প্রচণ্ড উথাল পাথাল করা হৃদপিণ্ডের ঝড়টা আরম্ভ হয়ে গেল। তার পরে যদি নিশ্চিত হতে পারত, তা হলে এত বেশী সমস্যা হত না। এখন বুকের ভিতরে যেন ড্রাম বাজছে। পুরোটা রাস্তা ভাবতে ভাবতে সে মুহসিন হলে এসে পৌঁছাল। রাতের খাওয়া, অধ্যায়ন-দুটোই মুলতবী করে দিল। বিছানায় শুয়ে কালো গাড়ির মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে লাগল; একেবারে চুল চেরা বিশ্লেষণ করতে করতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লো।

ঘুমিয়েও বেচারা গণি শান্তি পেল না। স্বপ্নের মধ্যে সেই বুক ছলাৎ ছলাৎ করা ঘটনা এক এক করে হাজার বার দেখলো। সকালে বিছানা ছাড়তে হল, লাল চোখ ও ক্লান্ত শরীরে।

সিনথিয়া অনেকটা শখের বশে ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। বাবা বলছিলেন, কমার্সের কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে। পরে বাবার ব্যবসার হাল ধরলে সুবিধা হবে। বাবার বিভিন্ন ব্যবসায় হাজার দশেক মানুষ কাজ করে। ইন্সুরেন্স, গার্মেন্টস, ব্যাংক নিয়ে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার লেন দেন হচ্ছে। এ সবের হাল হকিকত বুঝতে ও চালাতে অর্থনৈতিক জ্ঞানের কোন বিকল্প নাই।

কিন্তু সিনথিয়ার অন্য রকম হিসেব। ছাত্রী ভাল বলেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্স বিভাগে চান্স পেয়েছে। এখন ভুঁড়ি ভুঁড়ি ছাত্র ম্যাট্রিক, ইন্টারে জিপিএ ফাইভ পেয়ে সরাসরি ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে। সেখানে সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। মাইক্রো ও ম্যাক্রো ইকোনোমিক্স তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে। এই দুটো ব্যাপার যদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়, তা হলে শুধু বাবার ব্যবসা কেন, পুরো দেশের চেহারাই বদলিয়ে দেয়া সম্ভব।

বাবা বলেছিলেন এমেরিকায় যেয়ে পড়ালেখা করে আসতে। সিনথিয়া স্কুল-কলেজ দুটোই ছিল ইংলিশ মিডিয়মে। তার পরেও বিদেশের চাকচিক্যের হাতছানি তাকে বেশী টানে নি। সে ঠিক করেছে দেশে থাকবে এবং দেশের ইউনিভার্সিটিতে যাবে। বাবা অনেক বুঝিয়েছিলেন, পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আন্দোলন হয়, মারামারি হয়। মাসের পর মাস বন্ধ থাকে, সেশন জ্যাম হয়। ডিগ্রি পেতে অনেক বেশী সময় লাগে। বিদেশে গেলে সে রকম ঝামেলা নাই। বরং চাইলে বেশী কোর্স নিয়ে দ্রুত পড়ালেখার কাজ সেরে ফেলা যায়।

স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই ক্লাসে বন্ধু-বান্ধবীদের ক্রাশ খাওয়া ও ব্রেক আপ খাওয়া নিয়মিত দেখেছে। ছেলে মেয়েরা প্রেমে পড়ে বলেছে, তারা সব চেয়ে আকর্ষণীয়, হৃদয়বান সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। কয়েকদিন পরে বনিবনা না হলে ঘোষণা করেছে, প্রাক্তন সঙ্গী ছিল পৃথিবীর সব চেয়ে অধম মানুষ, একেবারে নরকের কীট। সিনথিয়া ছোট বেলা থেকেই ধীর-স্থির শান্ত। কোন ছেলে ব্যাপারে তার তেমন কোন আগ্রহ হয় নি। তবে অনেক ছেলেই আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু সিনথিয়া একেবারেই পাত্তা দেয় নি।

একে একে চেনা জানা বান্ধবীরা সঙ্গী বেছে নিল। সিনথিয়া কলেজে ক্লাস শেষে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাসায় ফিরে আসতো। অন্যদের মত অকারণ আড্ডা দিতো না কিংবা এইদিক সেইদিক ঘুরা ফেরা করতো না। একেবারে যে ইচ্ছা করতো না, তেমন কিন্তু জোড় গলায় বলা যাবে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে পীয়ার প্রেসার (Peer Pressure) মানে সাথীর চাপ। ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের ইংরেজি টিচার কেমন দৃষ্টিতে যে তাকাত, অন্য কেউ না বুঝলেও সিনথিয়া ঠিকই বুঝে নিল। নীরবে দৃষ্টির কথোপকথন দিয়ে এক কিশোরীর প্রথম প্রেমের সূত্রপাত হল।

