যখন তুমি আদর করো

হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে ঝিমচ্ছি। সোফায় অলস হয়ে বসে থাকলেও, মাথায় হাজারো চিন্তা। পরিবারে নতুন সদস্য আসছে। তাও আবার বিদেশ বিভুয়ে। পাশে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউ নাই। বাচ্চা হওয়ার পর কি কি করণীয় তার সম্পর্কে ধারণা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি। বই পড়ে অর্জন করা সামান্য কিছু জ্ঞানই সম্বল। এই নগণ্য ঢাল তলোয়ার নিয়ে কতটুকু এগুতে পারবো? তবে এতোটুকু বুঝতে পারছি জীবনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদের ঘাড়ে আসতে চলেছে।

আকাশ-পাতাল চিন্তায় ছেদ পড়ল। হালকা নীল রঙের পোশাক পরা একজন নার্স ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে কি যেনো বলছে। ইচ্ছা না থাকলেও নার্স কি বলছে সেটা বুঝার চেষ্টা করলাম। কি অদ্ভুত সে আমাকেই খুঁজছে। ইংরেজিতে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। আমার শরীর স্বাস্থ্য ঠিকই আছে। নার্সের আবার আমার কাছে কি দরকার হতে পারে? মুহূর্তেই মনে হলো বাচ্চা হওয়ার খবর আনল না কি? নাহ সে সম্ভাবনা নাই। এইতো কিছুক্ষণ আগে খবর নিয়ে এসেছি। বলল এখনো দেরী আছে। প্রজনন পথ না-কি আরও ডাইলুট হতে হবে। দু সেন্টিমিটার হয়েছে। আরও আট সেন্টিমিটার হলে বাচ্চা মহোদয়ের মাথা বের করার মর্জি হতে পারে। এই জ্ঞান আগেই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের সময় সব যেন কেমন গুলিয়ে গেল। মনে করতে পারলাম না, শিশু জন্ম নেয়ার সাথে সেন্টিমিটারের কি সম্পর্ক থাকতে পারে।

নার্স আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল প্রিয়তমার কাছে। কষ্টে বেচারার মুখ শুকিয়ে নীল হয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখে একবার তাকাল। মনে হলো আমাকে সেই হাসি উপহার দেবার চেষ্টা করছে, যেটা দেখেই আমার মাথার সব কিছু এলোমেলো হয়েছিল। আমি মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম। তবে বলাই বাহুল্য, মাথা এলোমেলো হওয়ার ব্যাপারটা আমার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। মেয়েটার চেহারায় কি যে যাদু আছে! চোখে পড়া মাত্রই আমি তলিয়ে যেতে থাকি মহাসাগরের অতল গহ্বরে। যাই হোক, ওই সব কথা এখন থাক। প্রতি-উত্তরে আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। দুর্ভাগ্য আমার মুখে হাসি জাতীয় কিছুই এলো না। ধীর পায়ে যেয়ে ওর হাত ধরে দাঁড়ালাম। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, “ইয়া আল্লাহ, হে রাহমানুর রহিম, মেয়েটার কষ্ট কমিয়ে দাও। তার বিনিময়ে না হয় আমাকেও ওর কষ্টটা দিয়ে দাও। ও তো গত ১০ মাসে ধরে অনেক ভুগেছে। এখন আবার নতুন করে কেনো......?”

কামরায় আরও দু জন নার্স ছিল। আমাকে দেখে ওরা চোখে চোখে কিছু বলাবলি করল। তাদেরই একজন আমার উদ্দেশ্যে বলল, “তোমাদের বাচ্চা বের হওয়ার সময় হতে চলেছে।” খবরটা শুনে খুশিই হলাম। যাক এতদিনের অপেক্ষা ও ভোগান্তির শেষ হবে। নাহ স্বস্তির দম নিতে পারলাম না। আরেকজন নার্স আমার দিকে তাকিয়ে হাত পা নাড়িয়ে গর গর করে একগাদা কথা বলল। মাথার মধ্যে কিছুই ঢুকল না। তবে এটুকু বুঝলাম আমাকে সে কিছু একটা করতে বলছে।

