কুরুক্ষেত্র

মেয়েরা জীবনের দুটো সময়ে ছেলেদের বুঝতে পারে না। প্রথমে, বিয়ের আগে। শেষে, বিয়ের পরে। আর ছেলেরা? তাদের কথায় পরে আসছি !

ঢাকা থেকে এক সময়ে খুব জনপ্রিয় একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। নাম বিচিত্রা। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। তার মধ্যে বিচিত্রা ছিল অন্যতম। দৈনিক বাংলা ভবন থেকে ছাপা হতো। বেশ কিছু কলাম থাকত। তার মধ্যে একটার কথা বলি। নাম ছিল কুরুক্ষেত্র। আরেকটা বিভাগ ছিল যার নাম “ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন”। অনেক পাঠক ছিলেন যারা পত্রিকার নতুন কপি পাওয়া মাত্র অনেকটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে এই দুই কলাম ও বিভাগের লেখাগুলো পড়ে ফেলতেন। কিছু মানুষ আবার একেবারে দিন গুনতেন কবে আবার হকার থেকে নতুন সংখ্যা পাওয়া যাবে।

পাঠকরা তাদের ভালোবাসা বিষয়ক সমস্যা লিখে পাঠাতেন “কুরুক্ষেত্র” কলামের জন্যে। তাতে মোটামুটি এক ধরনের ঘটনা বেরিয়ে আসতো। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক আর পারিপার্শ্বিকতার সংঘাতের ফিরিস্তি। "ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন” বিভাগে পাঠকরা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতেন তাদের মনে সুপ্ত আকাংখা প্রচারের জন্যে। বেশির ভাগ সময় বিজ্ঞাপনের ভাষা হতো এই ধরনের: গত ১২ই এপ্রিল ঢাকা রংপুর বাসে নীল ওড়না পরা মেয়েটাকে বলছি। আপনার সাথে যেই যুবকের তিন বার চোখা চোখি হয়েছিল আমি সেই লাল শার্ট পরা যুবক। আমি আপনার আরও কিছু বলতে চাই। আপনার আপত্তি না থাকলে নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করুন: ...............। এখানে প্রিয় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেই আমলে মোবাইল ফোন কিংবা ফেসবুক কোনোটাই ছিল না। ল্যান্ড লাইনও ছিল বেশ বিরল। হাতে গোণা কিছু মানুষ সেটা ব্যবহার করার সুযোগ পেতেন।

বিচিত্রার এই লেখাগুলোর আজকে মনে আসার কারণ হলো আমরা একদিকে দেখছি, ভালোবাসার প্রিয়জন খুঁজে পেতে মানুষের আকুল প্রচেষ্টা! যার জন্যে প্রয়োজনে টাকা পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করে না। অন্যদিকে সাধের ভালোবাসা যখন ধরা দিচ্ছে; প্রচণ্ড অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও কেন যেন বিরোধ চলে আসে। ফলশ্রুতিতে পরিবারের ভিতরে শুরু হচ্ছে যুদ্ধ। বাংলা ভাষায় যাকে নান্দনিক করে বলা হচ্ছে কুরুক্ষেত্র।

প্রাচীন ভারতে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়েছিল কুরুসক্ষেত্র নামের এক জায়গায়। বর্তমানে তা ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মধ্যে পড়েছে। সালটা ধারণা করা হয় খৃস্ট পূর্ব ৫০০-৬০০ সালের ভিতরে। যুদ্ধ মাত্র ১৮ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ভারত উপমহাদেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকে সৈন্যরা এসেছিল যুদ্ধ করতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যুদ্ধের প্রতিপক্ষ ছিল একই পরিবার থেকে সৃষ্টি হওয়া দুই গোত্র: কৌরভ আর পান্ডভ। যুদ্ধের ফলাফল এখন জরুরি না হলেও, এর পর থেকে পারিবারিক যুদ্ধ কুরুক্ষেত্র নামে পরিচিতি পায়। এ নিয়ে উপমহাদেশের প্রায় সব ভাষাতেই প্রচুর গল্প, কবিতা আর ছায়াছবি তৈরি হয়েছে।

