সানরাইস ফিউনারেল হোম

সানরাইস ফিউনারেল হোমে রাজনের চাকরিটা হয়ে গেল।

কাজটা বেশ সহজই বলতে হবে। মেন দরজা দিয়ে ঢুকলে রিসিপশন। মানুষজন ঢুকলে দেখিয়ে দিতে হয় তাদের মৃত প্রিয়জন কোন রুমে আছে। সারি সারি রুম। সব মিলিয়ে বিশটা। এগুলোর নাম ভিসিটেশন রুম। প্রতিটা রুমের দরজায় ভিতরের ক্ষণস্থায়ী বাসিন্দার নাম একটা সোনালী ফ্রেমের মধ্যে দেয়া থাকে। রাজনকে সকাল আটটার মধ্যে কাজে চলে আসতে হয়। সন্ধ্যা ছয়টায় কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় দিনই বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। নতুন চাকরি, বেতন ভাল; সে জন্যে হাসিমুখে কোন অভিযোগ ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছে। অবশ্য মার্কিন দেশে যত হাজার সমস্যাই থাকুক না কেন, কাজের জায়গায় বিশেষ করে কাস্টমারের সামনে কোন ভাবেই গোমরা মুখ দেখানো যায় না।

ফিউনারেল হোম বিষয়টা হয়ত কিছু বাঙালি বন্ধু ঠিক নাও বুঝতে পারেন। সহজ করে বলতে গেলে এরা মৃতদের সৎকারের ব্যবস্থা করে। তাই বলে বাংলাদেশের আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে। আমরা যে রকম একেবারে সবচেয়ে স্বল্প সময়ে অনেকটা তাড়াহুড়া করে মৃতকে দাফন করি, পশ্চিমারা কিন্তু সে রকম না। তবে একটা ব্যাপারে তাদের কঠিনভাবে নিয়ম মেন চলতে হয়। একমাত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মানুষ ছাড়া কেউ লাশ ধরতে পারে না। অবশ্য তাদের তত্ত্বাবধানে অন্যদের লাশ স্পর্শ করার অনুমতি আছে। লাশ থেকে জীবাণু ছড়াতে পারে, সেই জন্য এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া মৃতের যাতের কোন অমর্যাদা যাতে না হয়, সে দিকেও দৃষ্টি রাখতে হয়। একটু উনিশ বিশ হলেই আবার মিলিওন ডলারের মামলা খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

ফিউনারেল হোম নিয়ে আরেকটু বলি। ফিউনারেল হোমের লোকজন বিশেষ গাড়িতে করে মৃত দেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসে। পরিবার থেকে তারা জেনে নেয়, তাদেরকে কতদিন লাশ রাখতে হবে এবং বাড়তি আনুষ্ঠানিকতা কী কী হবে। সাধারানত, মৃত্যুর কয়েক দিন পরে মৃত দেহকে কবরে সমাহিত করা হয় কিংবা কারনেশন মানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই কয়টা দিন লাশ ফিউনারেল হোমে থাকে। এখানে শরীরের ভিতরের পচনশীল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ফেলে। তার পরে পরিবারের ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী লাশটাকে সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরানো হয় এবং কফিনের ভিতরে শুইয়ে রাখা হয়। কফিনের ভিতর, যাকে কাস্কেট বলে, মখমল জাতীয় দামী কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয়। মাথার নিচের থেকে একটু উঁচু করা দেয়া হয়। দেখলে মনে হয়, মানুষটা মারা যায় নি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটু জোড়ে ডাকলেই উঠে পড়বে। কিন্তু ডাকতে ইচ্ছা করে না। এত সুন্দর গভীর ঘুমের কাউকে শুধু চোখ ভরে দেখতেই মন চায়। শরীরের ভিতরে যে প্রাণ নাই, সেটা না বললে বুঝা খুবই কঠিন।

বাঙালি ছেলে রাজন ইকোনোমিক্সে গ্র্যাজুয়েশোন করেছে প্রায় মাস ছয়েক হল। অর্থনীতিতে পড়ালেখা করলেও অর্থের সন্ধান পেল না। এই এক অদ্ভুত দেশ এমেরিকা। কয়েক বছর পর পর অর্থনীতির অবস্থা পাল্টে যায়। কিছুদিন একেবারে রমরমা অবস্থা। চারিদিকে এত কাজ যে কাজ করার পর্যাপ্ত মানুষ পাওয়া যায় না। তার পরে আসে মন্দা। দেদার মানুষ চাকরি হারাতে থাকে। এর বাহারি নাম ‘লে-অফ’। রাজনের যখন গ্র্যাজুয়েশন হল, তখন এমেরিকায় মন্দা চলছে। এমেরিকার নাগরিকদেরই চাকরি নাই, সেখানে বিদেশী হয়ে সে কি করে চাকরি পাবে? তার পরেও ছোট বেলায় মুখস্থ করা রচনা ‘অধ্যাবসায়’ স্মরণ করে একনিষ্ঠভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেল। কিন্তু বেচারা তিন শত এপ্লিকেশন পাঠিয়ে ইন্টার্ভিউ পেল সবে তিনটা। চাকরির অফার পেল একটা। মুরগির ফার্মে ডিম কুড়ানোর কাজ। তাও সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা। রাজন হিসেব করে দেখল, যেই টাকা আয় হবে তার থেকে গাড়ির তেলের দামই উঠবে না। তা ছাড়া পড়া লেখা করে ডিম কুড়াবে, সেইটাই বা কেমন কথা। চাকরিটা সে নিল না। আর যাই হোক শিক্ষিত বাঙালি ছেলে তো ; যেমন তেমন কাজ করলে কি মান থাকবে?