যে সব বন্ধুরা বাচ্চা জন্ম নেয়ার সময়ে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পান নি, তাদেরকে খুবই সংক্ষেপে নর্মাল ডেলিভারির শেষ পর্যায়টা একটু বলি। প্রেগন্যন্সির শেষ দিকে ‘কনট্রাকশান’ আরম্ভ হয়। এতে ডেলিভারির পথটা প্রশস্ত হয় যাতে নবজাতক সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে। কনট্রাকশানের ফলে নির্গমন পথ দশ সেন্টিমিটার পর্যন্ত খুলে যায়। এই কনট্রাকশান প্রায় পাঁচ মিনিট পর পর আসতে থাকে এবং ১৫-৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এই ছোট সময়টাতে সন্তান সম্ভবা মাকে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে আধশোয়া হয়ে ডেলিভারি পথে চাপ প্রয়োগ করতে হয়। চাপটাকে প্রবলতর করার জন্যে সাথের নার্সরা হবু মাকে অর্ধ শোয়া হতে সাহায্য করে। মানে তখন হবু মাকে কোমর থেকে শরীরের উপরের অংশ বসার ভঙ্গিতে এবং পা দুটো ফাকা করতে হয়। কনট্রাকশান যখন আসে ঠিক সেই সময়টাতেই নার্সরা চিৎকার করে বলতে থাকে পুশ, পুশ (Push, Push)--- আরও জোরে ধাক্কা দাও। যত জোরে ধাক্কা হবে বাচ্চার বের হওয়ার পথটা ততো দ্রুত প্রশস্ত হয়। আমাকে এই কাজে নার্সদের সাথে অংশগ্রহণ করাটা না-কি খুব জরুরী! তার মানে কনট্রাকশান যখন আসবে, আমাকে নার্সদের সাথে ছন্দ মিলিয়ে প্রক্রিয়াটাতে অংশগ্রহণ করতে হবে।

নার্সরা আমার মনের অবস্থা যদি জানতো! বাড়িতে সাত ভাইয়ের মধ্যে আমার রোল নম্বর ছিল ছয়তে। পরিবারের কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমার প্রয়োজন হয়েছে বলে আমার মনে নাই। বাবা-মা, তার পরে উপরের পাঁচ ভ্রাতা অতিক্রম করে আমার কাছে চ্যালেঞ্জ আসতো না বললেই চলে। একে বিদেশের মাটিতে, তারপরে সমস্যা মোকাবেলায় অনভিজ্ঞ আমার মতো একজনের এই পরিস্থিতি কিছুটা নার্ভাস হওয়াটা কি একেবারে অস্বাভাবিক? প্রিয়তমার প্রেগন্যান্সির কষ্ট আর এই মুহূর্তে বাচ্চা প্রসবের ব্যথা আমার সহ্য সীমানাকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। বারে বারে মনে হচ্ছিল মেয়েটার এতো ভোগান্তির মুল আসামী হলাম আমি স্বয়ং। আমি কেনো যে বাচ্চা নেয়ার খায়েশ করেছিলাম! নিজেকে এই অপরাধের জন্যে কিছুক্ষণ পর পর চূড়ান্ত গালিগুলো দিচ্ছিলাম। নার্স আমার পাশে এসে ক্ষুদে প্রশিক্ষণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, কিভাবে বিছানার পাশে রাখা মনিটর দেখে বুঝতে হবে কখন কনট্রাকশান আরম্ভ হচ্ছে এবং তাকে কিভাবে শোয়া অবস্থা থেকে তুলে বসাতে হবে। সাথে কিছুটা আদেশের সুরে বলল, আমি ওই সময়ে স্ত্রীকে উৎসাহ দেবার জন্যে ওদের সাথে তাল মিলিয়ে জোরে জোরে পুশ, পুশ বলতে থাকি। এই দেশের নার্সদের হয়তো ধারণা প্রিয় মানুষ পুশ, পুশ বললে সন্তানের মা ধাক্কাটা আরও জোরে দিবে।

