বড় গোল একটা লাল টিপ  

টমাস  ইসলাম। প্রবাসী বাঙালির ফ্যাশন করা কোনো নাম না। বাঙালি বাবা আর শ্বেতাঙ্গিনী মায়ের উনিশ বছরের টগ বগে ছেলে   টমাস। বাবার শেষ আর মায়ের দেওয়া প্রথম নাম নিয়ে, তার পুরো নাম হয়েছিল, টমাস  ইসলাম।

টমাসের ডাক নাম টম। হাই স্কুল (১২ বছর)  শেষ করে ইউনিভারসিটি ভর্তি হয়েছে। পড়ালেখায় আহামরি কিছু না হলেও কখনো ঠেকে থাকে নি।এখন তার লক্ষ্য কোনো রকমে চার বছরের  ইউনিভারসিটি শেষ করে ফেলাটা। আসলে তার এতদূর পড়া লেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সে তার মা মেরীকে কথা দিয়েছিল।

নুরুল ইসলাম ননী টমের বাবা। ঢাকা শহরে জন্ম। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা একটা আধা সরকারী প্রতিষ্টানের মহা ব্যাপস্তাপক  ছিলেন। টাকা পয়সার সমস্যা ছিল না। খুবই শখ ছিল ছেলেও তার মত ইনজিনিয়ার হবে। কিন্তু বিধি বাম। ছেলে বুয়েটে   চান্সই পেল না।

খুবই অপমানিত বোধ করলেন নুরুল ইসলামের বাবা। কি বলবেন , তার সহকর্মী, বন্ধু - বান্ধব আর আত্তীয় স্বজনদের। তিনি সবাইকে বললেন, ছেলে ইনজিনিয়ারিং পড়তে এমেরিকা যাবে।

গোছানো মানুষ হিসেবে সুনাম ছিল বাবার। যোগাযোগ করলেন প্রবাসী বন্ধুদের সাথে।অল্প সময়ের  মধ্যে টোফেল পরীক্ষা দেওয়া, ভর্তি হওয়া আর এমেরিকা ভিসা নেয়া ---যাবতীয় সব কাজ হয়ে গেল।

 ২

এয়ারপোর্টে বিদায় জনাতে এলো বাবা, মা , আত্তীয় স্বজন আর বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব। মুখে বিষাদের ছায়া থাকলেও, সবাই কথা বলছিলো ননীর উজ্জল সুখকর  ভবিষ্যত নিয়ে ।

 ননী ইমিগ্রেশন এলাকা যখন ছাড়িয়ে যাচ্ছিল , তখন শেষ বারের মত ঘুরে তাকালো । বাবা মা গর্বিত আর ভারাক্রান্ত মুখ দুটো  দেখল। অন্যরা সবাই এয়ারপোর্টের দরজা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল। বাবা- মা বিশেষ পাসের ব্যবস্তা করে ভিতরে  ঢুকেছিলেন। ননীর দৃষ্টি বাবা মা ছাড়িয়ে এক কোনায় যেয়ে থমকিয়ে  দাড়ালো।

 আকাশী নীল  শাড়ি পরা চুমকি। কপালে বড়  গোল একটা টিপ। চোখ দুটো তার দিকে। কিন্তু দৃষ্টির গভীরতা আরো অনেক বড়, বিশাল। তার বুক  ছেদ হয়ে যাচ্ছে । অতীত , বর্তমান , ভবিষ্যত বিলীন হচ্ছে একটা বিন্দুতে। চুমকি যেন সেই বিন্দুকেই দেখছে।

 ননীর একবার মনে হলো, ছুটে ফিরে যেতে চুমকির  কাছে। কিন্তু না। যে দরজা দিয়ে সে একবার  ফেলে এসেছে , সেখানকার রাস্তা তো শুধু এক দিকেই যায়। কিন্তু চুমকির তো এখানে থাকার কথা না। তাও আবার কপালে সেই টিপ।

 ৩ 

চুমকির সাথে পরিচয়টা বেশ নাটকীয়। চুমকিরা ননীদের বাসায় ভাড়া থাকত । তারা  খুলনা থেকে মুভ হয়ে এসেছিল । দু তলা বাসার উপর তলায় থাকত ননীরা আর নিচের তলায় চুমকিরা । বাসার ছাদে প্রথম দিন চোখা চোখি, পরের দিন নাম জানা জানি আর কিছু কথা। পরের সপ্তায় চুমকি ননীদের স্কুলে ভর্তী হল।