কলেজ টিচার ফারহান লন্ডনে ছিল অনেক বছর। ঠিক ব্রিটিশদের মত গলার ভিতর থেকে শব্দ করে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে। ২৫-২৬ বছরের তরুণ শিক্ষক, লম্বা, চওড়া, কোঁকড়ান চুল। মাসের বেশীর ভাগ দিন-ই শেভ করে না। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। দেখতে বলিউডের অনিল কাপুরকে হার মানাবে। এ রকম ছেলে মেয়েদের চোখ, মন দুটোই কাড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ফারহান সিনথিয়াকে জয় করার অনেক চেষ্টাই করলো। শেষে, ব্যর্থ হয়ে সিনথিয়ার এক বান্ধবীকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাল।

দু জনের নীরব কথোপকথন চললেও, সরাসরি কথা বার্তা, ঘুরা ফেরা অল্প দিন পরেই আরম্ভ হল। কলেজের অন্য মেয়েরা হিংসার চোখে দেখত। তারা যেখানে প্রেম করে সমবয়সী চ্যাংড়া ছেলেদের সাথে; সিনথিয়া কিনা শেষে এসে সিনেমার নায়কের মত দেখতে একজন প্রতিষ্ঠিত পুরুষকে পেয়ে গেল! অন্যরা অবশ্য ফোড়ন কাঁটার সুযোগ হাতছাড়া করতো না, দেখিস নায়ককে বোরখা পড়িয়ে রাখিস। না হলে কোন সময়ে না আবার কার চোখে পড়ে যায়।

সিনথিয়া গর্বিত মুখে উত্তর দিত, আমাদের ভালোবাসা বিশ্বাসের উপর তৈরি হয়েছে। নায়ক কোথাও যাবে না। যাদের চোখ পড়বে, তাদের চোখ অকারণেই নষ্ট হবে। আমার নায়ক আমারই থাকবে।

গণির বাড়ি একেবারে পাড়া গাঁয়ে। অবশ্য একেবারে অজ গ্রাম বলা যাবে না। প্রাইমারি ও হাই স্কুল দুটোই আছে। দৌলতপুর উপজেলার বাঁধন গ্রাম। নামে যেমন, বাস্তবেও কেমন অজানা এক বন্ধনে গ্রামবাসীরা বাঁধা। একের প্রয়োজনে অন্যরা ছুটে আসে। যে কারোর সাফল্যে গ্রামের সবাই মহা আনন্দিত হয়। এখানে অল্প আয়ের মানুষ থেকে আরম্ভ করে বেশ কিছু বিত্তশালী মানুষও আছে। কিন্তু তাদের মাঝে আছে অদ্ভুত ধরণের সাম্য। বিত্তশালিরা সাধারণ মানুষদের সাথে অনায়াসে উঠা-বসা করে। আবার, মাঠে সব ছেলে মেয়ে নির্দ্বিধায় মিলেমিশে খেলাধুলা করে।

গণি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। পুরো স্কুল ও গ্রামে প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র। গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল যে গণি পড়ালেখায় বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। সরকার শুধু তার পড়ালেখার খরচই দিবে না; হাত খরচের জন্যে কিছু টাকাও দিবে। তখন থেকেই সে বড়দের একেবারে আদরের পাত্র হয়ে গেল। মুরুব্বিরা তাকে এটা সেটা কিনে দিতেন। সাথে মেলা উপদেশ। তারা নিশ্চিত করতে চাইতেন, ছেলে যাতে একদিন গ্রামের নাম উজ্জ্বল করে। অবশ্য সম বয়সীরা তাকে কোন বিশেষ সম্মানই দেখাত না। বরং সুযোগ পেলেই গণিকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতো। একবার চাচা গোত্রীয় একজন বলেছিলেন, ‘গণি মিয়াঁ একজন কৃষক’। হয়ত গণিকে আদর করেই বলেছিলেন। কিন্তু দুষ্টু ছেলেরা এইটাকে নিল অন্যভাবে। সুযোগ পেলেই, ‘গণি মিয়াঁ একজন কৃষক’ বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করতো। এই প্রচেষ্টা বেশীর ভাগ সময়ে সফল হত বলা যায়। কথাটা শোনা মাত্রই গণি তাদের দিকে দিকে তেড়ে আসতো।

বেচারা গণির মেয়েদের সাথে মেশার তেমন সুযোগ পায় নি। গ্রাম হলেও ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময়ে দু চার জন সম বয়সী বন্ধুরা ঠিকই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতো। রোমাঞ্চকর ঘটনা শুনে, গণির যে সে রকম কিছু করতে যে ইচ্ছা করতো না, তা কিন্তু না। মনে একটা গোপন ইচ্ছা ছিল, বিলকিসের বিশেষ দৃষ্টি যদি কোনভাবে কাড়া যেত। মেয়েটা এক ক্লাসে নিচে পড়তো। ডাগর ডাগর চোখের দৃষ্টি যেন বুকটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলত। মনে হত , আহারে মেয়েটা এত মিষ্টি কেন?