ভালোবাসার মানুষরা যখন সংসার আরম্ভ করে, তখন মানসপটে থাকে ফুলের বাগানের থেকেও সুন্দর আর স্বচ্ছ দীঘির পানির থেকেও পরিষ্কার এক মায়াবতী গন্তব্যের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দম্পতিদের সেখানে আর পৌঁছান হয় না। কিংবা তা ছুঁতে পারলেও ধরে রাখতে পারেনা। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ভালোবাসা নিয়ে দেখা স্বপ্ন ও তার বাস্তব চিত্রে কেনো এতো গরমিল? চলুন এই করোনা কালে বিষয়টা নিয়ে আমাদের অলস হয়ে যাওয়া উর্বর মস্তিষ্কটা একটু ঘামাই।

সমস্যাটা বিশ্লেষণ করলে অনেক কারণ বেরিয়ে আসবে। তবে একেবারে কিছু মূল কিছু বিষয় নিয়ে না হয় কথা বলি। এমেরিকায় কয়েক বছর আগে একটা বই খুব বিক্রি হয়েছিল। বইটার নাম ছিল: Men are from Mars, Women are from Venus। লেখক জন গ্রে’র কাছে পুরুষ আর নারীদের এত বেশী আলাদা মনে হয়েছিল; যেন তারা ভিন ভিন গ্রহ থেকে আসা প্রাণী। চিন্তা, ভাবনা, বিচারবুদ্ধি, কথাবার্তা, প্রকাশ, আচরণে একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। বুঝতেই পারছেন ভিন গ্রহের প্রজাতিরা এক সাথে থাকলে সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক!

ভিন গ্রহের বাসিন্দাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলার আগে আমাদের পৃথিবীর প্রচলিত একটা শব্দের কথা বলি। এর নাম ইগো (ego)। শব্দটা ইংরেজি। ঠিক মনের মতো কোনো বাংলা প্রতিশব্দ না পাওয়াতে ইংরেজি শব্দটাই ব্যবহার করছি। এর আভিধানিক অর্থ নিজের ব্যক্তিসত্তার বহিঃপ্রকাশ, নিজেকে বড় করে ভাবা, দেখা আর সে হিসাবে কাজ করা। নারী কিংবা পুরুষ কারোরই এই বাহারী গুণের কোনো ঘাটতি নাই। এই ইগো হলো দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি করার এক নম্বর ক্লিমিনাল। স্বামী ভাবে সে স্ত্রীর থেকে উপরের মাত্রার। অন্যদিকে স্ত্রীর ধারণা সেই বা কম কিসে। শুরু হয়ে যায় বিরোধ। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো, একজনের আরেক জনের সামনে বিবস্ত্র হবার অভিজ্ঞতা থাকলেও, তাদের মনের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে দেয়াল উঠতে থাকে। এক মন আরেক মন থেকে আড়াল হতে থাকে। গোপন হতে থাকে অনেক কিছুই। দুজনের উচ্চস্বরের বাক বিতণ্ডা পাড়ার মানুষ শুনে। পর্যায়টা সেই বিখ্যাত কৌতুকের সাথে মিলে যায়। বিয়ের প্রথম বছর স্বামী বলে স্ত্রী শুনে; দ্বিতীয় বছর স্ত্রী বলে স্বামী শুনে; এবং তৃতীয় বছর থেকে দু জনে বলে আর পাড়ার সবাইকে শুনতে হয়।