একই স্কুলের একই ক্লাসের দু জন হওয়াতে ভালো লাগা লাগি হয়ে গেল দু সপ্তাহের মাথায় । প্রস্তাবটা ননীর থেকেই আসল।  চুমকি সম্মতি দিল আরো তিন দিন পরে। এর পর এক জন আরেক জনকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারত না । প্রায় প্রতি রাতেই দু জন একসাথে আকশের তারা দেখত। চুমকির অনেক  তারা চেনা ছিল। সে সব গুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ননীর । এর পরে দু জনের ভালো লাগারর একটা বড় বিষয় ছিল রাতের তারা। চুমকি বলত আমাদের খারাপ দিনে আমরা রাতের আকাশের তারা দেখে কাটাব। তারা আমাদের শক্তি দিবে।

চুমকিরা ননীদের বাসায় ভাড়া ছিল প্রায় আড়াই  বছর। ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে চুমকিরা  বাসা কিনে পাশের পাড়ায় চলে যায়। কিন্তু এর পরেও সম্পর্কের কোনো ভাটা পরে নি। দেখা যোগযোগ চলল একেবারে নিয়মিত ভাবে।

দিনটা ছিল পয়লা বৈশাখ । তখনও তারা একই বাসায় থাকে। আগের দিন চুমকি ননীকে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, এতে একটা পাঞ্জাবী আছে। কালকে ভোরে এটা পরে আসবে। একসাথে রমনায় যাব।

সবুজ পাঞ্জাবী পরে ননী রাস্তার ওপারে চুমকির জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু দেরী হয়ে যাচ্ছিল। অস্তিরতা হছিল । দেখল চুমকির মত দেখতে একজন অপরূপ সুন্দরী হেটে আসছে তার দিকে। পরনে সাদা শাড়ী, লাল পার। কপালে বিশাল বড় একটা লাল টিপ। ননীর চোখটা পাথর আর বুকটা ছিদ্র হয়ে গেল। এর আগে চুমকিকে সে এমন সাজে কখনো দেখেনি। চুমকি এসে নির্ধিধায় ননীর হাত ধরল। দু জন একটা রিক্সা নিয়ে রমনা গেল।

চুমকির শরীরের ছোয়ায়  অন্য ধরনের আমেজ দিল। সাহস করে বলল, তোমাকে ভীষন ভালো লাগছে। তোমার ছোয়া, তোমার সাজ আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।  সব চেয়ে বেশী চোখ কাড়ছে তোমার কপালের টিপ । তোমার কপালের টিপ আমাদের দিনের তারা ।  তার পরে ননীর মানসলোকে সব সময় থাকতো চুমকির কপালের বড় গোল টিপ । চুমকি বিষয়টা খুব উপভোগ করত। কপালে বড় টিপ তার একটা অঙ্গই হয়ে যায়। প্রতিদিনই সে কপালে বড় একটা টিপ দিত।

কিন্তু তাদের সম্পর্কের পরিনতি তাদের চাওয়া অনুযায়ী  হলো না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর-পরই চুমকির বিয়ে হয়ে গেল। আরো দশ বছরের বড় এমন একজনের সাথে। ননীর  হয়ত করার কিছু ছিল না। তার সেই সময়ে চুমকিকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করার মত ক্ষমতা, সাহস --কোনটাই ছিল না। যদিও  চুমকি তাই অনুরোধ করেছিল।

ননী চুমকিকে না পেলেও, বেশ অনেক দিন প্রতিটা মুহূর্ত তাকে নিয়ে ভাবত। চোখে স্পষ্ট দেখতে পেত চুমকির কপালের বড় গোল টিপ। অবশ্য বিয়ের দিন চুমকি ননীকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। লেখা ছিল সে আর কপালে টিপ দিবে না। 