একবার সুযোগ বুঝে বলে ফেলল, “যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো তা হলে কিন্তু খুবই সুন্দর একটা ব্যাপার হতে পারে।” মেয়েটা গণিকে কোন উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপরে কেমন একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। গণি ধরেই নিল, বিলকিসের হয়ত সম্মতি আছে। সে যখন কঠিন কাজটা করতে পেরেছে, মিষ্টি মেয়ে তার কাছে ঠিকই ধরা দিবে।

কিন্তু বিষয়টা একেবারে অন্যদিকে মোড় নিল। গণি অতি উচ্ছাসে, তার বীরত্বের কথা বেশীক্ষণ গোপন রাখতে পারলো না। ঘনিষ্ঠ দু একজনকে গর্ব করে বলল, তার মনের বাসনা পূর্ণ হতে চলেছে। তার পরে এক কান দু কান করে অনেকের জানা হয়ে গেল। সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজটা করলো বিলকিস নিজে। বিলকিস জানালো তার মাকে, তার থেকে গণির মা হয়ে বাবা। পরিণতিতে বাবা সবার সামনে খেলার মাঠে গণিকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন এক কোণায়। তার পরে চালালেন উত্তম মাধ্যম।

গণির অপমানের কথা যারা উপস্থিত ছিল, তারা তো জানলোই সাথে সাথে চেনা জানা সব কিশোরী মেয়েরাও জেনে ফেলল। কয়েকজন এসে সহানুভূতি জানিয়ে গেল। কিন্তু যার জন্যে এত বিড়ম্বনা সেই বিলকিসের নেক নজরটা পাওয়া গেল গেল না। গণি বুঝল এক হৃদয়হীনার কাছে তার ভালোবাসার কোন দাম নাই। এই ঘটনার দু বছর পরে বিলকিসের বিয়ে হয়ে গেল। কিশোর গণি, মুরুব্বিদের উপদেশে কান দিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিল পড়ালেখা শেষ করে মানুষের মত মানুষ হতে পারলে, সুন্দরী মেয়ে বেছে নিতে সমস্যা হবে না। সেই পর্যন্ত কোন মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছা মুলতবী করে রাখলো। বেচারা ব্যর্থ প্রেমিক বন্ধুবান্ধবদের ‘গণি মিয়া একজন কৃষক’ উপহাস শুনতে শুনতে দিন পাড় করতে থাকলো।

কাকতালীয় বলতে হবে। পাড়াগাঁয়ের ছেলে স্কুল, কলেজে ভাল রেজাল্ট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে চান্স পেয়ে গেল। অন্যদিকে আলালের ঘরের দুলালী সিনথিয়াও একই বিভাগে ভর্তি হল। গণি জীবনে একসাথে পাঁচ শত টাকার পাঁচটা নোটের বেশী দেখে নি; তার অর্থের নীতি জানতে মানে ভবিষ্যতে ভাল উপার্জন নিশ্চিত করতে উচ্চ শিক্ষা নিতে আসতে হল। আর যেই মেয়ে ভাল করেই জানে, অর্থের কোন নীতি নাই বরং দুর্নীতির মূল্য কারণ; সেও এর সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে একই জায়গায় এলো। যাই হোক অনর্থের মূল কারণ অর্থ নিয়ে কাসুন্দি না বাড়িয়ে, মূল ঘটনায় ফিরে যাই। তবে এতটুকু বলা খুবই প্রয়োজন, অর্থ না থাকলে যেমন নানামুখী সমস্যা, তেমনি অর্থ থাকলেও ঝামেলার কোন কমতি হয় না।

পুরো নাম শামসুল গণি। ভেবেছিল ঢাকায় তার নতুন পরিচিতি হবে সামসুল কিংবা সামসু নামে। বিদেশী এক সিনেমায় নায়কের নাম ছিল স্যাম। নামটা কিন্তু শুনতে দারুণ লাগে। আবার সামসুল নামের কাছাকাছি। এই নামটা ছড়িয়ে দিতে পারলে কিন্তু দারুণ হত। পরের মুহূর্তে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগল। না থাক বিদেশী নামে কাজ নাই। গ্রামে ছোট বেলার বন্ধুরা জানলে আবার নতুন উদ্যমে খেপাতে লেগে যাবে। তার থেকে বরং সামসু অথবা সামসুল হলেই চলবে। শুধু কেউ যাতে আর ‘গণি মিয়া একজন কৃষক’ বলে ঠাট্টা না করে।

