নারী তুমি কি?

“গুগল” কে চিনেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পৃথিবীর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর মনে হয়ে গুগলের ঠোটের আগায় প্রস্তুত থাকে। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তার উত্তর দেয়া আরম্ভ হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও এমন কিছু প্রশ্ন হতে পারে যার উত্তর কিন্তু গুগল মামা আপনাকে দিতে পারবে না। অবাক হচ্ছেন তো? কি এমন প্রশ্ন যার উত্তর গুগলের কাছে নাই? আর গুগল যদি সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে, তা হলে সেই প্রশ্নের উত্তর-ই বা কিভাবে পাওয়া সম্ভব? বলছি, সামান্য একটু ধৈর্য ধরুন।

সকালে তাড়াহুড়া করে বের হচ্ছেন; মোবাইল ফোনটা খুঁজে পাচ্ছেন না কিন্তু সেটা গেল কই? আজকে দুপুরে কি রান্না হবে কিংবা আপনার নীল জামাটা কেনো আলমারিতে নাই। শুক্রবারে কার বাসায় যেনো আপনাদের যাওয়ার কথা। এ রকম হাজারো খুঁটি নাটি প্রশ্ন আছে যেগুলো গুগলের সাধ্য নাই উত্তর দেওয়ার। এই সব প্রশ্নের উত্তর বাড়ির বিশেষ একজন মানুষের কাছে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ। এইবার বলুন সেই ব্যক্তিটা কে? একটু সমস্যায় ফেলে দিলাম? আমি না হয় এর জবাবটা দিয়ে দেই। গুগল মামা যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এমন মানুষটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলো বাড়ির গৃহকর্ত্রী। বিপুল গুণের অধিকারী মহিলাটি হলেন সংসারের মা কিংবা স্ত্রী। সাধারণভাবে বলতে গেলে তারা নারী।

রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র, সুনীল বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত প্রেমিকদের নাম। নারীর সৌন্দর্য ও গুণে মুগ্ধ হয়ে তারা সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য সব রচনা। কত না নাম দিয়েছেন ভালোবাসার নারীদের। কৃষ্ণকলি, নিরুপমা, মাধবী, নাটোরের বনলতা সেন, নীরা সহ অবিস্মরণীয় নামগুলো প্রেম, সৌন্দর্য ও মুগ্ধতার প্রতীক হয়ে আছে। তবে প্রেমিকা নিয়ে গদ গদ হয়ে হাজারো আবেগ প্রকাশ করলেও, অনেক বড় মাপের কবি, লেখক ও প্রেমিক নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে নারীকে পূর্ণভাবে বুঝার ক্ষমতা তাদের নাই। কেউ বলেছেন নারীর মন আকাশের মেঘের মতো: এই ঝকঝকে নীল আকাশ তো ওই গুরুগম্ভীর ধুসর রঙে আচ্ছন্ন। আরেকদল বলেছেন, নারী একেবারে প্রকৃতির মতো। এই শান্ত-সৌম্য ঝিরঝিরে বাতাস তো পরের মুহূর্তে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস। নারী শিশুর জন্ম দেয়, নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক চাপ নিয়ে বসবাস করে। সমাজের নানা জ্বালা-যন্ত্রণা তাদের নিত্য সাথী। প্রকৃতি তাদের শরীরে পুরুষদের মতো শক্তি দেয় নি। কিন্তু কষ্ট সহিষ্ণুতায় তারা অনেক এগিয়ে। নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনের তারা অনেক বেশী বাস্তববাদী।

একজন পুরুষের দুটো চোখ। তারা শুধু সামনের দিকে দেখতে পারে। অন্যদিকে নারীর দুটো চোখ হলেও, বলা হয়ে থাকে তারা চতুর্দিকে দেখতে পায়। তবে এই দেখাকে আক্ষরিক ভাবে ধরে না নিয়ে বলতে হবে তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় (instinct/intuition/sixth sense) ব্যবহারের অসাধারণ এক মাত্রা আছে। বিষয়টা না হয় আরেকটু বুঝার চেষ্টা করা যাক। ধরুন সন্তান মায়ের থেকে মেলা দূরে ভিন্ন কোন দেশে চাকুরি করে। মা কিছুদিন ধরে পুত্রকে নিয়ে খুব অস্থির হয়ে আছেন। কয়েকদিন পর খবর এলো যে তার প্রাণ প্রিয় ছেলে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে আছে। প্রায়-ই দেখা যায় সন্তান কোন বিষয় গোপন করতে চেয়েছে, সেটা মা ঠিকই বুঝে ফেলছেন। আবার ধরুন পাড়ায় একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা হয়েছে। কিন্তু কেউ তার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করছে না। অনেকেই তখন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে কাজটা কে করতে পারে সেটা বের করার চেষ্টা করবে। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ক্ষমতা হলো মস্তিষ্ক যখন পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বাইরের জগতের ইঙ্গিত ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বিষয়টা অবচেতন মনে তড়িৎ গতিতে হয় বলে আমরা তার সঠিক প্রক্রিয়া ধরতে পারি না।

