আমি তোমার মনের ভিতর......

“আগে জানলে, তোমাকে বিয়েই করতাম না।”

“কি জানলে?”

“এই মেজাজ আর এই চেহারা ওয়ালা মেয়েকে পাগল ছাড়া আর কেউ বিয়ে করে?”

“তা হলে প্রেমে পড়ে মজনু হয়েছিলে কেন? আবার যে দুই বার স্যুইসাইট করতে নিয়েছিলেন জনাব! কথাটা নতুন করে মনে করে করিয়ে দিতে হবে না-কি?”

“সেই মেয়ে তো আর এখনকার তুমি না?”

“দেখ বেশী মাথা গরম করিয়ে দিও না। তুমি যেই অহনার প্রেমে পড়ে দিওয়ানা হয়েছিলে, সে ছিল আমার বাবার আদরের দুলালী। অনেক আদর-যত্নে বড় করেছিল। আর সেই আদরের দুলালীকে তুমি দিনে দিনে ধ্বংস করে আজকের অহনাকে বানিয়েছ।”

“কি বললে, আমি তোমাকে ধ্বংস করেছি। ঠিক আছে যাও বাবার বাড়ি যেয়ে আলালের ঘরে দুলালী হয়ে থাকো যেয়ে।“

“কি, কি বললে? আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলছো?”

“তা বলবো কেন? তুমিই তো বললে আমি তোমাকে ধ্বংস করে দিয়েছি।”

“ঠিক আছে, আমি আজকেই চলে যাবো।”

ব্যাস আরম্ভ হয়ে গেল, পারিবারিক তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আরেক পর্ব। একেবারে সম্মুখ যুদ্ধ।

প্রতিপক্ষ দুই নিয়মিত পরাশক্তি অহনা এবং কাজল।

দুই পক্ষের শান্তিকালীন সময় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র কিছু দিন আগে বড় একটা যুদ্ধের পরে অহনা চলে গিয়েছিল বাবার বাড়ি। যাবার সময় বলে গিয়েছিল, চল্লিশ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বিবাহ করে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে আকাশের মেঘ তাদের বাঁচিয়ে দিলো। অহনা অন লাইন ম্যাচিং সার্ভিসকে বলল, তার এমন ছেলের দরকার যে ছেলে মেঘের সাথে কথা বলতে পারে। শেষে দেখা গেল কাজলই এক মাত্র সে রকম ছেলে যার মেঘের সাথেকথা বলার ও বুঝার ক্ষমতা আছে। তার পরে দু জনের মিলমিশ হয়ে গিয়েছিল।

তিন মাসের মাথায় আবার নতুন করে সংঘর্ষ লাগল। অহনা এখন কম্পিউটারে বেশী সময় কাটায়। কাজল প্রথমে অবাক হলো। যে মেয়ে মাত্র কয়েক দিন আগে পর্যন্ত কম্পিউটারের আশে পাশে পর্যন্ত যেতো না, সে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে কাটাচ্ছে। আড়ি পেতে দেখল, বিষয়টা কি? যে রকম সন্দেহ অনেকটা সে রকম আবিষ্কার করলো। এখনও অহনাকে অন লাইন ম্যাচিং সার্ভিস থেকে ঠিকানা পাওয়া ছেলেরা ফেসবুকে নক করছে, ইমেল পাঠাচ্ছে। অহনা ওদের উত্তর দিচ্ছে। কয়েকজন আবার ফেসবুকের লাইক, কমেন্ট পর্যন্ত করছে। ব্যাপারটা ভাবতেই কাজলের শরীরটা রি রি করে উঠলো। কে জানি বলেছিল, মেয়েদের ভালোবাসা নদীর মতো। তা শুধু বয়েইযায়। অহনার ভালোবাসা কি এখন কাজলকে ছাড়িয়ে চলে গেছে অনেক দূর? এ গুলো ভাবতেই কাজলের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। কিছু একটা প্রচণ্ড শব্দ করে ভেঙ্গে ফেলতে পারলে হয়তো ভালো হতো।