কিন্তু বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। ক্লাসে প্রথম দিন ডিপার্টমেন্টর হেড করিম স্যার এক এক করে সবাইকে পুরো নাম বলতে বললেন। আরও বললেন কে কোন কলেজ থেকে সেটাও জানাতে। গণির যখন পালা আসলো সে তখন একেবারে নার্ভাস। অনেক কষ্টে শুধু মুখ থেকে বের হল গ ও ও ও ও ও ণি। কিছু ছেলে-মেয়ে বলার ধরন শুনে হেসে ফেললো। ক্লাস শেষ হতেই পিছন থেকে একজন ফোড়ন কাটলো, ‘গণি মিয়া একজন কৃষক’ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টে পড়ে। কৃষিকাজের কাজের আর মানুষ থাকলো না রে। সাথে সাথেই কয়েকজন ছেলেমেয়ে হেসে উঠলো।

খুব-ই বিব্রত হল গণি। জোড়ে একটা ধমক দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘মানুষের নাম নিয়ে রসিকতা করতে নাই। একেবারে কবিরা গুনাহ।’ কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু এলো না। বই-পত্র গুছিয়ে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বের হয়ে এলো। হায়রে কপাল, ভেবেছিল নামটা গ্রামেই রেখে আসবে, সেটা ওর সাথে ঢাকায় পর্যন্ত চলে আসলো। অবশ্য দোষ বেশীর ভাগ নিজের। কেন যে এমন নার্ভাস হয়ে নিজের এই নামটা এমন বোকার মত ফাঁস করে দিল। বাবা-মা’র উপর রাগ চলে আসলো। বাবা’র নিজের নামে গণি শব্দটা নাই, তার পরেও কেন যেন যে তার নামের সাথে গণি শব্দটা জুড়ে দেয়া হল।

বেশ ছোট বেলাতেই সে ‘গণি মিয়া একজন কৃষক’ বলার কারণ জেনেছিল। তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ে। খুব সাহস করে বাংলা’র শিক্ষক তপন স্যারকে প্রশ্ন করলো, তাকে কেন মানুষেরা ‘গণি মিয়া একজন কৃষক’ বলে বিরক্ত করে। স্যার গণিকে ভাল ছাত্র হিসেবে খুব স্নেহ করতেন। তিনি গণির দুঃখ ভাল করেই বুঝতে পারলেন। তিনি জানালেন, এক সময়ে ক্লাস টু থ্রি’র বাংলা পাঠ্য বইতে গণি মিয়া কৃষক নামে একটা গল্প ছিল। হয়ত বাবা গোত্রীয় কেউ বলেছে তার কোন বন্ধুকে, সেখান থেকে এক এক করে অন্যরা জেনেছে। এইটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। কৃষক হল জাতির মেরুদণ্ড। গণিকে কৃষক বললে বরং তার গর্বিত হওয়া উচিত। স্যার গণির লজ্জা ভাবটা কাটিয়ে দেবার জন্যে বললেন, “ছোট বেলায় বন্ধুরা আমাকে রসিকতা করে বলতো, ‘তপন, চলে যাও সুন্দর বন’।”

সিনথিয়া কামরানের প্রেম যেমন নীরব কথোপোকথন দিয়ে শুরু হয়েছিল, শেষটা কিন্তু হল একেবারে অন্যরকম, অন্যভাবে। প্রেমের বয়স যখন বছর দেড়েক, হঠাৎ শোনা গেল কামরান চাকরি ছাড়ার নোটিস দিয়েছে। সিনথিয়া এ ব্যাপারে কিছু জানতো না। গুজব ছিল লন্ডনে এক বিদেশিনীর সাথে তার অন্তরঙ্গতা ছিল। তার সাথে রাগ করে কামরান বাংলাদেশে চলে এসেছিল। সিনথিয়াকে কামরান এসব জানিয়েছিল। সিনথিয়া মেনে নিয়েছিল।

কামরান সিনথিয়ার থেকে দুটো বিষয় গোপন করেছিল। এক, বিদেশিনী মেরি শুধু গার্ল ফ্রেন্ড ছিল না। দু জন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। দুই, কামরান যখন রাগ করে লন্ডন থেকে চলে আসে, তখন বিদেশিনীর পেটে ছিল তার বাচ্চা। অবশ্য খবরটা পেয়েছে সে বেশ পরে। ছয় মাস পার হয়ে যাবার পর। সে জন্যে মেরিকে দোষ দেয়াটা ভুল হবে। কারণ সে যতবার ফোন করেছে কিংবা অন্যভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে, কামরান কোন উত্তর দেয় নি। শেষে অনেকটা বাধ্য হয়ে মেরি ইমেল করে অনাগত বাচ্চার কথা জানিয়েছিল।

