আনন্দ পঠন

এক শহরের খুব সজ্জন এক ব্যক্তি ছিলেন। তার ছিল সবার সাথে আপন মানুষের মত ব্যবহার; মুখে চিরস্থায়ীভাবে মিষ্টি হাসি লেগে থাকতো। তার পরে আবার ছিলেন বিনয়ের অবতার। জ্ঞানের কথা বলার দিক থেকে তার কোন জুড়ি ছিল না। কোন অজানা ব্যাপার জানতে হলে সবাই এই সজ্জনের কাছে ছুটে আসতো।

ভদ্রলোকের ছিল বিশাল বইয়ের সংগ্রহ। তার পরেও সুযোগ পেলেই মানুষের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে আসতেন। ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করে আসলেও, বই তার বিশাল সংগ্রহে হারিয়ে যেত। ফেরত কোনভাবেই দিতেন না। অন্যদিকে কাউকে তিনি একেবারেই তার সংগ্রহের কাছাকাছি পর্যন্ত যেতে দিতেন না। একবার প্রতিবেশীরা তাকে চেপে ধরলো, তার এ রকম রহস্যময় আচরণের কি কারণ ।

তিনি মুখ বাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, নিজের ধন-রত্ন অন্যের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত, এমন মানুষেরা যাতে হাত তোলে। উপস্থিত জনগণ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো, কিন্তু কেউ হাত তুললো না। শেষে তিনিই বলা আরম্ভ করলেন, ‘মিয়ারা যে জানে না তার কাছে কত বড় ধন-রত্ন আছে, তার কাছে ঐ রত্ন থাকার কোন প্রয়োজনীয়তা নাই। শেষে অনেকটা ফতোয়া দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এইজন্য বই ধার নিয়ে ফেরত না দিলে কোন অপরাধ হতে পারে না’।

ইসলাম ধর্মে বলা হচ্ছে, মহানবী (দঃ)কে আল্লাহ সুবান আ তা’ আলা প্রথম যেই ওহী বা বাণী পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল “পড়”। ঘটনাটা আরেকটু বিস্তারিত বলি। তালা হেরা পর্বতের গুহায় নবী করিম (দঃ) কে মহান আল্লাহ তা আলার দূত জিবরাইল (আঃ) বললেন, ‘পড়ুন’ । আমাদের রাসুল (দঃ) হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। তিনি কিভাবে পড়বেন, তিনি তো নিরক্ষর। জিবরাইল (আঃ) কথাটা তিনবার পুনরাবৃত্তি করে বললেন, “পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে পড়ুন, যিনি আপনাকে এক দলা রক্ত থেকে বানিয়েছেন। পড়ুন, আপনার প্রভুর জন্যে, যিনি সব চেয়ে বেশী উদার, যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দেন, মানুষ যা জানে না, তাকে তাই শিক্ষা দেন” ( সুরা আল-আলাকঃ ১-৫)।

বই পড়লে কি হয়? মানুষ জানতে পারে, তার জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। ইসলাম ধর্মে বলা হচ্ছে, জ্ঞান আহরণের জন্যে প্রয়োজনে চীন পর্যন্ত যাও। এই কথাটার মধ্যে একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। এক, নিজেকে সমাজের প্রচলিত জ্ঞান নিতে হবে। দুই, জ্ঞান বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনে দূরদেশ তথা চীনে পর্যন্ত কষ্টকর ভ্রমণ করতে হবে। তিন, চীনাদের ভাষা শুধু ভিন্ন না, তাদের ধর্ম বিশ্বাসও সম্পূর্ণ অন্য। প্রয়োজনে তাদের ভাষা শিখে, বিধর্মীদের কাছ থেকেও জ্ঞানের তালিম নিতে হবে।

