কেমনে চলর চবি?

কলার আইডি’ তে দেখলাম মাসুদ ভাই (Masud Reza) কল করছেন। তিনি আমার খুবই প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে একজন খুব বড় অনুপ্রেরণাকারী। তার যে কোনো কথাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বললেন, আমাদের শহরে ৫ অক্টোবর (২০১৯) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের উত্তর এমেরিকা সম্মেলন হবে। সেখানে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে চান। আসলে এই সম্মেলনটার কথা বেশ কিছু দিন ধরেই শুনছিলাম। কিন্তু কিছুটা দ্বিধা ছিল; আমি তো চবি মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়ে কিভাবে সেখানে যাই। উনিকে আমাকে আসস্থ করলেন, সেটা কোনো ব্যাপারই না। বরং উনি আমাকে বাড়তি কিছু আকর্ষণের কথা জানালেন। অনুষ্ঠানে তারা আট শত অতিথির আপ্যায়ন করবেন। তার মধ্যে প্রায় দু শ জন উত্তর এমেরিকার অন্যান্য শহর থেকে আসবেন। তিনি আরও বললেন, সবাইকে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি মাংস ও ডাল, ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করা হবে। রাতের খাবারের পর বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে গান পরিবেশনা করবেন চট্টগ্রামের ব্যান্ড সোলসের প্রাক্তন কিংবদন্তী শিল্পী তাজুল ইমাম ও তপন চৌধুরী। সামিনা চৌধুরীও গান করবেন। শেষে বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যান্ড মাইলসের পরিবেশনা করবে। যেখানে এতকিছুর আয়োজন সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে কেউ কি না যেয়ে থাকতে পারে? কিন্তু সেই মুহূর্তে অবশ্য আমার মনে অন্য এক চিন্তা ও আবেগ এসে ভর করেছে।

কর্ণফুলী নদীর পাড়ে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা অদ্ভুত সুন্দর রোমান্টিক এক শহরের নাম চট্টগ্রাম। সেখানে কেটেছে আমার প্রাণবন্ত শৈশব। সেন্ট প্লাসিড স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে উঁচু নিচু ঢালু রাস্তার শার্শন রোড, টাইগার পাস, দামপাড়া, পাথরঘাটা, লাভ লেন দিয়ে কতবার যে যাতায়াত করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নাই। সেখানকার প্রতিটা বাক আমার চেনা। কিছু দূরেই ছিল নয়নাভিরাম ফয়েজ লেক এবং আগ্রাবাদ ছাড়িয়ে আরেকটু গেলেই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। চারিদিকেই মন ভালো করে দেবার ভালোবাসার হাতছানি। এতো মায়াময় শহরটার একটা রেল জংশনের নাম ষোল শহর। জায়গাটা ছিল আমাদের নাসিরাবাদের বাসার বেশ কাছে। সেখানে রেল লাইন ধরে বন্ধুদের সাথে কখনো হেঁটে কখনো দৌড়ে অনাবিল আনন্দ পেয়েছি। এই জংশন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেনে চড়ে আসা যাওয়া করতো। সেই ছোট বেলা থেকেই ওদের দেখতাম জংশনে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে কিংবা ফিরে আসতো। তখন থেকেই আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ।

শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২১১০ একর পাহাড়ি এলাকা জুড়ে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুধু তাই না স্থাপত্য শৈলীর দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিং ও রাস্তাগুলো যে কারোর দৃষ্টি কেড়ে নিবে। এই দৃশ্য একবার না বাড়ে বাড়ে দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু নাহ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়য়ে আমার পড়া হয় নি। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু সেই শৈশবের ফেলে আসা চট্টগ্রাম ও সেই সময়কার স্মৃতির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার মানসপটে সব সময়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখানে বলে রাখি ১৯৮৩ সালের পর আমার আর চট্টগ্রামে যাওয়া হয়ে উঠে নি।