অহনা দেখলো বাড়ি ফিরে আসার পরে প্রথম কয়েক দিন কাজল তাকে খুব মনোযোগ দিলো। সাথে সাথে থাকা, বেড়াতে যাওয়া, গল্প করা, সুযোগ পেলেই হাত ধরে বসে থাকা আর কতো কি! এমন কি অহনাকে নিয়ে কয়েক বার ছাদে যেয়ে মেঘের সাথে কথা পর্যন্ত বলল। ঠিক সে-ই বিয়ের আগে প্রেম করার দিনগুলোর মতো। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই কাজল আবার আগের রুপে ফিরতে আরম্ভ করল। অহনা যেই কাজগুলো পছন্দ করে না, সেগুলো আবার চালু করল। ছুটির দিনে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে বসে মোবাইলে বন্ধুদের সাথে পুরোটা সময় কথা বলতে লাগল। অহনার সব কথা ভুলে যাওয়া রোগটাও ফিরে এলো। মামাকে চিঠিটা পোস্ট করেছ, গ্যাসের বিল দিয়েছ, কলের পানি বন্ধ হচ্ছে না, সারা দিন টিপ টিপ করে পড়ছে, মিস্ত্রিকে ডেকেছ?-------- এ রকম সব প্রশ্নের কাজলের উত্তর একই, “মনে ছিল না, ভুলে গেছি।” অহনার কাছে আবার নতুন করে মনে হতে লাগল তাকে সঠিক ও প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। সে গজ গজ করতো, “সব কাজই যখন ভুলে যাও, তখন বিয়ে করার কথাটা মনে রেখেছিলে কি করে? এ রকম লোকের সাথে আর যাই হোক ঘর করাটা মুশকিল।”

দুই পক্ষের কথা বার্তা বিভিন্ন মেয়াদের জন্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার অনশন ধর্মঘট পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু কোন আন্দোলনের ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। যখনই এক পক্ষের মনে হচ্ছে বেশী ছাড় দেয়া হয়ে গেছে, তখনই আবার নতুন করে আক্রমণ করা হচ্ছে। দুই পক্ষই কোনো সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজী না।

এ রকম কঠিন অবস্থার মধ্যে প্রকৃতির আরও কিছু রসিকতা করার ইচ্ছে হলো। ঘুমের মধ্যে এ পাশ ওপাশ করতে কাজলের সশব্দে নসিকা গর্জনের অভিষেক হলো। অহনা ধাক্কা দিয়ে কাজলকে এপাশ থেকে ওপাশ করলে মিনিট পাঁচেকের জন্যে নাক ডাকা বন্ধ থাকে। তার পরে আবার নতুন উদ্যমে আরম্ভ হয়। বেচারা অহনার ঘুম হারাম হয়ে গেল। কি মুশকিল, মানুষ আবার এত জোরে নাক ডাকে ন-কি!

অহনা প্রথমে কয়েক দিন সহ্য করার চেষ্টা করল। ভাবল তুলির মতো অভ্যাস হয়ে যাবে। তুলি একবার গল্প করেছিল, তার স্বামীও একবার হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে নাক ডাকা আরম্ভ করেছিল। কয়েক দিন সমস্যা হলেও তুলির এখন নাক ডাকার শব্দ শুনতে ভালোই লাগে। কেমন একটা ঘুম পাড়ানির গানের মতো মনে হয়। কিন্তু অহনার বেলায় হলো ঠিক উল্টো। রাতের ঘুমটা হারাম হয়ে গেল।

অনেকটা বাধ্য হয়ে, অহনা বেশ মিষ্টি করে বলল, “তুমি কি একটু ডাক্তার চাচার সাথে দেখা করতে পারো?” কথাটা শুনে কাজল ভাবলো নিশ্চয়ই অহনার কোনো সমস্যা হয়েছে। দুর্বল প্রতিপক্ষের সাথে তো আর যুদ্ধ চলে না। মনে মনেই ‘সিস ফায়ার’ মানে ঘোষণা করল। এখন থেকে যুদ্ধ বিরতি মানে যুদ্ধ একেবারে বন্ধ। জানতে চাইলো, “কেনো, কেনো ডাক্তার চাচাকে কি বলতে হবে?”