বিয়ের আগে পুরাদস্তুর প্রেম করেছি পাঁচ বছর। আমাদের সেই আমলে প্রেম বেশির ভাগটুকুই হতো অন্যদের অগোচরে। প্রেম চলতো চিঠিতে আর চোখের দৃষ্টিতে। প্রথমে মেলা দিন কেউ জানতেই পারে নি যে আমরা মন দেয়া নেয়ার কাজটা সেরে ফেলেছি। ঘটনাক্রমে আমাদের বন্ধু রিজু একটা প্রেম পত্র দেখে ফেলে। তারপর একমুখ থেকে আরেকমুখ করে খবরটা সমগ্র ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু সবাই জানলেও, অন্য বন্ধুদের উপস্থিতে ওর একেবারে কাছে যেয়ে বসতে, একটু ধরতে, একটু ছোঁয়া পেতে হাজারও ইচ্ছা করলেও প্রচণ্ড দ্বিধা এসে ভর করতো। মনের ইচ্ছা ‘পূরণ হতো না রে; হতো না’। ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছাগুলো কেঁদে কেঁদে বাষ্প হয়ে মেঘ হয়ে যেতো। তারপরে সেই মেঘ আকাশ থেকে রিমঝিম বৃষ্টি ঝরাত। যাই হোক ফিরে আসি বর্তমানে। ভাবলাম ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকদূর এগুতে পেরেছি। এখন আর আগের মতো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হচ্ছে না। তিনজনের নার্সের উপস্থিতিতে আমি ওকে সযত্নে টেনে বসাতে লাগলাম এবং ঠিক সময়ে বলতে লাগলাম পুশ পুশ। সব সংশয় ও টেনশন মুহূর্তে উবে গেল। কিছুক্ষণ পর পায়ের দিকে দাঁড়ানো নার্স আমাকে তার কাছে ডাকল। কাছে যেতেই বলল, “ওই দেখো তোমার মেয়ের চুল দেখা যাচ্ছে।” আমি নার্ভাস চোখে বাচ্চা বের হওয়ার পথে তাকালাম। আসলেও কিছু চুল দেখা যাচ্ছে। এক ধরণের আনন্দে মনটা ভরে উঠলো। তার মানে আমার সন্তান যে কোনো মুহূর্তে আমার কোলে চলে আসবে; পৃথিবীর আলো দেখবে, আমাদের জীবন আলোময় করে রাখবে।

না ভাবনা মোতাবেক ঘটনা হলো না। বেশ কিছু জটিলতা আরম্ভ হলো। কনট্রাকশানের জোর যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, সেভাবে এগুলো না। নার্সরা একজন ডাক্তার ডেকে কি সব পরামর্শ করল। পেটের মধ্যে বাচ্চাটাও আবার ঘুমিয়ে পড়ল। প্রসব পথ যতটুকু ডাইলেট বা প্রশস্ত হওয়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণ হলো না। ফলে বাচ্চা বের হওয়ার জন্যে পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি হয় নি। এর মধ্যে আরেকজন ডাক্তার এসে যোগ দিলো। প্রথমে দু জন ডাক্তার নিজেরা কিছু কথা বলল। তারপরে নার্সদের উদ্দেশ্য কিছু নির্দেশনা দিলো। আমার মস্তিষ্কে নতুন করে কেমন একটা জড়তা চলে এলো। ওরা কি কথা বলল তার বিন্দু বিসর্গ আমার মাথায় ঢুকল না। তবে এতোটুকু বুঝলাম কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। একজন নার্স আমাকে বলল, তুমি ওয়েটিং রুমে যেয়ে বসো। তোমাকে আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ডাকা হবে। বুঝলাম ওরা কিছু একটা করবে যা আমাকে দেখতে দিতে চায় না।