পত্রিকা থেকে আরম্ভ করে অন লাইন জব পোর্টালে প্রতিটা চাকরির বিজ্ঞাপন রাজনের মুখস্থ। যেই চাকরিটা পছন্দ হয়, তারা চায় অভিজ্ঞতা। যেখানে অভিজ্ঞতার দরকার নাই, সেখানকার কাজগুলো হয় ডিম কুড়ানো জাতীয় কাজ। পড়ালেখা চালাতে যেয়ে মেলা ধার দেনা হয়ে গেছে। তার পরে এত দিন ধরে কাজের আশায় ঘুরছে। সোমবার দিন সকালে অনলাইনে ফিউনারেল হোমের চাকরির বিজ্ঞাপনটা দেখলো। মাত্র চার লাইনের বিজ্ঞাপন। কলেজ পাশ হলেই চলবে। ওরা কাজ শিখিয়ে নিবে। তবে আরেকটা শর্ত আছে। নার্ভ শক্ত মানে সাহস থাকতে পারবে।

রাজন ভাবা আরম্ভ করল সে এপ্লাই করবে কি না। সে কলেজ পাশ। সেটা সমস্যা নাই। কিন্তু সাহস আছে কি-না, সেইটা জানবে কি করে। দেশে ভীতু ছেলে ছিল বলে বড়দের কাছ একটু বেশী সমাদর পেত। তেলাপোকা ছিল সাক্ষাৎ জম। মাকড়শা দেখলে চিৎকার করতে করতে অন্য রুমে দৌড়ে পালাতো। রাস্তায় কুকুর দেখলে তো কথাই নাই, ভাবতো এই বুঝি দৌড়ে এসে কামড় দিয়ে দিল। তার পরে জলাতঙ্ক...। অবশ্য বিদেশে আসার পর তেলাপোকা, মাকড়শার সাথে তেমন একটা দেখা হয় না। কদাচিৎ দেখা হলেও হৈ চৈ করে দৌড় দেয় না। আগের থেকে বয়স বেড়েছে না? নিজেকে সামলিয়ে নিতে পারে। বিজ্ঞাপনটা আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বার পড়ল। বিজ্ঞাপনদাতারা নিশ্চয়ই মাকড়শা, তেলাপোকা, কুকুর বিষয়ক সাহস থাকতে হবে এমন কথা বলছে না। যেহেতু ফিউনারেল হোম, তারা নিশ্চয়ই বুঝাতে চাইছে মৃতদের নিয়ে কাজ কর্ম করার মত সাহস থাকতে হবে। মানুষ মারা গেলে জড় পদার্থ হয়ে যায়। না পারে নড়তে, না পারে কথা বলতে। রাজন নিজেকে নিজেই বলল, “মৃতদের বোকারা ছাড়া আর কেউ ভয় পেতে পারে না।”

এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দেয়ার পরে মাথার মধ্যে মেলা চিন্তা এসে ভিড় করতে লাগল। ক্লাস টেনে যখন পড়ে, তখন পাশের বাসার রুশোর নানী মারা গেলেন। তার মাত্র একদিন আগে রাজনের সাথে উনার দেখা হয়েছিল। মিনিট দশেক নানী কথা বলেছিলেন। বিকাল বেলা কথা হল, আর সকাল বেলাই তিনি নাই। পাড়ার অন্যান্যদের সাথে উনাকে দাফন করতে রাজনও গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত তেমন কিছু মনে হয় নি। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে মাথার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে শত শত চিন্তা খেলতে লাগল। মানুষ কেন মারা যায়? মৃত্যুর পরে আত্মা কোথায় যায়? লাশকে কেন কবর দিতে হয়? শেষে রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর রাতে রাজন স্পষ্ট দেখতে পেল রুশোর নানী তার রুমে এসেছেন। তাকে দেখা মাত্রই রাজনের মনে হল উনাকে না কবরে রেখা আসা হয়েছে। তা হলে উনি এখানে এলেন কি করে? গলা শুকিয়ে শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কিদু মিনিটের মাথায় কাঁপুনি আরম্ভ হল। জোড়ে চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে বাবা-মা কে ডাকতে চেষ্টা করল। কিন্তু পুরো শক্তি দিয়েও গলা থেকে কোন স্বর বের করতে পারলো না। শুধু বুক থেকে কেমন ঘড় ঘড় শব্দ আসতে লাগল।

রাজনকে কালো স্যুট পরে সান রাইস ফিউনারেল হোমে কাজে আসতে হত। কোটের বাম দিকে বুকের কাছে একটা নেম ট্যাগে ইংরেজিতে লেখা রাজন আহমেদ, ফিউনারেল ডিরেক্টর ট্রেনী। তার মানে প্রশিক্ষণের পরে পুরো ফিউনারেল ডিরেক্টর। ইন্টার্ভিউয়ের সময়ে ম্যানেজার বলেছিলেন, “তোমার নির্দেশনায় লাশ হাসপাতালে থেকে নিয়ে আসা থেকে আরম্ভ করে সমাহিত করা পর্যন্ত প্রত্যেকটা কাজ হবে। অনেকটা মুভি ডিরেক্টরের মত।” এই বাজারে বেতন ভালই বলতে হবে। ট্রেনিং শেষ হলে বোনাস, কমিশন থাকবে। ম্যানেজার সাহেবের ভাষ্য অনুযায়ী কর্মচারীরা এখানে আজীবন কাজ করে। একবার চাকরি আরম্ভ করলে কোনভাবেই তারা ছাড়ে না। ইদানীং ব্যবসা তুমুল বেড়ে গেছে। তাই তাদেরকে আরও কর্মচারী যোগ করতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি খারাপ হলে ফিউনারেল হোমের ব্যবসা ভাল হয়। হার্ট এট্যাক, ব্লাড প্রেসারে মানুষ বেশী মরা আরম্ভ করে। তার সাথে যোগ হয় খুনা খুনি, সুইসাইড।

প্রচুর উত্তেজনা নিয়ে রাজন কাজ আরম্ভ করল। ভাল বেতন, তার পরে কয়েক দিন বাদে বেতন বাড়বে; ভাবতেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে যেত। রাজন ঠিক করে ফেললো সে খুবই মনোযোগ দিয়ে কাজ করবে। ভাল তাকে করতেই হবে। সবাই যাতে তার প্রশংসা করে। কিন্তু মনের এক কোণায় কেমন জানি খচ খচ করতে লাগল। মৃত মানুষ নিয়ে কাজ করবে, কোন ভৌতিক কিংবা ভয়ের ব্যাপার হবে নাতো? সাথে সাথেই তার সেই ক্লাস টেনের ঘটনা মনে পড়লো। সেই সময়ে মা বলেছিলেন, “তুই আসলে রুশোর নানীর কথা চিন্তা করে ভয় পেয়েছিলি।” পরে তিনি আরেকটু ব্যাখ্যা ও উপদেশ যোগ করেছিলেন, “ভয় পেলে মানুষের বোবা পায়। তখন সে কথা বলতে পারে না। তুই ভীতু টাইপের মানুষ। লাশের থেকে দূরে দূরে থাকবি। ‘বোবা পাওয়া’ রোগটা স্থায়ী হলে মহা বিপদ। মৃত্যু তখন অবধারিত।”

