
লেখা কেনো আসে না?
বেশ কিছুটা দিন ধরে আমার লেখা-লেখি বন্ধ। মানে চেষ্টা করেও লেখা বের করতে পারছিলাম না। লেখা-লেখি করছি আজ বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। কিছু পাঠক আছেন যারা নিয়মিতভাবেই আমার লেখা পড়েন। হয়তো পছন্দ করেন বলেই নতুন লেখার জন্যে অপেক্ষা করেন। তাদের কেউ কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন, আমার লেখালেখি বন্ধ কেনো? আসলেও আমিও বুঝতে চাচ্ছিলাম সমস্যাটা কোথায়? কেনো আমার থেকে লেখা বের হচ্ছে না। যেই কাজ করে আমার সব চেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য, সেখানে কি কারণে কাজটা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
প্রসঙ্গটাতে যাওয়ার আগে ছোট একটা ঘটনা বলি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে টেক্সাসের ডালাসে সাইদা (প্রকৃত নাম না) নামের এক ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় হলো। তার জন্ম ভারতে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন মেলা বছর ধরে। তিনি বিভিন্ন জনসেবা মূলক সংগঠনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ইদানীং তার বেশীর সময় কাটে মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশীদের সেবা করে। যারা পত্রিকা পড়েন তারা নিশ্চয়ই জানেন ট্র্যাম্প প্রশাসন এই সব প্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করাটা খুবই কঠিন করে দিয়েছে। তার পরেও ল্যাটিন এমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ শত শত মাইল পায়ে হেঁটে টেক্সাস বর্ডারে ভিড় করছে। সেখানে তাদের ভোগান্তি একেবারে চরমে। তাদের না আছে খাবার, না আছে মাথার উপর ছাদ। সাইদা ও তার সংগঠন মেক্সিকোতে এই সব হতভাগ্যদের খাদ্য ও অস্থায়ী বাস স্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন।
আমার সাথে দেখা হওয়ার কয়েকদিন আগে তিনি তার কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো গিয়েছিলেন। যেয়েই শুনলেন একজন ভারতীয় যুবক সেখানে এসেছে। কিন্তু তার কথা কেউ বুঝতে পারছে না। সাইদা যাতে এখনই যুবকের কাছে যায়। কারণ সে অনবরত কাঁদছে এবং বিলাপ বকছে। সাইদাও (আনুমানিক) ২৫ বছরের যুবকটা যে কি বলছে, তার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তার শরীর ও চেহারা দুই-ই বিধ্বস্ত। সারা গায়ে চাপ চাপ রক্তের দাগ। হয়তো কোনো কারণে আহত হয়েছিল। সাইদা হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ভাষাগুলো দিয়ে এক এক করে চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে সাইদার কোনো কথাই বুঝলো না। ফলে তিনি তেমন কিছু তথ্য বের করতে পারলেন না। অনেক কষ্ট করে উদ্ধার করলেন সে বাংলাদেশের। সাইদা বাংলা বলতে কিংবা বুঝতে পারেন না। তার মনে পড়ে গেল ডালাসে বসবাসরত পরিচিত একজন বাঙালির কথা। উনি সাথে সাথে ডালাসে কল করলেন।
সাইদা একবার যুবকের কানে ফোন দিয়ে, আরেকবার নিজের কানে নিয়ে বঙ্গ সন্তানের সমস্যা বুঝার চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জানলেন যে একদল যুবক বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছিল স্বপ্নের দেশ এমেরিকা আসার জন্যে। বিভিন্ন দালালের হাত ঘুরে পশ্চিম ইউরোপ, রাশিয়া হয়ে দক্ষিণ এমেরিকা মহাদেশের গুয়াতেমালায় এসে পৌঁছায়। তার পরে ওরা রওয়ানা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডারের দিকে। তারা বন-জঙ্গল পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলেছিল। পথে মাফিয়ারা তাদের সব সহায়- সম্বল ও অর্থ কড়ি, পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছিল। শুধু তাই না অন্ধকার ঘরে মেলা দিন আটকে রেখেছিল। এর মধ্যে কয়েকজন সঙ্গী না খেয়ে মারা যায়। আবার কয়েকজনকে মাফিয়ারা পালানোর চেষ্টা করার অপরাধে খুন করে ফেলে। যদিও এই যুবক মাফিয়াদের হাত থেকে পালিয়ে স্বপ্নের দেশের কাছাকাছি চলে আসতে পেরেছে। কিন্তু বর্ডারে এসে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র তার মতো মানুষদের ঢুকতে দিতে চায় না। বাঙালি যুবক বলল, সে খুবই ক্ষুধার্ত। শেষ কে কবে পেট ভরে খেয়েছিল সেটা এখন সে মনে করতে পারছে না। তার এমেরিকা যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা বাকী নাই। এমনকি দেশেও ফিরে যেতে চায় না। এমনকি সে দিন তারিখের হিসেবও গুলিয়ে ফেলেছে। দেশের থেকে কতদিন আগে কবে বের হয়েছে সেটা আর মনে করতে পারে না। সে বেশ কয়েকবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, তার আর বাঁচার একবিন্দুও ইচ্ছা নাই। সে মরতে চায়।