আজকে জ্ঞান আহরণ না, বই পড়া নিয়ে কিছু কথা বলবো। বাংলা সাহিত্যে খুব সম্ভবত প্রমথ চৌধুরী সব চেয়ে বেশী সোচ্চার ছিলেন বই পড়ার উপকারিতা প্রচারে। কিন্তু তাতে কয়টা বাঙালি উদ্ধুদ্ধ হয়েছে, সে ব্যাপারে মন্তব্য করাটা বেশ বিপদজনক। তবে তিনি কিছুটা সম্ভবত হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘বই কিনে কেউ কোনদিন ঠকে না’।

একবার এক শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সর্বশেষ কোন বই পড়েছো?’ ছাত্র সাথে সাথে উত্তর দিলো, ‘কেন জর্জ ওয়াশিংটনের লেখা বই। শিক্ষক মহোদয় বললেন, ‘আমার জানামতে জর্জ ওয়াশিংটন বড় নেতা ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি কোন বই লিখে যান নি’। কথাটা শুনেই ছাত্র নিচু গলায় উত্তর দিলো, ‘তিনিও লিখেন নি, আমারও সে জন্যে পড়া হয় নি’। বলুন তো, এটা বই না পড়ার কেমন উদ্ভট যুক্তি হতে পারে!

এই বার শিক্ষক মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি জীবনে কয়টা বই পড়েছো?’ ছাত্র এই বার মিন মিন করে উত্তর দিলো,'সে জন্যে, আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে’। শিক্ষক তো এইবার রীতিমত রেগে উঠলেন, ‘এইটা কেমন ফাইজালামো? কয়টা বই পড়েছো সেটা জানতে মৃত্যু পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হবে?’ এইবার ছাত্র বেশ আস্থা সহকারে জানালো, ‘আমার যখন জীবন শেষ হবে, তখন-ই শুধু জীবনে কয়টা বই পড়েছি, তার হিসাব করা সম্ভব, কারণ আমার জীবন এখনও চলছে’। বুঝলেন তো সবাই, এই ছাত্র শুধু নামেই ছাত্র। সে বই ভালোবাসে না, শুধু অযৌক্তিক কারণ দেখায়। কেউ কি কখনও বই না পড়ে শিক্ষিত বা জ্ঞানী হতে পেরেছে?

এক জন বিজ্ঞ মানুষ বলেছিলেন, ‘ব্যায়াম যেমন শরীরের উপকার করে, বই পড়লে তেমন মনটা সুস্থ থাকে। অনেকে বলতে পারেন, সে জন্য সিনেমা হলে যেয়ে সিনেমা দেখে আসলেই হয়। কিংবা টিভিতে এখন কত কিছুই না দেখায়। আবার দল বেঁধে, আড্ডা দিতে দিতে কাজগুলো করা যায়। আর বই পড়া কেমন একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। একা একা বইয়ের দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয়’।

সিনেমা কিংবা টিভি শো দেখলে, মনের ব্যায়াম হয়, ঠিকই। তবে বলা যেতে পারে আংশিক, কারণ দৃশ্য ও ঘটনা তৈরি করাই থাকে। কিন্তু গল্প, কিংবা উপন্যাসে পাঠককেই দৃশ্য নির্মাণ করতে হয়। এতে বাড়তি যে কাজটা হয়, সেটা হল আরও বেশী পরিমাণ মস্তিষ্কের সেলগুলো একের সাথে অন্য যুক্ত হয়ে দৃশ্য নির্মাণের কাজ করে । মস্তিষ্ক আরও বেশী কার্যকরী হয়। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে, আলজাইমার, ডিমনেসিয়ার মত মারাত্মক মানসিক রোগ রোধ করতে, কিংবা তীব্রতা কমাতে বই পড়া খুব-ই কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