অহনা খুব নরম করে বলল, “উনাকে বলো তুমি ঘুমালে ভীষণ নাক ডাকছ। সেই কারণে আমি আমি ঘুমাতে পারছি না। এর জন্যে তোমাকে ভালো একটা ওষুধ দিতে।” কাজল ধরে নিলো তাকে হেয় করার জন্যে প্রতিপক্ষ নতুন একটা কুট- কৌশল প্রয়োগ করছে। বেশ বিরক্ত গলায় উত্তর দিলো, “আমি নাক ডাকি আর আমি জানি না। আর উনি পাশে শুয়ে ঘুমাতে পারেন না। এর থেকে আজব কথা পৃথিবীর আর কেউ আগে শুনেনি।” কাজল ‘সিস ফায়ার’ উঠিয়ে নিয়ে একটা নোংরা ধরনের বাক্য অস্ত্র প্রয়োগ করল, “স্বপ্ন দেখার মাত্রা কিছুটা কমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল্পনিক নাক ডাকার শব্দ ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ হবে না।”

পরের দিনের ঘটনা বিজ্ঞানের সুফল ও কুফল একবারে প্রমাণ করে দিলো। ওই দিন রাতেই অহনা মোবাইল ফোনের ভিডিও অপশনে যেয়ে কাজলের নাক ডাকা রেকর্ড করলো। সকালে কাজলকে ভিডিও দেখাল। কাজল দেখে কিছু বলল না, কিছু একটা একটা চিন্তা করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বুঝল সে অহনার কাছে ঘায়েল হয়েছে। বক্সিং খেলায় চিৎপটাং হয়ে নক আউট হয়ে যাবার দশা আর কি।

রাতে কাজল বালিশ, কাঁথা নিয়ে বসার ঘরে সোফায় যেয়ে ঘুমালো।

অহনা প্রথমে এক হাত নিতে পারাতে খুশীই হলো। যাক বাবা অনেক দিন পরে একটু আরাম করে ঘুমান যাবে। আর যাই হোক এতো শব্দের তার ঘুমান সম্ভব না। এই সব ভাবতে ভাবতে আসলেও অহনা ঘুমিয়ে পড়ল। আহ কি আরাম। পৃথিবীতে ঘুমের থেকে প্রশান্তির জিনিষ কি আর কিছু আছে?

স্বপ্নের মধ্যে মনে হতে থাকলো যে ভীষণ নাক চুলকানোর মতো কিছু একটা দেখছে। একটু পরে মনে হলো নাকটা মনে হয় আসলেই চুলকাচ্ছে। চোখ খুলে বুঝার চেষ্টার করতে লাগল স্বপ্নের নাক চুলকানি কেন বাস্তব মনে হচ্ছে। কিন্তু চিন্তাটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। আরম্ভ হলো হাচ্চু, হাচ্ছু, হাচ্ছু। এক, দুই, তিন,............একুশ, বাইশ......তেত্রিশ। শুধু নাক না, গলা, চোখ সব চুলকাচ্ছে। বুঝল এলার্জি এ্যাটাক। বিয়ের পরে এই প্রথম। পৃথিবীর কোন ওষুধ এখন কাজ করবে না।

কাজল পাশের ঘর থেকে ছুটে আসলো। ভয় পেয়ে গেল। যুদ্ধের সব কথা ভুলে যেয়ে মানবতা এসে মনে ঠায় নিলো। চল, চল তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। অহনা হাচ্চুর ফাঁকে ফাঁকে জানাল, “একটু... পরে... কমে... আসবে.........।”

পরের দিন নাস্তার টেবিলে অহনা কাজলকে তার এলার্জি এ্যাটাকের বৃত্তান্ত জানাল। এই সমস্যাটা না বলে কয়েই আসে। বেশ কয়েক বছর আসেনি। কিন্তু একবার আসলে কিছুক্ষণ খুব যন্ত্রণার মধ্যে রাখে। কাজল ভাবল কালকের ঘটনার প্রতিশোধ এত অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটে গেল! ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন মনে হল। বুকের ছাতিটা ফুলিয়ে বলল, “আমার নাক ডাকার শব্দে একটা মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়েছিল। আর তোমার হাচ্ছুর শব্দে পুরো পাড়ার মানুষ ঘুম থেকে উঠে বসে ছিল।” দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম বলে ওপেনিং ব্যাটসম্যানকে বোল্ড আউট করার মহা প্রসাদ পেল। আহ, কি আনন্দ! প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করা গেল।

