আমার বাবার কথা

ফাদার’স ডে। বাংলা করলে হবে বাবা দিবস। ২০১৫ সালের বাবা দিবস (লেখাটা পুনরায় মুদ্রিত হচ্ছে) আর কয়েক দিন পরে। মাত্র দু মাস আগে মা হারিয়েছি। হয়তো সে কারণেই মনটা বিষণ্ণ থাকে। অনেকটা আনন্দ, উৎসাহ ছাড়াই ‘যাপিত জীবনের’ মতো সময় কেটে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও ফাদার’স ডে র কথা ভাবতেই কত শত স্মৃতি না এসে ভিড় করছে। বাবাকে নিয়ে, মাকে নিয়ে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাজারও ঘটনা এক এক করে মনে পড়ে যাচ্ছে। ।

বয়স তখন আমার পাঁচ-ছয় হবে। গাড়িতে করে রাজশাহী থেকে ঢাকা যাচ্ছি। ফেরি ঘাটে এসে গাড়ি দাঁড়াল। নিয়মঅনুযায়ী লাইনের প্রথম দিককার প্রাইভেট কার মানে ছোট গাড়িগুলো ফেরিতে উঠছিল। তার পরে অন্যান্য গাড়িগুলোর পালা। ফেরি ঘাটে বিভিন্ন ধরণের খাবারের দোকান। ক্ষুধার্তরা যে যার মত খাবার কিনে খাচ্ছিল। আমাদের গাড়ির সিরিয়াল আসতে বেশ কিছু সময় লাগবে বলে আমরাও একটা সুন্দর পরিষ্কার রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম।

অন্যরা কে কি অর্ডার দিয়েছিল, সেটা এখন মনে নাই। কিন্তু এতো দীর্ঘ দিন পরেও আমার নিজের অর্ডারটা স্পষ্ট মনে আছে। আমার খেতে ইচ্ছে হলো আমার সেই সময়কার প্রিয় খাদ্য ভাতের সাথে দুধ-আম। কিন্তু আমার আবদারে বড় ধরণের একটা সমস্যা দেখা দিলো। রেস্টুরেন্টে ভাত থাকলেও আম- দুধ ছিল না। আমাকে বলা হলো অন্য কিছু খেতে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। প্রথমে মিষ্টি করে বলা হলো তার পরে চোখ রাঙ্গিয়ে, শাসিয়ে বলল, বাছা তুমি অন্য কিছু খাও। সেই বয়সে যা হয় আমি আমার মোক্ষম অস্ত্রটা প্রয়োগ করলাম। প্রিয় খাদ্যের জন্যে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম। আমার দুধ-ভাত-আম চাই-ই চাই।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সেদিন ফেরি ঘাটে পাঁচ-ছয় বছরের এক শিশুর জয় হয়েছিল। সে বিজয়ীর হাসি হেসে তার প্রিয় খাদ্য ভক্ষণ করেছিল। অন্য সবাই তখন মহা-বিরক্ত হলেও, আমার এই বিশেষ খাদ্য আমার বাবাই সেখানে এনে জড়ো করেছিলেন। সে জন্যে সময় লেগেছিল, বাড়তি ভোগান্তি হয়েছিল বটে; কিন্তু তিনি সেটা করেছিলেন। একটা ছোট শিশুর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল। একটা শিশু স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল; সে জেনেছিল চাইলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।

বাবারা আসলে এই রকমই। তাদের আনন্দ সন্তানের সাধ পূরণেই। সে জন্যে ব্যয় কিংবা ত্যাগের হিসেব-নিকেশটা নিতান্তই গৌণ। বাবা হচ্ছে সন্তান-সংসারের শক্তি আর সাহসের প্রতীক। একেবারে কোনো অভিযোগ ছাড়াই তিনি সন্তান ও পরিবারের সবার জন্যে তাদের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাস-স্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করে চলেন। এর মধ্যেই আছে তার চরম পাওয়ার এক নীরব আনন্দ। সিগমণ্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, I cannot think of any need in childhood as strong as the need for a father's protection। এটা বলাই বাহুল্য, বাবা ছোট বেলায় সন্তানের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য যে কোনো কিছু করতেই সব সময়ই প্রস্তুত থাকেন।