এমেরিকার ওকলাহোমা শহরে ইউনিভারসিটিতে ভর্তী হয়ে এলো ননী । প্রথম সেমেস্টার বেশ সুন্দর কাটল। দু একদিন পর পর বাবা মার ফোন কল আসতো। তাদের গলায় থাকত উৎকন্টা আর ননীকে নিয়ে গর্বের সব কথা। বাবা সব খরচ পাঠাতেন । ক্লাস, পড়া লেখা, আর ডর্ম (হোস্টেল) নিয়ে সময় কাটল। কিন্তু একটা বিশেষ ঘটনাও ঘটল।

মেথস -১ ক্লাসে পরিচয় হলো মেরি জোন্সের সাথে। হাসি খুশী আর অনর্গল কথা বলার মানুষ মেরি কিছু দিনের মধ্যে ননীর মন জয় করে নিল। মেরির ননীর সব কথা জানা হয়ে গেল। বাবাকে খুশি করার জন্যে আমেরিকা আসা থেকে আরম্ভ করে চুমকির কথা পর্যন্ত। ননীও জানলো মেরির সংগ্রামের জীবনের কথা।  

মেরির মায়ের বয়স যখন পনের, তখন তার জন্ম। তার বাবা ছিল মায়ের হাই স্কুল সুইট হার্ট। কখনো বাবাকে দেখে নি। নানা নানির কাছে বড় হয়েছে। এখন নিজে একাই একটা এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকে। সপ্তাহে পচিশ ঘন্টা কাজ করে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে। সাথে কিছু সরকারী ঋণ নিয়েছে। চলে যাচ্ছে  মোটা মুটি।

 ননী খুবই অবাক হয় শুনে, যে তার নানা নানী তাকে কঠিন ক্যাথলিক ক্রিস্টান হিসেবে বড় করেছে। মেয়েকে যে শিক্ষা তারা  দিতে পারেননি , নাতনিকে তার পুরোটাই দিয়েছেন। সে মদ খায় না, এমনকি এখনো মেরির কোনো ছেলে বন্ধু নাই। প্রায় এক শ মাইল দুরে ছোট একটা শহরে তারা থাকে। প্রতি দিন ফোন করে বলে ধর্ম মেনে চলতে। বড় শহরের নিয়ম কানুনে গা ভাসিয়ে না দিতে।

ননীর অবাক হওয়ার সীমা পরিসীমা থাকে না। একজন আমেরিকার মেয়ের মধ্যে  খুঁজে পায় তার হারানো কাউকে। কল্পনায় মেরিকে শাড়ী পড়ায় আর কপালে দেয় বড় একটা গোল টিপ।

একদিন খবর আসে বাবার চাকরী চলে গেছে। সামরিক সরকার নতুন একজনকে বসিয়েছে তার পদে । আর বাবার নামে দিয়েছে নানা ধরনের মামলা । অল্প কিছু দিনের মধ্যে দেশের থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেল । মেরি ননীর একটা কাজের ব্যবস্থা  করে দিল । কিন্তু তার পরেও সুবিধা করা গেল না খরচের র দিক থেকে। ননী অনেকটা বাধ্য হয়ে মেরির কাছে যেয়ে উঠল।

ননী পড়া ছেড়ে দিয়ে ফুল টাইম কাজ আরম্ভ করলো। মেরির গর্ভে  তখন  ননীর সন্তান,   টম। মেরিকেও  কাজ , লেখা পড়া ছেড়ে দিতে হলো। তার প্রেগনেনসিতে বড় ধরনের একটা সমস্যা ধরা  পরলো।  ডাক্তার বেড রেস্টে থাকতে বলে দিলো।  ননীও মেরিকে জানালো বাসায় থাকর জন্যে। 

 কিভাবে যেন খবর পৌছে যায়  বাবা মার কানে। ছেলে সাদা মেয়ের সাথে থাকে, বিয়ে করেনি আর বাচ্চা হচ্ছে। তাদের নাতি । বাবা সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে চিটাগং যাবার পথে তাদের গাড়ি ঢাকা-আরিচা রাস্তার খাদে পড়ে। হাসপাতালে নেয়ার পথে দু জনই মারা যান।

ঘটনার প্রায় মাস খানেক পরে ননীর  কাছে খবর পৌছায়। তার যোগাযোগের  ঠিকানা  আর কারোর কাছে ছিল না । তাদের পাড়ার এক ছেলে থাকত ক্যানসাসে। সেই ননীকে খুঁজে বের করে খবর দেয়।