অনেক পুরুষ আছে, যারা এখনও সেই সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা ভাবনা নিয়ে বসবাস করে। স্ত্রীকে উঠতে, বসতে শাসন করতে চায়। কিন্তু পৃথিবী অনেক এগিয়েছে এবং সাথে সাথে বদলেও অনেক। আগে নারীদের প্রতিকারের বেশী উপায় ছিল না। মুখ বন্ধ করে, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছে। কিন্তু নারী আজ আয় করতে জানে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে তারা শিক্ষিতা। পুরুষদের গায়ের জোর মানতে তারা আর রাজী না। আবার তার বিপরীতটাও আছে। স্ত্রী তার কর্তৃত্ব স্বামীর উপর চাপাতে চায়। পুরুষ এতে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আরম্ভ হয়ে যায়, কুরুক্ষেত্রের প্রথম ইনিংস। পুরুষরা শান্তি রক্ষার জন্যে নীরব থাকলে অনেকটা মাতৃ-তান্ত্রিক ধরনের পরিবার সৃষ্টি হয়। দু পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চলতে থাকে। তবে শান্তি ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ে থেকেই যায়।

ইগো সরাসরি স্বামী-স্ত্রীর যোগাযোগ (communication) ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর বিভিন্ন উদাহরণ হলো: এক জন আরেক জনের সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয়া, কিছু খবরাখবর ও তথ্য গোপন রাখা, এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে কথাবার্তা বন্ধ করে যুদ্ধে যোগদান করা। এই পর্যায়ে অন্য পক্ষের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ যেতে পারে।

ফলশ্রুতিতে একে অপরের উপর থেকে শ্রদ্ধা হারাতে থাকে। জীবনসঙ্গীর প্রাপ্য আসন নড়বড়ে হয়ে উঠে। পরিবারে নতুন এক ধরনের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যায়। একে অপরকে নীরব অথবা সরবে অপমান আর কষ্ট দেয়ার লড়াই। কুরুক্ষেত্রে যোগ হয় চার, ছক্কা মারার আপ্রাণ চেষ্টা। ক্রিকেট বলের মত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বারে বারে আঘাত প্রাপ্ত হতে থাকে।

স্বামী-স্ত্রী তাদের একে অপরের ভালোবাসার মধ্যেখানে অবশ্যই কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায় না। একে অপরের ভালোবাসা মানুষের নামের তালিকায় শীর্ষ অবস্থান কেউ ছাড়তে রাজী না। স্বামী যখন স্ত্রীকে জানায় অফিসের কাজ কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি তার কাছে সব চেয়ে বড়, তখনই স্ত্রীর মনে মুকুট হারানোর কষ্ট সৃষ্টি হয়। সংস্কৃতি-পরায়ণা এক স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছিল, স্বামী আর সংস্কৃতিকে সে সমান ভাবে ভালোবাসে। স্বামীর মন সাথে সাথে রক্তাক্ত হয়েছিল। স্বামী, স্ত্রী তাদের ভালোবাসায় শীর্ষে রাখবে তাদের জীবন সঙ্গীকে। অন্য মানুষ কিংবা কাজ-- আসবে পারস্পরিক সমঝোতায় এবং প্রয়োজনে। কারো আসনচ্যুতি যাতে না হয়। এই নিয়ম না মানলে ভীষণ বিপদের আশঙ্কা। ভালোবাসার রাজত্ব হারানোর বেদনাকে সম্ভবত এই পৃথিবীর অন্য কোনো কষ্টের সাথে তুলনা করা যায় না। তবে এই রাজত্ব ভৌগোলিক না। তার থেকে অনেক বড় একটা কিছুর। এটা হলো মনোজগতের রাজত্ব।

