বাজনাহারায় বাজনা

পৃথিবীতে সুখী মানুষ কয়জন? চেহারা দেখলেই কি বুঝা যায় একজন জীবন নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট? না-কি বেশিরভাগ মানুষ বেঁচে থাকাটাকে বোঝা মনে করে?  অনেককেই বলতে  শুনেছি  তাদের বুকের গহীনে একটা হাহাকার আছে (owner of a lonely heart)। তা হলে কি অসুখীরাই দলে ভারী?  ওরকম জটিল আলোচনা আপাতত না হয় স্থগিত রাখি!  তবে আজকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশে  অজ পাড়া গায়ে বসবাসরত একজন ব্যক্তির সাথে ; যিনি আমার দৃষ্টিতে একজন খাঁটি সুখী মানুষ। কেনো তাকে এই বিশেষণ দিলাম,  সেটা ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যে সবিনয় অনুরোধ করছি। 

মানচিত্রের উপরের দিকটা হলো উত্তর। বাংলাদেশের সব চেয়ে উত্তরের জায়গাটার নাম তেঁতুলিয়া। 'টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া' বলতে যে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বুঝায় সেটা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু অনেকেই হয়তো দেশের দুই প্রান্তের জায়গা দুটো  ভ্রমণ করেননি। যারা এখন পর্যন্ত তেঁতুলিয়া ও সংলগ্ন অঞ্চলটা  ঘুরে দেখেননি;  তাদেরকে  স্থানটা  সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে আমার সাম্প্রতিক  সফরের  আনন্দটা সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই। 

ভারতের সাথে বাংলাদেশের  উত্তর দিককার বর্ডার চেক পোস্টের নাম 'বাংলাবান্ধা’'।  এটা হলো পঞ্চগড় জেলার অন্তর্গত একটা উপজেলা। ব্রিটিশদের বিভাজন করা রেখার দুই  দিকে এখন দুই দেশ। সীমান্ত রেখার এক দিকে লাল সবুজ পতাকা, অন্য দিকে অশোকচক্র  সম্বলিত প্রতিবেশী দেশের ঝাণ্ডা। দু দিকেই অস্ত্র হাতে  সীমান্ত রক্ষীরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। সীমান্ত রেখা অতিক্রম করতে হলে রক্ষীদের পাসপোর্ট, ভিসা দেখাতে হয়। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস চলে এলো। আমরা  সৃষ্টিকর্তার তৈরি পৃথিবীকে কত শত ভাবেই না বিভক্ত করে নিজেদের মধ্যে হানাহানি জিয়ে রেখেছি। John Lennon র বিখ্যাত গান  "Imagine there is no country… " কানের মধ্যে বাজতে লাগল। পুরো মানব জাতির সবাই যদি একই দেশের নাগরিক হতো তা হলে বিষয়টা কেমন হতো? (https://genius.com/John-lennon-imagine-lyrics

বাংলা-বন্দ দেখা ও ছবি তোলা শেষ করে ১৭ কিলোমিটার দূরে তেঁতুলিয়ায় এলাম। এখানেও ভারতের সীমান্ত ও তাদের গড়া কাঁটা তারের বেড়া বেশ কাছের থেকে দেখলাম।  ফালানির লাশ সীমান্তের বেড়ার উপর বহুদিন ঝুলন্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। কি মর্মান্তিক ও ভয়ঙ্কর দৃশ্য ই না হয়েছিল!  প্রতি  বছরই ঐ দিকের গুলিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক  বাংলাদেশী নিহত হয়। ঠিক করলাম এখানে দাঁড়িয়ে মনটা বিক্ষিপ্ত না করে আরেক দিকে যাবো। আমাদের মতো আরও কিছু দর্শনার্থী ওই পাড়ের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছিলেন। পেছনে কিছু রিক্সা ভ্যান ও তাদের চালকদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ভাবলাম স্থানীয়দের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষায় আছে। কিন্তু না আমার চিন্তা ভুল প্রমাণিত হলো!  

