একজন দেবীর গল্প

পহেলা বৈশাখ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক দল ছেলে মেয়ে রুমাল চোর খেলছে রমনা পার্কের এক কোণায়। সকালে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান দেখার পরে তারা গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। দলের এক জন ছেলে মিশা প্রস্তাব দিল রুমাল চোর খেলার। ছেলেরা সাথে সাথে রাজী। মেয়েরা প্রথমে ইতস্তত করলেও, পরে পরে এক করে সবাই রাজী হয়ে গেল।

হাসি-আনন্দ—হৈ-চৈ নিয়ে খেলা তুমুল জমে উঠলো। এর মধ্যে বেশ কিছু উৎসাহী দর্শকও এসে ভীড় করল । রাস্তা দিয়ে রিকশা, গাড়িতে করে যারা যাচ্ছিল, তারাও বুঝতে চেষ্টা করল, কি হচ্ছে ব্যাপারটা। খেলোয়াড় আর দর্শকদের হাসা-হাসি তুঙ্গে পৌঁছল, যখন তুহিন রুমাল নিয়ে দৌড়াতে যেয়ে টলতে টলতে উল্টিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ আগে, খেজুরের রস মনে করে, সে এক গ্লাস তাড়ি ঢগ ঢগ করে গিলে খেয়েছিল। পড়বি তো পড়, যেয়ে পড়লো এক গর্তের ভিতরে। সেখান থেকেই চিৎকার করতে থাকলো, তোমরা যে যেদিকে পারো, পালাও, পালাও; ভূমিকম্প হচ্ছে।

তুহিনকে গর্ত থেকে উদ্ধার করার পরে আবার নতুন করে খেলা আরম্ভ হল। তিন জন আউট হল। চারিদিকে মহা উল্লাস। খেলা খুব জমে উঠলো। শম্পা মিশার পেছনে রুমাল ফেলে ধীরে ধীরে আগাতে থাকলো। মিশা যখন বুঝল, ততক্ষণে শম্পা তার পেছনে এসে হাজির। মিশার পিঠে কিল মারতে যেয়ে, শম্পা একেবারে তার বুকের উপরে যেয়ে পড়লো। মিশা ঘুরে শম্পার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আর তাতেই এই বিপত্তি। আরেক দফা হাসাহাসির বন্যা উঠলো।

কিন্তু ঘটনা সবার কাছে হাসির হলেও, মিশা সাথে সাথে গম্ভীর হয়ে গেল। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। শম্পা পায়ে কিছুটা ব্যথা পেল। কিন্তু কথাবার্তায় কিছু প্রকাশ করলো না। মিশা শম্পার কাছে এসে বলল, আমি সরি। শম্পা বলল, এইটা কোন ব্যাপারই না।

মিশা ভাবতে থাকল, তার বুদ্ধিতেই এই খেলা আর তার ঘুরে দাঁড়ানোর কারণেই শম্পা বেচারির সবার সামনে পড়ে যাওয়া। তাও আবার তার উপরে। মেয়েটা নিশ্চয়ই তাকে লাফাঙ্গার ভাবছে। মনে করতে পারে পুরোটাই হয়তো তার দুষ্ট পরিকল্পনা। নিজের উপরে খুব বিরক্তি আসতে থাকলো। শালা কেন যে রুমাল চুরি খেলার প্লানটা মাথার মধ্যে এলো!

পরের দিনই বেশ কিছুটা দূর থেকে মিশা দেখল, শম্পা একটু খুড়িয়ে হাঁটছে। আসলে ওদের পরিচয় একেবারে অল্প দিনের। সখ্যতা এখন তেমন গড়ে উঠে নি। ওদের সবারই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বয়স মাস তিনেকের। তার মধ্যে এমন একটা ঘটনা। ছুটে গিয়ে শম্পার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। ভাবলো আরেকবার সে বলবে, কালকের ঘটনায় আসলে সে ভীষণ মানে প্রচণ্ড সরি। যদি কোন ধরনের প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ পায়, তা হলে তা সে মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত।

