দোয়ার বরকত

মোনাজাত শব্দের বাংলা অর্থ হতে পারে “একান্তে কথা বলা”। যারা মুসলমান ধর্মের অনুসারী তাদের কাছে, মোনাজাত শব্দটার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। মুসলমানরা মোনাজাতের মাধ্যমে পরম করুণাময় আল্লাহ তা’ আলার কাছে প্রার্থনা করেন, অনুগ্রহ ভিক্ষা করেন। এর সাথে সাথে আরেকটা শব্দ চলে আসে, তা হলো “দোয়া।” আল্লাহ তালার কাছে শর্ত-হীনভাবে নিজেকে সমর্পণ করে, কিছু চাওয়াটা হলো আমাদের চলতি কথায় দোয়া। মুসলমানরা মহান আল্লাহ’র কাছে মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া চায় কিংবা তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। আসুন আমরা আজকে দোয়া সম্পর্কে জরুরী কিছু বিষয় জানার চেষ্টা করি, ইনশা আল্লাহ।

আমারা আল্লাহ তা আলা'র কাছে কি- না চাই! ইহকালে সুখ শান্তি এবং পরকালে যাতে জান্নাতে যেতে পারি, তার জন্যে আমরা মোনাজাত করি, দোয়া করি। ইদানীং কালে যুক্ত হয়েছে পরম করুণাময় যাতে আমাদের করোনা ভাইরাসের গজব থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ সুবহান আ তা আলা কুরআন শরিফে বলেছেন, “আমার কাছে চাও, আমি তোমার (প্রার্থনার) উত্তর দিবো।”(সুরা গাফির -৪০: ৬) আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, তোমার যদি কিছু চাওয়ার থাকে, তবে আল্লাহ’র কাছ থেকে চাও, আর যদি তোমার সাহায্যের দরকার হয়, সেটাও আল্লাহ’র কাছ থেকে চাও। (তিরমিজি শরিফে মুহম্মদ ইবনে ইসা’র বর্ণনা)

জীবন প্রবাহের মধ্যে আমাদের অসংখ্য সমস্যা, অভাব ও প্রয়োজন হয়। পরীক্ষায় পাশ, চাকরিতে প্রমোশন, রোগ থেকে মুক্তি আরও কত কী! যদি প্রশ্ন করা হয়, আমরা কার কাছে, আমাদের সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যে আর্জি করতে পারি, আমাদের সাহায্যের জন্যে হাত পাততে পারি। আল্লার নির্দেশ মোতাবেক, আমরা একমাত্র তার কাছেই হাত তুলতে পারি। নবী করিম (দঃ) বলে গেছেন, মুসলমানরা একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহ’র কাছে হাত তুলবে। এর ব্যতিক্রম করার অনুমতি নাই।

পরম করুণাময় প্রতিটা দোয়া মঞ্জুরের কথা বলেছেন। তবে হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ’র কাছে হাত তোলার আগে নিজেকে খাঁটি করার প্রয়োজন আছে। আল্লার’র নির্দেশিত ও আমাদের রসুল (দঃ) প্রদর্শিত পথে থেকেই, আল্লার কাছে কোন কিছুর জন্যে প্রার্থনা করা উচিত। তবে এমনভাবে আল্লাহ’র কাছে চাইতে হবে, যাতে সেখানে কোন দোদুল্যমানতা না থাকে। একেবারে পূর্ণ ১০০% বিশ্বাস থাকলে, আল্লাহ কাউকে নিরাশ করেন না।

আমাদের নবী করিম(দঃ) আরও বলে গেছেন, “সবার দোয়াই আল্লাহ মঞ্জুর করবেন, কিন্তু সে ফল পাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা যাবে না; এবং বলতে পারবে না, আমি দোয়া চেয়েছি, কিন্তু কোন ফলাফল পাচ্ছি না।”(বুখারি শরিফ ৫৯৮১, মুসলিম ২৭৩৫) মুসলিম শরিফে আরও বলা আছে, দোয়া অবৈধ দাবী কিংবা পরিবারের সম্পর্কের বিরুদ্ধে না হলে, পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন তা মঞ্জুর করবেন। এ ব্যাপারে সুরা বাকারায় আছে, “আল্লাহ’র সাহায্য ধৈর্য সহকারে চাও।” (২ঃ ৪৫-৪৬) ।

দোয়া পূরণ হওয়ার একটা শর্ত আছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কুরআন শরিফে পরিষ্কার বলা হয়েছে, আল্লাহ কারোর ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে চেষ্টা করে”(সুরা আর রা’দ ১৩: ১১)। মানে তো বুঝতেই পারছেন, শুধু চাকরির জন্যে দোয়া করলেই হবে না, চাকরি পাওয়ার জন্যে একই ভাবে চেষ্টা করতে হবে, কাজ করতে হবে; না হলে চাকরি আপনি পাবেন না। শুধু করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্যে দোয়া করলেই হবে না; সবাইকে নিজের নিজের ক্ষেত্র থেকে নির্দেশাবলী অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।

আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা জানি কম, বুঝি কম, এবং ভবিষ্যতে আমাদের জন্যে কি অপেক্ষা করছে, তার কিছুই জানি না। পরম করুণাময় আল্লাহ তা’ লা মহাজ্ঞানী, তিনি অতীত, বর্তমানের যেমন সব কিছু জানেন; ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে কি হবে, তাও তার জানা। আমরা অধম বান্দা, দোয়া চেয়েই অধীর হয়ে পড়ি। দোয়ার ফলাফল আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম, সেই ভাবে হচ্ছে না বলে ধৈর্যহারা হয়ে যাই। কিন্তু, আমরা তো জানি, মুমিন মুসলমান আল্লাহ’র কাছে হাত পেতে দোয়া চাইলে, তিনি কখনও তাকে নিরাশ করেন না। সুরা বাকারায় আল্লাহ তা আলা জানিয়েছেন, “আমি আমার বান্দার খুব কাছাকাছি। আমি তাদের প্রতিটি প্রার্থনার জবাব দেই।”(২: ১৮৬)

দোয়া সম্পর্কে একটা মতবাদ হলো, তিন ভাবে দোয়া মঞ্জুর হতে পারে। প্রথম, যে বিষয়ে দোয়া চাওয়া হয়েছিল, আল্লাহ তা সরাসরি মঞ্জুর করতে পারেন। দ্বিতীয়, আল্লাহ যেহেতু তার খাস বান্দার সব চেয়ে ভালোটা চান, তাই তিনি যা চাওয়া হয়েছিল, তা না দিয়ে, এর থেকে ভালো কিছু মঞ্জুর করতে পারেন। সর্বশেষে, আমাদের চাওয়া দোয়ার ফলাফল আমরা এই পৃথিবীতে দেখে যেতে না পারলে, আল্লাহ তা আমাদের শেষ বিচারের দিনের জন্যে সঞ্চয় করে রাখতে পারেন। আমাদের কারোর যদি বিচারের দাঁড়ি পাল্লায় নেকির অভাব পড়ে, আল্লাহ তা আলা তখন তার কাছে, আমাদের সঞ্চিত দোয়াগুলোকে নেকি বানিয়ে নেকির পাল্লাকে ভারি করে দিতে পারেন। ইনশা আল্লাহ, তখন আমরা সবাই জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি পাবো।

আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন, আমাদের প্রতি অত্যন্ত সদয়। আমরা বিশাল বড় ভুল করলেও, তওবা বলে মাফ চেয়ে, একই ভুল না করার প্রতিজ্ঞা করলে; তিনি আমাদের ক্ষমা করে দেন। তিনি চাইলে আমাদেরকে, অবাধ্য হওয়ার শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। তিনি গাফুরুর রাহিম, ক্ষমাকারী ও দয়াবান।

আলহামদুল্লি আল্লাহ; সকল প্রশংসা আল্লাহ’র। ইনশা আল্লাহ, আল্লাহ’র পথে চলে, ইবাদত বন্দেগির সাথে সাথে, আমরা সব ব্যাপারেই মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে দোয়া চাইতে পারি। সেটা হতে পারে, নিজের কিংবা চেনা-জানা- অচেনা, যে কারোর জন্যে। যিনি দোয়া যাচ্ছেন, তিনি ইহকাল ও পরকাল—দুই জগতে উপকৃত হচ্ছেন, ফজিলত পাচ্ছেন। তিনি অন্য কারোর জন্যে দোয়া চাইলে, যার জন্যে দোয়া চাওয়া হচ্ছে, তিনি, এবং সাথে সাথে দোয়াকারী নিজেও অশেষ উপকারের ভাগীদার হচ্ছেন।

এখানে একটা কথা যোগ করতে চাই। নামাজের পরে দু হাত তুলে যে দোয়া চাইতে হবে---এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। দোয়া যে কোন সময়ে চাওয়া যেতে পারে। পুরো নামাজটাই বিশেষ করে সুরা ফাতিহাকে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে সরাসরি আর্জি কিংবা দোয়া বলা যেতে পারে।

আসুন, আমরা আল্লাহ’র কাছে দোয়া চাইতে যাতে কোনো দ্বিধা বোধ না করি। আমাদের কাছে যেহেতু সাহায্য পাওয়ার এমন শক্তিশালী, সুন্দর একটা মাধ্যম আছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহারে সব সময়ে সচেষ্ট থাকি। আমরা নির্দ্বিধায় পরম করুণাময়ের কাছে দোয়া করি, “ইয়া আল্লাহ আমরা যাতে করোনা গজব থেকে বের হয়ে আসার উপায় পেয়ে যাই। আপনি সারা পৃথিবীর মানুষের দুর্ভোগ শেষ করে দিন। রাব্বুল আল আমিন আমাদের সেই ক্ষমতা দিন, যেন আমরা ইহকালে আপনার নির্দেশিত রাস্তায় চলতে পারি, আমাদের সকল সমস্যা যাতে সহজ হয়ে যায় এবং আমরা সবাই জান্নাতে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করি।" আমিন