নাহ আমাকে আর ওয়েটিং রুমে ফিরে যেতে হলো না। পরের মুহূর্তেই ডাক্তারদের একজন কিছু একটা বলে উঠলো। এইবার কথাটা বুঝলাম। ডেলিভারি করাতে আরেক রুমে নিয়ে যাবে। এক মিনিটের মধ্যে যন্ত্রপাতি খুলে রেডি হয়ে বিছানা ঠেলে সবাই বের হয়ে পড়ল। আমিও দুরু দুরু বুকে ওদের সাথে সাথে ডেলিভারি রুমে চলে এলাম। পাশের যন্ত্রপাতিগুলোকে সাথে সাথে জোড়া লাগানো হলো। ডাক্তাররা যেয়ে প্রিয়তমার পায়ের দিকে যেয়ে দাঁড়ালো। এইদিকে বেচারির কষ্টে কষ্টে একেবারে প্রচণ্ড কাহিল অবস্থা। হাসপাতালে এসেছিলাম আগের দিন বিকালে। মনে হচ্ছে বেচারির শরীরে তেমন কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট নাই। তারপরে শিশু এখনও ঘুমাচ্ছে। সে জন্যে তাকে এনেসথেসিয়া কিংবা ব্যথার ওষুধ দেওয়া হলো না। ওষুধের প্রভাবে মায়েরও ঘুমিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। তাতে বাচ্চার কাছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছলে অন্য ধরণের জটিলতা তৈরি হবে। শুধু এতটুকু পরিষ্কার উপলব্ধি করলাম, বাচ্চা হওয়ার সময়ে নারীদের যেই কষ্ট হয়, পৃথিবীর কোনো পুরুষের পক্ষে সেই পরিমাণ কষ্ট সহ্য করাটা একেবারে অসম্ভব। বিধাতা নারীদের কষ্ট সহ্য করার এই প্রচণ্ড ক্ষমতা দিয়েছিলেন বলেই হয়তো শিশুরা জন্ম নিতে পারে।

অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণ হাজির হলো। প্রায় ১৩/১৪ ঘণ্টার এই পর্যায়টা শেষ করে ডাক্তাররা শিশুটাকে সুস্থ-সবলভাবে বের করে আনল। আমার সন্তান এই সুন্দর মায়াবী পৃথিবীর আলো দেখল। একটুক্ষণ পরেই সে সশব্দে চিৎকার করে কেঁদে তার আগমন বার্তা ঘোষণা করল। এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে ডাক্তার-নার্সদের যেই দল বাচ্চা ডেলিভারির কাজ করে চলেছিল তারা যেন হাফ ছেড়ে স্বস্তি পেলো। হঠাৎ সবাই হাত তালি দিয়ে উঠল। বুঝলাম সফলভাবে কাজটা করতে পারার জন্যে তারা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করছে। খুবই অবাক হলাম তাদের সাফল্য উদযাপনের ধরণ, স্থান-কাল, ও পাত্রের কথা ভেবে। কিন্তু মাথায় প্রশ্ন এলো এদের এতো খুশী হওয়ারই বা কি থাকতে পারে? হাসপাতালে নিয়মিতভাবে কত শিশুরই না জন্ম হচ্ছে। প্রতি বারে নিশ্চয়ই তারা এভাবে হাত তালি দিয়ে উঠে না। পরে অবশ্য উদ্ধার করলাম বিষয়টা কি।

বাচ্চা মায়ের পেটে নির্ধারিত সময়ের কয়েকদিন বেশী থাকাতে কিছুটা বেশী বড় হয়ে গিয়েছিল। সেই তুলনায় প্রসবের জায়গাটা ততোটা প্রশস্থ হয় নি। সে জন্যে ডাক্তার-নার্সদের মেলা সূক্ষ্ণ কসরত করতে হয়েছে। একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলেই বড় সমস্যা হয়ে যাবার আশংকা ছিল। কিন্তু ওরা বাচ্চা বের করে আনার কাজটাতে সফল হলেও বেচারি মায়ের প্রজনন পথের বেশ কিছুটা জায়গা ছিঁড়ে রক্তাক্ত হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকল। এর মধ্যে ডাক্তার-নার্সরা দু দলে বিভক্ত হয়ে মা ও শিশুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সেই সময়ে আমার অনুভূতি দারুণভাবে মিশ্র। একদিকে বাবার হওয়ার উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে আমার প্রিয়তম মানুষটার জন্য বুক-ভর্তি সহানুভূতি। তুলতুলে সুন্দর নরম মেয়েটা এতো লম্বা সময় ধরে ভীষণ ব্যথায় ভুগেছে। তারপর কষ্টটা এখন আরও বেড়েছে। আমি ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে একজন নার্স আমার কোলে আমার ঔরসজাত কন্যাকে দিয়ে গেল। বাচ্চাটার মুখ ওর মাকে দেখালাম। এই কষ্টের মধ্যে মেয়েটা মুখে কেমন একটা আনন্দের আভা চলে এলো। একটুক্ষণ পরেই বাচ্চাটাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে নার্সরা ওদের কাজ আবার আরম্ভ করল। অন্যদিকে ডাক্তাররা নতুন মায়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার কাজ করে চলল।