মধ্য বয়স পার করেছেন এমন এক ভ্যান চালক এসে বললেন, " স্যার গ্রামটা ঘুরে দেখবেন না-কি?" আমি জিজ্ঞাসু ও সন্দেহ ভরা চোখ নিয়ে জানতে চাইলাম, "এখানে আর কি দেখার আছে?" বেশ আস্থার সাথে উনি বলতে লাগলেন, "আপনাদের পাঁচটা টুরিস্ট স্পট দেখাব। একবার দেখলে বহু দিন মনে রাখবেন।"  ঠিক ভরসা পেলাম না; এখানে এমন কি-বা দেখার থাকতে পারে!  তার পরেও ভাবলাম হাতে যেহেতু সময় আছে,  নিদেনপক্ষে  "রিক্সা ভ্যানে ভ্রমণ" (Jouney by a Rickshaw Van)’র অভিজ্ঞতাটা নিয়ে রাখা যেতে পারে। 

আমার সহযাত্রী আরও তিনজন; স্ত্রী, শ্যালক ও শ্যালিকা। আমরা চার জন্যে পা ঝুলিয়ে ভ্যানে বসে পড়লাম। সত্যি কথা বলতে কি, টিভিতে যাত্রী সহ রিকশা ভ্যান চলতে দেখলেও নিজে কখনও এতে সওয়ার হওয়ার সুযোগ পাইনি। রিক্সায় উঠতেই মনটা ফুরফুরা হয়ে গেল। ডিসেম্বর মাসের মৃদু হিমেল বাতাস ও মিষ্টি রোদ শরীর আর মনকে সতেজ করে দিলো। সাথে যোগ হলো আমাদের রিক্সা ভ্যান চালকের প্রাণবন্ত ধারা বর্ণনা।  তার কথার মধ্যে যেমন ছিল তথ্য, তেমন ছিল আন্তরিকতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আমাকে আকর্ষণ করল,  যে উনি কাজটা করে পরম আনন্দ পাচ্ছেন, গর্বিত হচ্ছেন। অভিব্যক্তিটা শুধু তার স্বরে না;  চোখে, মুখে ও পুরো শরীরের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল।

মজনু মিয়া (আসল নাম না) একজন পেশাদার টুরিস্ট গাইডের মতো বর্ণনা দেওয়ার সাথে সাথে নিজের জীবন বৃত্তান্ত দিয়ে চললেন। একাত্তরের যুদ্ধের সময় এই এলাকায় প্রথম এসেছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। বোনের বিয়ে হয়েছিল তেঁতুলিয়ার এক বাসিন্দার সাথে। ভগ্নিকে দেখতে এসে জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলেন। তার পরে এখানেই থিতু হয়ে যান। এলাকার প্রতিটা মানুষ তার চেনা-জানা, প্রতি ইঞ্চি জমি তার পরিচিত। পরিবার,  পরিবেশ, গ্রাম, দেশ ও সমাজের প্রতিটা মানুষের জন্য তার অগাধ টান।   বুঝলাম ভালোবাসাটা সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে।

প্রথমে মজনু মিয়া আমাদের নিয়ে এলেন মহানন্দা নদীর পারে। শীতকাল হওয়াতে সম্ভবত নদীতে তেমন পানি নাই। বেশ কিছু চর পড়েছে। নদীর একূল থেকে ওকূল পর্যন্ত পরিপূর্ণ পানি না থাকলে আমার চোখের তৃষ্ণাটা ঠিক মিটে না। তার পরেও ছোট ছোট চরগুলো নিয়ে অন্যরকম এক সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে।  দেখলাম ঠিক আমাদের মতো ঐ দেশেরও কিছু মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো তাদেরও কেউ কেউ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি দুটো দেশের কৃত্রিম বিভাজনে ব্যথিত হচ্ছে। 