ননীকে স্বাভাবিক করার অনেক চেষ্টাই মেরি করে। কিন্তু না , ননীর পৃথিবীর সব ব্যাপার থেকে আগ্রহ উঠে যায়। কাজ ছাড়া বাকি সময়টা বীয়ারেরে বোতলে চুমুক দিয়ে সময় কাটাত।

 ৫

 মায়ের গায়ের রং আর বাবার চেহারা পেল টম। ননী পুরোটা সময়ই ছিল বাচ্চা প্রসবের সময়। মেরির কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল। কিন্তু তার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছিল মায়ের কথা ভেবে। একদিন তো তার মাকেও হয় তো এর থেকে বেশি ভুগতে হয়েছিল । ননী শুনেছে তার জন্ম হয়েছিল গ্রামের বাসায়, এক দাইমার হাতে। মেরির পাশে ডাক্তার , নার্সের ছড়া ছড়ি। মা কোনো ব্যথার ওষুধ পাননি । মা নাতি হওয়ার খবর শুনলে কতনা খুশি হতেন। সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছিল, মায়ের তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার গল্প। লাল শাড়ী পড়িয়ে রাঙ্গা বউ আনবেন। ফুটফুটে নাতনি হবে। আরো অনেক কিছু ।

না আজ মা নাই । নিজের প্রথম ছেলের জন্ম । উল্লাস করে খবর দেয়ার মত কাউকে পেল না। কাজে ফোন করে বলল আগামী তিন দিন সে যাবে না। ভাবলো সময়টা মেরির সাথেই কাটাবে।  দিনের অর্ধেকটা তাই করলো। মেরিকে বিভিন্নভাবে অঙ্গীকার করলো নিজেকে পরিবর্তন করার। একজন আদর্শ বাবা হওয়ার। মেরি কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকলো।

বীয়ারের  নেশা আসল। মেরিকে বলল ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরবে।  বীয়ারের বোতলে চুমুক দেয় মাত্র সব যেন কেমন হয়ে গেল। মনে হলে তার কেউ নাই, সেও কারো না। ছোট টমের চেহারা মনে করার চেষ্ট করলো। তার  নিজের প্রতিরূপ মনে হল, কিন্তু  তার কাছে ছুটে  গেল না। মেরির নিষ্পাপ মুখটা ভেসে উঠলো, তবুও আকর্ষণ আসল না। ভাবলো ননী, সে এখানে কি করছে। বাবা মা তাকে নিয়ে স্বপ্ম দেখত। তারা আজ নেই। তারা কি মারা যাবার আগে তাকে নিয়ে খুব বেশী অপমানিত, লজ্জিত ছিলেন। ওদের মৃত্যুর জন্যে কি ননীর অবদান আছে। বাবা কি তার কথা চিন্তা করে গাড়ি চালানার সময় অসতর্ক হয়েছিলেন। নাকি চাকরী হারানো মানতে পারছিলেন না। নানা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুর পাক করতে থাকলো। 

 নুরুল ইসলাম ননীর আর সংসার জীবনে ফেরা হলো না। শুধু একটা দায়িত্ব পালন করে চলল। আয়। ভালো কাজের জন্যে উন্নতি হল বেশ তাড়াতাড়ি। আয়ও বাড়লো একই তালে। অবশ্য চাকরি হারাতে হয়েছিল তিন বার। প্রতি বারই ৩-৪ মাসের মধ্যে চাকরি হয়ে যায়। এই তিন বারই ননীর লে অফের প্রথম মাসেই মেরি চাকরী আরম্ভ করেছিল। ননীর চাকরি হওয়ার সাথে সাথেই সে আবার আগের জীবনে ফিরে গিয়েছে। ছেলে আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

মেরির এমেরিকাতে জন্ম হলেও, নানা নানির শিক্ষা থেকে কখনো দূরে যায় নি। চার্চে যাওয়া, বাইবেল পড়া এসবে টমকে অভ্যস্ত করেছে। প্রতিটা কাজে ননীকে যুক্ত করতে চেয়েছে। উদাসীন ননী কোনো কিছুতেই আগ্রহ পায়নি। টমের জন্মের মাস খানের পরে মেরি টমকে নিয়ে গেল ব্যাপটাইজ করাতে। ননী বলল ওটা আবার কি। তার সময় নেই এসব কাজে যাওয়ার। রোববারে যখন মেরি টমকে নিয়ে চার্চে যেত, ননী আগের রাতের নেশার ঘোরে তখন অচেতন । বাসায় যখন ক্রিস্টমাস ট্রী এলো, ননীর চোখে সেটা পড়লই না।