রিও গ্র্যান্ড নদীটা বেশ বড় একটা জায়গা জুড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও এমেরিকাকে বিভক্ত করে রেখেছে। নদীটা তেমন গভীর না হলেও ভীষণ খরস্রোতা। পানিতে কুমিরের কোনো অভাব নাই। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রিজ থেকে লাফ দান। সাঁতরে নদী পার হতে পারলেই চূড়ান্ত গন্তব্য মানে যুক্তরাষ্ট্রের ডাঙ্গায় পৌঁছান যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর থেকে অনেক বেশী সম্ভাবনা পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ার কিংবা কুমিরের পেটে চলে যাবার। কয়েকদিন আগে একটা ছবি সারা পৃথিবীতে ভাইরাল হয়েছিল। মৃত বাবার গেঞ্জির মধ্যে মৃত শিশু কন্যার লাশ। হয়তো বাবা মেয়েকে শরীরের সাথে আটকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সাঁতরে আসার জন্যে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। পরে খরস্রোতা নদী তাদের অন্য দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। নদীটা পাড়ি দিতে যেয়ে জীবনের সব স্বপ্নই শেষ হয়ে গেছে।
নদীটার উপরে দু দেশের মধ্যে একটা ব্রিজ আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দিকে কড়া পাহারা থাকে। প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র না থাকলে সাথে সাথেই ফিরিয়ে দেয়। এই ব্রিজের উপর-ই সাইদা বাঙালি যুবকটাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি অনুবাদকের মাধ্যমে বঙ্গ সন্তানকে জানিয়ে দিলেন তিনি এখন-ই পাশের গ্রামে যেয়ে কিছু খাবার কিনে আনবেন। সে যাতে ঠিক এখানেই অপেক্ষা করে। এর পরে তিনি দেখবেন আর কোনো সাহায্য করা যায় কি-না। সাইদা ছুটলেন কিছু খাবার কিনে আনতে। ফিরে আসতে আসতে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল। সম্ভবত মিনিট চল্লিশেক।
সাইদা ফিরে এসে দেখেন যুবকটা আগের স্থানে নাই। প্রথমে ভাবলেন হয়তো আশে পাশে কোথাও অপেক্ষা করছে। চারিদিকে চোখ বুলালেন। নাহ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছুটে গেলেন ব্রিজের মেক্সিকো প্রান্তে। না সেখানেও তাকে চোখে পড়লো না। চারিদিকে চোখ বুলাতে লাগলেন এবং কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে লাগলেন যাতে তার খোঁজ মিলে। মনের মধ্যে ভীষণ খারাপ একটা চিন্তা কাজ করছিল। সে নদীতে ঝাঁপ দেয় নি তো! আশে পাশের কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলেন কেউ তাকে দেখেছে কি-না। সেখানে এতো মানুষের ভিড় কিন্তু আলাদা করে কিছু বলতে পারলো না। তবে তিনি শুনলেন এই অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকজন নদীতে লাফ দিয়েছে। সাইদা ছুটে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তে। তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। নদীর তীর বরাবর বেশ কিছুটা জায়গা চষে বেড়ালেন। পাওয়া গেল না বঙ্গ সন্তানটাকে। কোনো অলৌকিক কিছু ঘটে না থাকলে সে স্রোতের টানে ভেসে গেছে নয়তো কুমিরের উদরে চলে গেছে। দেশে রেখে আসা প্রিয়তমা মা, স্ত্রী ও পরিবারের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার এইভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বিদেশ বিভুয়ের এক নদীতে।