চাকরির প্রথম দিনটা দারুণ গেল। কয়েক ঘণ্টা লেগে গেল বিভিন্ন ধরণের নিয়মাবলী পড়ে ও সাইন করে। এমেরিকা এই এক ব্যাপার। মামলা খাওয়ার ভয়ে চাকরিদাতারা সব পরিস্থিতির জন্য ছাড় পত্র অগ্রিম স্বাক্ষর নিয়ে রাখে। কয়েকটা ভিডিও দেখতে হল। এর মধ্যে চোখটা ঢুলু ঢুলু হয়ে গেল। গত রাতে তেমন একটা ঘুমাতে পারে নি। নতুন চাকরির টেনশানের সাথে যোগ হয়েছিল মারা যাওয়ার পরে মানুষ কি করে সে সব নিয়ে ভাবনা। চোখটা লেগে আসার সাথে সাথেই দেখল ভয়ের একটা স্বপ্ন। রুশোর নানী বলছে, “বাছা এই চাকরিটা ছেড়ে দাও।” রাজন চোখ খুলেই বুঝলো সে স্বপ্ন দেখেছে। বাংলাদেশ থেকে এমেরিকা আসা কি একজন মৃতের পক্ষে সম্ভব? এখানে আসতে হলে ভিসা, টিকেট, টাকা কত কিছুই না লাগে। আসলে সারা দিন ধরে মৃত্যু আর রুশোর নানীকে নিয়ে ভেবেছে, সে জন্যে ঘুমের মধ্যে আবোল তাবোল দেখছে।

যাই হোক দুপুর নাগাদ রাজনের আসল কাজ আরম্ভ হল। জন নামের ষাটোর্ধ বয়সের পুরনো এক ফিউনারেল ডিরেক্টরের দায়িত্ব পড়ল রাজনকে প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়ার। ভদ্রলোক কুজো হয়ে হাঁটে। মাথা ভর্তি পাকা চুল। এই বয়সে চুল কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার বেলায় ব্যতিক্রম হয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত করা ব্যাপারটা হল তার গলার স্বর। শীতল, গম্ভীর ও স্পষ্ট। লোকটা বেশ ধীরে ধীরে কথা বলে। রাজনের মনে হল, বাংলাদেশ হলে নাম করা কোন আবৃত্তিকার হতে পারত। নির্ঘাত শিমুল মোস্তফার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যেত। ভদ্রলোকের কথাগুলো একবারে বুকের ঠিক মাঝখানে সবচেয়ে গভীর জায়গায় চলে যায়। লোকটাকে দেখে ও তার কথা শুনে রাজনের গায়ে কাটা দিয়ে গেল। লোকটা মৃতদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটানোর জন্যই হয়ত এ দশা হয়েছে। এইবার রাজন নিজের কৌতুকে নিজেই মনে মনে হাসল, জীবিত ও মৃতের মধ্যেকার যে সময়কাল সেখানে ভদ্রলোকের বসবাস। ওর নিজের অবস্থাও কি একদিন এরকম হবে?

জন রাজনকে নিয়ে পুরো ফিউনারেল হোম দেখাল। সানরাইজ ফিউনারেল হোমের পূর্ব কোণে বারান্দার মত জায়গা সেখানে গাড়িতে করে লাশ নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে নেয়া হয় ক্লিনিং, ও কসমেটিক এরিয়াতে। এখানে চারটে রুম। মৃতের গোসল করানো, শরীরে ভিতরের পচনশীল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বের করার জায়গাটা, চেহারায় কসমেটিক প্ললেপ দেয়ার পরে শেষ রুমে নিয়ে কাপড় চোপড় পরানো হয়। এই চার রুমের উল্টোদিকে বেশ বড় একটা কামরা। সেখানকার দেয়াল, দরজা সবই লোহার। কোন জানালা নাই। এইটাই হিমঘর। সেখানে গোটা বিশেক কফিন সারি সারি ট্রলির উপরে রাখা হয়েছে। রাজনকে বলতে হল না, প্রতিটা কফিনের মধ্যে একটা করে মানুষের লাশ আছে। মনে আসলো সেই গান, “হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস।” রঙ্গিন স্বপ্নগুলো এখন কফিনের মধ্যে বন্দী। তার পরে স্বপ্নগুলো চলে যাবে মাটির নিচে কবরের অন্ধকারে কিংবা পুড়ে ছাই হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

বিল্ডিঙটার অন্য প্রান্তে ক্রিমেশন রুম। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির ওভেনে ২০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১০৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় লাশ পুড়িয়ে ছাই করা হয়। বিল্ডিঙের পেছনেই বিশাল কবরস্থান। প্রচুর গাছ পালা, ছোট করে সব সময়ে ঘাস কাটা। দেখলে মনে হয় একটা পার্ক। সেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের কবর দেয়ার জন্য জায়গা আলাদা করা আছে। রিসিপশনের লাগোয়া হল সারিসারি ভিসিটেশন রুম। আর উল্টো দিকে বড় একটা শপ। সেখানে ফুল থেকে আরম্ভ করে কফিন, কাস্কেট জাতীয় নানা ধরণের ফিউনারেলের জিনিষ পত্র বিক্রি করা হয়।

দেখতে দেখতে কাজের টিন মাস পার হয়ে গেল। রাজন ফ্রন্ট ডেস্ক একাই সামাল দিতে পারে। জন এসে মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় কাজ দেখিয়ে দিয়ে যায়। বাড়তি হিসেবে কিছু উপদেশও দেয় । একবার ভদ্রলোক নিজের থেকেই জানালো, “এখানে ধীর লয়ে, মোটা গলায় কথা বললে কমিশন বেশী আসে। মৃত মানুষদের পরিবারের সাথে এভাবে কথা বললে তারা বেশী ভরসা পায়। তখন দামী কফিন, কাস্কেট, কববের জায়গা, ফুল ইত্যাদি শত ধরণের জিনিষ সহজেই বিক্রি করা যায়।” এই প্রথম রাজন জনকে হাসতে দেখল। টাকা মুখে হাসি ফুটাতে পারে না এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে।