ননী আর মেরির জন্ম পৃথিবীর দু প্রান্তে।  কিন্তু যেন একজন আরেকজনের দেশের, সংস্কৃতি নিয়ম পালন করছে। ননী পশ্চিমের আনন্দ ফুর্তিতে গা  ভাসিয়ে জীবের অর্থ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করতে থাকলো। অন্য দিকে মেরি মদ,পার্টির কাছেই যেত না। পোশাক , আচার আচরণে ছিল একেবারে  রক্ষনশীল। পায়ের নিচের দিকটা দেখা যাবে এমন স্কার্ট পর্যন্তও পরতো না । 

মেরি কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। ক্যাথলিক ক্রিস্টিয়ান শিক্ষায় বিশ্বাসীরা  ডিভোর্স নিয়ে ভাবতে পারে না। ননীর সাথের অসহনীয় জীবন ভাগ্যের লিখন হিসাবে মেনে নিয়েছে। একজন আদর্শ গৃহ বধু , মা হিসেবে নিজের দায়িত্ব নিখুত ভাবে পালন করার চেষ্টা করে এসেছে।

 ৬

মেরির ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে টমের বয়স তখন ১৪। এক বছরের মধ্যেই মেরি মারা যায়। অসুখটা ধরা পড়ার পরে মেরি ননীর সাথে কিছু  কথা বলে যা ননীকে মেরি, টম আর সংসারের জগতে ফিরিয়ে আনে। মেরি বলে, তুমি যেই কারনেই হোক আমাকে তোমার স্ত্রী  হিসাবে মেনে নিতে পার নি  হয়ত তোমার মনে ছিল সেই গোল লাল টিপ দেয়া মেয়েটি । আমি সারা জীবন তোমার মন পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করেছি। তোমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধে যা ঠিক, তাই করেছি । যদিও তোমাদের অনেক কিছুই আমার ক্যাথলিক নিয়ম কানুনের সাথে মিলে গিয়েছে। বাংলাদেশ আর ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে । মদ খাই নি, কোনো পুরুষের কাছে যায়নি। কিন্তু  সৃষ্টিকর্তা আমার কপালে তোমাকে জয় করার সুখ লিখেননি । যাই হোক, আমি যদি তোমাকে কোনো দুঃখ দিয়ে থাকি, মাফ করে দিও। শুধু একটা কথা দাও,টমকে তুমি দেখে রাখবে। ওর শরীরে তোমার রক্ত বইছে ।

মায়ের অসুস্হতা সাথে সাথে টম বদলাতে  থাকলো । মা তাকে আর আগের মত আগলে রাখতে পারে না । ননী  একদিন দেখল ছেলে বাসায় মেয়ে বন্ধু আর বীয়ার এনেছে। প্রতিবাদ  করতে পারল না । হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা  মেরিকেও এসব বলা হলো না । কিন্তু মেরি, মারা যাবার এক দিন আগে টমকে ডেকে বলল, তুমি আমাকে প্রোমিস কর তুমি পড়ালেখা শেষ করবে আর মেয়েদেরকে কখনো অপমান করবে না। 

 ৭

মেরির মৃত্যুর দিন ননীর মনে হলো অনেক দিন রাতের আকাশ দেখা হয় না। অন্ধকার হওয়ার পরে আকাশের দিকে তাকালো । কি আশ্চর্য্য, আমেরিকার আকাশ আর বাংলাদেশের আকাশ তো একেবারেই একই রকম। তার চেনা  তারা গুলো ঠিক বাংলাদেশের মতই একই জায়গা থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা হলে এতদিন তারাগুলো তাকে এতদিন দেখে রেখেছে । কিন্তু সে তো একবারও তারা গুলোর দিকে মাথা তুলে তাকায়নি। একবার চুমকি বলেছিল  খারাপ দিনে তাদের শক্তি আসবে তারা দেখে। সাথে সাথে মনে হলো চুমকির কথা। দিনের তারার মতই একটা ব্যাপার ছিল চুমকির কপালের বড় গোল টিপ।