যারা সচেতন তারা জানেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেমন চরম প্রতিকুল পরিবেশে স্বল্প-শিক্ষিত বাঙালিরা প্রবাসে কাজ করে। তারা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাচীন কালের দাসের মতো রাত-দিন শ্রম দিচ্ছে। তাদের অস্বাস্থ্যকর মানবেতর পরিবেশে থাকতে ও খাওয়া-দাওয়া করতে বাধ্য করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, মালেয়েশিয়া, ইউরোপসহ প্রায় সব জায়গাতেই একই ধরণের কষ্টকর জীবন। মরুভুমির তুমুল গরমে কিংবা ইউরোপের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাজে বিরতি নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। বৈধ কাগজ-পত্র না থাকলে বাড়তি আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। ধরা পড়লে পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার। এই মুহূর্তেই পৃথিবীর নানা দেশের বহু বাঙালি অবৈধ ভাবে যাওয়ার জন্যে জেলের ভিতরে পচছে।
এইসব বঙ্গ সন্তানদের পাঠানো অর্থই ব্যাঙ্ক থেকে গায়েব করছে দেশের উচ্চশিক্ষিত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলা-কামলা’রা। ঋণের নামে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠিয়ে বিদেশে পাচার করছে। একের পর এক ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়েছে তো কি হয়েছে? বাঙালিরা জীবিত, মৃত কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসলে কার কি যায় আসে? তাদের পরিবর্তে দ্বিগুণ সংখ্যক বঙ্গ সন্তান পাঠানোটা কোনো ব্যাপারই না। তারা আবার দয়া-মায়াহীন প্রবাসে যেয়ে আয় করবে, দেশে নতুন করে টাকা পাঠাবে। আবার টাকা লোপাট হবে। এইতো গেল অর্থনৈতিক দিক। সামাজিক অঙ্গনে জীবন্ত মানুষ পোড়ান, প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা, শিশু ধর্ষণ, নিরীহ বাবা-মা’কে পিটিয়ে মারা আর কাউকে খুব বেশী বিচলিত করছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে জিপিএ ফাইভের ছড়াছড়ি। কিন্তু উদ্ভাবনের দিক থেকে বাংলাদেশ একেবারে সর্ব নিম্নের একটা দেশ। যে দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধ চলছে, একমাত্র তারাই এক্ষেত্রে আমাদের থেকে পিছিয়ে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগের প্রভাব থেকেই বুঝা যায় সেখানে কেমন পরিস্থিতি। পানি মেশানো কিংবা ভেজাল ওষুধ দিয়ে মশা মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। ফলে মশা মরে নি। বরং রোগটা সারাদেশ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন এই করুণ অবস্থা? উত্তর একটাই- দুর্নীতি। তার সাথে যোগ হয়েছে স্বদেশপ্রেম শূন্যতা ও স্বার্থপরতা। বলা হয় বাংলাদেশের মানুষ না-কি খুব ধর্ম ভীরু। কিন্তু এতো দুর্নীতি ও অন্যায় করে তারা কি মুখ নিয়ে শেষ বিচারের দিন সৃষ্টি কর্তার সামনে যেয়ে দাঁড়াবে? তবে আমি কখনই বলছি না যে দেশে সৎ ও পরিশ্রমী মানুষের অভাব আছে। কিংবা দেশে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে না। তবে এই উন্নয়নের জন্য বঙ্গ সন্তানেরা কি প্রচণ্ড মূল্য দিচ্ছে, সেটা ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা-কামলারা অনিয়ম করার আগে কি একবারও ভেবে দেখে? না-কি যে যতো বড় কালো টাকার পাহাড় বানাতে পেরেছে, তার সমাজে দাপট ও গ্রহণযোগ্যতা ততো বেশী!
আমি লেখা-লেখি করি একটা সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আমাকে কে ভাষায় কথা বলার অধিকার এনে দিয়েছে, আমি সেই ভাষাতেই লিখি। ইংরেজিতে লেখার সুযোগ থাকলেও আমি প্রচণ্ড অহংকার নিয়ে বাংলায় লিখি। প্রায় প্রতিটা লেখায় এমন কিছু তুলে আনার চেষ্টা করি যাতে পাঠকের মানুষ হিসেবে আরেকটু এগিয়ে যাবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু উপরের ঘটনাগুলো বারবার আমার স্মৃতিপটে চলে আসছিল। তখন আমার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছিল, আমি ও আমার মতো যারা ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের কথা বলেন তারা কি তা হলে ব্যর্থ। তাদের নতুন করে লেখার কি যৌক্তিকতা আছে? পরে অবশ্য আমি সিদ্ধান্ত শুধরে নিয়েছি। ভালো কিছু ছেড়ে দিলে তো অন্যায়েরই জয় হবে। সুন্দরের বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্যে আরও বেশী একনিষ্ঠ হওয়াটা এখন সময়ের দাবী। সমাজে সততা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমরা আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না। মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে সত্য ও সুন্দর কখনই পরাস্ত হতে পারে না।
আগস্ট ১৯, ২০১৯
কাজী হাসান
লেখকঃ quazih@yahoo.com