মিশা শম্পার সামনে যেয়ে হাঁপাতে থাকল। দৌড়ে আসতে গিয়ে এই অবস্থা। মিশার চোখ পড়ল, শম্পার পাশে দাঁড়ান মেয়েটার দিকে। মুখ দিয়ে সরি কি, কোন শব্দই আসলো না। শুধু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হল। মেয়েটার চোখগুলো বড়, বড়। কেমন যেন মায়াবী। মনে হল যুগ যুগান্তরের পরিচয়। বুকের কোন একটা জায়গায় রক্ত চলচল বন্ধ হয়ে গেল। নিজেকে নিস্তেজ লাগতে লাগল।

শম্পা বলল, পরিচয় করিয়ে দেই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রুমকী। আমাদের পাড়াতেই থাকে। আর্টস কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিছু বলার আগেই রুমকী বলল, আপনি না-কি মানুষ ফেলে দেবার পরিকল্পনা করতে ওস্তাদ। আমার বন্ধুকে বড় ধরনের একটা প্লান করে আপনার বুকে নিয়ে ফেলেছেন। কথাটা শুনে, মিশা থতমত খেল। রুমকী উচ্চস্বরে হো হো করে হাসতে থাকল। শম্পা একটা মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকল।

কিছুক্ষণের মধ্যে মিশা নিজেকে সামলে নিল। দুপুরে তারা একসাথে টিএসসিতে যেয়ে লাঞ্চ করলো। অনেক কথা আর হাসাহাসি হতে থাকল। এক দিকে শম্পা যেমন ধীর স্থির, অন্যদিকে মনে হয়, কথায় কথায় হাসাই জানি রুমকীর প্রধান কাজ। মিশা মজার মজার কথা বলতে সিদ্ধহস্ত। তিন জনের সমাবেশ বেশ জমে উঠল।

দুপুরে খাবারের কিছুক্ষণ পরে, শম্পা চলে গেল। বলল, কাকারাইলে তার এক খালা থাকে। তাকে সেখানে যেতে হবে। রুমকীও চলে যেতে চাচ্ছিল। মিশা বলল, কোন কাজ না থাকলে, আরেকটু থেকে যাও। এর মধ্যে তারা সবাই সবাইকে তুমি করে বলছে। মিশাকে অবাক করে দিয়ে রুমকী থেকে গেল মিশার সাথে।

দুজন হাঁটতে হাঁটতে চলল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির দিকে। পথে অনেক কথা হল। কার কি ভাল লাগে, কার বন্ধুরা কেমন, কার বাবা-মা বেশি কড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। রুমকী কথায় কথায় হাসি, মিশার মনটাকে একেবারে কেড়ে নিল। লাইব্রেরিতে পাশা পাশি দুটো বই রাখা ছিল। একটা ইয়া বড়, আরেকটা একেবারে ছোট। মিশা বলল, মনে হচ্ছে, বড় বইটা বাচ্চা পেড়েছে। কথাটা শুনে রুমকী খুব জোরে হাসতে লাগল। কিন্তু, এইবার মিশার মনে হল, এত হাসি একটা মানুষ হাসে কি করে। এই হাসির অন্তরালে কি অন্য কিছু আছে।

দিন যেতে থাকলো। তিন জনের সম্পর্ক কাছাকাছি হতে থাকলো। মিশা আর শম্পার দু জনই ইতিহাস বিভাগের। একই সাথে ক্লাশ থাকাতে দিনের অনেকটা সময় একসাথে কাটে। দিনে কমপক্ষে এক বার হলেও, রুমকী এসে কিছু সময় এক সাথে কাটিয়ে যায়। যতক্ষণ একসাথে থাকে তার বেশীর ভাগ সময় ওদের রুমকীর হাসি শুনতে হয়। প্রায় আশে পাশে যারা থাকে, তারা বুঝতে চেষ্টা করে ওদের কাছে এতো হাসির কী আছে। অনেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিশা, শম্পা বেশ বিব্রত হয়।

মিশা আর শম্পার সম্পর্ক স্বচ্ছ হতে থাকে। এক জন আরেক জনের মুখ দেখলেই বূঝে ফেলে ভিতরকার সব কথা। বলার আগেই অন্য পক্ষের জানা থাকে অনেক কিছুই। এক দিন, মিশা বুঝল শম্পার মন খারাপ। কিন্তু, শম্পা ক্লাশ করছে, নোট নিচ্ছে , আর সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। শম্পাকে একা পাওয়া মাত্রই, মিশা চেপে ধরল। প্রথমে শম্পা বলল, আরে দূর কিছু হয় নি। পরে, শম্পা বলল তার গল্প।