এইটা কেউ কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে, এই পৃথিবীর বুকে মানব জাতি জ্ঞানে, বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে প্রতিনিয়তই এগিয়ে চলেছে। এক সময়কার গুহামানব আজ মহাশুন্যে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই সংবাদ, তথ্য ও তত্ত্ব হাজার হাজার মাইল দূরে পৌঁছে যাচ্ছে। সেই গুহামানব প্রস্থর যুগ থেকে এতো উন্নতি করলো কি করে? মানুষ এগিয়েছে ধীরে ধীরে। সে বইয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছে তার লব্ধ জ্ঞান। এইভাবে প্রতিটা প্রজন্ম আগের প্রজন্মের জ্ঞান বাড়িয়ে পরের প্রজন্মের জন্যে বই রেখে গেছে। মানে বই আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে চলেছে। এইখানেই মানুষের সাথে মূল পার্থক্য। প্রতিটা পশু ও পাখিকে প্রথম থেকে কার্যক্রম শিখতে হয়। তারা লিপিবদ্ধ করতে জানে না। তাদের আগের প্রজন্ম থেকে শেখার কোন সুযোগ নাই। পশু- পাখির কত প্রজাতিই না পৃথিবীর বুক থেকে বিলিন হয়ে গেছে।

বই পড়লে আর কি কি উপকার হতে পারে, জানতে চান? এতে মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ে। এর ফলাফল আরেক জায়গাতেও যেয়ে পৌঁছায়। এখনকার দিনের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ হতাশাগ্রস্ত। আমরা সবাই চাই, তারা এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক। বই পড়ার অভ্যাস করলে তারা ধীরে ধীরে জীবন সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠতে পারেন। তারা তার পরে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধরণের গঠনমূলক কাজ করতে পারবেন। সাথে সাথে পেতে পারেন অনাবিল মানসিক প্রশান্তি। জীবনকে মনে হবে আরও অনেকবেশী আনন্দময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ।

দেখলেন তো, জ্ঞান আহরণ ছাড়াও বই পঠনে আরও কত ধরণের উপকার হতে পারে। অনেকে অভিযোগ করেন, মনের মত বই খুঁজে পান না। আরেকটা ভাষা জানা থাকলে, ভিন দেশের গল্পের বই পড়া যায়। তা ছাড়া, ইদানীং কালে প্রচুর বিদেশী নামজাদা লেখকদের বই অনুবাদ হচ্ছে।

এখন তো বই পড়া খুব সহজ। অনলাইনে বেশ কিছু মানুষ বই পড়েন। বিদেশে এটা খুবই সাধারণ দৃশ্য ট্রেন, প্লেন, বাসের যাত্রীরা ট্যাবলেট কিংবা পুস্তক খুলে পড়ছেন। এক সময় ধারণা করা হচ্ছিল, অনলাইনের দাপটে ছাপানো বই হয়তো একদিন উঠেই যাবে। কিন্তু ছাপানো বইয়ের কদর কমে নি। ব্যাপক সংখ্যক পাঠক হাতে বই নিয়ে ছাপানো বই পড়তে ভালোবাসেন। বিশ্বব্যাপী অনলাইন বই আর ছাপানো বই, দুই-ই সমতালে এগিয়ে চলেছে।

এবার একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। কিছু মানুষ মন্তব্য করেন, আর তো আরেক জন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কিংবা হুমায়ুন আহমেদ তৈরি হবে না। এখানে বলি, বই (কিছু আসমানি পুস্তক ছাড়া) কিন্তু আপনার-আমার মত মানুষেরাই লিখেছে। প্রশ্ন করি,বড় মাপের লেখক তৈরির জন্যে আপনার কি কোন দায়িত্ব আছে?

আমার উত্তর অবশ্যই সবার দায়িত্ব আছে। আমরা অস্বাস্থ্যকর পোলাও-বিরানির খাবার জন্যে কিংবা অন্যান্য নিছক কারণে কতনা অর্থের অপচয় করি। তার থেকে কিছু বাঁচিয়ে; আমরা নিয়মিতভাবে বই কিনতে পারি। শুধু কিনলেই চলবে না, বইগুলো পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারি। এভাবে পূর্ণ উৎসাহ দিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি আরেকজন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা হুমায়ুন আহমেদ। ফলে সময়ের দাবী মিটবে। জাতি ও দেশ সঠিক দিক নির্দেশনা পাবে। বাঙালি যে অন্য কারোর থেকে কোন অংশে কম না, সেটা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে।

৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com