কামরান মেরিকে ঈর্ষান্বিত করার জন্যে না নিজের একাকীত্ব দূর করার জন্যে সিনথিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতা করেছিল, তা বলা মুশকিল। হয়ত দুটোই। তবে ঘনিষ্ঠতা হলেও, কামরান কখনো সরাসরি বলে নি সে সিনথিয়াকে বিয়ে করবে। অন্যদিকে সিনথিয়া ধরেই নিয়েছিল, ছেলে-মেয়ে’র এত কাছাকাছি হওয়ার পরের পর্যায়ই হল বিয়ে। এর আগে সে আর কোন ছেলের এত কাছাকাছি যায় নি। সিনথিয়ার ধারণা ছিল দু জনের বিয়ে হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

না, বিয়ের প্রসঙ্গ দু জনের কেউ তুলে নি। দু জনের শেষ বিদায়ক্ষণ ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের। কামরান বলেছিল, তিন দিন পরে সে চলে যাচ্ছে। দেশে ফেরার কোন প্ল্যান নাই। পকেট থেকে বিদেশিনী বউ ও তাদের ফুটফুটে শিশুর ছবি দেখিয়ে বলেছিল, আমার পরিবার। অবাক হল সিনথিয়া, নিজের যদি পরিবারই থাকে, তা হলে এভাবে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কি দরকার ছিল! না-কি ছেলেরা এ রকমই হয়। নিজের একাকীত্ব দূর করতে যেই মেয়েকে মনে ধরে, তার দিকেই এগিয়ে যায়। না সিনথিয়ার কামরানকে বেশী দোষ দিতে ইচ্ছা করলো না। কামরান তাকে বিয়ে করার অঙ্গীকার কখনও করে নি।

তার পরেও কামরানের চলে যাওয়া সিনথিয়া’র অনেকগুলো রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সাথে সাথে বালিশও সিক্ত হয়েছিল। কিন্তু কেউ তা জানে নি; কাউকে বলতে ইচ্ছা হয় নি। ক্লাসের কয়েকজন বান্ধবী বলাবলি করতো, সিনথিয়া ছ্যাক খেয়েছে। সিনথিয়া’র কঠিন কিছু উত্তর দিতে ইচ্ছা হত, কিন্তু দেয় নি। যার সাথে প্রেম হয় নি, তার থেকে আবার ছ্যাক হয় কি করে?

সিনথিয়া ঠিক করে ফেলল, আর না। এখন থেকে নিজের মত থাকবে। পড়ালেখা, বাসা, পরিবার নিয়ে তার পরিধি হবে। কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক না করে সে বেশ থাকতে পারবে।

সিনথিয়া গণির চোখের ভাষা প্রথম দিন-ই বুঝতে পেরেছিল। বেঞ্চে সে আগেও ছেলেদের পাশে বসেছে। ছেলেদের কামুক প্রতিক্রিয়া কম বেশী যে হচ্ছে, সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় নি। কিন্তু গণির প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারে ভিন্ন। যেন তার সাথে মিশে যেতে যাচ্ছে। ছেলেটার দৃষ্টি’র পুরোটাই আনন্দ, বিস্ময়, ও সম্মানের। সে সিনথিয়া’র কাছে আসতে চায়, আগলে রাখতে চায়। এই ছেলে কামরানের থেকে একেবারে অন্যরকম। চোখ দিয়ে বলে দিচ্ছে, “সিনথিয়া, আমি তোমাকে ভালোবেসে বিলীন হয়ে যেতে চাই।”

ছেলেটাকে নিয়ে ক্লাসের অন্যরা হাসাহাসি করতো। কথার মধ্যে কুষ্টিয়ার অঞ্চলিক ভাষার টান একেবার স্পষ্ট। পোষাকে, চলা ফেরায় গ্রাম্য ধরণটা চলে আসতো। তার পরে নাম বলল গণি। প্রথম দিন রোল কলের সময় কেমন নার্ভাসটাই হয়ে পড়েছিল। ছেলেটা অন্যদের বিদ্রূপে বেশ বিব্রত হত। তার পরেও যে গণির চোখ তাকেই সারাক্ষণ খুঁজতো, সেটা সিনথিয়া’র ভালো করেই জানা ছিল। কিন্তু ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা ছেলের প্রতি, সিনথিয়ার বিশেষ কোন ধরণের আগ্রহ হয় নি।

দেখতে দেখতে ওরা অনার্সের থার্ড ইয়ারে চলে এলো। দেখতে সহজ, সরল হলেও গণি সবাইকে প্রমাণ করে দেখাল পড়ালেখায় সে একেবারে তুখোড়। বেশীর ভাগ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর সেই পাচ্ছিল। ক্লাসের কিছু মেয়ে গণির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু গণি এক মনেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। শুধুমাত্র সিনথিয়া জানতো, এই পণ্ডিত ছেলেটা তাকে দেখলে কেমন উতলা হয়ে যায়। চোখে চোখ পড়লে এক লক্ষ কথা এক বারেই বলে ফেলে।