শম্পার ছোট বেলাতেই তার বাবা আর মা আলাদা থাকা আরম্ভ করে। বনিবনার সমস্যা ছিল। মা তার ভাইয়ের সাথে থাকে। গত কাল খবর এসেছে, মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ কিছু বছর থেকে তার মানসিক রোগ। কথা গুলো বলতে বলতে, শম্পা কাঁদতে থাকল। বলল, মায়ের আদর কি সে জানে না। মিশার চোখও পানিতে ভরে উঠলো। কিন্তু ছেলেরাতো কারো সামনে চোখের পানি ফেলে কাঁদতে পারে না। আমাদের সংস্কারের মনে হয় কঠিনভাবে নিষেধ করা আছে।

শম্পা একদিন মিশাকে বলল, ঘুরে দাড়াও দেখি। শম্পা মিশার প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে ভিতরে কিছু রেখে আবার জায়গা মত ফিরিয়ে দিল। বলল, খবরদার হলে না ফেরা পর্যন্ত মানি ব্যাগটা খুলবে না।

মিশা থাকতো সূর্য সেন হলে। তার বাবা ঢাকার বাইরে বদলী হয়ে যাওয়াতে হলে এসে উঠতে হয়েছে। গতকাল রাতে খেতে যেয়ে শেষ টাকাটাও খরচ হয়ে গেছে। তার টাকা এসে পৌঁছে নি। মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েছিল না খেয়ে থাকার। সে এ ব্যাপারে কিন্তু কিছুই বলে নি শম্পাকে। কিন্তু, শম্পা বিষয়টা জানলো কি করে?

পরে মিশা আবিষ্কার করলো, শম্পা সবার জন্যেই নিবেদিত প্রাণ। কার কখন কী লাগবে, কী ভাবে যেন সে বুঝে ফেলে। তার পরে তার যা যা আছে তা দিয়েই মানুষের সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক বার মিশা দেখলো শম্পা এক টোকাইকে ব্যাগে যা টাকা ছিল সব দিয়ে দিলো। কেও হাসপাতালে আছে শুনলে, তার যাওয়া চাইই চাই। হোক সে কোন পরিচিত মানুষের পরিচিত কিংবা একেবারে অজানা। কাওকে সাহায্য করতে কোন কার্পণ্য তার মধ্যে নাই। কারো প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোতে শম্পা একেবারেই সংকচহীন।

মিশা মাঝে মাঝে শম্পার সাথে বিভিন্ন সাহায্য মিশনে যায়। সেও অংশগ্রহণের চেষ্টা করে। একবার মিশা শম্পাকে বলল, আমি আজকে থেকে তোমার নাম বদলে দিলাম। তোমাকে নাম দিলাম, দেবী। যে অন্যকে সাহায্য করার জন্যে নিজের কথা, নিজের প্রয়োজনের কথা বিন্দু মাত্র ভাবে না; সে কোনভাবেই মানুষ হতে পারে না। সে অবশ্যই এক জন দেবী!

শম্পা বলল, আর ফাজলামি করতে হবে না। আমি দেবী হলে, আপনি হলেন দেব। যে দেবীর ভিতরের কথা বুঝে ফেলে, দেবীকে সারাদিন আনন্দের মধ্যে রাখে , তার সাথে দিনের বেশীর ভাগ সময় থাকে, সে দেবতা না হয়ে পারে না। দেব ছাড়া তো আর দেবী হতে পারে না!

একদিন কৌতূহল বশে মিশা শম্পাকে রুমকীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলো। বলল, তার হাসিতে বুকের রক্তে একটা দোলা লাগে। ওর হাসির একটা অন্যরকম ভাষা আছে। দেবী শম্পা বুঝে ফেলল, মিশা তোমাকে বলা হয় নি। রুমকীর জীবনটা আসলে বড় একটা গল্প আছে।.........