সপ্তাহের বেশীর ভাগ দিনই মোটামুটি ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে হঠাৎ করেই দেখা যায় কোন দিন কাজের চাপ কমে গেছে। হয়ত দেখা গেল পর পর দু দিন মৃত মানুষের সৎকারের কোন নতুন অর্ডার আসে নি। আগের অর্ডারের কাজ গুছিয়ে ফেললেই হাতের কাজ কমে আসে। কর্মচারীদের ফিউনারেল হোমসের মধ্যে অকারণ হাসাহাসি, আড্ডা দেয়া নিষেধ। ম্যানেজার বলেছিলেন, এইসব করলে মৃতদের অসম্মান করা হবে। রাজনের জানতে ইচ্ছা করেছিল, নীরব, অন্ধকার জগত থেকে কোন রসিক মৃতের যদি হৈ চৈ, হাসি-ঠাট্টা শুনতে মন চায়। না, সে এই প্রশ্ন ম্যানেজারকে করে নি। আসলে ম্যানেজারের সাথে রসিকতা করার সাহস হয় নি। অবশ্য জন ফিস ফিস করে কাব্যিক গলায় অন্য একটা কারণ বলেছিল, “এইটা আসলে মৃতদের কথা মনে করে না, তাদের আত্মীয়স্বজনদের দেখানোর জন্যে। তাদের ব্যথায় কর্মচারীরা সব ব্যথী। ফলে তারা খরচ করতে ভরসা পায়।”

বৃহস্পতিবার বিকাল ছয়টায় রাজনের ছুটি হওয়ার কথা। সে সেই হিসেবে কাজ গুছিয়ে আনছিলো। ভিসিটেশোন রুমে মোট নয়টা লাশ ছিল। সে ওগুলোর ট্রলি ঠেলে ঠেলে হিম ঘরে দিয়ে আসলো। সব দরজা চেক করলো যে ঠিক মত লক করা হয়েছে কি না। আজকে সারাদিন বিশেষ কোন ব্যস্ততা ছিল না। আগামী কাল শুক্রবার বেশ ব্যস্ততা যাবে। মোট দুটো কবর ও একটা ক্রিমেশন হবে। রাজনকে সবগুলো কাজে তদারকিতে সাহায্য করতে হয়। ট্রেনী বলে কথা। সে কাজের চাপ নিয়ে কোন অভিযোগ করে নি। এখন সময় সব ধরণের কাজ শিখে নেয়ার। ম্যানেজার কয়েকবার বলে গেছেন, তিনি রাজনের কাজে খুশী। তিনি রাজনের জন্য লাশ ধরা, ক্রিমেশন করা, কবর দেয়ার লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দিবেন। রাজন চট করে হিসেব করে দেখেছে, তখন তার আয় বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের মত হবে। তখন দেশে যেয়ে সুন্দরী একটা বঙ্গ ললনা বিয়ে করে নিয়ে আসলেই হবে।

ফিউনারেল হোম থেকে বের হওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ানো মাত্রই ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলো। এর মধ্যে রাজন ভারী গলায় কথা বলা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে, “হ্যালো, this is সান রাইজ ফিউনারেল হোম। আপনাকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” অন্যদিক থেকে ম্যানেজার সাহেব বলতে লাগলেন, “সরি রাজ। তোমাকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে। আমি টমকে কমিউনিটি হাসপাতালে পাঠিয়েছি, একটা মেয়ের ডেড বডি আনার জন্যে। হাসপাতাল বডি রিলিজ করে দিচ্ছে। সে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে বডি নিয়ে আসবে। মেয়েটাকে ক্লিন ও মেক আপ দেয়ার জন্যে কাউকে পেলাম না। তুমি যতটুকু পার কাজগুলো সেরে রেখো। আমি ভোর বেলায় চলে আসবো। মেয়েটার আঙ্কেল সকাল আটটায় আসবে। তিনি অনেক দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। তাকে কোনভাবেই মেয়েটার রক্তাক্ত ও লিটল ডিকম্পোজ মুখটা দেখানো যাবে না।” রাজনকে এদেশীরা নামটা ছোট করে রাজ বলে ডাকে। ব্যাটারা যদি জানত, রাজ-রাজা মানে কি। রাজাদের নাম ছোট হয় না, বরং আগেকার দিনে যে রাজা, ক্ষমতা ও অর্থে যত বড়, তার নাম তত বড় হত!

রাজন কিছুটা চিন্তায় পড়ল। সে কাজগুলো করতে দেখেছে, বেশ কয়েকবার অন্যদের সাহায্য করেছে; কিন্তু নিজে কখনও করে নি। পারবে তো কাজটা করতে? মনে বিশ্বাস আছে সে পারবে। তা ছাড়া এরকম সুযোগ এত তাড়াতাড়ি পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। সে এই কাজ ভাল করতে পারলে লাইসেন্স পাওয়া সহজ পাওয়া সহজ হবে। তার মানে কেল্লা ফতে, একগাদা টাকা বেতন ও বিয়ে। রাজন মেয়েটার বডি রিসিভ করার দরকারি কাজ এগিয়ে রাখা আরম্ভ করলো। ট্রলি রেডি করে ফেলল। পরিষ্কার, এক্সট্রাকশান ও কসমেটিক দেয়ার জায়গা গুছিয়ে ফেললো। একা কাজগুলো করা কঠিন হবে, তার পরেও তাকে পারতে হবে।

রাজন প্রস্তুতি শেষ করার পর ঘড়ির দিকে তাকাল। ফোন কলের পর পঞ্চাশ মিনিট পার হয়ে গেছে। তার মানে হাতে আছে দশ মিনিট সময়। আরেকবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। না সব ঠিক ঠাকই আছে। কাজ সারতে সারতে কমপক্ষে ঘণ্টা দু য়েক লেগে যাবে। কিছু খেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সাথে তেমন কিছু নাই। অবশ্য চট করে যেয়ে পাশের রাস্তার ম্যাগডোনাল্ডসে যেয়ে বার্গার কিনে আনা যেতে পারে। সেটা হয়ত ঠিক হবে। পুরো ফিউনারেল হোমে সে ছাড়া আর কেউ নাই। নিজেই কথাটা ঠিক করে নিল। মানে জীবিত কেউ নাই। খাওয়ার কিনতে যাওয়ার বুদ্ধিটা বাদ দিলো। যদি এর মধ্যে টম লাশ নিয়ে চলে আসে, তা হলে সমস্যা হয়ে যাবে। রাজন ভেনডিঙ মেশিনে কয়েকটা কয়েন ফেলে চিপস, পানির বোতল বের করে নিল। আপাতত এইটা দিয়ে ক্ষুধা মেটাতে হবে। বাসায় যাওয়ার পথে কোন ফাস্ট ফুডের দোকানে থেমে ভাল করে খেয়ে নিলেই হবে।