আরও অনেক কারণে সংসারে কুরুক্ষেত্র চালু হতে পারে। অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক উপাদান ছাড়াও, সন্দেহ, শারীরিক (যৌন) জটিলতা, মতের অমিল, ইত্যাদি তো আছেই। সবগুলো কারণ বিশ্লেষণ হয়তো আমাদের স্বনামধন্য সমাজ বিজ্ঞানীরা করবেন। ইগো থেকে সৃষ্টি হওয়া আধিপত্য বিস্তারের চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে, একেবারে খোলা-মন যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখলে, কোন সমস্যাই সংসারকে কুরুক্ষেত্রে পরিণীত করতে পারে না। ফলাফল হিসেবে একের সম্মান অন্যের কাছে অটুট থাকে। পরিবারে আনন্দের কোনো কমতি হয় না। তা হলেই সফলভাবে কুরুক্ষেত্র শব্দটাকে পরিবার থেকে তাড়িয়ে ইতিহাস বইয়ে ফেরত পাঠানো যাবে।

যাই হোক, এতক্ষণ বেশ কঠিন আলোচনা হলো।। চলুন একটু হালকা হই। ভিন, ভিন গ্রহ থেকে আসা মানব-মানবীদের কিছু বৈশিষ্ট্য বলি। তারা পারিবারিক শান্তিকালীন অবস্থায় পৃথিবীর ভাষা ব্যবহার করলেও, কুরুক্ষেত্র চলাকালীন অবস্থায় তার গুঢ় অর্থ কিন্তু বদলে যেতে পারে। তার কিছু উদাহরণ দেই: (কিন্তু প্রিয় পাঠক আপনাদের অবশ্য নিজেকেই বের করতে হবে কোন পক্ষ এগুলো কখন এবং কেন প্রয়োগ করতে পারে)ঃ

We need to talk = I need to complain (আমাদের কথা বলতে হবে=আমার অভিযোগ আছে)

We need = I want (আমাদের দরকার=আমি চাই)

I'm not yelling! = Yes I am yelling because I think this is important (আমি চিৎকার করছি না= আমি চিৎকার করছি, কারণ আমি মনে করছি এইটা জরুরি)

How much do you love me? = I did something today you're really not going to like (তুমি কি জানো আমি তোমাকে কত ভালবাসি? = আমি আজকে এমন কিছু করেছি, যা তুমি একেবারে পছন্দ করবে না)

You have to learn to communicate = Just agree with me (তোমাকে কথা বলা শিখতে হবে=আমার সাথে একমত হয়ে যাও)

Yes = No (হ্যা=না)

No = No (না=না)

Maybe = No (হয়ত=না)

I'm sorry = You will be sorry (আমি দুঃখিত= তুমি বুঝবে মজা)

নাহ, আমরা কেউ চাই না কারোর পরিবারেই কুরুক্ষেত্রের পরিবেশ তৈরি হউক। এখন না হয় পারিবারিক যুদ্ধ মানে কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি না হওয়ার মূলমন্ত্রটা বলি। পরিবারের ভালোবাসা বৃক্ষ সার্থকভাবে বেড়ে উঠার জন্যে পরিচর্যা থাকাটা একেবারেই অত্যাবশ্যক। গাছে পানি না দিলে, আগাছা সরিয়ে না দিলে গাছটা যেমন দুর্বল হয়ে মারা যেতে পারে তেমনি একে অপরের সুখ-দুঃখের সমান সমঝদার না হলে ভালোবাসা সমস্যাযুক্ত হয়ে যায়। একটা শক্ত লোহা খণ্ড বাইরে ফেলে রাখলে রোদে পুরে, বৃষ্টিতে ভিজে জং পড়ে। তখন সেটাকে মচকানো অনেক সহজ হয়ে যায়।

লেখাটার প্রথমে বলেছিলাম, আমি আজকে জানিয়ে দিবো পুরুষরা আসলে ঠিক কখন নারীদের একেবারে ১০০ ভাগ বুঝতে পারে। আসলে এর উত্তর শুধু আমার কেনো কারোরই জানা নাই। বড় বড় কবি-লেখকরা নারীর মন বুঝতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। আকাশের রঙের মতো যে নারীর মন প্রতিনিয়তই বদলে চলে। তবে প্রকৃত প্রেমিকের কাছে নারীর মনের প্রতিটা রং-ই সুন্দর ও মায়াবী।