এর পর ননী মদের বোতলে হাত দেয়নি। টম খুব একটা কথা বলে না। বাবা আর নানী এক সময় যে জীবন কাটিয়েছে , তাতেই গা ভাসিয়ে দেয় । ননী কথা বলে , প্রতিবাদ করে। একবার খুব উত্তেজনাও তৈরী হয় । টম সরসারি বলে, এ ব্যাপারে কথা বলার অধিকার তোমার নেই। তাছাড়া মায়ের আজীবন অপমানের শোধ সে নিচ্ছে  এইভাবে। বাবার সমস্যা থাকলে সে এখনি বাড়ি ছেড়ে চলে রাজি।

 ননীর  বাঙালী মন নিজের ছেলেকে বাসায় রাখতে চায়। ছেলের মাকে যে অপমান , অবজ্ঞা করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। ছেলেকে একজন আদর্শ মানুষ করতে চায়। টম বাবাকে আপন মনে করে না।  সব কিছুতেই  তার সন্দেহ। ননী নিজের কাছেই পণ করে, বাকি জীবন এই ছেলেকে খুশি করার জন্যে কাটিয়ে দিবে।

 সব লজ্জা , অপমান, গ্লানি নীরবে সহ্য করে যায় ননী। রাতের আকাশের তারা আর বড় গোল টিপের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করে।  মনে করে  রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট বেলায় পড়া কবিতা,  “আমাদের গেছে যে দিন , একেবারে কি গেছে ? কিছুই কি নাই বাকী ? ........রাতের সব তারারা থাকে দিনের আলোর গভীরে “   নিজে নিজেকে শোনায়। একবার মা বলেছিল মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে মিটি মিটি জ্বলে। তা হলে বাবা , মা , মেরি কি এখন আকাশের তারা ? চুমকি , সেও তো ননীর কাছ থেকে হারিয়ে গেছে । তাও এক ধরনের মৃত্যু । চুমকিও নিশ্চয়ই আকাশের অন্য কোনো এক তারা। এরা সবাই তার সাথে প্রতিনীয়ত কথা বলছে। সে কখনোই একা না। তার সবাই আছে । বলছে আমদের সুখী করতে হলে, তোমাকে জয়ী হতেই হবে।

প্রায় বছর দু এক পড়ে, সরাসরি কথা বলে ছেলের সাথে। বললো, বাবা যদি ভুল   করে , ছেলেকে একই কাজ করে তার প্রতিশোধ নিতে হবে, তার কোনো যুক্তি নাই। পৃথিবীটা অনেক বড়। ভালো হয়ে ভালো কাজ করে , সবার মুখ উচু করা যায়। নিজের আর অন্যদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করা যায়। তাতেই মা ওই পার থেকে সুখী হতে পারে।  প্রথমে কোনো উত্তর না  দিলেও , কয়েকদিন দিন পরে টম বাবাকে বলে, সেও একটা সুস্থ জীবন চায়।  বাবাকে আর নিজের যথেষ্ট শাস্তি এর মধ্যে হয়েছে। মায়ের শেষ অনুরোধ তাকে রক্ষা করতে হবেই। সে একজন ডাক্তার হবে ।    

ননী আর টম মেরির কবরের পাস থেকে ফিরছে। টম আজ পুরোপুরি ডাক্তার । দু জনের সম্পর্ক এখন ভালো। এক জন আরেক জনকে বুঝতে পেরেছে। টম কিছুদিনের মধ্যে একটা বাঙালী মেয়ে বিয়ে করবে। সে নিজে তাকে খুঁজে বের করেছে। মেয়েটা বাংলাদেশ থেকে পড়তে এসেছে। আগামী বছর সেও ডাক্তারি পড়া শেষ করবে। পুরো  ডাক্তার হতে আরো বছর তিনেক লাগবে।  গত কাল ননীর  সাথে দেখা করতে এসেছিল। পরনে ছিল আকাশী নীল  শাড়ি আর কপালে বড় গোল লাল একটা টিপ।

www.lekhalekhi.net