কথায় বলে না গাইতে গাইতে গায়েন। সিনথিয়া গণির উতলা প্রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে কেমন করে যেন, গণি মিয়াকে বুকের মধ্যে ঠায় দিয়ে দিল। কিন্তু কথাটা সে ছাড়া আর কেউ জানলো না। ছেলেটা তাকে দেখলে এমন নার্ভাস না হলে কাছে যেয়ে দু চারটা কথা বার্তা বলা যেত। মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলেটা একেবারে ভিতুর ডিম। পরের মুহূর্তে মনে হয়, তার জন্যে ভিতুর ডিম-ই ভালো। বেশী স্মার্ট হলে কথা, ঘটনা গোপন করে; ঠকায়। বুক ভেঙ্গে দিয়ে বিদেশে চলে যায়। না থাক, সে ঠিক করেছে কামরান যত সাহসীই হোক না কেন, তার কথা ভাববে না।

গাড়িতে করে বাসায় ফেরার সময়ে সেদিন ক্ষণিকের জন্য দেখল গণি মিয়া তাদের বাসার গেট থেকে বের হচ্ছে। ভিতু, বোকা ছেলেটার দেখি অনেক সাহস! পরের মুহূর্তেই খুব হাসি পেল। ওর এত সাহস কখনও হবে না, যে সিনথিয়ার সাথে দেখার করার জন্যে সরাসরি বাসায় চলে আসবে। না হাসতে হল না। মনে পড়লো, কাল রাতে মা বলেছিলেন, “রিচির জন্যে একটা খুব ভাল প্রাইভেট টিউটার পাওয়া গেছে। তোর বাবা বলছিলেন, ছেলেটা খুব ব্রাইট। ক্লাসে ফাস্ট হয়। অনেক নাম করবে। নিজের রোজগারে পড়ালেখার খরচ চালায়। তোর বাবা, অফিসের রহমান সাহেবের কাছ থেকে ছেলেটার কথা শুনেছেন। তার ছোট মেয়েকে পড়ায়। এখন রিচিকেও পড়াবে।”

পরের দিন সিনথিয়া একেবারে অন্য রকম একটা কাজ করলো। ফার্স্ট পিরিওড শেষ হওয়ার পর মিনিট দশেকের গ্যাপ ছিল। একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গণির দিকে এগিয়ে গেল। মিষ্টি করে বলল, “কি আমাকে গত কাল চিনতে পেরেছিলে? তোমার নতুন ছাত্র রিচি আমার ছোট ভাই।”

সিনথিয়া যেমন ভেবেছিল অনেকটা সে রকম হল। গণি যেন ভয়ে আতঙ্কে নিজের মত গুটিয়ে যেতে থাকলো। মুখ দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কাজ হল না, কি বলবে মাথার মধ্যেই এল না। সিনথিয়া বেচারাকে আর বেশীক্ষণ কষ্টে রাখল না। বলা আরম্ভ করলো, “আগামী কাল বিকাল পাঁচটায় পাবলিক লাইব্রেরিতে এসো। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।” কথাটা শেষ করে সিনথিয়া আর দেরী করলো না। আরেক দিকে চলে গেল।

গণির আনন্দে লাফাতে ইচ্ছা করছিল। চাঁদটা বুঝি আকাশ থেকে নেমে এসেছে। না পুরো আকাশটাই নেমে এসেছে। চাইলে এখন সে শুধু চাঁদ কেন পুরো আকাশটাই ছুঁতে পারে। পরের ক্লাসগুলোতে একেবারে মন দিতে পারলো না। আগামীকাল নিয়ে একের পর এক প্ল্যান করে চলল। ভাল শার্ট-প্যান্ট পরে যেতে হবে। গুলশানের মেয়ে বলে কথা। তার সামনে যেমন-তেমন পোশাক পরে তো আর দাঁড়ানো যায় না।

গণি ক্লাস শেষ করে দেরি করলো না। চলে গেল এলিফ্যাণ্ট রোডের রহমান প্লাজায়। সেখান থেকে দেখে শুনে ভালো দামী একটা শার্ট কিনতে হবে। নতুন একটা প্যান্ট কিনতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আইডিয়াটা মাথার থেকে ঝেড়ে ফেলল। একবারে এত টাকা খরচ করে ফেললে বিপদে পড়তে হবে। মাসের মাত্র শুরু। গতকাল বই কিনতে যেয়ে বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে গেল। তার আগের দিন পুরো মাসের খাবার খরচ জমা দিয়েছে। যাই হোক যাওয়ার আগে গোসল করে, মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে গেলে; সিনথিয়া’র প্যান্টের দিকে চোখ-ই যাবে না। সাথে জিন্সের প্যান্ট পরবে। প্যান্টের বয়স পাক্কা দেড় বছর, একটু রং চটে গিয়েছে। তাতে কি যায় আসে? এখন বাজারে রং চটা ছেঁড়া জিন্স বিক্রি হয় মেলা দামে!