গত দু দিন ধরে শম্পা ক্লাশে আসছে না। রুমকীরও দেখা মিলল না। মিশা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো। কিছু তো বলে যায় নি। অসুস্থ হয়ে পড়ে নি তো। ক্লাশের শেষে গেল আর্ট কলেজে। যদি রুমকী কিছু খবর দিতে পারে। একই পাড়ায় থাকে, বেস্ট ফ্রেন্ড।

মিশাকে দেখে রুমকী ছূটে আসলো। এসে বলল, আরে মজনু সাহেব, গত কাল তো লাইলী বেগমের বিয়ে হয়ে গেছে। এমেরিকায় থাকে পাত্র। লাইলী আর না করলো না। আমেরিকায় যাওয়া নিয়ে কথা। চাট্টিখানি ব্যাপার না, মশাই। তাই দুম করে বিয়ে করে ফেলল। মজনুকে খবর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না।

মিশার মুখ শুকিয়ে গেল। পিপাসা লাগল। ভাবল না এটা হতে পারে না। যাই হোক তাদের মধ্যে তো কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। তার পরেও কেন এত খারাপ lagche? প্রেম না থাকলেও, তারা একে অপরের। তারা তো দেব-দেবী। মুহূর্তেই শত শত স্মৃতি আর চিন্তা এসে ভীড় করতে লাগল।

রুমকীর হো হো হাসিতে মিশা আবার বাস্তবে ফিরলো। হাসতে হাসটে বললো, কেমন ঘোল খাওয়ালাম। আসলে ওর বিয়ে হয় নি। খুলনা যেতে হয়েছে এক ঘণ্টার নোটিসে । বড় বোনের বাচ্চা হয়েছে। ডেলিভারি দু সপ্তাহ আগে হয়েছে। এখন, সে সেবা কার্যক্রম চালাবে বোনের বাসায়। আমাকে অবশ্য দায়িত্ব দিয়েছিল তোমাকে খবর পৌঁছে দিতে। কিন্তু ইচ্ছে করেই আজকের খেলাটা তোমার সাথে খেললাম।

এক মাস পরে শম্পা ফিরে এলো। মিশা বলল, একটা ভীষণ খবর আছে। শম্পা নির্বিকারভাবে জিজ্ঞাসা করল, কি তুমি রুমকীকে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছ? আমি জানতাম তুমি এই কাজটা করবে। ওর জীবনে তোমার মত একতা দেবতার খুবই দরকার ছিল। কিন্তু, মিশার মনে হল, খবরটায় যতটুকু উত্তেজিত সে মনে করে ছিল শম্পা হবে, তা তো সে হল না! তবে কি..., তবে কি দেবকে নিয়ে দেবীর কি অন্য কোন চিন্তা ছিল?

এর মধ্যে জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। প্রায় পঁচিশ বছর। শম্পা ঢাকাতেই থাকে। শম্পার জীবন সঙ্গী তার পরোপকারী স্বভাবকে বাঁকা চোখে দেখে। জটিলতা, আর কষ্টের সৃষ্টি হয়। পরিবেশ কেমন যেন ভীষণ অসহনীয় হয়ে উঠে। অন্যদিকে মিশা, রুমকী থাকে এমেরিকার কোন এক শহরে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে শম্পার ক্লান্তি ভর করে। আর পাঁচটা মানুষের মত তারও ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। একটু আশ্রয়, একটু সমর্থন, একটু স্বীকৃতি। মন চায় পাশের মানুষরা তাকে বুঝুক। সে তো আর বাস্তব দেবী না। রক্ত, মাংসের মানুষ।

শম্পা মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাখি উড়ে যেতে দেখে, মেঘ উড়ে যেতে দেখে। পাখি উড়ে যায়, তার পরে আবার নীড়ে ফিরে আসে। কিন্তু মেঘ একবার চলে গেলে; কী আর ফিরে আসে? মনে আসে মিশার কথা। সে তো একজন দেব পেয়েছিল। কিন্তু, তাকে সে উৎসর্গ করেছিল তার প্রিয় এক জনের জন্যে।

ঘটনাক্রমে মিশার সাথে শম্পার যোগাযোগ হয়; ফেস বুকে। ছোট করে একটা করে একটা ম্যাসেজ পাঠায়ঃ দেব, কালকে পয়লা বৈশাখ। দেবীর আরেকবার দেবের বুকের মধ্যে মাথা রাখতে ইচ্ছে করে। পড়ে যেয়ে না, সত্যি করে। বাকী জীবনের শক্তি হয়তো সেখানে লুকানো। সেটা বের করে আনা খুব দরকার। ইতি, দেবী।

উৎসর্গ ঃ নিজেকে যারা অন্যদের জন্যে বিলিয়ে দেয় মাদার টেরেসার মতই।

পহেলা বৈশাখ, ১৪১৮

এপ্রিল ১৪, ২০১১

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com