বাথরুমে গেল রাজন। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হবে, তাই ভাবল মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিবে। ক্ষুধা নিয়ে তাড়াহুড়া করে কাজ করার জন্যে বেশ ক্লান্তও লাগছিল। অনেকক্ষণ ধরে হাত মুখ ধুলো। মাথার চুলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। পকেটে চিরুনি ছিল, সেটা দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে নিলো। কাজগুলো সে দ্রুতই সারল। বাথরুমের কাজ মোটামুটিসাত মিনিটে সেরে ফেলল। লাইটটা বন্ধ করে বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময়ে মনে হল আয়নায় তো নিজের মুখ একবারও দেখা হয় নি। ভাবা মাত্রই সে দুটো কাজ একসাথে করলো। কাজ দুটো হলঃ লাইটটা অফ করা ও আয়নার দিকে তাকানো। লাইটটা নিভে যাওয়ার মুহূর্তে মনে হল আয়নায় সে নিজের মুখ না দেখে একটা কিশোরী মেয়ের মুখ দেখলো। কি সুন্দর মিষ্টি চেহারা। মনে হচ্ছে রাজনের পরিচিত। নিজের অজান্তেই লাইট আবার জ্বালালো। না চোখের ভুল। আয়নায় নিজের মুখ দেখা যাচ্ছে। আবার লাইট বন্ধ করে বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল। কিন্তু নিজের থেকেই আয়নার দিকে চোখ চলে গেল। অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত। আয়নায় সেই মেয়েটাকে আবার দেখলো। এইবার চেহারার অবস্থা একেবারে অন্য রকম। মুখটা রক্তাক্ত। চেহারাটাও কিছুটা বিকৃত।

রাজন দৌড় দিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো। ভয় এসে ভড় করল। একটু পরেই হাসি লাগল। তার মস্তিষ্ক মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই বাথরুমে যেয়ে উল্টা পাল্টা দেখে এসেছে। এইবার ধীরে ধীরে চিপস, ঠাণ্ডা পানি খেল। মাথার থেকে বাথরুমের আয়নায় কি দেখেছে সেটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। বাইরের দিকে চোখ দিলো। একেবারে অন্ধকার। জানালা দিয়ে কবরস্থানের দিকে তাকাল। কোন মানুষের ছায়া পর্যন্ত দেখা গেল না। পুরো জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। যারা কবরে ফুল দিতে আসে, তারা সাধারাণত অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরে যায়। মৃত প্রিয় মানুষ মাটির নিচে অন্ধকারে শুয়ে থাকবে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু জীবিত মানুষ অন্ধকারে কখনো স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না।

চারিদিকে একেবারে নীরব। ফিউনারেল হোমটা বেশ ভিতরের দিকে। রাস্তা দিয়ে কোন গাড়ি গেলে জীবিত মানুষ পাশ দিয়ে চলে গেল বলে মনে হত। রাজনের মাথায় এলো সে যেন একটা দ্বীপ। দ্বীপের চারিদিকে পানি থাকে, আর তার চারিদিকে সব মৃত মানুষ আর মৃত মানুষ। আয়নায় যে সে মেয়ের মুখ দেখলো, সে কি মৃতদের কেউ? তাকে দেখা দিয়েছে। হয়ত কিছু বলতে চায়। ঘড়ির দিকে তাকাল। টম আসতে মেলা দেরী করছে। বুঝতে পারল না, এখন কি করতে পারে। তার কাছে টমের ফোন নম্বর নাই। ম্যানেজারকে ফোন করতে মন সায় দিল না। কিসে আবার কি মনে করে বসে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। বুকটা ধড় ধড় করে কেঁপে উঠলো। ফোন তো আসতেই পারে। আসলে আশাতীত কিছু হলে মানুষ কম বেশী আৎকিয়ে উঠে।

টম ফোন করেছে। হাসপাতালে ঝামেলা হচ্ছে। আরও কয়েকটা লাশ রিলিস হচ্ছে। তার সিরিয়াল আসতে আসতে আরও ঘণ্টা খানেক লেগে যেতে পারে। রাজনের উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিল। এইদিকে রাজন বুঝতে পারছে না এখন সে কি করবে। এর মধ্যে আবার বাথরুমের যাবার দরকার হয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ চাপ সহ্য করল। নিজের উপর খুব বিরক্তি লাগা আরম্ভ করল। অনেকটা বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক করে ফেলল, এইবার বাথরুমে লাইট অফ করবে না। লাইট জ্বালিয়ে রাখবে। সকালে যে আসবে সে লাইট বন্ধ করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আয়নার দিকে না তাকিয়ে লাইট অন করল।

এইবার রাজন ধীরে সুস্থে বাথরুমের কাজ সারল। টমের ডেড বডি নিয়ে আসতে দেরী আছে। তা ছাড়া মনটাকে শক্ত করতে হবে। আয়না সে যা দেখেছে, সেটা মনের ভুল। আয়নার অন্য কারোর প্রতিচ্ছবি আসা কোনভাবেই সম্ভব না। আসলে ব্যাপার এমন হতে পারে, সে একটা মেয়ের লাশ আসার অপেক্ষায় আছে, সেই জন্য সুন্দরী একটা মেয়ের মুখ আয়নায় দেখেছে। কিন্তু একবার শান্ত, সুন্দর এবং আরেকবার রক্তাক্ত চেহারা দেখল, তার কি ব্যাখ্যা হতে পারে। মেয়েটার সুন্দর চেহারা কি কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেছে? এক্সিডেন্ট কিংবা কোন দুষ্ট লোকের আক্রমণে?? ম্যানেজার সাহেব এ রকমই মনে হয় বলেছিলেন। মেয়েটা মুখ পরিষ্কার ও স্বাভাবিক করতে হবে। সকাল আটটায় মেয়েটার এক চাচা আসবে। তিনি আবার হার্টের রুগী। তিনি ছোট মেয়েটার বিকৃত চেহারা সহ্য করতে পারবেন না।