কত শার্ট যে দেখল। কিন্তু কোনটাই মনে ধরল না। মেয়েটা যে কি রং পছন্দ করে? জানতে চাইলেই হত। না সেটা কিন্তু আসলে সম্ভব ছিল না। শেষে পাঁচ শত টাকা দিয়ে একটা লাল শার্ট কিনলো। একবারে একটা টিউশনির প্রায় অর্ধেক টাকা চলে গেল। তবে নীল জিন্সের সাথে বেশ মানাবে। মাথায় এলো কোন জুতা পরবে। একমাত্র কালো জুতা গত মাসে ডান পায়ের কোণার দিকে ছিঁড়ে গেছে। ডান পায়ের জুতার সোলটা কিছুটা খুলে গেছে। হাঁটলে জুতার থেকে কেমন চপাত চপাত শব্দ হয়। নতুন একটা কেনার ইচ্ছা ছিল বলে আর মুচির কাছে নেয়া হয় নি। ইদানীং চামড়ার স্যান্ডেল পরে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে। শেষে ঠিক করলো, রুম মেটের সুজনের স্নিকার কেডস ধার নিবে। ছেলেটা একেবারে দিল দরিয়া। চাইলে সে না করবে না।

ওই দিকে সিনথিয়ারও গণি মিয়াকে আরেকটু অবাক করতে মন চাইলো। ছেলেটা তাকে পছন্দ করে। তার নিজেরও ইদানীং ছেলেটার ভাল লাগার জবাব দিতে ইচ্ছে করে। বাইরের পোশাকে-আশাকে কী যায় আসে? অন্তরের ভিতরটা খাঁটি হলেই চলবে। সেখানে শুধু মাত্র সিনথিয়ার স্থান হলেই সারবে। সিনথিয়া ঠিক করলো শাড়ী পরবে। ইউনিভার্সিটিতে কখনো শাড়ী পরে গিয়েছিল কি-না সেটা মনে করতেই পারলো না। ভেবে চিন্তে ঠিক করলো, সে শাড়ী পড়বে। নীল শাড়ী, একেবারে গাঢ় নীল। এক অনুষ্ঠানে এই নীল শাড়ী পরে গিয়েছিল। তখন সবাই এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন তারা সাক্ষাৎ কোন নীল পরী দেখছে!

মহেন্দ্রক্ষণ আসতে আর মাত্র দু ঘণ্টা বাকী। গণি অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করল। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিলো। শরীর মুছে পুরো মাথায় যত্ন করে তেল দিল। সিঁথি কেটে চুল আঁচড়াল। প্যান্ট পড়ল, পিন খুলে খুলে নতুন শার্ট পরল। কিন্তু আয়নার সামনের যেয়ে পড়লো বিড়ম্বনায়। শার্টটা ইস্ত্রি না করে পরা যাবে না। জায়গায় জায়গায় কুঁচকে আছে।

গণি ছুটে গেল চার তলার ইতিহাসের ফাইনাল ইয়ারের কুদ্দুস ভাইয়ের কাছে। তার ইস্ত্রি ধার নিয়ে এসে তারটা দেয়ালের প্লাগে ঢুকিয়ে দিল। তখন মনে পড়লো রুমমেটের জুতা মানে স্নিকার কেডসের কথা। রুমমেটকে জুতা ধার নেয়ার কথাটা বলা হয়ে উঠে নি। তাতে কি যায় আসে? বেশী হলে তিন ঘণ্টার জন্যে জুতাটা পরবে। গণি রুমমেটের খাটের তলায় উকি দিল। ওখানেই সব সময় জুতাটা শোভা পায়। না সেখানে নাই। রুমের প্রতিটা জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কোথাও নাই। তার মানে জুতার মালিক জুতাটা পরে বের হয়েছে। রাগের চটে নিজের জিহ্বায় কামড় দিতে ইচ্ছা হল। কেন যে সে রাতের বেলায় রুম-মেটকে জুতা ধার নেয়ার কথা বলে রাখে নি।