এতো কষ্টের মাঝেও মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই ওর মুখে আমি সেই হাসিটা দেখলাম। যেটার জন্যে আমি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো কিছুই নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিতে পারি। নাহ, ওইদিকে চিন্তাটাকে বিন্দুমাত্র এগুতে দিলাম না। কিন্তু মনে হলো এই মুহূর্তে আমি ওর জন্যে কি কিছু একটা করতে পারি, যা সামান্য হলেও, ক্ষণিকের জন্যে হলেও প্রিয়তমাকে একটু ভালো লাগা দিবে? মনে হলো, নিদেনপক্ষে ওর কানে কানে আমার সমস্ত আবেগ মিশিয়ে মিষ্টি করে বলতে পারি ‘ধন্যবাদ’। পরের মুহূর্তেই মনে হলো, আমাকে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় উপহারটা দেয়ার জন্যে শুধু মৌখিক ধন্যবাদ; নাহ মনটা সায় দিলো না। আরও বড় কিছু করতে ইচ্ছা হলো। তা ছাড়া আমার গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ। সেখান থেকে কোনো শব্দই বের করাতেই কঠিন কসরত হবে। একটা বুদ্ধি মাথার মধ্যে ঝিলিক খেয়ে গেল। মেয়েটার কপালে ঠোট দিয়ে একটা ভালোবাসার চিহ্ন নিশ্চয়ই একে দিতে পারি। ঠিক করলাম সেটাই করবো। এই অদৃশ্য চিহ্ন আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে স্মরণীয় করে রাখবে। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের সংস্কার আমার উপর ভর করল। রুম ভর্তি মানুষ, তার পরের এ রকম একটা পরিস্থিতি। সংশয়ের চাপে কাজটা করতে যেয়েও পারলাম না।

মেয়েটা চোখের ইশারায় আমাকে কাছে আসতে বলল। ভাবলাম কিছু হয়তো দরকার। মাথা ঝুঁকিয়ে ওর মুখের পাশে মুখ আনলাম। প্রিয়তমা দু পাশের দু হাত উঠিয়ে আমার মুখটা জড়িয়ে বুকের কাছে নিলো। তারপরে আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু করতে পারি নি; তাই করলো। আমার মুখে ভালোবাসার ছোঁয়া ছুঁয়ে দিলো। বিনিময়ে আমি কিছুই করতে পারলাম না। একেবারে নিরুত্তর ও নিস্তব্ধ মূর্তি হয়ে রইলাম। ভিতরটা কেমন ভালোবাসায় আর মায়ায় সিক্ত হয়ে গেল। বাঙালি ছেলেদের তো আবার অশ্রুসিক্ত হতে নাই!

ঘটনাকাল পার হয়ে এসেছি আজ কয়েক দশক হলো। তারপরেও অনুভূতিটা আমার মধ্যে প্রতিটা মুহূর্তে বর্তমান। কবীর সুমনের লেখা ও সুর করা একটা গান আমার ভিতরের সেই সুখটাকে কেমন যেনো ভীষণ উথাল-পাতাল করে ফেলে:

এ তুমি কেমন তুমি চোখের তারায় আয়না ধর

এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর কর

ঝরেছ বৃষ্টি হয়ে আগেও তুমি আবার ঝর

এ কেমন কান্না তুমি আমায় যখন আদর কর

https://www.youtube.com/watch?v=B_ucVJpcHVc

শেষে বলি, নারীর ভালোবাসার মহাসাগরের গভীরতা মাপার ক্ষমতা আমার মতো এই ক্ষুদ্র মানুষের নাই। ভাবি, এই সামান্য কয়েক বছরের মনুষ্য জীবনে সেই বিশাল মহাসাগর থেকে কতটুকু ভালোবাসা-ই সেচে তুলতে পারবো? আর অগণিত অ-সেচা ভালোবাসা রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে মন যে আমার একেবারে চাইবে না! বুকটা ভেঙ্গে বিদীর্ণ হয়ে চুরমার হতে থাকবে।

জুলাই ১৫, ২০১৮

কাজী হাসান

প্রবাসী লেখক: quazih@yahoo.com

(লেখাটা আমাদের ভালোবাসা বার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ণ প্রকাশ করলাম)