বিতর্ক থাকলেও ষষ্ট ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে নারীরা পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে। যদিও বিজ্ঞান বলে পুরুষদের মস্তিষ্কেরও সমান ক্ষমতা আছে। কিন্তু পুরুষদের একই পরিস্থিতিতে সফল সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিমাণ মহিলাদের তুলনায় বেশ কম। এর কারণ সম্ভবত বাইরের ইঙ্গিত পুরুষদের মস্তিষ্ক ঠিক ধরতে পারে না। কিংবা ধরতে পারলেও নারীদের মতো প্রক্রিয়া (process) করতে পারে না। তবে আমার মনে হয় এই সব জটিল বিশ্লেষণ না হয় আমরা আমাদের বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি। যার কাজ সে করলেই সব দিকেই উত্তম। কিন্তু প্রশ্ন হলো সব সময়ে কি তাই হয়? গত বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে দেখা গেল, ইউরোপের ছোট একটা দেশের বেশীর ভাগ নামী-দামী কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বিনিয়োগ করেছিল। এক পর্যায়ে তাদের বিনিয়োগ নাই মানে শূন্য হয়ে যায়। ফলে দেশের মানুষকে প্রচুর ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এর পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বড় ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোর শীর্ষ পদের দায়িত্ব শুধু মহিলারা পাবে। এর ফল কিন্তু শুভ হয়েছিল। দেশটা বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে অনেক উন্নতি পেয়েছিল। তবে পুরো কৃতিত্ব শুধুমাত্র নারীদের ষষ্ট ইন্দ্রিয় ব্যবহারের ক্ষমতাকে দিলে সম্ভবত ভুল হবে। স্বভাবগত ভাবেই নারীরা বেশী ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে না। পরিবারকে আগলে রেখে এগিয়ে নেয়াটাই এদের মূল লক্ষ্য। বাহবা পাওয়া কিংবা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার স্বপ্ন তারা দেখে না।

এইবার ইসলাম ধর্মের ইতিহাস থেকে একটা ঘটনা বলি। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (দঃ) নবওতি প্রাপ্তির পর এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন। ৬ হিজরিতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে তাঁকে ওমরাহ করতে যেতে হবে। সে সময়ে তিনি মদিনায় ছিলেন। তিনি সাহাবীদের ওমরাহ পালন করতে যাবার পরিকল্পনার কথা জানালেন। সবাই দল বেঁধে তীর্থ যাত্রায় রওয়ানা দিলেন। কিন্তু পরে মক্কার দ্বার প্রান্ত থেকে তাদের ফিরে আসতে হয়েছিল। মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে চুক্তি হলো। চুক্তি অনুযায়ী, সেই বার মুসলমানরা আর কাবা ঘরে যাবে না। কিন্তু পরের বছর পর থেকে তারা হজ্ব পালন করতে আসতে পারবে। এই চুক্তি ছিল মুসলমানদের জন্য বিশাল বিজয়। কারণ তাদের ক্রম বর্ধমান শক্তিকে কুরাইশরা মেনে নিয়ে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। রাসুল্লাহ (দঃ) চুক্তি হওয়ার পর সাহাবীদের জানালেন, এইবার আর তারা মক্কা শহরের ভিতরে যাবেন না। ফলে তাদের কারোরই কাবা ঘর পরিদর্শন করা হবে না।

হজরত মুহাম্মদ (দঃ) সাহাবীদের বললেন, মক্কার দ্বার প্রান্তেই পশু কোরবানি দিয়ে, চুল ছেঁটে, ওমরাহ’র পোশাক পরিবর্তন করে ফেলতে। কিন্তু সাহাবীরা অনেক আশা করে এসেছিলেন যে তারা কাবা ঘরের নিকটে যেতে পারবেন। প্রিয় নবী (দঃ) কথায় তারা এমন হতাশ হলেন যে তার আদেশ পালন করতে দ্বিধা করলেন। হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এমন পরিস্থিতির জন্যে একেবারে প্রস্তুত ছিলেন না। তার এখন কি করা উচিৎ সেটা মাথায় এলো না। তিনি আশা করছিলেন জিব্রাইল (আঃ) ফেরেশতা আল্লাহ তা আলা’র কাছ থেকে ওহী নিয়ে উপস্থিত হবেন। সেখান থেকে তিনি জেনে নিবেন তার করণীয়। কিন্তু আল্লাহ তা আলা’র কাছ থেকে কোনো ওহী এলো না। রাসুল্লাহ (দঃ) কিছুটা চিন্তিত হয়ে তাবুতে ফিরলেন। তার স্ত্রী সায়ীদাহ উম্মে সালমাহ (আঃ) সব শুনে বললেন, তিনি একাই যাতে পশু কোরবানি দিয়ে চুল কেটে পোশাক পরিবর্তন করে ফেলেন। তিনি স্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক কাজ করলেন। হজরত মুহাম্মদ (দঃ)’র দেখা দেখি অন্যরাও অনিচ্ছা স্বত্বেও তাকে অনুসরণ করলেন। একটা পরিস্থিতির সুন্দর পরিসমাপ্তি হলো।

সম্মানিত বন্ধুরা নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন, সাধারণ বান্দাদের কাছে যেহেতু ওহী আসে না, তাদের কাছে শুধুমাত্র অন্য উপায়টাই খোলা। সাথে সাথে সম্মানিত বান্ধবী ও বোনদের বলছি, পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা আপনাদেরকে জানা ও অজানা নানা ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনারা সচেষ্ট হলেই কিন্তু পরিবারের পুত্র, সন্তান, স্বামী কিংবা অন্য কারোর উ-শৃঙ্খল হবার সম্ভাবনা অনেক কমে আসে।

ডিসেম্বর ১২, ২০১৮

কাজী হাসান
লেখক: quazih@yahoo.com