ইস্ত্রি নিয়ে লাল শার্টের উপরে দিতেই দিনের সব চেয়ে বড় ঝামেলাটা হল। ইস্ত্রি যেই পরিমাণ সাইজ তটটুকু জায়গার শার্টের কাপড় পুড়ে উঠে এল। গণি ইস্ত্রিটা সেট না করেই প্লাগের মধ্যে তার ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এইদিকে জুতা খুঁজতে খুঁজতে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল এবং ইস্ত্রিটা হয়ে গেল গনগনে গরম। নাইলনের শার্ট সেটা নিতে পারে নি। গণি রাগে দাঁত কিটমিট করতে লাগলো।

হাতে মাত্র পনের মিনিট সময়। উপায় নাই, কালকে যেই শার্ট পরেছিল সেটাই গায়ে দিয়ে দিল। পা ঢুকিয়ে দিল তার একমাত্র স্যান্ডেলে।

সিনথিয়া’র অবস্থা ওইদিকে তথৈবচ। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক দিয়েছিল। সাথে মানান সই সাজ গোঁজ। কপালে দিল ইয়া বড় টিপ। সমস্যা হল ব্লাউস নিয়ে। তার নীলের রঙের ব্লাউসটা মাস তিনেক আগে যে সে বান্ধবী রিনিকে ধার দিয়েছিল, সেটা মনেই ছিল না। মেয়েটাই বা কেমন, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ধার নেয়, তারপরে কাজ হয়ে গেলে ফেরত দেয় না। সিনথিয়া সাথে সাথে ঠিক ক্রে ফেললো রিনিকে ভবিষ্যতে আর কিছু ধার দিবে না। এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন বান্ধবী না থাকলে কোন যায় আসে না। এক এক করে আরও কয়েকটা ব্লাউস পরে দেখলো। কোনটাই শাড়ীটার সাথে ঠিক যাচ্ছিল না। একবার মনে হল, ওই ছেলে বুঝবেই না ব্লাউসের রং শাড়ীর সাথে যাচ্ছে না। না তেমন করতে ইচ্ছা করলো না। বিষয়টা ঠকানো হয়ে যায় না? না সে নিজে কাউকে ঠকাতে চায় না আট কারোর কাছ থেকে ঠকতেও চায় না।

নীল শাড়ী’র জায়গায় অন্য কোন শাড়ী পরলে কেমন হয়? আলমারি খুলে এক এক করে সবগুলো শাড়ী বের করে দেখলো। না কোনটাই পরতে মন সায় দিল না। তা ছাড়া শাড়ীর রঙের সাথে মেক আপ মেলানোর একটা ব্যাপার আছে। এর মধ্যে তো আর ঘড়ির কাঁটা থেমে নাই, সে দিকে বেশ অনেকক্ষণ নজর দিতে পারে নি। তাকিয়ে দেখে পাঁচটা বাজতে মাত্র এক ঘণ্টা বাকী। গুলশান থেকে শাহবাগ যেতে ঘণ্টা খানেক লেগে যেতে পারে। ইদানীং যেই ট্রাফিক হয়। বিরক্ত লাগা আরম্ভ করলো। কেমন একটা লজ্জার ব্যাপার হবে ছেলেটা এসে যদি অপেক্ষা করা আরম্ভ করে। সময় দিয়ে সময়মত না যাওয়াটা, সিনথিয়া একেবারেই পছন্দ করে না। ব্লাউস পেলেই তো আর শুধু হবে না, শাড়ী পরতে হবে। সেটাও কম ঝক্কির ব্যাপার না। এর আগে সে যতবার কোন প্রোগ্রামে শাড়ী পরে গেছে, মা প্রতিবারই সাহায্য করেছেন। মা আজকেই বাসাতেই নাই। খালার বাসা হয়ে বাজারে যাবেন, আসতে আসতে আরও কমপক্ষে ঘণ্টা দু য়েক। মাকে আগে বললে হয়ত তিনি ঠিকই মেয়েকে শাড়ী পরিয়ে দিতেন। সিনথিয়া প্ল্যান ছিল সে নিজেই শাড়ী পরবে। মা’র সাহায্য নিলে, তিনি জানতে চাইতেন সিনথিয়া এত সেজে গুঁজে কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। তাকে বলতে ইচ্ছা করে নি, সে একজন ছেলের সাথে কথা বলতে যাচ্ছে। সিনথিয়া দৌড়ে বাথরুমে ছুটে গেল। ঠোঁটের লিপস্টিক ও মুখের মেকাপ পরিষ্কার করে নীল। বাঁধা চুল খুলে ফেলল।

সিনথিয়া যখন ঘর থেকে বের হল, তখন মনেই হল না সে একজন ছেলেকে বিশেষ কিছু বলতে বের হচ্ছে। পরনে অন্য সব দিনের মত জিন্স, টপস, স্যান্ডেল। একেবারে ইউনিভার্সিটি যাওয়ার বেশভুষা। এই ধরনের পোশাকে গণি তাকে অনেকবার দেখেছে।

জুলাই ২, ২০১৬

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com

www.lekhalekhi.net