এইটা একেবারে অনস্বীকার্য যে সন্তান লালন পালনের পেছনে মা সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন। অবশ্য তাদের সাথে সাথে ও পাশে থেকে সন্তানদের সব চেয়ে বড় অবদান রাখেন বাবা। তবে বাবা তার কাজ নেপথ্যেই পালন করেন। অনেকটা ছায়াছবির পরিচালকের মতো। দর্শক তাকে না দেখলেও, সিনেমা নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব তার ঘাড়ে। আমার বাবা তার কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। পরিবারের সবার সফলতা, আনন্দই যেন তার সার্থকতা। আমি নিজে বেশ কম বয়স থেকেই বাবাকে বুঝতে চেষ্টা করতাম। আমাদের ছিল বেশ বড় পরিবার আর আয় ছিল সীমিত। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়ে নিজে নিজে ঠিক করেছিলাম কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়বো না। অবশ্য আমরা সবাই জানি প্রাইভেট না পড়লে মেলা বিড়ম্বনার সম্মুখিন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাই হোক, বিষয়টা বাবা ঠিকই ধরতে পারলেন। তিনি আমাকে শাসনের সুরে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আমার কাজ হচ্ছে পড়া লেখা করা; যাতে আমি সংসারের অত্যাবশ্যক খরচ নিয়ে মাথা না ঘামাই। আমাদের যেটা প্রয়োজন, তা পূরণে তিনি কখনই বিন্দু মাত্র দ্বিধা করেন নি। বরং আমাদের প্রতিটা ব্যাপারে তার মহা-উৎসাহ দেখেছি।

আমার লেখালেখির জীবনে সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণাদানকারী হচ্ছেন আমার বাবা। আমার প্রতিটা লেখা তিনি ক্লান্তি-হীনভাবে মহা-আগ্রহ নিয়ে পড়েন। আমার বই হাতে পেলে শুধু নিজে পড়েই ক্ষান্ত হন না, পরিচিত সবাইকে পড়তে দেন। লাইব্রেরীতে দিয়ে আসেন, সেখান থেকে নিয়ে যাতে অন্যরাও পড়তে পারেন। সবার কাছে বুক ফুলিয়ে বলেন, তার ছেলে বই লিখে; সে একজন লেখক। কিন্তু আমি একেবারে পরিষ্কারভাবে জানি, লেখালেখির ক্ষমতা আমি তার থেকেই পেয়েছি। আমিও নিজে তার মতো অনুভূতিগুলিকে যতটুকু না মুখে বলে প্রকাশ করতে পারি; তার থেকে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ-বোধ করি লিখে ব্যক্ত করতে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, আমার সেই ছোট বেলা থেকে যে আমি লিখতে পারবো। সেই জন্যে আমাকে উৎসাহ দেয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো কার্পণ্য ছিল না। তবে আমার কাছে সব চেয়ে বড় গর্বের বিষয় হচ্ছে, লিখতে হলে নিজের মধ্যে যে আস্থা থাকতে হয়, সেটা তিনিই আমার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন। “My father gave me the greatest gift anyone could give another person: he believed in me.” —Jim Valvano। আমার জীবনের আমার সব চেয়ে বড় উপহারটা আমি তার থেকে পেয়েছি। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন আমি চাইলে যে কোনো বড় কাজই করতে পারবো।

আমার ভাতিজি অন্তু ঘোষণা করেছিল, দাদার মত কোন মানুষ না পেলে সে বিয়েই করবে না। আমার বাবার আমার মায়ের জন্যে ভালোবাসা একেবারে কিংবদন্তীর কাহিনীর সমতুল্য। প্রিয়তমাকে খুশী করার জন্যে যে কোন ধরণের কষ্ট করতে ছিল তার মহা আনন্দ। সেটা হউক না কেন বেশ রাতে ঘুমের প্রস্তুতির সময়ে, যখন পাড়ার দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তখন মায়ের জন্যে দূরে কোথাও থেকে পান, কোক (coke) কিংবা কোন ওষুধ কিনে আনা। এখানে বলে রাখি, আমার মায়ের মাঝে মাঝে রাতে খাওয়ার পরে পেটে অস্বস্তি হতো। তখন তার পান, কোক কিংবা কোনো ওষুধের দরকার হয়ে পড়তো। আমরা অধম সন্তানেরা মায়ের সেই অনুরোধ পালনে নিজের আরামের কথা বড় করে বিবেচনা করতাম। কিন্তু আমাদের বাবা ঠিকই বের হয়ে মায়েরা কষ্ট উপশমের জন্যে পান, কোক কিংবা ওষুধ কিনে আনতেন।