যাই হোক ফিরে আসি চবি’র ডালাস কনভেনশন প্রসঙ্গে। সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আমি যোগদান করি সন্ধ্যা সাতটায়। প্রথমেই মেজবানি মাংস দিয়ের ভুঁড়ি ভোজ হলো। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় রান্নার প্রশংসা না করলেই না। মনে হচ্ছিল চট্টগ্রামে বসেই খাচ্ছি। আয়োজকরা করে দেখালেন বিদেশ বিভুয়ে এতো মানুষের খাবার এতো চমৎকারভাবে প্রস্তুত করাও সম্ভব! আসলে আতিথেয়তার দিক থেকে চট্টগ্রামের মানুষের স্থান শীর্ষে। তাদের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডে সবসময়েই বিশালত্ব। এর পর খোশ মেজাজে সঙ্গীত উপভোগের জন্যে যেয়ে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মঞ্চে চলে এলেন তাজুল ইমাম ও তপন চৌধুরী। একক ও দ্বৈত জনপ্রিয় সব সঙ্গীত দিয়ে মাতিয়ে দিলেন। “পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে; এসেছে দারুণ মাস” গানটা দারুণ এক মুহূর্ত এনে দিলো। সেই আবেশ কাটতে না কাটতেই শোনা গেল, “মন শুধু মন ছুঁয়েছে; ও সে তো মুখ খুলেনি o ho....”। মন তো মন খুঁজবেই, একটু ছোঁয়া তো চাবেই। আবারও সেই দরাজ কণ্ঠের সুর ভেসে এলো, "ও পাগল মনরে, আচ্ছা পাগল মনরে দিন গেলে তুই ঘাড়ত বই বই হান্দিবি।" ফেলে আসা সেই শৈশব ও যৌবনের উচ্ছ্বাসে ফিরে গেলাম। হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোকে মনে করে এখন ‘পাগল মনের কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।’ পরের শিল্পী সামিনা চৌধুরীর “কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে” গানের সুরে চলে গেলাম কবিতার কোনো এক মায়াবী রাজ্যে। শেষে এলো ব্যান্ড মাইলস। তারা তাদের ৪০ বছর পূর্তি পালন করছে। অনেকটা এই ব্যান্ডটার সাথে বেড়ে আমার প্রজন্মের বেড়ে উঠা। তারাও তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গান দিয়ে প্রতিটা দর্শকের মন জয় করে নিলো। তারা যখন ধরলো আমাদের সোনালী দিনগুলোর সেই বিখ্যাত ‘নীলা’ গানটা, “নীলা, তুমি কি চাও না হারাতে ওই নীলিমায়? যেখানে দু'টি মন এক হয়ে ছবির মতো জেগে রয়।। নীলা, তুমি কি জানো না আমার হৃদয়ের ঠিকানা? যেখানে তোমার আমার প্রেম মিলে মিশে এক হয়।” মুহূর্তেই ভাবলাম নীলা কি এতদিনে আমার হৃদয়ের ঠিকানা জেনেছে? তাকে যে আবার খুঁজে বের করতে ভীষণ ইচ্ছা করছে! প্রশ্নটা করতে মন চাইছে!!

যারা বাংলাদেশে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তারা ‘বহিরাগত’ শব্দটার সাথে পরিচিত। চবি’র ছাত্র না হয়েও আমার নিজেকে একবারের জন্যও বহিরাগত মনে হয় নি। বরং আবারও দেখলাম চট্টলার ছোঁয়া পাওয়া মানুষগুলো অতিথিকে কতো সুন্দর করে আপন করে নিলো। বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেলা দিন পর দেখা হলো। চমৎকার একটা সময় পার করলাম। শেষে বলি, মাসুদ রেজা ভাই, রায়হান ভাই, শাহ জুলফিকার ও আয়োজকদের প্রত্যেককে এত বড় একটা অনুষ্ঠান করার জন্যে আকাশের সমান এক বিশাল বড় ধন্যবাদ। আপনারা সত্যিই আমাকে আমার শৈশবের মধুর সময়গুলোকে থেকে ঘুরিয়ে এনেছেন। এই অভিজ্ঞতাটা দেওয়ার জন্য জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞটা প্রকাশ করার সঠিক ভাষা আমার জানা নেই।

অক্টোবর ৭, ২০১৯

ডালাস, টেক্সাস