রাজন অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছে। সেটা কোনভাবেই পারছে না। ঘুরে ফিরে মেয়েটার দুই চেহারা মনে হচ্ছে নাকের উপরে ভাসছে। একেবারে অস্থির লাগা আরম্ভ করল। এইভাবে চললে চাকরি করাটাই সম্ভব হবে না। মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে। মানুষে পাগল অথবা উন্মাদ বলে ডাকতে পারে। কি হবে সেইটা নিয়ে চিন্তা না করে, বর্তমানে ফিরে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। না সুবিধা করতে পারল না। ছোট বেলায় ভয় পেলে মা সাথে সাথেই বলতেন, “ভয়, বনে না মনে? ” আবার মেয়েটার চেহারা আয়নায় দেখা গেল। রাজনের চেহারা ফ্যাকাসে হওয়া আরম্ভ হল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, হার্ট বিট বেড়ে প্রচণ্ড বেড়ে ধুপ ধুপ করে শব্দ করতে লাগলো। মাথাটাও কেমন হালকা হয়ে গেল। তার মানে তার ব্লাড প্রেশার ভীষণ ধরণের কমে গেছে। যে কোন মুহূর্তে সে মেঝেতে পড়ে যেতে পারে। একবার ভাবল পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে ৯১১ এ কল করে। সাথে সাথে পুলিশ ও এম্বুলেন্স চলে আসে। অনেক কষ্টে পকেটে হাত দিল। ফোন সেখানে নাই। সেলফোনটা ডেস্কের উপর থেকে নিয়ে পকেটে ঢুকানো হয় নি।

প্ল্যান ছিল বাথরুমে লাইট সে অফ করবে না এবং আয়নার দিকে ভুল করে হলেও তাকাবে না। চোখটা নিজের অজান্তেই আয়নার দিকে চলে গিয়েছিল। সেই সুন্দর মেয়েটা আবার আয়নায়! লাইট জ্বলছে এবং মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। এইবার রাজনের কিছুটা সাহস এলো। মেয়েটাকে কেন পরিচিত মনে হয়েছিল, সেটা বুঝার চেষ্টা করল। আরে এই ছোট মেয়েটার মধ্যে কেমন একটা বাঙালি বাঙালি ভাব আছে। এইটা মনেরই ভুল। বাঙালিদের মধ্যে সংখ্যায় বেশী মুসলমান ও হিন্দু। তারা এই ধরণের দামী ফিউনারেল হোম ব্যবহার করে না। সৎকার খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেরে ফেলে। কিন্তু একটা ব্যতিক্রম হলেও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে বাঙালি খৃস্টানের মেয়ে।

রাজনের জন্য আরও বড় ধরণের বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। মেয়েটা কথা ধরল। তখন মেয়েটার কেমন এক লাস্যময়ী চেহারা। বিদেশে বেড়ে বাঙালি বাচ্চাদের মত কথা আরম্ভ করল, “আঙ্কেল আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে হবে...।” রাজন বুঝলো না তার এখন কি করা উচিত। দৌড়ে পালাতে পারলে সব চেয়ে ভাল হত। শরীর, হাত, পা সব দশ মণ ওজনের হয়ে আছে। তবে সাহায্য আসলো অন্য জায়গা থেকে। ডেস্কের ফোনটা বিকট শব্দে বাজতে লাগল। সাথে সাথে আয়না থেকে মেয়েটা গায়েব। রাজন নিজের বল ফিরে পেল। সে ছুট দিল ফোনটা ধরার জন্যে। ওই দিক থেকে টম বিরক্ত হয়ে বলছে, “তোমাকে বললাম না দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে। আর তোমার কোন খবর নাই।” রাজনকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টম ফোনটা রেখে দিল। এবার রাজন ছুটলো ডেড বডি রিসিভ করার জন্যে।

দরজা খুলে দেখে টম একটা ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনকে দেখে গজ গজ করা আরম্ভ করল, “আজকে আমার বিবাহ বার্ষিকী। আর আমি কি-না রাত এগারোটা পর্যন্ত লাশ নিয়ে পড়ে আছি। বউ আজকেই ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এই ম্যানেজারের সাথে আমি আর চাকরি করবো না। মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে না। আমি এই চাকরির নিকুচি করি।” টম রাজনের হাতে একটা প্যাকের ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এর ভিতরের মেয়েটার ফাইল, ছবি ও পোশাক আছে।” টম আর অপেক্ষা করল না।

রাজন ট্রলি ঠেলে ক্লিনিং রুমে নিয়ে গেল। পুরো শরীর ঢাকা। চেহারা তখনও দেখা হয় নি। মাথার উপরে ক্যামেরা-ভিডিও চলছে। মৃত দেহ পরিষ্কার করার সব নিয়ম কানুন মানা হচ্ছে কি-না, সেটা কঠিনভাবে পরীক্ষা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোন হের ফের হলে জেল জরিমানা হয়ে যায়। রাজন মেয়েটার শরীরকে পানি ও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করার জন্যে প্রস্তুত করলো। প্রথমে মাথার দিক থেকে কাপড় সরাল। মেয়েটাকে বেশ পরিচিত বলে মনে হওয়া আরম্ভ হল। আরেকটু কাপড় সরিয়ে পুরো মুখটা দেখল। ম্যানেজারের বর্ণনা পুরোটা মিলল না। মুখটা রক্তাক্ত হয়েছিল বুঝা যায়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে পরিষ্কার করে দিয়েছে। তার পরেও বুঝা যাচ্ছে, কোন কোন জায়গা থেকে রক্ত বের হয়েছিল।