দিনের শেষে, মাকে তার সারা দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো বলা চাই। মাকে তিনি ডাকতেন ‘বেগম সাহেব’ আবার কখনো ‘ম্যাডাম’ বলে। বাসায় ঢুকে জানিয়ে দিতেন, ম্যাডাম আজকে একটা রগড় হয়েছে। তার পরে খেতে বসে বলতে থাকতেন সারাদিনের সব বৃত্তান্ত। একাত্তরের পাক হানাদারদের বন্দিখানা থেকে আমার মাকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন। সেগুলো আমার মা আর পুরো পরিবারের জন্যে তার প্রচণ্ড ভালোবাসা ও উৎকণ্ঠায় ঠাসা থাকতো। সেগুলো পড়লে এখনও চোখ ভিজে আসে। আমার মা ওই পারে চলে গেছেন, তার পরেও প্রিয়তমার জন্যে তার সেই ভালোবাসা এক বিন্দুও কমে নি। মায়ের প্রিয় ফুল ছিল হাসনাহেনা আর শিউলি। তিনি মায়ের কবরে উপর লাগিয়ে দিয়েছেন এই দুই ফুলের গাছ। মা বাড়ির ফার্নিচার যেভাবে রেখে গিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই তিনি রেখে দিয়েছেন। শোবার ঘরের দেয়ালে তিনি যোগ করেছেন তার জীবন সঙ্গিনীর বেশ অনেকগুলো প্রাণবন্ত ছবি। চলে যাওয়া মানুষটার সাথের স্মৃতি তিনি পরম যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন।

আমরা সাত ভাই। এখন তার পুত্র, পুত্র-বধূ, পৌত্র মিলিয়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিরিশ। তিনি এদের সবাইকে প্রচণ্ড ভাবে, একেবারে সমান তালে ভালোবাসেন। পরিবারের বাইরে মানুষদের বিপদে-আপদেও তিনি সবার আগে পাশে যেয়ে দাঁড়ান। অনেক মানুষ তার এই উদারতার সুযোগ নিয়ে তাকে ভুগিয়েছে। বাবা তার নিজের মা’কে হারিয়েছিলেন জন্মের কিছুদিন পরেই। অনেকটা আদর- ভালোবাসা-হীন জগতে তার বেড়ে উঠা। আমি প্রায়ই ভাবি, এ রকম এক জন মানুষের মধ্যে এত ভালোবাসা এলো কি করে!

পৃথিবীর অন্য সব সন্তানের মতো, আমি কোন ভাবেই বাবার কাছে আমার ঋণের এক বিন্দুও শোধ করতে পারব না। তবে ‘বিশ্ব বাবা দিবসে’ হয়তো তাকে একটা ক্ষুদ্র উপহার নিশ্চয়ই দিতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটাই বা কি হতে পারে? আজকের এই লেখাটাই না হয় সে রকম একটা উপহার হয়ে থাকুক। আমি জানি তিনি এই লেখাটা পড়বেন; এবং অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ভেবে আকুল হবেন।

When a father gives to his son, both laugh; when a son gives to his father, both cry.---- Jewish Proverb ছোট বেলায় কোন একটা খেলনা কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনের “কুয়াশা” সিরিজের সর্ব শেষ বই পেয়ে কত না খুশী হয়েছি। তখন শুধুমাত্র আমার খুশীর কারণে তার ভাল লাগার কোন সীমা-পরিসীমা থাকতো না। আমি জানি, আমার আজকে এই উপহার পেয়ে বাবা আমার মতই কাঁদবেন। অবশ্যই সেটা হবে নীরবে, নিঃশব্দে এবং সবার অগোচরে।

পৃথিবীর প্রতিটি বাবাকে আমার ফাদার’স ডের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আমার মতে তারা প্রত্যেকে বাবাই একেক জন unsung hero। আর সেই যে বললাম, চলচ্চিত্র পরিচালকের মত তারা নেপথ্যে থেকেই সব কিছুর আয়োজন করেন। তাদের যথাযোগ্য কৃতজ্ঞতা ও সম্মান কখনই দেওয়া হয় না। তারা অফুরন্ত ভালোবাসা শুধু দিয়েই যান। স্বীকৃতি কিংবা প্রতিদান কোনটাই কোন ভাবে তারা আশা করেন না।

জুন ৭, ২০১৫

কাজী হাসান

লেখক—quazih@yahoo.com