কাজল বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। এই বুঝি অহনা বের হয়ে এলো। মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা কাজ করছে। এক সময়কার লাস্যময়ী অহনা আর তার সাথে হাসি মুখে কথা বলে না। তার সব কিছুতেই মহা বিরক্তি। এখন দু জন দুই ঘরে শোয়। এটা কি কিসের দাম্পত্য জীবন? একটু নরম শরীরের ছোঁয়া ছাড়া কি ঘুমানো যায়? কিন্তু অহনা যখন ওই সবের কোন মর্যাদা দেয় না, তখন আবার কিসের কি?

ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করে উঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো মেয়েটার এতো সময় লাগছে কেন। অবাক কাণ্ড। অহনার কানের মধ্যে হেড ফোন দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছে। কি অদ্ভুত ওর না চলে যাবার কথা। দেখা যাক আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।

পরের বার যেয়ে দেখা একই অবস্থা। অহনা একেবারে বইয়ের মধ্যে ঢুকে আছে। মাঝে মাঝে আবার মুচকি মুচকি হাসছে। হয়তো হাসির কোনো গল্প। কাজল যেয়ে অহনার পিঠে টোকা মেরে হাতের ইশারায় বলল, “কি ব্যাপার, তোমার চলে যাবার কি হলো?”

অহনা একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কানের

হেড ফোন খুলে বইটা পাশে রেখে কাজলের দিকে তাকাল। সেই-ই দৃষ্টি, একেবারে সেই দৃষ্টি। আগে যখন ওরা প্রেম করতো, তখন কোন কারণে যদি এক দিন দেখা না হয়েছে তখন অহনা এক বুক কষ্ট চোখের মধ্যে নিয়ে তাকাতো; সেই দৃষ্টি। অহনা সেই অপলক দৃষ্টির মধ্যেকত লক্ষ কথাই না লুকিয়ে থাকত, “কোথায় ছিলে, কেমন ছিলে, তোমাকে না দেখে চোখটা শুকিয়ে পাথর আর বুকটা মরুভূমি হয়ে গেছে।” ঠিক সেই আগের মতো কাজলের বুক ছিদ্র হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার পরে মোমের মতো গলে গলে পড়তে লাগল। এখন চাইলেই কাজল এই অপরূপা মেয়েটার জন্যে সুন্দরবন থেকে সবচেয়ে মায়াবী চোখের হরিণ খুঁজে নিয়ে আসতে পারে। ও বললেই এভারেস্টের চূড়ায় যেয়ে এক মুঠো বরফ নিয়ে আসতে পারে। এই মেয়েকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকা একেবারে অসম্ভব। মেয়েটা না থাকলে সে একেবারে সাহারা মরুভুমি হয়ে যাবে; শুকিয়ে কাঠ হয়ে মরেই যাবে।

কাজলের অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। অহনা কাজলের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল, “তোমার পাশের সোফায় গত তিন রাত একটা সুন্দরী মেয়ে যে ঘুমায়, তা কি তুমি জানো?” আসলে অহনা গত কয় রাত কাজল ঘুমিয়ে যাবার পরে পাশের সোফায় যেয়ে শোয়, আবার সকালে কাজলের উঠার আগে বিছানায় ফিরে আসে। অহনা বলতে লাগলো, “তোমার নাক ডাকার শব্দ, এখন আমার তুলির মতো, ঘুম পাড়ানির গান মনে হয়। তুমি আজকে থেকে আমার সাথে বিছানায় ঘুমাবে।”

সাথে সাথেই অহনার সব কিছু-ই কাজলের কাছে মিষ্টি মনে হতে লাগল। এ যে চিনির থেকে বেশী মিষ্টি, গুড়ের থেকে বেশী মিষ্টি, মধুর থেকে বেশী মিষ্টি। এই মিষ্টিতে কোন ক্লান্তি নাই। এ যে একেবারের অন্য রকম মিষ্টি। যে এ মিষ্টির সাধ এক বার পেয়েছে, সে-ই শুধু জানে এ কি রকম মিষ্টি!

পারিবারিক তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ অনির্দিষ্ট কালের জন্যে মুলতুবী হয়ে গেল।