কিছুক্ষণ আগে আয়না এক কিশোরী মেয়েটার যে চেহারা দেখেছিল, তার সাথে বেশ মিলে গেল। ওই মেয়েটার মুখের যে সব জায়গা থেকে রক্ত পড়ছিল, সেই সব স্পট একই। রাজন প্যাকেট থেকে ফাইল বের করল। সেখানে প্রয়োজনীয় ইন্সট্র্যাকশান দেয়া থাকে। ফাইলে মেয়েটার কয়েকটা ছবি পেল। তার মধ্যে রক্তাক্ত মুখের ছবিও আছে। সম্ভবত হাসপাতালে ভর্তির সময়ে নেয়া হয়েছিল। আরেকটা তার জীবিত অবস্থার ছবি। দুটো ছবিই আয়নার দু অবস্থার প্রতিচ্ছবির সাথে একেবারে মিলে গেল। মেয়েটা জানতো, তার শরীরকে এই ফিউনারেল হোমে আনা হবে। সে জন্যে রাজনকে কিছু বলতে চাচ্ছিল।

রাজন খুব যত্ন ও মনোযোগ দিয়ে এক এক করে ডেড বডি নিয়ে যা যা করার কথা ছিল, তার সবই করলো। কিছুক্ষণ আগেও যার হাত, বুক কাঁপছিল, সে এখন এক মনে শক্ত হাতে কাজ করে ফেলল। শেষে বডিটাকে একটা নতুন ট্রলিতে শুইয়ে হিম ঘরে দিয়ে আসল। সকালে মেয়েটার চাচা এসে ঠিক করবে কেমন কফিন, কাস্কেট ও অন্যান্য ব্যবস্থা কী কী হবে। হিম ঘর থেকে বের হয়ে রাজন দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। রাতের দেড়টা বাজে। আবার মনে হল পুরো অঞ্চলে সেই একমাত্র জীবিত। বাকী সবাই মৃত। কিন্তু এক ফোটাও ভয় কাজ করল না। বাথরুম ব্যবহারের দরকার ছিল না। তার পরেও বাথরুমে গেল। মেয়েটার কথা শুনতে হবে।

বাথরুমে যেয়ে লাইট বন্ধ করে দিল। লাইট জ্বললেও কোন অসুবিধা হত না। রাজন জানে মেয়েটার আত্মা এখানেই আছে। আয়নার দিকে তাকাতেই মেয়েটাকে দেখতে পেল। মেয়েটা মিষ্টি করে বলল, “আমার শরীরটাকে এত যত্ন করে রেডি করার জন্যে মেনি থ্যাংকস।” রাজন মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। মেয়েটা বলতে লাগল, “আপনি তো ফাইল দেখে জানেন আমার নাম সামান্থা। আমার বাবা আপনার মত বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। তবে খৃস্টান ছিলেন। আমার মা ‘কে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে। কিন্তু আমার মা জন্মের পরে ক্যান্সারে মারা জান। আমার বয়স তখন সবে পাঁচ।”একটু দম নিয়ে সামান্থা বলে চলল, “আপনার আমাকে পরিচিত বলে মনে হওয়ার কারণ হল আমার মধ্যেও যে আপনার মত বাঙালি রক্ত।” রাজন এই বার বুঝল মেয়েটা তাকে কেন আঙ্কেল বলে সম্বোধন করছে।

রাজন স্বাভাবিক স্বরেই বলল, “শুনলাম তো তোমার গল্প। এখানকার প্রতিটা মৃত মানুষের কোন না কোন গল্প আছে।” সামান্থা কেমন একটা মায়াবী কণ্ঠে বলতে লাগল, “প্লিস অস্থির হবেন না। আমি খুব অল্প সময়ে আমার কথা শেষ করব। আমার মায়ের কবর এই কবরস্থানে।” রাজন এই বয়সের কোন মেয়েকে এত গুছিয়ে কথা বলতে শুনে নি।

রিকি গোমেজ বরিশালের বাঙালি ছেলে। সেখানেই জন্ম, সেখানেই বেড়ে উঠা। মিশনারি স্কুল, কলেজে লেখা পড়া শেষ করে এমেরিকার ভিসা পেতে কোন সমস্যা হয় নি। কলেজের প্রিন্সিপাল ফাদার এরিক একটা চিঠি দিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে ভালই কাজ হয়েছিল। সে সময়ে এমেরিকার ভিসা পাওয়াটা সোনার হরিণ পাওয়ার মত একটা ব্যাপার ছিল। বেশ কিছু ধার দেনা করে রিকি চলে এলো এমেরিকায়। কিন্তু বাস্তবটা যেমন কল্পনা করেছিল, তারে ধারে কাছেও হল না। সব কিছুর জন্যে পয়সার প্রয়োজন। মাস শেষে বিল দিতে না পারলে, কোন ক্ষমা নাই। জরিমানা জুড়ে দিবে। তার পরেও দিতে না পারলে, এপার্টমেন্ট থেকে বের করে দিবে, ইলেকট্রিক-পানির লাইন কেটে দিবে।

রিকি বুঝলো আয় না করে উপায় নাই। এখানে বাবা-মা’র হোটেলে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা নাই। তার পরে ঋণের বোঝা। ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখার জন্যেও মেলা খরচ। আরম্ভ করলো রিকির কঠিন জীবন সংগ্রাম। বড় একটা গ্রোসারি দোকানে রাত আটটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত ষ্টকিঙের চাকরি নিল। ভারী মালামাল নিয়ে এসে শেল্ফে তুলে রাখতে হয়। ভেবেছিল সহজ কাজ। কাজের শেষে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ক্লাসে ছুটতে পারবে। দু দিন কাজ করেই হাত পা ফুলে ইয়া বড় হয়ে গেল। সাথে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। তার পরেও দাঁতে দাঁত চেপে কাজ চালিয়ে যেতে লাগল।

কাজের জায়গাতেই পরিচয় হল এমা নামের এক মেয়ের সাথে। ব্রেকে টুকটাক কথা হল। সে এসেছে মেক্সিকো থেকে। রিকির মতই ইউনিভার্সিটি যায়। দেখতে বেশ ফর্সা। বেশ মজার মেয়ে। কিছুক্ষণ পর পর তার হাসা চাই। প্রথমদিকে হাসির শব্দে রিকির বিরক্ত লাগতো। ব্রেকে টাইমে রিকি একবার চুপ করে বসেছিল। পকেটে টাকা ছিল না যে কিছু কিনে খাবে। এমা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। সে নিজের খাবার রিকির সাথে শেয়ার করলো। রিকি অবশ্য আপত্তি করেছিলো। কিন্তু এমা গ্রাহ্য করে নি। খাবার ছিল রুটি, চিকেন ও সালাদ। এমা শেখাল স্প্যানিশ ভাষায় রুটিকে টরটিয়া বলে। টরটিয়ার ভিতরে চিকেন, সালাদ দিয়ে পেঁচিয়ে খেতে হয়। রিকির ভালই লাগল মেক্সিকান খাবার।