বাংলাদেশে গ্রামগুলোর চেহারা ইদানীং পাল্টে গেছে।  বেশির ভাগ জায়গায় পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে।  বাড়িগুলো ইট-সিমেন্টের তৈরি; ছাদে টিন দেওয়া। প্রতিটা বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। গ্রামবাসীদের পোশাকে আশাকে আগের সেই দারিদ্রের ছোঁয়া নাই। প্রায় প্রতিটা পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশ থেকে আয় করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। পুরো কৃতিত্ব প্রবাসীদের দিলে ভুল হবে। এক সময়কার মঙ্গা পীড়িত উত্তর বঙ্গের অন্য রকম চেহারা। মাত্র কিছু বছর আগে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এখন বিশাল জায়গা জুড়ে চা'র চাষ হচ্ছে। শুধু তাই না কমলা, কলা, বাশ,  সুপারির বিস্তীর্ণ ক্ষেতগুলো দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে গেল।  জানলাম এই অঞ্চলে বহু বছর ধরে সরিষা, আম ও কাঁঠালের উৎপাদন হয়ে আসছে। তা ছাড়া এখানকার (দিনাজপুর) উৎপাদিত চাল একেবারে বিশ্ববিখ্যাত।  তথ্যগুলো মজনু মিয়া শুধু দেননি;  তিনি আমাদের প্রায় প্রতিটার ক্ষেতের পাশ থেকে ঘুরিয়ে আনলেন । এমনকি, কোন ক্ষেতের কোন জায়গায় ছবি তুললে মানুষের চোখ কাড়বে তাও দেখিয়ে দিলেন। তাকে বিদায় দেওয়ার সময়ে মনে হলো কিছুটা সময় একজন প্রকৃত সুখী মানুষের সাথে কাটালাম!    

উত্তর বঙ্গের আরও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান দেখলেও আমি দুটো জায়গার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটা হলো দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কান্তনগর গ্রামে ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত কান্তজীর মন্দির। এই মন্দিরকে কান্তজীউ বা আবার কান্তনগর মন্দির নামেও ডাকা হয়।  তিনতলা মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন থাকার কারণে অনেকে নবরত্ন মন্দিরও বলেন।। কথিত আছে  শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে  মন্দিরটা নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময়কার দিনাজপুরের মহারাজা ও জমিদার প্রাণনাথ রায় এই মন্দিরের কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৭২২ সালে তার মৃত্যু হলে তার পোষ্যপুত্র ১৭৫২ সালে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন।  পিরামিড আকৃতির মন্দিরটা তিন ধাপে উঠে গিয়েছে।  তিন ধাপের কোণাগুলোর উপরে মোট নয়টা অলংকৃত শিখর বা রত্ন আছে; যা দেখে মনে হতে পারে একটি উচু ভিত্তির উপর প্রকাণ্ড একটি রথ দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের দেওয়ালের টেরাকোটা ইটে মহাভারতের নানা ঘটনা চিত্রায়িত হয়ে আছে। দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থানটা  হলো ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এবং বর্তমানে পরিত্যক্ত রেল স্টেশন "বাজনাহার"। পুরনো স্থাপত্য ধারায়  নির্মিত স্টেশনের  নাম বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে খোদাই করা। জায়গাটা একেবারেই অযত্নে পড়ে আছে।  বাজনাহারা স্টেশনের বাজনা আজ হারিয়ে গেছে।  কিছুটা সংরক্ষণ ও যত্ন করার মানসিকতা থাকলেই,  বাজনাহার রেল স্টেশন বর্তমান প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের  ইতিহাসের একটা  বড় সাক্ষী হয়ে থাকতে পারে। 

একটা দেশের সবচেয়ে বড় পরিচয়টা কি? অবশ্যই সেটা তার জনগণের কর্ম। হাজারও খেটে খাওয়া বাঙালি আজ দেশের হাল ধরেছে। তারা কাজ করছে প্রবাসে, গার্মেন্টস, ব্যাংকিং, কৃষি সহ বহু ধরনের কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে প্রমাণ হচ্ছে তাদের উৎকর্ষতা। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বাড়ছে। সমাজ এবং দেশের অধিপতি ও নেতৃত্ব সততার সাথে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে খুব শিঘ্রি সুখী বাঙালি জাতি মাথা  উঁচু করে দাঁড়াবে। 

“ আনন্দকে ভাগ করলে দুটি জিনিস পাওয়া যায়; একটি হচ্ছে জ্ঞান এবং অপরটি হচ্ছে প্রেম। ”

—--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

জানুয়ারি ২১, ২০২২