শুধু খাবার না, একে একে তারা অনেক কিছুই শেয়ার করা আরম্ভ করল। ছোট এক রুমের এপার্টমেন্ট নিয়ে একসাথে থাকা আরম্ভ করল। এতে দু জনের খরচ কমে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে বিছানাও শেয়ার হয়ে গেল। এমার বুদ্ধিতে রিকি কাজ কমিয়ে ক্লাস বাড়িয়ে দিল। অন্যদিকে এমা পড়ালেখা স্থগিত রেখে নিজে আরেকটা চাকরি নিল। রিকিকে বলল, “আমরা একজন একজন করে পড়ালেখা করব। তুমি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলে, আমি স্কুলে ফিরে যাব।” রিকির লজ্জাই লাগতো, যেই মেয়েকে সে কয়েকদিন আগেও চিনতো না, সে এখন তার জন্যে কি কষ্টটাই না করছে! রিকি কিছু বলতে চাইলো এমা বলতো, “আমি আমার ভালোবাসার জন্যে সব করতে পারি। দেখো একদিন আমাদের ভাল দিন আসবে। তখন আমাদের কষ্ট করতে হবে না। আমরা বিয়ে করবো, আমাদের সংসার হবে।”

দুই দেশ থেকে আসা দুই মানব-মানবীর মধ্যে টুইটুম্বুর প্রেম হল। রিকি পড়ালেখা শেষ করে পিএম মোটরে চাকরি পেল। কাজ শিখল বেশ দ্রুত গতিতে। সাত বছরের মাথায় সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে গেল। প্রচুর আয় রোজগার। অন্যদিকে এমা স্কুলের টিচার হল। দুই জনের সুখের কোন অন্ত থাকল না। পারলে সারাক্ষণ একসাথে থাকে। ওরা ঠিক করল, গত দশ বছর একসাথে থেকে যেই কাজটা করে নি, সেই কাজটা এবার তারা করবে। তারা ভালোবাসাকে চিরস্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য বাচ্চা নিবে। দু জনের একসাথে থাকার এগারো বছর পরে সামান্থা জন্ম নিল।

অস্থায়ী পৃথিবীতে সব কিছুর একটা যবনিকা আছে। এমা সেটা মানতে রাজী ছিল না। মারা যাবার আগে রিকিকে বলে গিয়েছিল, “তোমার মৃত্যুর পর, আমার যেখানে কবর হবে, সেখানে যাতে তোমারও কবর হয়। এর যেন কোন ব্যতিক্রম না হয়। পরকালেও তোমাকে আমি কাছাকাছি চাই।” রিকি কথা দিয়েছিল সে রকমটাই হবে। যার কাছে এত ঋণ, তার এই সামান্য আবদার তো মানতেই হবে।

আয়নার ভিতর থেকে সামান্থা আবার কথা আরম্ভ করল, “বাবা উইল করে কথাটা জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো, বাবা ও আমার মৃত্যু এই ভাবে হবে। গত সোমবারে একটা এইটিন উইলার ট্রাক এসে আমাদের গাড়িকে সামনের দিক থেকে ধাক্কা দিল। হাসপাতালে নেয়ার পরে আমাদের দু জনকেই লাইফ সাপোর্টে নেয়া হল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা দু জনেই ব্রেন ডেড হয়ে যাই।” এতগুলো কথা বলে সামান্থা একটু থামলো, “আমাদের শরীর থেকে আমাদের আত্মা বের হয়ে আসে। তারপরেও আমরা বাবা-মেয়ে কথা বলতে পারছি। বাবার ধারনা, তার ছোট ভাই, মানে আমার ছোট চাচু, তার মৃত্যুর খবর পেয়ে মিনাসোটা থেকে এসে লাশ দেশে পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু বাবা এখানে সানরাইজ ফিউনারেল হোমে মায়ের কাছাকাছি থাকতে চান।”

রাজন বুঝতে পারছিল না তার এখন কি বলা উচিত। সামান্থা আবার বলা আরম্ভ করলো, “তোমার একটা বিশেষ ও বিরল গুণ আছে, যেটা তোমার ম্যানেজার ধরতে পেরেছে। তোমার মৃত মানুষের সাথে কমিউনিকেট করার ক্ষমতা আছে। এইজন্যই তিনি তোমাকে এখানে চাকরি দিয়েছেন। আরেকটা কথা সব মৃত মানুষ কিন্তু কমিউনিকেট করতে পারে না। শুধু অল্প কিছু মানুষ পারে। তাদের মধ্যে আমি একজন।”

রাজন জানতে চাইল, “বুঝলাম, কিন্তু আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি?” সামান্থা উত্তরে বলল, “কাল সকালে আমার চাচু আসবে। তাকে বাবার এটর্নি খবর দিয়েছে। বিকালে বাবার ডেড বডিও চলে আসবে। তুমি তোমার ম্যানেজারকে আমার কথাগুলো বলবে। তিনি চাচুর সাথে কথা বলবেন। বাবাকে আর আমাকে যাতে এখানেই রাখে। আমরা পুরো পরিবার সানরাইজ ফিউনারেল হোমের কবরস্থানে থাকব। আমাদের পরিবারের নতুন সান রাইস মানে সূর্যোদয় এখানেই হবে।

সামান্থাকে দেখতে কেমন জানি ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। গলার আওয়াজ অস্পষ্ট হতে আরম্ভ করেছে, “জানো মৃতদের একটা ব্যাপার মজার। তাদের কাছে কোন অতীত, ভবিষ্যৎ নাই। সব কিছুই বর্তমান। একটা সরলরেখার এই দিক এবং ওই দিক। কিন্তু পুরো সরলরেখাটা মৃতরা একবারে একসাথে দেখতে পায়। সেই কারণে আমি জানি সকালে চাচু আসবে; বাবার বডি আসবে বিকালে।”

অক্টোবর ৩১, ২০১৬

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখকঃ quazih@yahoo.com